আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

জীবন কি ভীষন ক্ষণস্থায়ী!

পথের প্রান্তে আমার তীর্থ নয় ,,,,,পথের পাশেই আছে মোর দেবালয়
আমি যে বছর ক্লাশ ফাইভ থেকে সিক্সে উঠলাম সে বার দুটি বোন আমাদের সাথে এসে নতুন ভর্তি হলো আমাদের স্কুলে । পিঠাপিঠি এই দুই বোন মির্জাপুরের ভারতেশ্বরী হোমসের ছাত্রী ছিলো। প্রায় দেড় বছরের ছোটো বড় হলেও কিন্ত ওরা একই ক্লাসে পড়তো। দুজনে ই ছিল আমার বান্ধবী, কিন্ত ছোটো বোন টি ছিল আমার বয়সী। ওর সাথেই ছিল সবচেয়ে ঘনিষ্ঠতা কারন আমাদের দুজনের মন মানষিকতা ছিল একই রকম।

আবার আমাদের দুজনের নামও ছিল একটু আন কমন । প্রচন্ড রাশভারী পিতার অত্যন্ত মেধাবী কন্যা আমার প্রিয় বান্ধবীটিকে তার বাবা এইচ এস সি প্রথম বর্ষে পড়ার সময় বিয়ে দিয়ে দেন। বিয়ের পরেও তার পড়াশোনা আর আগায় নি বিভিন্ন কারনে। এটা তার মনে এক বিরাট ক্ষোভের সৃস্টি করেছিল। যার ফল ছিল তার সন্তানদের পড়াশোনার ব্যাপারে তার বিরাট আত্মত্যাগ।

মাস তিনেক আগের ঘটনা । হঠাৎ মাঝ রাতে প্রচন্ড এক পেট ব্যাথায় কাতর হয়ে পড়লো আমার বান্ধবী। কাছাকাছি এক হাসপাতালে নিয়ে গেল বাসার সবাই। ডাইগনোসিস হলো গলব্লাডারে ইনফেকশন। চিকিৎসার পর তিনদিনেও সেখানে কোনো উন্নতি না হওয়ায় নিয়ে গেল স্কয়ার হাসপাতালে।

সেখানে আবিস্কার হলো প্যানক্রিয়াস, লিভার, গলব্লাডার সবখানেই ভয়ংকর ক্যনসারের মরণ থাবা। সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয় যা তা হলো, বিন্দুমাত্র কোনো সিম্পটমই ছিলনা। তারপর ব্যংকক, ইন্ডিয়া সব জায়গা থেকেই ফিরিয়ে দিল। কি সুন্দর স্বাস্হ্য, কি হাসি খুশী প্রান প্রাচুর্যে ভরা, কি নরম মন আমার বান্ধবীকে আজ হাসপাতালে দেখে আসলাম মৃত্যুর মুখোমুখি। ওর সবচেয়ে বড় গুন ছিল,ওর চোখে সবাই ভালো কেউ খারাপ না ! সামনা সামনি তো নয়ই, কারো আড়ালেও কখনো কারো বিরুদ্ধে একটা কথাও বলেনি এই জীবনে।

কাল রাতে হাসপাতালে ভর্তি হয়ে রাত ১১টার দিকে শ্বাস টেনে টেনে একটি ফোনই করেছিল, সেটা আমাকে, "জুন আসিস, আমি মনে হয় আর বাঁচবোনা, তোকে ভীষন দেখতে ইচ্ছে করছে"। বল্লাম "আমি কাল সকালেই আসবো, তুই একটু ও চিন্তা করিসনা, ভালো হয়ে যাবি"। এটাই ছিল তার বলা শেষ কথা। এরপর ই সে কমায় চলে যায় আর কারো সাথেই কথা বলেনি। আমি এর সাতদিন আগেও বাসায় অনেক সুস্থ দেখে এসেছিলাম।

অনেক ভালোবাসে ও আমাকে। যে কোনো ধরনের রান্না করতে পারতো অনায়াসে। শুধু তাই নয় রান্না করে সবাইকে খাওয়াতে ভালোবাসতো। আমার সাথে গল্প করতে করতে কি অপুর্ব কেক বানাতো। আমি ওর তৈরী বুটের ডালের হালুয়া পছন্দ করি বলে এমন একটা শবেবরাত যায়নি যে ও আমার জন্য বক্স ভরে নিয়ে আসেনি! কি খেতে ভালোবাসি, জন্মদিনে কি ধরনের গিফ্ট পছন্দ করি সব ওর নখদর্পনে ছিল।

ওর সাথে জীবনে সামান্যতম মনোমালিন্য কোনোদিন হয়েছে বলে আমি মনে করতে পারিনা। রাতে যেতে পারিনি, সকালে গিয়েছিলেম। আমার গলা শুনলে যেই চোখ ঝলমল করে উঠতো খুশীতে, সেই চোখে কোনো দৃস্টি নেই, মরা মাছের মতন ঘোলাটে । আমার ডাক শুনে সেই চোখ মেলে চাইলো শুন্য দৃস্টিতে, তবে আমার দিকে নয়,কোন সুদুরের পানে কে জানে! একটা কথাও বলতে পারলোনা, যে কিনা আমার সাথে ঘন্টার পর ঘন্টা কথা বলে যেত। আমি ওর বাসায় গেলে ওর ছেলে মেয়েরা বলতো 'আজ আম্মুর খুশীর দিন, জুন আন্টি এসেছে, কত গল্প আর হাসাহাসি যে হবে'।

বিছানায় শুয়ে বসে চা নাস্তা খেতে খেতে দুই বান্ধবীর কত স্বপ্ন, কত কল্পনা এসবই কি শেষ হয়ে যাবে একটি মৃত্যুর সাথে সাথে ? কত স্মৃতি আমার ওর সাথে,যা মনে হলে চোখ পানি ধরে রাখতে কষ্ট হচ্ছে। প্রতিদিন একবার টেলিফোনে ঘন্টাখানেক গল্প না করে থাকতে পারতামনা। আর আজ আমি সারাক্ষন টেলিফোনের দিকে কান পেতে রাখছি কখন শেষ খবরটা আসে। আর সবচেয়ে আশ্চর্য্য এবং করুন ঘটনা তা হলো ওর সেই বড় বোন যে ওর দেড় বছরের বড় ছিল, আমাদের সাথে পড়তো সেও মারা গেছে এখন থেকে ঠিক দেড় বছর আগে। কি অদ্ভুত কো-ইনসিডেন্স! এখন তাই মনে হচ্ছে জীবন কি ক্ষনস্থায়ী ! কিসের আমাদের অহংকার! কি নিয়ে গর্ব করি আমরা।

তিন মাস আগেও তো ভাবেনি সে একথা স্বপ্নেও! অত্যন্ত মানসিক কষ্ট নিয়ে যখন বের হয়ে বাসায় আসি তখন দেখি আমার মোবাইলটা নেই ব্যাগে। আজ ৮ই মার্চ রাতের বেলা আমার বান্ধবী চলে গেল সেখানে যেখান থেকে কেউ কোনোদিন ফেরেনা।
 

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.