আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

[আত্মজৈবনিক সাক্ষাৎকার] আমার আমি -সৈয়দ আবুল মকসুদ



সৈয়দ আবুল মকসুদ বাংলাদেশের ব্যতিক্রমী ব্যক্তিত্ব। দেশের প্রধান লেখক, চিন্তাবিদ ও গবেষকদের একজন। বাংলা একাডেমী পুরস্কার পেয়েছেন সাহিত্যে সামগ্রিক অবদানের জন্য। পেয়েছেন আরও অনেক পদক-পুরস্কার। প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা প্রায় ৪০টির মতো।

গবেষণা করেছেন সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ, মওলানা ভাসানী, মহাত্মা গান্ধীকে নিয়ে। এসব ক্ষেত্রে বাংলাদেশে তিনি পথিকৃৎ। আরও গবেষণা করেছেন ও জীবনী লিখেছেন উনিশ শতকের কবি হরিশচন্দ্র মিত্র ও গোবিন্দচন্দ্র দাস সম্পর্কে। পথিকৃৎ নারীবাদী খায়রুন্নেসা খাতুন সম্পর্কেও গবেষণা করেছেন। একজন বামপন্থি চিন্তাবিদ।

সামাজিক আন্দোলনে তাঁর ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ ও অত্যন্ত সক্রিয়। ইন্দো-মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ, পশ্চিমী ভোগবাদ, পশ্চিমী সংস্কৃতি ও সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে তিনি ২০০৩ সাল থেকে গান্ধীবাদী সত্যাগ্রহ শুরু করেছেন। বর্জন করেছেন পাশ্চাত্য পোশাক। সুশাসন ও পরিবেশ রক্ষা আন্দোলনের তিনি একজন প্রধান নেতা। কর্মময় তাঁর জীবন।

নীতি-আদর্শের প্রশ্নে আপসহীন। তাঁর ব্যক্তিজীবন, দর্শন ও চিন্তাধারা নিয়ে প্রকাশিত হলো এই সাক্ষাৎকার সাপ্তাহিক : কোনো নির্দিষ্ট বিষয়ে নয়, সাপ্তাহিক-এর পক্ষ থেকে আমরা আপনার ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে বিভিন্ন বিষয়ে কথা বলব। তাতে প্রসঙ্গক্রমে আসবে আপনার বেড়ে ওঠার কথা। অর্থাৎ কীভাবে আপনি সৈয়দ আবুল মকসুদ হয়ে উঠলেন। আপনার কর্মজীবন, লেখকজীবন।

আসবে আপনার দর্শন এবং আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক প্রভৃতি বিষয়ে আপনার চিন্তাধারার কথা। সামাজিক কর্মকাণ্ডে আপনার কর্মকাণ্ডের কথা। যা হোক, জন্ম কখন কোথায়? সৈয়দ আবুল মকসুদ : এই যে জন্মের কথা বললেন, এ এক অপার রহস্য। এই যে জগৎ, জীবন ও কাল বা সময়Ñ এসব রহস্যের কোনো শেষ নাই। আমাদের যে জন্ম হয়Ñ অনাদিকাল থেকে হচ্ছে মানুষের জন্ম পৃথিবীতেÑ কেউই সে সম্পর্কে কিছু জানি না।

নিজের জন্মের কথা অন্যের কাছ থেকে জানতে হয়। আমার জন্ম ২৩ অক্টোবর ১৯৪৬-এ। বুধবার সন্ধ্যা ৬.১৫ মিনিটে। ৬.১৪ মিনিটেও আমি পৃথিবীতে ছিলাম না। থাকলেও ছিলাম মাতৃগর্ভে।

তার দশ মাস আগেই বা আমি কোথায় ছিলাম? জন্ম মানিকগঞ্জ জেলার এলাচিপুর গ্রামে। শিবালয় থানায়। আরিচাঘাটের মাইলখানেকের মধ্যে। এখন জায়গাটি নদীর মধ্যে। সেই জায়গায় চলে সারাদিনরাত ফেরি, নৌকা ও লঞ্চ।

ওখানে আমার জন্ম হওয়ার কথা নয়। আমার জন্ম হওয়ার কথা কলকাতায়। সেখানকার কোনো মাতৃসদনে কিংবা কলকাতার কোনো হাসপাতালে অথবা বাড়িতেই। কার জন্ম কোথায় হবে, কখন হবে, কারও কোনো হাত নেই। তাই বাবা-মা ও অন্য সবাই ঠিক করে রাখলেন জন্ম হবে কলকাতায়, ভূমিষ্ঠ হলাম এলাচিপুরের পদ্মাপাড়ের এক বাড়িতে।

