আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

বায়ান্ন থেকে দুই হাজার এগারো—ঊনষাট বছর (২য় পর্ব)

মনুষ্যত্ব থাকলে তাকেই মানুষ বলা হয়। কিন্তু.। .। ।

একুশে ফেব্রুয়ারি, আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস।

এ দিবসটি একদিকে শোকের অন্যদিকে আনন্দের। শোকের দিন এ জন্য যে, ১৯৫২ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারি বাংলা ভাষায় কথা বলার অধিকার আদায় করতে গিয়ে ঢাকায় সালাম, বরকত, রফিক জব্বারসহ অনেকেই তাদের মূল্যবান জীবন দিয়েছিলেন। আর আনন্দের এ জন্য যে, ভাষা শহীদদের ত্যাগের বিনিময়ে ২১শে ফেব্রুয়ারি আজ আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের মর্যাদা পেয়েছে। ভাষা শহীদরা তাদের জীবন দিয়ে আমাদের শিখিয়েছে, একুশ মানে মাথা নত না করা। মূলত একুশের যে আন্দোলন তা শুধু ভাষার আন্দোলন নয়, তা ছিল অন্যায়ের বিরুদ্ধে ন্যায়ের আন্দোলন।

এ ধরনের আন্দোলন অতীতেও ছিল, বর্তমানের আছে এবং ভবিষ্যতেও থাকবে। সারা পৃথিবীর মানুষ প্রায় ৬ হাজার ভাষায় কথা বলে। তবে ভাষাতত্ত্ববিদরা মনে করছেন,আগামী একশ বছরের মধ্যে প্রায় তিন হাজার ভাষা পৃথিবী থেকে বিলুপ্ত হয়ে যাবে। এক হিসেবে দেখা গেছে, আজকের পৃথিবীতে প্রতি দুই সপ্তাহে একটি করে ভাষা বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে। বিস্ময়ের ব্যাপার হলো, পৃথিবীতে এমন ৫১টি ভাষা আছে যেগুলোর প্রতিটিতে মাত্র একজন করে ব্যবহারকারী রয়েছে! এ চিত্র থেকে একটা বিষয় পরিস্কার যে, বিশ্বের জীবন্ত ভাষাগুলো দিন দিন হারিয়ে যাচ্ছে।

এই বিলুপ্তির হার বন্যপ্রাণী কিংবা গাছপালা বিলুপ্তির হারের চেয়েও বেশী। কিন্তু বাংলাভাষার ক্ষেত্রে এর ব্যতিক্রমী দৃষ্টান্ত দেখা যায়। বর্তমান বিশ্বে প্রায় ২৫ কোটি মানুষ বাংলা ভাষায় কথা বলে। ব্যবহারকারীর সংখ্যার দিক থেকে বাংলা ভাষার স্থান ৫ম। তবে ১৯৯৯ সালে প্রকাশিত The Summer Institute of Linguistics এর হিসেবে অনুয়ায়ী ব্যবহারকারীর সংখ্যার দিক থেকে বাংলার অবস্থান ৪র্থ।

" শুধু বাংলাদেশের মানুষই যে এ ভাষায় কথা বলে তা নয় বরং ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, আসাম, ত্রিপুর, মণিপুর,বিহার ও উড়িষ্যা এবং মিয়ানমারের আরাকান অঞ্চলের রোহিঙ্গারাও বাংলা ভাষায় কথা বলে। আফ্রিকার দেশ সিয়েরা লিয়নে বাংলাকে ২য় সরকারী ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। বিশ্বে বাংলাই সম্ভবত একমাত্র ভাষা-যার মর্যাদা রক্ষার জন্য ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারী ঢাকায় পুলিশের গুলিতে আব্দুস, সালাম,রফিক,বরকত,জব্বার সহ আরো অনেকে প্রাণ দিয়েছেন। এই ঘটনার প্রতিবাদে সারা পূর্ব পাকিস্তানে আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে ও তীব্র আকার ধারণ করে। অবশেষে পাকিস্তান সরকার বাংলাকে উর্দুর সম-মর্যাদা দিতে বাধ্য হয়।

তবে বাংলা ভাষার জন্য কেবল বাংলাদেশের মানুষ জীবন দেয়নি ; ভারতের আসামের কয়েকজন মানুষও এ ভাষায় কথা বলার অধিকার আদায় করতে গিয়ে জীবন দিয়েছেন। ১৯৬১ সালের মে মাসে বাংলা ভাষার ব্যবহার বন্ধ করার প্রতিবাদে ভারতের আসামের শিলচর শহরে পুলিশের গুলিতে প্রাণ দিয়েছেন ১১ জন। ১৯৬১ সালে আসাম প্রাদেশিক সরকার শুধু অহমীয়া ভাষাকে রাজ্যের একমাত্র সরকারী ভাষা ঘোষণা দিলে বাঙালীদের ভেতর ক্ষোভ দানা বাঁধে । ১৯ মে শিলচরে সকাল ৬টা-সন্ধ্যা ৬টা ধর্মঘট পালন করা হয়। ধর্মঘট চলাকালে আসাম রাইফেলসের গুলিতে ঘটনাস্থনে প্রাণ হারান ১১ জন ভাষাবিপ্লবী।

