আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

ভূমিকম্পের ঝুকি ও করনীয়

খুব জানতে ইচ্ছে করে...তুমি কি সেই আগের মতনই আছো নাকি অনেকখানি বদলে গেছো...

ভূমিকম্পের ঝুকি ও করনীয় হাসান কামরুল ভূকম্পন শব্দের উৎপত্তি ভূত্বকের লিথোস্ফিয়ার ¯তর থেকে, যেখানে প্রতিনিয়ত কয়েক হাজার ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় গলিত ম্যাটেরিয়াল বা পদার্থ উৎতপ্ত হচ্ছে, ফলশ্র“তিতে অসম্ভব শক্তির সৃষ্টি হচ্ছে ভূত্বকের নীচে যা সময় অসময়ে বিভিন্ন ফাটল বা ফল্ট এলাকা দিয়ে পৃথিবীর উপরিভাগে বের হয়ে আসে, আর বের হয়ে আসা এ শক্তির পরিমান এতো বেশি যে উৎপত্তি ˉহলের বি¯তীর্ণ অঞ্চল জুড়ে নৃশংসতম ভয়াবহতার সৃষ্টি হয়। পৃথিবী নামক এ গ্রহটা বিভিন্ন অংশে বিভাজিত, ভূ-তত্ত্বের ভাষায় যাকে বলা হয় প্লেট, যা লিথোস্ফিয়ারের ক্রম বর্ধমান উৎতপ্তের কারনে ক্রমশই সচল। সা¤প্রতিক সময়ে বাংলাদেশে ছোট ও মাঝারি মানের বেশ কয়েকটি ভূকম্পন অনুভূত হয়েছে যা জনমনে আতংক ও ভয়ের কারণ হয়ে দাড়িয়েছে, বড়ো মাপের ভূমিকম্পের আশংকা মানুষকে তাড়া করে বেড়াচ্ছে। বাংলাদেশ সত্যিকার অর্থেই ভূমিকম্পের ঝুকির মধ্যে রয়েছে, কারণ বাংলাদেশ নদী বিধৌত এক অঞ্চল, এ দেশের অনেক নদীই সাংঘার্ষিক প্লেটের ফসল, মধুপুর গড় একটি ক্রিয়াশীল ফাটল এলাকা, চট্রগ্রাম, পার্বত্য চট্রগ্রাম ও সিলেট অঞ্চলে বেশ কয়েকটি ক্রিয়াশীল ফাটল বা ক্রিয়াশীল ফল্ট জোন রয়েছে, যা ভূমিকম্পের উৎপত্তিˉহল হতে পারে, যদি বড়ো কোন ভূমিকম্পের উৎপত্তিˉহল বাংলাদেশের ভূ-অভ্যন্তরে হয় তবে এর ভয়াবহতার মাত্রা হবে কল্পনাতীত আর যদি উৎপত্তি¯হল হাজার মাইল দূরে ভিন্ন কোনো ˉহানে হয় তাহলে বাংলাদেশে এর সামান্য প্রভাবই পড়বে, যেমনটি ২০০৪ সালের সুনামির বেলায় দেখা গেছে। ছোট ছোট ভূকম্পন অনেক সময় বড়ো ভূমিকম্পের হাত থেকে বাঁচিয়ে দেয়, যদি ও বিশেষজ্ঞরা মনে করেন এ ধরনের ছোট ছোট ভূকম্পন বড়ো ধরনের ভূকম্পনের আশংকাকে বাড়িয়ে দেয়, আসলে মাটির নীচে পুঞ্জিভূত শক্তি সব সময়ই ভূপৃষ্টে উঠে আসার চেষ্টা করে, আর এ শক্তি কখনো বিস্ফোরিত রূপ ধারন করে আবার কখনো শান্ত মেজাজে শক্তির উদগিরণ ঘটায়, যেভাবেই শক্তি পৃথিবীর উপরিভাগে বা ভূপৃষ্ঠে আসার চেষ্ঠা করুক না কেন ভূকম্পন অনুভূত হবেই।

তবে এ কথা সত্য যে, ছোট ছোট ভূকম্পন বড়ো ভূমিকম্পের ঝুকি কমিয়ে দিচ্ছে কারণ ছোট ছোট ভূকম্পন মাটির নীচে সঞ্চিত শক্তিকে হ্রাস করে দিচ্ছে, ফলে বাংলাদেশে বড়ো মাত্রার ভূমিকম্পের আশংকাও দিন দিন কমে যাচ্ছে। আর ছ্টো ভূকম্পনে আতংকের কিছু নেই কারণ এর ˉহায়িত্ব ও মাত্রা সব সময় সহনীয় পর্যায়ে থাকে। বড়ো মাত্রার ভূমিকম্পের বেলায় আসলে করণীয় কিছু থাকেনা কারণ এর মাত্রা এতো ধংসাতœক হয় যে কোনো কিছু বুঝে উঠার আগেই সব কিছু ধ্বংসযজ্ঞে পরিণত হয়, ১৮৯৭ সালে ঘটে যাওয়া “গ্রেট আসাম ভূমিকম্প” আজো ভয়াবহতার স্বাক্ষী দেয়। বড়ো মাপের আর একটি ভূমিকম্প হলে এ অঞ্চল পৃথিবীর ইতিহাসে ভয়াবহতার নৃশংসতার জ্বলন্ত দৃষ্টান্ত হবে; পানিতে লবণাক্ততা বেড়ে গিয়ে পুরো নদী সিস্টেম বিকল করে দিবে ফলে সুপেয় পানির সংকট দেখা দিবে,ভূমি ধ্বসে জীবন মাল ধ্বংস করে দিবে, নদীর তীর ভেঙ্গে বিশালাকৃতি ধারন করবে এমনকি নদীর গতি পর্যন্ত পরিবর্তীত হয়ে যেতে পারে। ১৮৯৯ সালের ভূমিকম্পের কারণে ব্রহ্মপুত্র নদের গতিপথ পাল্টে যায়।