সাপ্তাহিক : কলকাতায় কেন জন্ম হওয়ার কথা? সৈয়দ আবুল মকসুদ : আমার বাপ-দাদাদের বাড়ি এলাচিপুরে মুঘল আমলের আগে কোনো এক সময় থেকে। আমার নানা ছিলেন কলকাতার মানুষ। কলকাতারও নয়, উত্তর প্রদেশের ফয়েজাবাদ, লক্ষেèৗয়ের কাছে। তিনি অবাঙালি-উর্দুভাষী। হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গার কারণে ১৯২৬ সালে তিনি তাঁর অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রীকে অর্থাৎ আমার নানিকে নিয়ে কলকাতায় চলে আসেন এবং সেখানেই স্থায়ীভাবে থেকে যান।

আমার মা সালেহা বেগমের জন্ম হওয়ার কথা ছিল ফয়েজাবাদ, হলো কলকাতার পার্ক সার্কাস এলাকার মেহের আলী স্ট্রিটে। এরই নাম নিয়তি। ওতে কারও হাত নেই। যা হোক, আমার নানা ছিলেন মধ্যবিত্ত। একটি ছোট ছাপাখানা ছিল।

তিনি অকালে মারা যান। তার প্রেস দেখাশোনা করতেন তার শ্যালক। আমি যখন মায়ের পেটে তখন আমার সেই নানা, আম্মার মামা ব্যবস্থা করেছিলেন সাত মাসের গর্ভবতী অবস্থায় আম্মাকে কলকাতায় নিয়ে যাবেন। সব ঠিকঠাক। বাকশো-পেটারা বাঁধাছাঁদা শেষ।

বাড়ির ঘাটে নৌকা। কারণ আমাদের বাড়ি ছিল পদ্মার পাড়ে। নৌকায় আব্বা-আম্মা যাবেন শিবালয় বা আরিচা স্টিমারঘাটে। সেখান থেকে গোয়ালন্দ। গোয়ালন্দ থেকে শিয়ালদা।

নিয়তির কি পরিহাস। দিনটি ছিল ১৭ আগস্ট। তার আগের দিন ছিল ডাইরেক্ট অ্যাকশন ডে বা মুসলিম লীগের প্রত্যক্ষ সংগ্রাম দিবস। কেউ ভাবেনি ওইদিন উপমহাদেশের মানুষের ভাগ্য নির্ধারণ হয়ে যাবে। কলকাতায় ১৬ তারিখে গোলমালের কথা শুনে আম্মার যাওয়া মুলতবি হয়।

ঠিক হয় দু’চারদিন পরে পরিস্থিতি শান্ত হলে যাবেন। ১৯৪৬-এর ১৬ থেকে ১৯-২০ আগস্ট পর্যন্ত কলকাতায় যে নারকীয় হত্যাকাণ্ড হয় শুধু উপমহাদেশ নয়, মানবজাতির ইতিহাসে তার তুলনা বিরল। চার-পাঁচ দিনে হাজার বিশেক হিন্দু-মুসলমান পরস্পরের হাতে নিহত হয়। দাঙ্গা পরিস্থিতি কিছুটা শান্ত হলেও রক্তপাত কমবেশি হতেই থাকে। আমার মায়ের আর কলকাতায় যাওয়া হয়নি।

তখনও নয়। কোনো দিনই নয়। আমারও জন্ম বাংলাদেশের মাটিতেই হলো। আমার মা তাঁর জন্মস্থান এবং প্রিয়তম শহর কলকাতায় আর কোনোদিন যাননি। ১৯৪৮ সালের ২০ নভেম্বর মাত্র ২২ বছর বয়সে পৃথিবীকে ভালো করে জানার আগেই তিনি মারা যান।

তাঁর মৃত্যুও অপমৃত্যুই বলা চলে। তিনি ছয় মাসের অন্তঃসত্ত্বা ছিলেন। যথাসময়ের আগেই একটি মৃত কন্যাসন্তান প্রসব করার সময় একলেমশিয়া বা প্রসবকালীন ধনুস্টঙ্কার হয়ে তিনি মারা যান। আমার বয়স তখন দুই বছর দুই মাস। তিনি তাঁর সবচেয়ে প্রিয় বস্তুকে পৃথিবীর কূলকিনারাহীন এক উত্তাল সাগরে ফেলে রেখে চলে গেলেন।

