আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

নাট্যকার রবীন্দ্রনাথ

বাংলা ভাষার শ্রেষ্ঠ কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সাহিত্য সৃজন প্রতিভা কেবল কাব্য ও সংগীত রচনায় সীমাবদ্ধ নয়; এই সত্য আজ সবারই জানা। দেশ, সমাজ, কৃষিকাজ ও সর্বজনীন শিক্ষা নিয়ে তাঁর ভাবনা আমাদের আন্দোলিত ও অনুপ্রাণিত করে আসছে। বিশ্বজুড়ে বাংলার এই মহান কবির আসন পাতা। আমাদের শ্লাঘার বিষয় হলো, আমাদের বঙ্গের তথা আজকের বাংলাদেশের শিলাইদহ, পতিসর ও শাহজাদপুর থেকে সঞ্চিত সুখ-দুঃখ ও আনন্দ রবীন্দ্রনাথের অনন্য মনন গঠনের সহায়ক ছিল। তিনি পিতৃপুরুষের জমিদারি দেখতে পূর্ববঙ্গে একনাগাড়ে ছয় বছর কাটিয়েছিলেন; তার পরও ভেঙে ভেঙে এসেছেন একাধিকবার।

পদ্মাপারের মানুষের সুখ-দুঃখ এবং পূর্ববঙ্গের অবারিত নিসর্গ যুবক রবীন্দ্রনাথকে উদ্বুদ্ধ করেছিল তাঁর সৃষ্টিশীল নানা বর্ণের লেখনীতে। তাঁর সোনার কলম হয়ে উঠেছিল বহুপ্রভা।
‘১৪০০ সাল’ কবিতায় রবীন্দ্রনাথ নিজেই সংশয় প্রকাশ করেছিলেন এই বলে যে, ‘আজি হতে শতবর্ষ পরে/ কে তুমি পড়িছ বসি আমার কবিতাখানি/ কৌতূহলভরে’। মনে হয়, রবীন্দ্রনাথের সংশয় ছিল শতবর্ষ পরে তাঁর পরিচিতির ঔজ্জ্বল্য আগের মতো থাকবে কি না! এই সন্দেহ অমূলক নয়। কালের ধোপে তাঁর সময়ের অনেক বড় লেখক হারিয়ে গেছেন, বিপরীতে আড়াই হাজার বছর আগের গ্রিক নাট্যকার সফোক্লেসের ওডিপাস নাটক বিরতিহীনভাবে অভিনীত হয়ে চলেছে।

খুব সম্ভবত একজন লেখকের দীর্ঘজীবী হওয়ার রসায়নটি আমাদের অজানাই থেকে যায়।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বিচিত্র সাহিত্যসম্ভার বিশ্ববাসীর দৃষ্টি নতুন করে আকর্ষণ করল তাঁর সার্ধশততম জন্মবার্ষিকীতে। বাংলাদেশে রবীন্দ্রনাথের সার্ধশততম জন্মবার্ষিকীতে আমাদের দেশের সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের সহযোগিতায় মঞ্চস্থ হলো তাঁর একাধিক নাটক। সর্বকালের সেরা নাট্যকার শেক্সপিয়ারের নাটকের সংখ্যা ৩৭ এবং রবীন্দ্রনাথের নাট্য রচনার সংখ্যা ষাটের অধিক। তাঁর গভীর অথবা তত্ত্ব নাটকের পাশাপাশি রয়েছে তাঁর গীতি ও নৃত্যনাট্য, হাস্যকৌতুক, ব্যঙ্গকৌতুকসহ বিভিন্ন কমেডি নাটক।

রবীন্দ্রনাথ নিজেও প্রতিভাবান অভিনেতা ও নাট্যপ্রয়োগকর্তা ছিলেন (তখন ‘নির্দেশক’ কথাটি প্রচলিত ছিল না)। তাঁর বিখ্যাত বিসর্জন নাটকে তিনি দুটি মুখ্য চরিত্র রঘুপতি ও জয়সিংহের ভূমিকায় ভিন্ন প্রযোজনায় অভিনয় করেছিলেন। বিশ শতকের মধ্যভাগে শিশির কুমারের মতো প্রতিভাধর অভিনেতাকে কেন্দ্র করে কলকাতার সাধারণ রঙ্গালয়ে নবযুগের সূচনা হয়। তখনকার রঙ্গমঞ্চে রবীন্দ্রনাথের কমেডি নাটকগুলোর—যথা: চিরকুমার সভা, শেষরক্ষা—বহুল অভিনয়ের সংবাদ পাওয়া যায়। তাঁর ট্র্যাজেডি নাটক বিসর্জনও সেই সময় অভিনীত হয়েছিল, কিন্তু তাঁর অনন্য সৃজন ডাকঘর, রক্তকরবী, রাজা, অচলায়তন ও মুক্তধারার মতো নাটকগুলো রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বাড়ির চত্বরের বাইরের সাধারণ রঙ্গালয়ে তেমন একটা অভিনীত হয়নি।

