ব্যাংকিং খাতে তারল্য (নগদ অর্থ) সঙ্কট ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। গ্রাহকদের চাহিদা পূরণ ও দৈনন্দিন ব্যয় মেটাতে হিমশিম খাচ্ছে অধিকাংশ বাণিজ্যিক ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান। ব্যাংকগুলোর পক্ষে এলসি খোলাও অসাধ্য হয়ে পড়েছে। গত মাসে একসঙ্গে ৩০টি বাণিজ্যিক ব্যাংক বিভিন্ন মেয়াদের আমানতের সুদের হার ৫০ পয়সা থেকে শুরু করে সাড়ে ৩ টাকা পর্যন্ত বাড়িয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংক ও বিভিন্ন ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
তারা বলছে, একসঙ্গে এতগুলো ব্যাংকের আমানতে সুদের হার বাড়ানোর ঘটনা এটাই প্রথম।
দীর্ঘমেয়াদিভাবে নগদ টাকার সঙ্কট মেটাতে বিভিন্ন আমানত সংগ্রহে হন্যে হয়ে ঘুরছে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো। আমানত রাখতে আগ্রহী করতেই আমানতের সুদের হার বাড়ানো হয়েছে। এমনকি আমানত রাখতে বেশি করে উদ্বুদ্ধ করতে ছয় বছরে দ্বিগুণ মুনাফার লোভও দেখাচ্ছে কোনো কোনো ব্যাংক। অপরদিকে সাময়িকভাবে তারল্য সঙ্কট মেটাতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে রেপো ও বিশেষ তারল্য সহযোগিতা নিচ্ছে ব্যাংকগুলো।
কোনো কোনো ব্যাংক কলমানির মাধ্যমে সাময়িকভাবে এ সঙ্কট মেটাচ্ছে। ট্রেজারি বন্ড জমা রেখেও টাকা ওঠাচ্ছে কেউ কেউ।
বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে আগের মতো চাহিদা অনুযায়ী নগদ টাকার সহায়তা পাওয়া যায় না বলেও অভিযোগ করেছেন ব্যাংকাররা। ব্যাংকগুলোর অর্থের সংস্থান অর্থাত্ আমানত না বাড়ার কারণে গ্রাহকদের চাহিদা অনুযায়ী সঠিক সময়ে ঋণ সরবরাহ করতে ব্যর্থ হচ্ছে। অবস্থা এমন যে, আগে যেখানে ঋণ দেয়ার জন্য গ্রাহকদের পিছু পিছু হাঁটতে হতো, এখন ওই গ্রাহকদের থেকে অনেকটা পালিয়ে বাঁচতে চাচ্ছে ব্যাংকগুলো।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তাগিদের কারণে অগ্রিম জমা হার (এডি রেশিও) ঠিক রাখতে আমানত সংগ্রহে ব্যাংগুলো হন্যে হয়ে ঘুরছে। এছাড়া সম্প্রতি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সিআরআর ও এসএলআর জমার পরিমাণ বৃদ্ধির ফলে প্রায় আড়াই থেকে তিন হাজার টাকা অতিরিক্ত জমা দিয়েছে ব্যাংকগুলো। এসবের পাশাপাশি সাম্প্রতিক সময়ে জ্বালানির পাশাপাশি ভোগ্যপণ্যের দাম বেড়ে যাওয়া ও অনুত্পাদনশীল খাতে আমদানি ব্যাপক হারে বেড়ে গেছে। বিশেষ করে তৈরিজাত পণ্য আমদানি হয়েছে ব্যাপক। ফলে আমদানি ব্যয় অনেকগুণ বেড়েছে।
ব্যাংকাররা বলছেন, বর্তমানে বিভিন্ন মেয়াদি আমানত রাখলে ১২ থেকে ১৩ শতাংশ সুদ দেয়া হচ্ছে। ছয় বছর মেয়াদি আমানতে কোনো কোনো ব্যাংক আরও বেশি সুদ দেয়ারও প্রস্তাব করছে। আমানত জমা রাখার পর সিআরআর এবং এডি রেশিও ঠিক রেখে শতকরা ৭৮ টাকা লোনের জন্য ব্যবহার করা যায়। ফলে সব মিলিয়ে আমানতে বর্তমানে সুদের হার দাঁড়াচ্ছে ১৪ দশমিক ৬ শতাংশ। কিন্তু ঋণের সুদের হার বেঁধে (ল্যান্ডিং ক্যাপ) শতকরা ১৩ শতাংশের বেশি সুদ নেয়া যাবে না, এ শর্তের কারণে ব্যাংকগুলো সুদের হারও বাড়াতে পারছে না।