আমি জানলাম না আমার সবচেয়ে আপনজন চিরদিনের জন্য আমাকে ছেড়ে চলে গেলেন এমন কোথাও যেখান থেকে আর কোনো দিন ফিরবেন না। বিস্ময়কর মনে হবে, আমি যে মাতৃহীন সে কথা আমি জানলাম প্রায় পনের বছর বয়সে, মায়ের মৃত্যুর এক যুগ পরে। আমার বিমাতা, বেগম রোকেয়া আখতার ছিলেন নিঃসন্তান। অতিশয় স্নেহশীল। তিনি আমাকে তাঁর বুকে টেনে নিয়েছিলেন নিজের পেটের সন্তানের মতো।

তিনিই আমার মা। তাঁকে মা ছাড়া আমি আর কিছ্ইু ভাবতে পারি না। ১৯৮০’র মে মাসে তিনি মারা যান। আমার মায়ের মৃত্যুও একটি রহস্যের মতো। কোনো নোটিশ না দিয়ে তাঁর কাছে মৃত্যু আসে।

তাঁর মৃত্যুর সপ্তাহখানেক আগে আব্বা পদ্মার চরে পাখি শিকারে যান। শিকারে তাঁর শখ ছিল। হাতও ভালো ছিল। সেদিন কয়েকটি বেলেহাঁস ও মাত্র একটি ঘুঘু শিকার করেন। ঘুঘুটি ছিল যমজ-ঘুঘুর একটি।

শিকার ঘুঘুটির জোড় ঘুঘুটি নদীর চর থেকে আব্বার নৌকার পিছে পিছে আমাদের বাড়িতে আসে। একপর্যায়ে ঘুঘুটি আমাদের উঠানে ছটফট করতে থাকে। ঘুঘুটির ছটফটানি দেখে আম্মা বিচলিত হন। রাতে কি এক স্বপ্ন দেখেন। সকালে আব্বাকে বলেন, ঘুঘুটি মারা ঠিক হয় নাই।

আরও বলেন, তিনি আর কয়েকদিন আছেন। তাঁকে যেতে হবে। আমাকে দেখিয়ে আব্বাকে বলেন, ওকে রেখে যাচ্ছি। দেখে রাখবেন। ১৭ নভেম্বর, হঠাৎ তাঁর ব্লিডিং শুরু হয়।

২০ তারিখে মারা যান। কয়েকদিন আগে আমাদের পারিবারিক ডাক্তার নিবারণচন্দ্র সাহা পোদ্দার আমাকে একটি জাপানি কাগজী লেবুর চারা দিয়েছিলেন। সেটি আব্বা-আম্মার শোবার ঘরের সামনে উঠানের এককোণায় আম্মার কথামতো লাগানো হয়েছিল। সেই লেবু গাছটির পাশে ওই রাতেই আম্মাকে শুইয়ে দেয়া হয়। ওই গাছটি পরে অনেক বড় হয়।

শত শত লেবু ধরত। পেকে পড়ে যেত। ওই গাছটির প্রতি আব্বার এত দরদ ছিল যে বাড়ি যখন নদীতে ভেঙে যায়, অন্য জায়গায় গিয়ে বাড়ি করা হয়, ওই গাছটিকে বহু কষ্টে তুলে নিয়ে সে বাড়িতে লাগান তিনি। কিন্তু সেখানে গিয়ে গাছটি বাঁচেনি। লেবুর চারাটি যিনি দিয়েছিলেন সেই নিবারণ ডাক্তার ছোটবেলা আমাকে পড়াতেনও।

ছিলেন আমার কাকার মতো। ছোটকাকার সহপাঠীও ছিলেন। তাঁকে ১৯৭১-এর জুনে পাকিস্তানি সেনারা পদ্মানদী থেকে গুলি করে হত্যা করে। তিনি ধুতি পরে নদীর পাড়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন। জীবন ও জগতের অনেক ব্যাপারেই কোনো গ্রহণযোগ্য ব্যাখ্যা হয় না।