রবীন্দ্রনাটক সম্পর্কে একটা সাধারণ ভীতি কাজ করত যে, তাঁর সিরিয়াস নাটকগুলো রূপক ও প্রতীকী সংলাপের জাল ছিন্ন করে দর্শকহূদয়ে পৌঁছাবে না। তখন মনে করা হতো রবীন্দ্রনাটকের অনেক সংলাপই দুরূহ, যা মাথার ওপর দিয়ে চলে যায়। রবীন্দ্রভক্ত নাট্যাচার্য শিশির কুমার ভাদুড়ীও রবীন্দ্রনাথের অনন্য নাট্যসৃজন রক্তকরবী শঙ্কাভরে মঞ্চস্থ করেননি। কারণ, তিনি এই নাটকের মঞ্চসাফল্য নিয়ে সন্দিহান ছিলেন। রবীন্দ্রনাথের মৃত্যুর ১৩ বছর পরে অনন্য অভিনেতা ও নির্দেশক শম্ভু মিত্রের নির্দেশনায় কলকাতার বহুরূপী নাট্যদলের রক্তকরবী মঞ্চায়ন আসমুদ্রহিমাচল কাঁপিয়ে দিয়েছিল।

আজকের বাংলাদেশেও রক্তকরবী সর্বাধিক অভিনীত নাটক। এ প্রসঙ্গে আমাদের মনে করতে হয়, পাকিস্তান আমলে ড্রামা সার্কেলের রক্তকরবীর সফল প্রযোজনার স্মৃতি এবং আমাদের স্বাধীন সার্বভৌম দেশে বাংলাদেশ টেলিভিশনে মুস্তাফা মনোয়ারের অত্যন্ত সফল প্রযোজনা রক্তকরবীর স্মৃতিও অক্ষয় হয়ে আছে। বর্তমান লেখকের নির্দেশনায় নাগরিক নাট্য সম্প্রদায় রক্তকরবীর এ পর্যন্ত ১০৮টি প্রদর্শনী করেছে এবং এই নাট্য প্রযোজনা আজও চলমান রয়েছে। রবীন্দ্রনাথের নৃত্য ও গীতিনাট্য চণ্ডালিকা, শ্যামা, চিত্রাঙ্গদা ও মায়ার খেলার সঙ্গে আমাদের দেশের দর্শকদের পরিচয় ছিল আগে থেকেই, কিন্তু তাঁর সংলাপবহুল মঞ্চনাটকগুলো প্রধানত রবীন্দ্রজয়ন্তী ও মৃত্যুবার্ষিকীকে কেন্দ্র করে মঞ্চস্থ হতো।
রবীন্দ্রনাথের সার্ধশততম জন্মবার্ষিকীকে কেন্দ্র করে তাঁর মঞ্চনাটকগুলো নবদ্যোতনায় ও নব অর্থে আমাদের দেশের দর্শকদের কাছে উন্মোচিত হলো।

তাঁর জীবন, সমাজ ও গভীর রাজনীতিলগ্ন নাটকগুলোর মঞ্চায়ন দর্শকদের কাছে বিপুলভাবে গৃহীত হলো। রবীন্দ্রনাটক এখন ফ্যাশন নয়, তা দেশ, মানুষ এবং সর্বোপরি জীবনের কথা বলে—এই বোধের জন্ম হলো। আমাদের এই অর্জন সাম্প্রতিক কালের। রবীন্দ্রনাথের সার্ধশততম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে কেবল ঢাকার মঞ্চেই প্রদর্শিত হলো রথের রশি, রথযাত্রা, চিরকুমার সভা, শেষ রক্ষা, চণ্ডালিকা (মঞ্চনাটক রূপে), তাসের দেশ, কালের যাত্রা, শোধবোধ, বিসর্জন, নিশিমন বিসর্জন (বিসর্জন-এর রূপান্তরিত রূপ), অচলায়তন, ডাকঘর, রাজা, রক্তকরবী, গোড়ায় গলদসহ আরও কয়েকটি নাটক। দেশের অন্যান্য জেলা শহরে মঞ্চস্থ হলো রবীন্দ্রনাথের বিভিন্ন নাটক।


এখন নির্দ্বিধায় বলা যায়, রবীন্দ্রনাথই বাংলা নাটকের শ্রেষ্ঠ রূপকার; তিনি এখন পোশাকি কোনো নাট্যকার নন, শেক্সপিয়ারের নাটকে যদি বিশ্ব অবগাহন করতে পারে, তবে অবশ্যই রবীন্দ্রনাটকেও স্নাত হতে পারে নিখিলহূদয়। ।

সোর্স: http://www.prothom-alo.com

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.