আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

ব্যাথা

প্রবাসী

ব্যাথা কথায় বলে “যার ব্যাথা সেই বোঝে”,যে সমস্ত উপসর্গ নিয়ে রোগীরা ডাক্তারের স্মরনাপন্ন হন তার মধ্যে ব্যাথা অন্যতম প্রধান। ব্যাথার গুরুত্ব এত বেশী যে আজকাল ব্যাথাকে বলা হচ্ছে ৪র্থ গুরত্বপর্ন লক্ষন, পালস বা নাড়ী, টেম্পারেচার বা তাপমাত্রা, এবং রেস্পিরেশান বা শ্বাসপ্রশ্বাস এর পরেই ব্যথার স্থান। ব্যাথা কি? অন্যান্য সমস্ত অনুভুতি যেমন দেখা , শোনা, তাপ, ঠান্ডা, স্পর্শ ইত্যাদি, ব্যাথাও তেমনি এক প্রকার অনুভুতি, এক প্রকার কস্টকর অনুভুতি। অল্প ব্যাথা হলে সহ্য করেন অসহ্য ব্যথায় চিৎকার গড়াগড়ি করেন। শরীরের যেখানেই হোক না কেন ব্যাথা নার্ভ দিয়ে স্পাইনাল কর্ড দিয়ে তা মস্তিস্কে গেলেই আমরা বুঝতে পারি।

কোথায় ব্যাথা,কতটুকু ব্যথা, কি ধরনের ব্যাথা ইত্যাদি । যে পথ দিয়ে ব্যাথা মস্তিস্কে যায় তা হল মোটামুটি রিসিপ্টর- নার্ভ-স্পাইনাল কর্ড- মস্তিস্ক। বিভিন্ন ধরনের ব্যাথার যন্য রয়েছহে ভিন্ন ভিন্ন ধরনের রিসিপ্টর। ব্যাথার জন্য তা ফ্রি নার্ভ এন্ডিং। রিসিপ্টর হল অনেকটা ডিশ টিভির রিসিভারের মত, এটা অনুভুতিকে গ্রহন করে তা পাঠিয়ে দেয় মস্তিষ্কের দিকে।

এই পথের কোথাও যদি আঘাত বা রোগ হয় তখন ব্যাথা অনুভবে্র পরিমান ও কম বা বেশী হতে পারে। ইন্টারন্যাশনাল এসসিয়েশান ফর স্টাডি অফ পেইনের সংগা হল “ব্যাথা এক প্রকার কস্টকর অনুভুতি যা শরীরের সুনির্দিষ্ট কোষ বা কলা’র ক্ষতি থেকে অথবা ক্ষতি হতে পারে এমন সব কারন থেকে হয়। “ ব্যথা আমাদের বাচার জন্য অপরিহার্য। ব্যথা আমাদের জানান দেয় রোগ হয়েছে. যেমন ধরুন নার্ভের কিছু রোগ যেমন ডায়াবেটি্স, কুষ্ঠ, যেখানে ব্যাথা অনুভুতি লোপ পায়, ফলে ইনফেকশান হয়ে পচে গেলেও রোগী থা্কেন নির্বিকার। এমন ও ঘটে জীবন বাচাতে হয়তো কেটেই ফেলতে হয় অংশটা।

আবার সব ব্যথায় যে উপকারী তা ও নয়। বাড়ির দারোয়ান যেমন নিজেই কখনো কখনো চুরি করে ঠিক ব্যথাও তেমনি কস্ট দিতে থাকে, উপকারের পরিবর্তে ক্ষতির কারন হয়ে দাঁড়ায়। যেমন ধরুন কোমর ব্যাথা, হাজার টা পরীক্ষা করানো হল, বিশেষজ্ঞ ডাক্তার দেখালেন কয়েক ডজন কিন্তু ব্যথার কারন পাওয়া গেল না। ভিন্ন ভিন্ন ডাক্তার ভিন্ন ধরনের কারন বললেন নানান ধরনের ঔষধ খেলেন, কিন্তু ব্যাথা সেই তিমিরেই। কাজ করতে কষ্ট, ঘুমাতে কষ্ট, হাটতে কষ্ট ইত্যাদি।