অনেক ব্যাপারে কার্যকারণ থাকলেও, অনেক কিছুই ঘটে যার কোনো অর্থ নেই। এ জন্যই সম্ভবত ফরাসি অস্তিত্ববাদী দার্শনিক জা-পল সার্ত্রে মানুষের সংজ্ঞা দিয়েছেন ‘আ ইউজলেস প্যাশন’ বা এক অর্থহীন ভাবাবেগ বলে। জাতিসত্তার দিক থেকে আমার মা বাঙালি ছিলেন না। তাঁর মাতৃপিতৃভাষা ছিল উর্দু। আমার নানা-নানি ছিলেন ভারতের উত্তর প্রদেশের ফয়েজাবাদের অধিবাসী।

১৯২৫-২৬ সালে উত্তর প্রদেশের বিভিন্ন জায়গায় হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গা হয়। সেই দাঙ্গার সময় আমার মা ছিলেন মায়ের পেটে। তখন দাঙ্গার উপদ্রব থেকে বাঁচতে আমার অন্তঃসত্ত্বা নানিকে নিয়ে নানা কলকাতা আসেন। আম্মার জন্ম কলকাতায়। নানা-নানি আর ফয়েজাবাদে যাননি।

আম্মা কলকাতায় বেড়ে উঠলেও একটুও বাংলা জানতেন না। উর্দুই ছিল তাঁর একমাত্র ভাষা। ইংরেজি বুঝতেন ও কোনো রকমে পড়তে পারতেন। আমার দাদা ও তার পূর্বপুরুষ বহু শতাব্দী যাবত মানিকগঞ্জের অধিবাসী। আমাদের সেই গ্রাম এলাচিপুর তিরিশের দশকের শুরুতে পদ্মার ভাঙনে বিলীন হয়ে যায়।

তখন কাছেই আর একটি বাড়ি করা হয়েছিল। সেই বাড়িতেই আমার জন্ম। সেটিই এখন নদীর মধ্যে। আরিচা পাটুরিয়া থেকে ফেরিতে পারাপারের সময় আমার বাড়ির উপর দিয়ে যেতে হয়। সাপ্তাহিক : শৈশবে আপনাদের বাড়ির পরিবেশ কেমন দেখেছেন? সৈয়দ আবুল মকসুদ : শৈশবের বাড়ির পরিবেশের কথা বলার আগে একটি অপ্রাসঙ্গিক কথা বলতে চাই।

একটি জিনিস আমি ভেবে দেখেছি। সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা-হাঙ্গামা আমার খুব বেশি পীড়িত করে। কোথাও সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার কথা শুনলে আমি বিচলিত হই। ছুটে যাই। সাপ্তাহিক : সে তো দেখছিই।

যে কোনো দুর্গত মানুষের পাশে আপনাকে... সৈয়দ আবুল মকসুদ : যে কোনো দুর্গত এক কথা আর সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা অন্য জিনিস। যে কথা বলছিলাম, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার মধ্যে আমার মায়ের জন্ম। আমার জন্ম সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার সময়। এই কারণেই আমার ধারণা জন্মগতভাবে আমি সাম্প্রদায়িক বিবাদ-বিসম্বাদের প্রতি খুবই সংবেদনশীল। বাংলার সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা নিয়ে একটি বই লেখার ইচ্ছা আমার বহুদিনের।

শৈশবের বাড়ির পরিবেশের কথা বলছিলেন। সেকালের যে কোনো গ্রামীণ মধ্যবিত্তের বাড়ির মতোই। ভিন্ন শুধু ওইটুকু যে গ্রামেও আমাদের বাড়িতে বই ও পত্রপত্রিকা পড়ার পরিবেশটা ছিল। আম্মা যতদিন বেঁচেছিলেন ততদিন বাড়িতে কলকাতা থেকে তিন ভাষার পত্রিকাই আসত। আম্মার জন্য উর্দু পত্রিকা।

বাড়ির অন্যদের জন্য বাংলা, ইংরেজি। আব্বা, সৈয়দ আবুল মাহমুদ, পদ্যচর্চা করতেন। পত্রপত্রিকা পড়া ছিল প্যাশন। তখন রেডিও ছিল না। আগের দিনের কাগজ পরদিন বিকেলে শিবালয় আসত।

গোয়ালন্দ থেকে বড় বড় স্টিমার আসত আরিচায়। তাতে ডাক আসত। সেই শিবালয় বা আরিচাঘাট নেই। নদীর মধ্যে। তা ছিল একটি বন্দরের মতো।