রাজ্য সরকার শেষ পর্যন্ত সিদ্ধান্ত বাতিল করতে বাধ্য হয়। এরপর আসামে বাংলাকে ২য় রাজ্যভাষা হিসাবে ঘোষণা করা হয়। বাংলা ভাষায় কথা বলার অধিকার আদায় করতে গিয়ে বাঙালীরা যে ত্যাগ স্বীকার করেছেন তা ইউনেস্কোর নজরে আনার জন্য কানাডা প্রবাসী বাংলাদেশীদের সংগঠন ‘মাদার ল্যাংগুয়েজ অফ দ্যা ওয়ার্ল্ড' প্রচেষ্টা শুরু করে। ১৯৯৯ সালের ১৭ নভেম্বর তাদের প্রচেষ্টা সফল হয়। ওই দিন ইউনেস্কোর ৩০তম অধিবেশনে বাংলাদেশ ও সৌদি আরব ২১শে ফেব্রুয়ারীকে ‘আন্তজার্তিক মাতৃভাষা দিবস' হিসাবে স্বীকৃতি জানানোর প্রস্তাব উত্থাপন করে এবং অপর ২৫টি দেশের সদস্যরা সেটিকে অনুমোদন করে।

এরপর থেকে সারা বিশ্বে প্রতি বছর পালিত হয়ে আসছে 'আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। ' ইউনেস্কোর পর জাতিসংঘও একুশে ফেব্রুয়ারিকে ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস' হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। ২০০৮ সালের গত ৫ ডিসেম্বর জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে এ স্বীকৃতি দেওয়া হয়। ২১শে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে জাতিসংঘ ভাষা শহীদদের প্রতি নিঃসন্দেহে ব্যাপক সম্মান দেখিয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশের মানুষ এতেই কি সন্তুষ্ট ? মোটেই না।

আর এ জন্যই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের ৬৪তম অধিবেশনে বাংলাভাষাকে জাতিসংঘের ৭ম দাপ্তরিক ভাষা হিসেবে গ্রহণ করার জন্য সদস্য দেশগুলোর সমর্থন চেয়েছেন । বাংলাকে জাতিসংঘের অফিসিয়াল ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দেয়ার ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দাবির সাথে একমত হয়েছে পশ্চিমবঙ্গ সরকার। গত বছরের ২১শে ডিসেম্বর জাতিসংঘের দাপ্তরিক ভাষা হিসেবে বাংলাকে স্বীকৃতি দেওয়ার দাবিতে একটি সর্বদলীয় প্রস্তাব পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভায় গৃহীত হয়েছে। জাতিসংঘের দাপ্তরিক ভাষা হিসেবে এখন ছয়টি ভাষা স্বীকৃত। এসব ভাষা হলো- ইংরেজি, চাইনিজ, আরবি, ফরাসি, রাশিয়ান ও স্প্যানিস।

এর মধ্যে রুশ ভাষায় কথা বলে বিশ্বের প্রায় ১৭ কোটি মানুষ । কিন্তু বাংলায় কথা বলে প্রায় ২৫ কোটি মানুষ। ফলে রুশ যদি জাতিসংঘের অফিশিয়াল ভাষা হওয়ার যোগ্যতা রাখে তাহলে বাংলা কেন পারবে না? সরকার যদি কূটনৈতিক তৎপরতা জোরদার করে তাহলে একদিন না একদিন বাংলাভাষা অবশ্যই জাতিসংঘের অফিশিয়াল ভাষার স্বীকৃতি পাবে। বাংলা ভাষা যদি জাতিসংঘের অফিসিয়াল ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি পায় তাহলেই 'ভাষা শহীদ'দের আত্মত্যাগ স্বার্থক হবে। আলোচনার শেষ পর্যায়ে একটাই আহ্বান, কেবল ফেব্রুয়ারিতেই নয়, মাতৃভাষার চর্চায় আন্তরিক থাকতে হবে সারা বছর।

বাংলাভাষা শুদ্ধভাবে বলতে ও লিখতে হবে এবং এ ভাষার সাহিত্য ও সম্পদের সাথে আমাদের পরিচিতি বাড়াতে হবে। কেননা মাতৃভাষার গৌরব বাড়লে আমাদেরও গৌরব বাড়বে। সুত্র > Click This Link

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.