ব্যাথার কারনঃ-১) রোগ্ বা আঘাতে যদি অঙ্গ প্রত্যঙ্গে ক্ষতি হয় যেমন ধরুন ফোড়া হয়ে পুজ হল, ব্যথায় তা টনটন করছে এটাকে আমরা বলি “নসিসেপটিভ পেইন”, ২)দ্বিতীয় কারন হল ব্যাথা অনুভব করার পথ যেমন নার্ভ, ব্রেইন বা স্পাইনাল কর্ড কোন কারন ছাড়াই ব্যথা জানান দিতে শুরু করে। এটাকে বলে “নিউরোপ্যাথিক পেইন” ব্যাথার প্রকারঃ- ১) একিউট বা স্বল্প কালীন ব্যাথা – ৬ সপ্তাহের কম স্থায়ী ব্যথা এগুলো । এই ধরনের ব্যথা তে কোষ কলার ক্ষতির সুন্নির্দিস্ট কারন থাকে অধিকাংশ ক্ষেত্রে এবং ব্যাথার কারন চিকিৎসা করলে আরোগ্য লাভ করেন রোগী। ২)দীর্ঘকালীন ব্যথা বা ক্রনিক পেইনঃ- ৬ সপ্তাহ তো বটেই অনেক ক্ষেত্রে মাস বা বছরের পর বছর ধরে থাকে এই ধরনের ব্যাথা। এখানে কোষ বা কলা’র ক্ষতির কারন থাকে না, কেন ব্যথা হচ্ছে তাও অস্পষ্ট অধিকাংশ ক্ষেত্রে।

ফলে চিকিৎসাও কস্টসাধ্য। অন্যভাবে ভাগ করতে গেলে ১) হাড় বা মাংশপেশীর ব্যাথা বা সোমাটিক পেইন এবং ২)শরীরের বিভিন্ন প্রত্যঙ্গের যেমন হার্ট বা কিডনীর ব্যাথা- ভিসেরাল পেইন, ভিসেরাল পেইনের কারন নির্নয় করা যায় অধিকাংশ ক্ষেত্রে এবং চিকিৎসায় তা ভালো হয়। ভিসেরার ব্যাথা হয় তীব্র এবং জরুরী চিকিৎসার দরকার পড়ে। তবে মুশকিল হল রোগি ব্যথার জায়গা সম্পর্কে নিশিত ভাবে বলতে পারেন না অনেক ক্ষেত্রে। যে সমস্ত প্রশ্ন ডাক্তাররা ব্যথা সম্পর্কে জানতে চানঃ ১) কোথায় ব্যাথা? গীঠে? পে্টে? বুকে? হাতে ,পায়ে? ২) কি পরিমান? সহ্যের মধ্যে? তীব্রতা বাড়ছে বা কমছে?কখন বাড়ে বা কখন কমে? ৩) কি ধরনের? জ্বালাপোড়া?, টনটনে, কাটার ব্যাথা, সুচ ফোটা? , ইলেক্ট্রিক ব্যাথা? জিলিক মারা ব্যথা ইত্যাদি।

৪) কতদিন ধরে ব্যথা?কিভাবে হল? হঠাৎ? ধীরে ধীরে? ক্রমশঃ বাড়ছে না মাঝে মাঝে কমে বাড়ে ইত্যাদি ৫) শরীরের অন্য কোথাও ব্যথা আছে কিনা? থাকলে ব্যাথাগুলোর মধ্যে সম্পর্ক কি?ব্যাথাটা এক স্থানেই থাকে না বিভিন্ন জায়গায় ঘোরাফেরা করে? ৬) কি করলে ব্যাথা বাড়ে বা কমে? ৭)দৈনন্দিন কাজে ব্যাঘাত ঘটে কিনা, ইত্যাদি। ব্যাথার ডায়াগনসিসঃ- ব্যাথা রোগের উপসর্গ আবার নিজেই রোগ। রোগির লক্ষন, শারীরিক পরীক্ষা, এবং পরীক্ষাগারের বিভিন্ন ধরনের পরীক্ষা সব কিছুরই দরকার পড়ে। মোট কথা হল ব্যাথা কেন হচ্ছে তার কারন তন্ন তন্ন করে খোজা উচিৎ। রক্তের বিভিন্ন পরীক্ষা, এক্স রে, এম আর আই, আল্ট্রাসোনগ্রাফী, প্রস্রাব পরীক্ষা, নার্ভের পরীক্ষা যেমন ইলেক্ট্রমায়োগ্রাফী নার্ভ কন্ডাকশান স্টাডি।

সব কিছুর পরে ও কারন না পাওয়া গেলে তখন চিন্তা করা যেতে পারে রোগীর মানসিক অবস্থা। দুশ্চিন্তা, অবসাদ থেকেও ব্যাথা জন্ম নিতে পারে। ব্যাথা থেকে যেমন দুশ্চিন্তা হয় ‘কেন হচ্ছে ব্যাথা, সারছে না কেন? কি হল? মারাত্মক কিছু কিনা?ইত্যাদি। আবার দুশ্চিন্তা ব্যথার পরিমান বাড়িয়ে দেয় বহুগুন। দুসচিন্তা বা অবশাদ্গ্রস্থ ব্যাক্তির ব্যথার অনুভুতি অনেক বেশী তীব্র।