সন্ধ্যার পরে আব্বা খবরের কাগজ নিয়ে বসতেন। পড়ে খবর অন্যদের বলতেন। শৈশবে অনেক দৈনিকের সঙ্গে আমার পরিচয় ঘটে। কলকাতার আনন্দবাজার পত্রিকা, স্টেট্সম্যান ও ইত্তেহাদ। পরে ঢাকার আজাদ, ইত্তেফাক ও মর্নিং নিউজ।

সব কাগজ একসঙ্গে থাকত না। ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে। কিছুদিন একটা, তারপর আরেকটা। প্রতিদিন সন্ধ্যার আগে ডাকপিয়ন পত্রিকা ও চিঠিপত্র থাকলে তা নিয়ে আসতেন। প্রতিদিন তাকে দেখতে দেখতে তার সঙ্গে আমার ভাব হয়ে গিয়েছিল।

আমার গর্ভধারিণী মায়ের কথা বলেছি। তাঁর কোনো স্মৃতি নেই আমার। যে মা আমাকে লালনপালন করেছেন তাঁর কাছে আমার ঋণ অপরিশোধ্য। চৌদ্দ বছর বয়সে প্রথম জানলাম তিনি আমার আপন মা নন। কীভাবে তা সম্ভব? আমার আব্বা বিত্তবান ছিলেন না।

কিন্তু সমাজকর্ম করায় এলাকায় তাঁর বিশেষ প্রভাব ছিল। মানুষ খুব ভালোবাসত। সেকালের মানুষ এখনকার মতো বিশ্বাস ভঙ্গ করত না। রাত একটার মধ্যে আম্মার দাফন হয়ে যায়। বাড়ির উঠানে ওই লেবুগাছের কাছে।

জানাজার সময় আব্বা উপস্থিত জনতাকে একটি অনুরোধ করেন। তিনি বলেছিলেন, ঘরসংসার করতে আমাকে হয়ত কখনো আবার বিয়ে করতে হতে পারে। আপনারা আমার ছেলেটিকে দয়া করে বলবেন না যে ওর মা নাই। আত্মীয়স্বজন ও গোটা উপজেলার লোক আব্বার সেই অনুরোধ রক্ষা করেছিলেন। আরও রহস্যজনক যে আমার বিমাতারও কোনো সন্তানসন্ততি ছিল না।

তিনি আমাকে এতই স্নেহ করতেন যে মাতৃস্নেহের অভাব কখনো বোধ করিনি। আমি যখন নবম শ্রেণীতে পড়ি তখন আব্বার অতি গোপনীয় কিছু কাগজপত্রের মধ্যে তাঁর একটি ডায়েরি পাই। সেখানে ১৯৪৮ এর ২০ নভেম্বরের এন্ট্রি থেকে জানতে পারি মায়ের মৃত্যু সংবাদ। তা জেনেও আমার বিশেষ খারাপ লাগেনি। তা নিয়ে আমি আর কারও সঙ্গে আলোচনা করিনি।

প্রতিজ্ঞা করেছিলাম, আমার স্নেহময়ী বিমাতার জীবদ্দশায় মায়ের সম্পর্কে তাঁর মৃত্যু নিয়ে কারও সঙ্গে কোনো কথা বলব না। ১৯৮১-র মে’তে আমার এই আম্মা মারা যান। সেই দিনটি ছিল আমার জীবনের সবচেয়ে শোকের দিন। তাঁর মৃত্যুরও কয়েক বছর পরে এক রাতে, বাড়িতে কেউ ছিল না, কাজের লোকও নয়, প্রবল বর্ষণ হচ্ছিল, আমি আমার মায়ের মৃত্যুর কথা তুলেছিলাম। আব্বা নীরব রইলেন।

আমিও চুপ থেকে অন্য প্রসঙ্গে গেলাম। পরে চাচা-চাচি ও আত্মীয়স্বজনের থেকে আম্মা ও নানা-নানি সম্পর্কে জেনেছি। সাপ্তাহিক : কীভাবে বেড়ে উঠলেন। শৈশবে পড়াশোনা প্রভৃতি... সৈয়দ আবুল মকসুদ : আমি স্কুলে ভর্তি হয়েছি অনেক দেরিতে। একেবারে ষষ্ঠ শ্রেণীতে।