ভূমিকম্প এমন এক প্রাকতিক দূর্যোগ এর আগাম বার্তা বা সতর্ক সংকেত দেয়া সম্ভব নয়, কেবল ভূমিকম্পের সময় এর মাত্রা রিখটার স্কেলে নির্ণয় করা যায়, তবে ভূমিকম্পের সময় সর্তকতা অবলম্বন করলে জান মালের ক্ষয় ক্ষতি অনেকাংশে কমিয়ে আনা সম্ভব। ভূমিকম্পের ˉহায়িত্ব স্বল্প সময়ের মাত্র কয়েক সেকেন্ডের কিন্তু এর ক্ষয় ক্ষতির মাত্রা অনেক বেশি তাই এ অল্প সময় সাহস, ধৈর্য ও বুদ্ধির সঙ্গে মোকাবিলা করতে হবে, হতবুদ্ধিতার কারনেই যেকোন প্রাকৃতিক দূর্যোগে ক্ষয় ক্ষতির মাত্রা বেড়ে যায় অনেকাংশে। ভূমিকম্পের ঝুকির মধ্যে রয়েছে ঢাকা শহর কারণ এ শহরের তুরাগ নদী একটি সচল ভূ-ফাটল এলাকা বা ক্রিয়াশীল ফল্ট এলাকা, ঢাকার অদূরে রয়েছে মধুপূর গড় যা নব্যতম ক্রিয়াশীল ফল্ট জোন, যা দিয়ে অধিক মাত্রায় ভূ-অভ্যন্তর থেকে শক্তির উদগিরণ ঘটতে পারে। তাই এ এলাকায় ভূমিকম্পের উৎসˉহল হলে ঢাকায় ব্যাপক ক্ষয় ক্ষতি হবে, এর পিছনে অন্যতম কারণ হবে অধিক জন বসতি, অপরিকল্পিত নগরায়নের ফলে জলাধার ও ফাঁকা ˉহান কমে যাওয়া, পানির ভূস্তরের আধার শূন্য হয়ে যাওয়া বা নীচে নেমে যাওয়া, দালান তৈরির সময় বিল্ডিং কোড না মানা ইত্যাদি কারণে ঢাকা ভয়াবহ ঝুকির মধ্যে রয়েছে, ঢাকা ছাড়া ও চট্রগ্রাম ও সিলেট শহর ভূমিকম্পের ঝুকিপূর্ণ শহর, ইতিমধ্যে চট্রগ্রাম শহরে ভূগর্ভˉহ পানির স্তরে সমূদ্রের লবণ পানির অনুপ্রবেশ ঘটেছে, যার ফলে চট্রগ্রাম শহর সুপেয় পানির অভাবে ভুগছে। ঐ এলাকায় বড়ো ধরনের ভূমিকম্প হলে সুপেয় পানির আধার বলে অবশিষ্ট কিছু থাকবেনা, ভূমি ধ্বসের ফলে জান ও মালের ভয়াবহ ক্ষতি সাধন হবে, যা পূর্ণগঠনে বহুবছর লাগবে।