সমস্ত ব্যথাই রোগীর জন্যে কস্টের, একে হাল্কাভাবে উড়িয়ে দেওয়া ভুল। ব্যাথা কখনোই ভান নয় । আগে যেখানে মানসিক বলে উড়িয়ে দেওয়া হত অনেক ব্যাথা কে এখন দেখা যাচ্ছে বিভিন্ন ধরনের রাসায়নিক পদার্থের তারতম্যের কারনা তা হচ্ছে এবং এই তারতম্যের কারন চিকিৎসা করলে রোগি আরোগ্য লাভ করছেন। ব্যাটা পাগল, রোগি সাজছে, মাথায় দোষ ইত্যাদি হয়ত ডাক্তারের জন্য স্বস্তি দায়ক, এই কারনে যে রোগের কারন খুজে পাওয়া গেছে, রোগির জন্যেী তা কখনই সুখকর নয়। চিকিৎসাঃ- ব্যাথার চিকিৎসা দুরুহ বিশেষ করে ক্রনিক বা দীর্ঘকালীন ব্যাথা ত বটেই।

ব্যাথাকে গ্গুরুত্ব দি্যেই চিকিৎসা বিজ্ঞানে নতুন শাখার জন্ম “পেইন মেডিসিন” যদিও ব্যাথার জন্য আজ স্বতন্ত্র শাখা আছে ব্যাথার চিকিৎসা করেন অনেক ধরনের বিশেষজ্ঞই। ফিজিক্যাল মেডিসিন, নিউরোলজি, অর্থপেডিক, নিউরোসার্জারি, ইন্টারনাল মেডিসিন, রিউমাটলজি ইত্যাদি। ব্যাথা শুধু রোগীর জন্য নয় ডাক্তারের জন্যও মাথা ব্যাথার কারন বিশেষ করে ক্রনিক বা দীর্ঘকালীন ব্যাথা। ঔষধঃ- ১)প্যারাসিটামলঃ-ব্যথার ঔষধ গুলোর মধ্যে সবচে কম ক্ষতিকর। দীর্ঘ বা অতিরিক্ত মাত্রা লিভারের ক্ষতি করে।

কার্যক্ষমতা ও কম অনান্য ব্যাথার ঔষধ এর চেয়ে। ২)অনান্য ব্যাথার ঔষধঃ- এদের কে সংক্ষেপে বলা হয় (এন এ এস আই, ডি)। সাধারন ভাবে ব্যথার ঔষধ বলতে এই ধরনের ঔষধকেই বোঝায়। বিভিন্ন কোম্পানীর ৫০ বা ততোধিক ঔষধ রয়েছে, ন্যাপ্রক্সেন, ডাইক্লোফেনাক, আইবুপ্রোফেন, ইত্যাদি। মাত্রা, কার্যক্ষমতা ইত্যাদি ভিন্ন হোলেও গুরত্বপুর্ন পার্থক্য নেই, একটার সাথে আরেকটার।

পার্শ প্রতিক্রিয়া অনেক , বিশেষ করে পাকস্থলির আলসার। কিডনীর ক্ষতি , রক্তক্ষরন বা রক্ত তৈরীতে বাধা থেকে রক্তহীনতা, হৃৎপিন্ড এবং রক্ত নালীর ক্ষতি। এমন কি পাকস্থলী তে ফূটো ও করে দিতে পারে এরা। এদের মধ্যে এক প্রকার ঔষধ হল “সিলেক্টিভ কক্স-২ ইনহিবিটর” যেমন সেলিকক্সিব, ইটরিকক্সিব ইত্যাদি। এই ঔষধ গুলো তুলনামুলক ভাবে কম ক্ষতি করে পাকস্থলীতে তবে আবার হৃতপিন্ডের উপর মারাত্মক পার্শপ্রতিক্রিয়া আছে।

রোফেকক্সিব নামের ঔষধটা ২/৪ বছর বাজারজাত ছিল। এই ঔষধ সেবন কারী দের মধ্যে স্ট্রোক, হার্টএটাক উল্যেখযোগ্যভাবে বেড়ে যাওয়ার পর তা বাজারজাত নিষিদ্ধ হয়ে যায়। ব্যাথার ঔষধ যত কম যত কম মাত্রায় যত কম দিন সম্ভব এবং সম্ভব হলে না খেয়ে ব্যথা সহ্য করাও ভালো। ৩)স্টেরয়েডঃ-যেমন প্রেডনিসোলোন, ডেক্সামেথাসোন, কর্টিসোন ইত্যাদি শক্তিশালি প্রদাহ নিবারনকারি । ডাক্তারের পরামর্শ ছাড়া এ গূলো খাওয়া ঠিক নয়।