আব্বা মানুষের কাজ নিয়ে এত ব্যস্ত থাকতেন যে আমাকে পড়ানোর সময় তাঁর ছিল না। আমার হাতেখড়ি হয় আমাদের পারিবারিক নাপিতের হাতে ও পারিবারিক ডাক্তারের কাছে। সেকালে গ্রামীণ জীবনে ধোপা, নাপিত হতেন বংশানুক্রমিক। অতীতে কোনো এক সময় কোনো নাপিতকে দু’এক বিঘা জমি লিখে দেয়া হয়েছিল। তারপর বছরে ধানের মৌসুমে মণ দুই ধান দেয়া হতো।

নাপিত সারা বছর বাড়ির সব লোকের, চাকরবাকরদের, সবার চুল কাটত। আমাদের নাপিতের নাম ছিল লোকনাথ শীল। কাকের মতো কালো ছিলেন দেখতে। কর্কশ তাঁর কণ্ঠস্বর। আমাকে পড়াতেন : আÑম, পড়ো-আম।

সারাদিন তিনি গ্রামে গ্রামে ক্ষৌরকর্ম করতেন। বিকেলে আমাকে পড়াতেন। তাকে দেখলে বড়ই বিরক্ত হতাম। তিনি সেটা টের পেতেন। আব্বার ভয়ে কিছু বলতেন না।

আব্বা যখন বলতেন, কী লোকনাথ, তোমার ছাত্র পড়ে ঠিকমতো? লোকনাথ কাকা বলতেন, আজ্ঞে, খুব ভালো করতেছে। মাথা তো ভালো। আসলে আমি ভালো করতাম না। আমার অমনোযোগ সহ্য করে কোনো রকমে ‘বর্ণবোধ’ ও ‘আদর্শলিপি’ তিনি শেষ করান। তারপর রাশি রাশি বাল্যশিক্ষা বই কলকাতা থেকে ছোট চাচা পাঠাতেন।

ছোট চাচা ভারতের নাগরিকত্ব গ্রহণ করেছিলেন। এক উড়িষ্যার মহিলাকে বিয়ে করেছিলেন। তাঁর সহপাঠী ছিলেন ওই যে নিবারণ ডাক্তারের কথা বললাম, একাত্তরে শহীদ হন, তিনি আমাকে পড়াতেন। প্রত্যেক দিন নয়Ñ সপ্তাহে ৩-৪ দিন। আমার শিক্ষার ভিত্তি তিনি তৈরি করেন।

তিনি একটি পয়সাও নেননি কোনোদিন। আমি তাঁর কাছে ঋণী। আমার মনে আছে, একদিন অপরাহ্ণে তিনি আমাকে পড়িয়ে যাচ্ছিলেন। আব্বার সঙ্গে কথা বললেন। আব্বাকে বললেন, দাদাবাবু ও তো কবি হবে, লেখক হবে।

যখন তিনি এ কথা বলেন তখন কবি ও লেখক কি তা আমি জানতাম না। তারপরে আরও বহু শিক্ষকের কাছে আমি পড়েছি। তাঁরা বৈতনিক শিক্ষক। দায়িত্ব পালন করেছেন মাত্র। আমাকে গড়ে তুলতে কোনো বিশেষ ভূমিকা পালন করেননি।

সাপ্তাহিক : তারপর প্রথম কোন স্কুলে ভর্তি হলেন? সৈয়দ আবুল মকসুদ : ঝিটকা আনন্দমোহন হাই স্কুলে। তখন ওটা মানিকগঞ্জের ভালো স্কুল ছিল। তার হেডমাস্টার ছিলেন কালীপ্রসাদ ভৌমিক। তাঁর মতো ব্যক্তিত্বসম্পন্ন কোনো ভাইস-চ্যান্সেলর যদি এখন আমাদের কোনো পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় পেত আমরা ধন্য হতাম। আমি ভালো ছাত্র ছিলাম না।

তবু তিনি আমাকে স্নেহ করতেন। আমাদের স্কুলে ছিল লাইব্রেরি। তাতে বহু বই ছিল। তার যিনি চার্জে ছিলেন, সেই সংস্কৃতের পণ্ডিতের সঙ্গে আমি ভাব জমিয়েছিলাম। ওই ঘরে বসে বই পড়ার সুযোগ পেতাম।

