আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

একটি সরল আত্মসমর্পন

বন্ধ চোখে মুহূর্তটা ফাঁকি দিয়ে চলে যায়, স্বপ্নগুলো নির্মম বাস্তবতা ছাড়া কিছু নয়। চূর্ণ ধুলিকণা, সবই যেন চূর্ণ ধুলিকণা।

লাশটিকে ঘিরে মানুষের সংখ্যা বেড়েই চলেছে, অন্তত একবার হলেও লাশটিকে সবাই এক পলক দেখতে চায়। এই মৃত লোকটি যখন বেঁচে ছিল, তখন সবাই তার নাম কতই তো শুনেছে। কারো হয়ত সামনা সামনি দেখার সুযোগ হয়েছে, কারো হয় নি।

তাই শেষবারের মত এক পলক দেখে নেবার সুযোগ কেউ হাতছাড়া করছে না, এমন সুযোগ তো জীবনে বারবার আসে না। বেলা বাড়ছে, রোদের প্রখরতাও বাড়ছে। কিন্তু মানুষের ঢল কিছুতেই কমছে না, রোদ উপেক্ষা করে সবাই দাঁড়িয়ে আছে, যতক্ষণ সম্ভব দেখে নিচ্ছে মৃত মানুষটাকে । লাশটার দিকে তাকালে এখনো একটু আধটু ভয় লাগে, মনে হয় একদৃষ্টতে যেন কার দিকে তাকিয়ে আছে। রোদের আলোয় চিক চিক করছে চোখদুটো।

মরে যাবার পরও কেন যেন মানুষ কাছে যেতে ভয় পাচ্ছে, পলকহীন চোখদুটো বুজিয়ে দিতে সাহস পাচ্ছে না। যখন বেঁচে ছিল তখন কি না করেছে লোকটা, কিন্তু লাশটার দিকে তাকালে যেন খুব অসহায় মনে হয়। কেমন বেদনার্ত চোখে তাকিয়ে আছে সবার দিকে, খুব কষ্ট পেয়ে মরেছে মনে হয়। হয়ত জীবিত অবস্থায় যে যত হিংস্র, মৃত্যুর পর সে তত অসহায়। মৃত লোকটিকে এক নামে সবাই চেনে।

ড্যাগার মন্টু - ভয় পাইয়ে শহরের যে কারো আত্মা কাঁপানোর জন্য এই একটি নামই এতদিন ছিল যথেষ্ট। ড্যাগার সম্ভবত তার আসল নাম নয়, নিজের দেয়া নাম। এই লাইনে যারাই থাকে সবার নামেই এমন উদ্ভট উদ্ভট সব বিশেষণ যুক্ত থাকে। ড্যাগার মন্টু করত না এমন কোন কাজ নেই, এই লাইনের কিংবদন্তি বলা যায় তাকে। শহরের ছোটবড় সকল মাস্তান, চাঁদাবাজ, সন্ত্রাসী, ছিনতাইকারী, পকেটমার, চোর আর ডাকাতদের নেতা ছিল সে।

মন্টুর নামে থানায় যে কতগুলো কেস আছে তার ইয়ত্তা নেই, পুলিশকে জিজ্ঞেস করলেও হয়ত বলতে পারবে না। এত কেসের হিসাব পুলিশ কিভাবে রাখবে? সরকারী দেলের নেতাদের শেষ ভরসা এই মন্টু। গত নির্বাচনে গফুর হাজী যখন শোচনীয়ভাবে হারতে যাচ্ছিল, তখন এই মন্টুই নাকি দলবল নিয়ে সব কেন্দ্র দখল করেছিল। অবশেষে বিপুল ভোটে জয়ী হয়েছিলেন গফুর হাজী। মন্টুর কথা আমি খুব বেশী কিছু জানি না, তবে আমার স্পষ্ট মনে আছে পাড়ার জোড়া খুনটার কথা।

একই সাথে দুজন খুন হবার ঘটনা ওটাই আমাদের পাড়ায় প্রথম। সবাই যখন মন্টুর নামে কেস করতে গিয়েছিল, পুলিশ তখন কেস নিল না। কামাল সাহেবকে থানার ওসি বললেন, "ভাই, আর কত মামলা নেব মন্টুর নামে। জানেন তো, পনের বছর ধরে মন্টুকে খুঁজছি। পনের বছরেও যখন খুঁজে পেলাম না, আর পাবার আশা নাই।

শুধু শুধু কেস করে কি লাভ, এর চেয়ে বাসায় গিয়ে নামাজ-কালাম পড়েন, দান-খয়রাত করেন, কাজে লাগবে। " যখন ছোট ছিলাম, কত কি না চিন্তা করতাম - চোখের সামনে যারা জ্যান্ত মানুষ মেরে ফেলে, তারা কি মানুষ? তাদের হৃদয়ে কি কোন কোমলতা নেই? দয়া-মায়া নেই? ভালোবাসা নেই? মানুষকে কাঁদতে দেখলে আমার তো কান্না পায়, ওদের কি পায় না? কান্না না পাক, একটুও কি খারাপ লাগে না? কষ্ট হয় না? পরদিনই পত্রিকার প্রথম পাতায় হেডলাইন হল মন্টু। বড় বড় লাল অক্ষরে লেখা, "টপ টেরর ড্যাগার মন্টুর আত্মহত্যা"। হেডলাইনটা শুধু আমাকেই না, সারা দেশের মানুষকে হতবাক হয়েছে। যে চোখের পলকে জ্যান্ত মানুষের লাশ ফেলে দিতে পারে, মানুষ মারা যার কাছে ছেলেখেলা, সে কেন আত্মহত্যা করবে? নিউজটার কয়েকটা লাইন একবার পরে বিশ্বাস করতে পারলাম না, কয়েক বার পড়লাম, জোরে জোরে শব্দ করে পড়তে থাকলাম - "সামিনারর সাথে মন্টুর সাত বছরের ঘনিষ্ট সম্পর্ক ছিল।

গত সপ্তাহে এক প্রবাসী ব্যবসায়ীর সাথে সামিনার বিয়ে হয়ে যায়। এই আকষ্মিক বিচ্ছেদের ব্যাথায় ভালোবাসার কাছে সহজ আত্মসমর্পন করে গতকাল ভোর সাড়ে পাঁচটার দিকে আত্মহত্যা করে মন্টু। " প্রায় সপ্তাহখানেক হয়ে গেল, কিন্তু সহজ কিছু প্রশ্নের উত্তর শত চেষ্টা করেও খুঁজে পাচ্ছি না। যে ভালোবাসতে পারে, প্রিয়জন হারানোর বেদনায় যার মন কাঁদে, ভালোবাসার মানুষকে না পাওয়ায় যে জীবন দিতে পারে, পিঁপড়ার মত মানুষ মারা কিভাবে তার পক্ষে সম্ভব? মন্টু কি আমাদের মত সাধারণ একজন মানুষ? তার হৃদয়েও কি আনন্দ ছিল, দুঃখ ছিল, ভালোবাসা ছিল, ব্যাথা ছিল? হয়ত এককালে আর দশজনের মত আবেগে ভরা সাধারণ মানুষই ছিল মন্টু; আমাদের আঘাত আর সমাজের চাপে বাধ্য হয়েছে সে নিজেকে বদলাতে। সবকিছুই বদলে ফেলেছিল মন্টু, কেবল নিজের হৃদয়কে বদলাতে একটু দেরী করে ফেলেছে।


অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.