বাংলাদেশ ব্যাংকের এক কর্মকর্তা বলেন, বেশিরভাগ ব্যাংকের তহবিল ব্যবস্থাপনায় দুর্বলতা রয়েছে। এতে তাদের তহবিল ব্যবস্থাপনা ব্যয় বেড়ে চলছে। সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, ব্যাংকগুলো আমানতের সুদের হার বাড়িয়ে দিলে ঋণের ক্ষেত্রেও সুদের হার বাড়াতে হবে। অন্যথায় তারা লোকসানের সম্মুখীন হবে। এজন্য ল্যান্ডিং ক্যাপ ওঠাতে ব্যাংক মালিকরা বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে দাবি করছেন।
এমনকি আইএমএফসহ বিশ্ব আর্থিক প্রতিষ্ঠান দিয়েও সুপারিশ করাচ্ছেন তারা।
ঋণের সুদের হার বাড়ালে উত্পাদন ব্যয় আরও বেশি বেড়ে যাবে। বর্তমানে দেশে এমনিতেই বিদ্যুত্ ও গ্যাসের সঙ্কট রয়েছে। এজন্য বিনিয়োগকারীরা বিনিয়োগমুখী হচ্ছেন না। এর ওপর ঋণের সুদের হার বাড়ালে বিনিয়োগকারীদের ব্যয় আরও বেড়ে যাওয়ায় তারা বিনিয়োগে আরও বেশি নিরুত্সাহিত হবেন।
পণ্যের উত্পাদন ব্যয় বেড়ে গেলে বিদেশি পণ্যের সঙ্গে মূল্যের প্রতিযোগিতায় টিকতে পারবেন না। এতে অনেক কারখানা বন্ধ হয়ে যাবে। অপরদিকে মূল্যস্ফীতি বেড়ে যাবে। এতে সাধারণ মানুষের দুর্ভোগের শেষ থাকবে না।
ব্যাংকগুলোর ব্যবস্থাপনার দুর্বলতা ও এলসি খোলার ক্ষেত্রে অসতর্কতাকে দায়ী করেছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা।
ঋণের সুদের হার বেঁধে দেয়ায় লোকসান কমাতে গত বছর আমানতের সুদের হার সর্বোচ্চ সাড়ে ১৩ শতাংশ থেকে সাড়ে সাত শতাংশে নামিয়ে এনেছিল। এতে তাদের আমানত সংগ্রহের পরিমাণ কমে যায়।
সুদের হার নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের গত জানুয়ারি মাসের পরিসংখ্যানে দেখা যায়, গত ডিসেম্বরে যেখানে ছয় মাসমেয়াদি আমানতের সর্বোচ্চ সুদের হার ছিল ৯ শতাংশ, জানুয়ারি মাসে তা বাড়িয়ে সর্বোচ্চ ১৩ শতাংশে উন্নীত করেছে কোনো কোনো ব্যাংক। এর মধ্যে পাঁচটি ব্যাংক সব ধরনের আমানতের সুদের হার বাড়িয়ে দিয়েছে। আর ২৫টি ব্যাংক নির্দিষ্ট মেয়াদি আমানতের সুদের হার বাড়িয়েছে।
গত মাসে ৩০ বাণিজ্যিক ব্যাংকের মধ্যে ২৩টিই সুদের হার বাড়িয়েছে অস্বাভাবিক হারে। ৯টি বিদেশি ব্যাংকের মধ্যে সুদের হার বাড়িয়েছে ছয়টি। অপরদিকে চার সরকারি মালিকানাধীন বাণিজ্যিক ব্যাংকের মধ্যে সুদের হার বাড়িয়েছে একটি। বিভিন্ন হারে আমানতে সুদের হার বাড়ানো ব্যাংকগুলো হলো—পূবালী ব্যাংক, ন্যাশনাল ব্যাংক, এনসিসি ব্যাংক, ঢাকা ব্যাংক, ব্যাংক এশিয়া, অগ্রণী ব্যাংক, এবি ব্যাংক, আইএফআইসি ব্যাংক, দি সিটি ব্যাংক, ইবিএল ব্যাংক, প্রাইম ব্যাংক, সাউথ ইস্ট ব্যাংক, আল-আরাফাহ ব্যাংক, এসআইবিএল ব্যাংক, ডাচ-বাংলা ব্যাংক, মার্কেন্টাইল ব্যাংক, এক্সিম ব্যাংক, প্রিমিয়ার ব্যাংক, স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংক, ট্রাস্ট ব্যাংক, মিউচুয়াল ব্যাংক, যমুনা ব্যাংক, শাহজালাল ইসলামী ব্যাংক, ব্র্যাক ব্যাংক, কমার্শিয়াল ব্যাংক, স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংক, হাবিব ব্যাংক, সিটি ব্যাংক, আল-ফালাহ ব্যাংক এবং এইচএসবিসি ব্যাংক।
উল্লেখ্য, গত কয়েক মাস আগেও তারল্য সঙ্কট ছিল না।
এমনকি চাহিদা না থাকায় ব্যাংকগুলোর কাছে আমানত বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছিল। ওই সময় ব্যাংকগুলোর কাছে অলস আমানত পড়ে ছিল প্রায় ৩৮ হাজার কোটি টাকা
উৎস: আমারদেশ
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।