সেখানে আর বিশেষ কেউ যেত না। পাঠ্যবই মুখস্থ করায় আমার কোনো আগ্রহ ছিল না। তার পরিণতি অবশ্য ভালো হয়নি। সাপ্তাহিক : ঢাকায় এলেন কখন? সৈয়দ আবুল মকসুদ : কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার জন্য আমার চাচাত ভাইদের ঢাকায় বাসা নিতে হয়। ভাইয়েরা ছিলেন সাতজন।

আমি একা। সবাই মনে করত এবং এখনও করে আমরা আট ভাই। পাকিস্তান আগে এবং পরেও কয়েক বছর আমাদের পরিবারের ঢাকার চেয়ে কলকাতার সঙ্গেই যোগাযোগ ছিল বেশি। আত্মীয়স্বজনের বেশিরভাগই থাকতেন কলকাতায়। আমি জীবনে প্রথম ঢাকায় আসি বাহাত্তরের মার্চে।

ভাষা আন্দোলনের পনের বিশ দিন পরে। তখন এবং ষাটের দশক পর্যন্ত আমরা যাতায়াত করতাম স্টিমার ও লঞ্চে। যা বলছিলাম। একুশে ফেব্রুয়ারির কয়েকদিন পরে ঢাকায় আসি। শহীদ রফিক ছিলেন মানিকগঞ্জের মানুষ।

একুশে ফেব্রুয়ারির পরপরই গোটা দেশ শোকে নিমজ্জিত হয় এবং ক্রোধে ফেটে পড়ে। রফিককে নিয়ে আব্বা লিখেছিলেন একটি পদ্য। পনের ষোল পৃষ্ঠার মতো। সেই পদ্য ছাপতে ঢাকায় আসেন। আমাকেও নিয়ে আসেন।

পাটুয়াটুলিতে আমাদের আত্মীয়দের কয়েকটি ছাপাখানা ছিল। স্বাধীনতার আগে তা ছিল কলকাতায়, ’৪৭-এর পর এক্সচেঞ্জ করে তাঁরা ঢাকায় আসেন। কবিতাটি নজরুলের অনুকরণে রচিত হয়েছিল। দুটি লাইন আমার মনে আছে। যেমনÑ মহারম মাস আসিতে যদিও এখনো অনেক দেরি, আমার বাড়ির আঙিনায় আজ কোন্ কারবালা হেরি।

ঢাকায় আমাদের বাসা ছিল লালবাগ শাহী মসজিদের কাছে শেখ সাহেব বাজারের সঙ্গে হরমোহন শীল স্ট্রিট। আমাদের বাসার উল্টো দিকেই ছিল রাশেদ খান মেননের শ্বশুরের বাড়ি। তিনি আমাদের প্রতিবেশী হওয়ায় তখন নয় পরবর্তীকালে ষাটের দশকে আমার রাজনৈতিক জীবন নির্মাণে উপকারই হয়েছিল। তাঁর বাড়িতে খুলনা থেকে কয়েকজন আত্মীয় আসতেন। তাঁরা ছিলেন মার্কসবাদী।

তাঁদের থেকে মার্কসবাদের দীক্ষা নিই। ঢাকায় আসি সন্ধ্যার পরে। ফতুল্লা থেকে দেখতে পাই নক্ষত্রের মতো রাশি রাশি আলো। ঢাকার আলো দেখে শিহরিত হই। পরদিন সকালে নাস্তা খেয়ে আব্বা ও আমার এক ভাইয়ের সঙ্গে বের হই।

শহীদ মিনারের বেষ্টনী দেয়া জায়গাটি দেখি। সারা শহর শোকে দুঃখে থমথমে। ওখান থেকে মেডিকেল কলেজ, কার্জন হল, হাজী শাহবাজের মসজিদ ও মাজার, রমনা কালীবাড়ি দেখে সলিমুল্লাহ মুসলিম হলে এসে অনেকক্ষণ ঘুরে দেখি। এসব দেখে মনটা ভরে যায়। প্রথমবার দিন পাঁচেক ছিলাম ঢাকায়।

সাপ্তাহিক : রাজনীতি সম্পর্কে কখন সচেতনতা আসে? সৈয়দ আবুল মকসুদ : আমার বাবা ছিলেন রাজনীতিসচেতন মানুষ। সক্রিয় রাজনৈতিক কর্মী। স্থানীয় নেতা। ১৯২১ সালে ব্রিটিশবিরোধী অসহযোগে যোগ দিয়ে জেল খেটেছেন। ১৯৪৪-এর এপ্রিল পর্যন্ত কংগ্রেস করতেন।