সিলেটের টিপাইমুখ অঞ্চল ভূমি কম্পন প্রবন এলাকা গত দু,শো বছরে এ অঞ্চলে রিখটার স্কেলে ৫ মাত্রার ভূমিকম্প হয়েছে শতাধিকবার, ১৯১৮ সালের ৮ ই জুলাই এ অঞ্চলে ভূমিকম্পের মাত্রা ছিল রিখটার স্কেলে ৭.৬। বরাক নদীর অববাহিকা জুড়েই রয়েছে অসংখ্য ফল্টলাইন, যা ঐ এলাকার নদী ও শাখা নদী সমূহের গতি প্রবাহ নিয়ন্ত্রন করে থাকে; আর এ এলাকার বাঁধ নির্মিত হলে মনিপুর, আসাম ও বাংলাদেশের সিলেট অঞ্চল ভূমিকম্পের ঝুকির মুখে পড়বে আর ভূমিকম্প বা অন্য কোনো কারনে বাঁধটি ভেঙ্গে গেলে ভাটি অঞ্চল সিলেট ও ময়মনসিংহ এলাকা পানিতে তলিয়ে যাবে, দুই কোটি মানুষ সরা সরি ক্ষতিগ্রস্ত হবে। জলবায়ুর পরিবর্তনের ফলে এমনিতেই বাংলাদেশ ক্ষতির সম্মুখিন তার উপর বড়ো ধরনের ভূমিকম্পের বিপর্যয় নেমে আসলে অর্থনৈতিক যে ক্ষতি হবে তা কাটিয়ে উঠতে বহু বছরের প্রয়োজন হবে, যার ফলে অর্থনৈতিক কাঠামো ভেঙ্গে পড়বে, মানবিক বিপর্যয় দেখা দিবে। ভূমিকম্পের পরবর্তী উদ্ধার তৎপরতার উপর ক্ষয় ক্ষতির পরিমান অনেকাংশে নির্ভরশীল, আর উদ্ধার তৎপরতার জন্য আধুনিক যন্ত্রপাতি ও সাজ সরঞ্জামের প্রয়োজন তা অত্যন্ত ব্যয় বহুল, তাছাড়া ও দক্ষ জনবলের প্রয়োজন,যাতে করে মহুর্তের মধ্যেই উদ্ধার তৎপরতা শুরু করা যায়। এর আগে ও প্রয়োজন জনসচেতনা বৃদ্ধি করা, আর জনসচেতনা বৃদ্ধির লক্ষ্যে ব্যাপক হারে প্রচারনা চালাতে হবে কারণ সচেতনাই হতে পারে আতœরক্ষার অন্যতম কৌশল ।

ঝুকিপূর্ণ এলাকা হিসাবে সরকারের দায়িত্ব অনেক, ভূমিকম্পের মতো প্রাকৃতিক দূর্যোগ মোকাবিলায় পূর্ণ প্রস্তুতি থাকা প্রয়োজন, এ লক্ষ্যে দূর্যোগ মন্ত্রনালয়ে আলাদা সেল ও পর্যাপ্ত বরাদ্ধ থাকা দরকার , আধুনিক যন্ত্রপাতি, সাজ সরঞ্জাম ও দক্ষ জনবল দিয়ে ফায়ার বিগ্রেডকে ঢেলে সাজাতে হবে। ভূমিকম্পের সময় ঘরের বাহিরে থাকলে গাছের নীচে থাকা যাবেনা, ফাঁকা কোনো ˉহানে আশ্রয় নিতে হবে, গাড়িতে চলন্ত অবˉহায় থাকলে নেমে নিরাপদ ˉহানে ফাকা জায়গায় আশ্রয় নেয়া বাঞ্জণীয়, ঘরের ভিতর থাকা অবˉহায় ভূমিকম্প হলে চকি বা খাটের নীচে থাকা নিরাপদ, দালানের ভিতর থাকলে ছাদের উপর আশ্রয় নেয়া নিরাপদ, নৌকা, লঞ্চ, স্টিমারে থাকলে লাইফ জ্যাকেট পরে নিতে হবে। ধ্বংসস্তুপের নীচে আটকে পড়াদের বাঁচাতে বাহির থেকে অক্সিজেন সরবরাহ করতে হবে, ধ্বংসস্তুপ সরানোর সময় আটকে পড়াদের অবˉহান নিশ্চিত করার লক্ষ্যে সার্চ লাইট দিয়ে ভালোভাবে পরখ করে দেখতে হবে, শব্দ তরঙ্গের অনুপ্রবেশ ঘটিয়ে আটকে পড়া মানুষের গতিবিধি ও অবˉহান নির্ণয় করতে হবে। লিফটে আটকে পড়া ব্যক্তিরা ভূমিকম্পে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে, ভূমিকম্পের ফলে বহুতল ভবন দেবে যেতে পারে বা আশে পাশের অন্য ভবনের উপর হেলে পড়তে পারে,আর এ অবˉহায় বিদ্যুত, গ্যাস ও পানির লাইনের বিচ্যুতি ঘটে ভয়াবহতার সৃষ্টি হতে পারে ফলে ভবনের ভিতরের অবকাঠামো ধ্বসে পড়ে প্রাণহানির আশংকা বেড়ে যাবে। এ অবˉহায় ভূমিকম্পের সময় পানি, বিদ্যুত ও গ্যাসের সরবরাহ লাইন বন্ধ করে দিতে হবে, হাসপাতালগুলোতে পর্যাপ্ত চিকিৎসা সেবার ব্যবˉহা রাখতে হবে,উদ্ধারকৃত ব্যক্তিদের দ্রুত হাসপাতালে নেয়ার ব্যবˉহা থাকতে হবে, উদ্ধার তৎপরতা নির্বিঘেœ সম্পন্ন করার জন্য জনগনের সম্পৃকত্তা বাড়াতে হবে।

প্রকাশিত: দৈনিক সমকাল, ১৮ই সেপ্টেম্বর,২০১০,সম্পাদকীয় পাতায় হাসান কামরুল : ভূ-তত্ত্ববিদ

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।