বেশী মাত্রায় বেশীদিন খেলে চোখ মুখ ফোলা থেকে, ব্লাড প্রেসার , হাড়ক্ষয়, এমন হাজারটা সমস্যার সৃষ্টি করে। তবে কার্যকরী,জীবন রক্ষাকারী এবং যখন অন্য কোন ঔষধ কাজে আসে না তখন ব্যবহার করা হয়। ৪)আফিম জাতীয় ব্যাথার ঔষধঃ-আফিম, মরফিন, পেথিডিন, মেথাডন ইত্যাদি শক্তিশালী কার্যকর ঔষধ। অপারেশানের পর, ক্যান্সার ব্যথা ইত্যাদিতে একমাত্র ঔষধ। এদের ও পার্শ প্রতিক্রিয়া অনেক।

বমি, স্বাশপ্রশাষ কমিয়ে দেওয়া, কৌষ্টকাঠিন্য,এমন কি মৃত্য পর্যন্ত হতে পারে অতিরিক্ত মাত্রা হলে। অপেক্ষাকৃত কম শক্তিশালী আফিম জাতিয় ঔষধ ট্রামাডোল, টাপেন্টাডোল। পার্শ প্রতিক্রিয়া আফিমের মতই। ৫)অবসাদে ব্যবহৃত ঔষধঃ- এমিট্রিপ্টালিন, নর ট্রিপ্টালিন, সিটালোপ্রাম, ঔষধগুলো ব্যথা নিরাময়ে কার্যকর। ৬)মৃগী রোগে ব্যবহৃত ঔষধঃ- গ্যাবাপেন্টিন, প্রিগ্যাবালিন ডুলক্সেটিন ঔষধগূলো নিউরোপ্যাথিক ব্যথায় একমাত্র কার্যকর ঔষধ।

৭) স্থানীয় ভাবে অচেতনকারী বা লোকাল এনেস্থেটিক ঔষধ গুলো যেমন লিডকেন ও ব্যবহার করা হয় ব্যাথা নিরাময়ে। ৮) ইঞ্জেকশানঃ অনেক ব্যাথা নিরাময়ে স্টেরয়েড বা লোক্যাল এনেস্থেটিক ঔষধ ইঞ্জেকশান দিয়ে ফল পাওয়া যায় । ৯) নার্ভ ধংশ করে দেওয়া হয় ইঞ্জেকশান দিয়ে বা অপারেশান করে। যখন কোন ঔষধে কাজ করে না যেমন ক্যান্সারের ব্যাথা তে তখন এ গূলো ব্যবহার করা হয়। ১০) বিভন্ন ধরনের ফিজিওথেরাপী রয়েছেঃ- শর্ট ওয়েভ ডায়াথার্মি, আল্ট্রাসাউন্ড, ইলেক্ট্রোথেরাপী,ইত্যাদি।

এদের ভাল দিক হল এরা পার্শপ্রতিক্রিয়া মুক্ত দির্ঘদিন ব্যাবহার করা যায়। ১১) বিভিন্ন ধরনের ব্যায়াম, যোগ ব্যায়াম ইত্যাদি ১২)আকুপাঙ্কচার ১৩) অপারেশানঃ-পিঠে বা নার্ভের উপর অপারেশান করা হয় যখন কোন কিছু করার থাকে না । ১৪) মানসিক চিকিৎসাঃ- রোগীর মনের চিকিৎসা ব্যথা নিরাময়ে প্রয়োজন। সাইকোথেরাপী, কগ্নিটিভ বিহেবিয়ার থেরাপী ইত্যাদি। ১৫) রোগীর শিক্ষা বা পেশেন্ট এডুকেশানঃ- রোগ সম্পর্কে চলনসই ধারনা দিলে ব্যাথা চিকিৎসায় তা উল্ল্যেখযোগ্য ভুমিকা রাখে।

উপসঙ্গহারঃ-ব্যাথা হয় প্রায় সব রোগেই। ব্যাথার চিকিৎসা সব সময় সহজ কাজ নয়। বিভিন্ন ধরনের চিকিতসা পদ্ধতি বা বিভিন্ন বিশেষজ্ঞ সম্ননয়ে চিকিৎসার দরকার পড়ে।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।