তারপর মুসলিম লীগে যোগ দেন। কিন্তু ফজলুল হকের প্রতি ছিল তাঁর বিশেষ শ্রদ্ধা। বিশেষ করে কৃষকদের জন্য ঋণসালিসী বোর্ড করায় তাঁর প্রতি আব্বার শ্রদ্ধা ছিল গভীর। ১৯৫০ এ তিনি কৃষক প্রজা পার্টিতে যোগ দেন। তখন ওই দলের সাংগঠনিক অবস্থা ছিল দুর্বল।

মুসলিম লীগের জোর বেশি, আওয়ামী লীগেরও উত্থান ঘটছিল। যে কোনো কারণেই হোক মওলানা ভাসানীর প্রতি আব্বা প্রসন্ন ছিলেন না। বলা চলে বিরূপ ছিলেন। অবশ্য তিনি মৃত্যুর আগে দেখে গেছেন তাঁর পুত্রই মওলানাকে নিয়ে গবেষণা করে বই লিখেছে। সে বই প্রকাশে তাঁরও কিছু ভূমিকা ছিল।

মওলানাকে আব্বা মনে করতেন ছদ্মবেশী কমিউনিস্ট। যা হোক, নির্বাচনী রাজনীতি কি তা প্রথম দেখি চুয়ান্নর নির্বাচনের সময়। ওই সময় দেখি তিন জাতীয় নেতাকেÑ ফজলুল হক, মওলানা ভাসানী ও সোহরাওয়ার্দী। তখন মানুষ একসঙ্গে বলত ‘হক-ভাসানী-সোহরাওয়ার্দী’। আমাদের বাংলা ঘরে বসে কর্মীরা সাদা কাগজে পোস্টার লিখতেন।

‘নৌকা মার্কায় ভোট দিন’। সেই কাগজ মসজিদ, ইস্কুলের দেয়ালে এবং বড় গাছের গুঁড়িতে সেঁটে দেয়া হতো। সেকালের নির্বাচন এখনকার মতো ছিল না। আমাদের এলাকায় লীগের জনপ্রিয় প্রার্থী রাজা মিয়া হেরে গিয়েছিলেন যুক্তফ্রন্টের প্রার্থী কৃষক প্রজা পার্টির আবদুল লতিফ বিশ্বাসের কাছে। শিবালয় একটি প্রধান স্টিমারঘাট হওয়ায় বড় নেতারা সব ওই পথেই যাতায়াত করতেন।

শেখ মুজিবকেও আমি তখনই প্রথম দেখি। ইউসুফ আলী চৌধুরী মোহন মিয়াকেও দেখি। অনেক নেতার মধ্যে মোহন মিয়াকে আব্বা শ্রদ্ধার চোখে দেখতেন। নির্বাচনের কয়েকদিন পর লতিফ বিশ্বাস কেন্দ্রীয় খাদ্যমন্ত্রী হন। তাঁকে মানিকগঞ্জ সিনেমা হলে সংবর্ধনা দেয়া হয়।

আমার আব্বা কবিতার মানপত্র পাঠ করেন। তখন জানলাম মন্ত্রী কাকে বলে। মন্ত্রী হওয়ার আগে যিনি ছিলেন আমাদের কাছের মানুষ। রাতারাতি মন্ত্রিত্বের কারণে হয়ে গেলেন দূরের মানুষ। তাঁর কাছে যাওয়া যায় না আগের মতো।

লতিফ বিশ্বাস বিএনপি নেতা এম কে আনোয়ারের শ্বশুর। সাপ্তাহিক : সেইকালের রাজনীতি কেমন দেখেছেন। সমাজ কেমন ছিল। রাজনীতি কেমন বুঝতেনÑ সে সম্পর্কে কিছু বলুন? সৈয়দ আবুল মকসুদ : সেকালের রাজনীতি সম্পর্কে তো আমার কোনো অভিজ্ঞতা নাই। কোনো আগ্রহও ছিল না।

কিছু কিছু অবস্থা সম্পর্কে জানা আছে। সমাজ এখনকার মতো ছিল না। পঞ্চাশের দশকের কথা বলছি। ভয়াবহ দারিদ্র্য দেখেছি। শতকরা ৭০ জন মানুষ অতি গরিব।

একটার বেশি জামা ছিল না অধিকাংশ মানুষের। পঞ্চাশ ভাগ লোক জুতা কি জিনিস জানত না, অন্যকে পায়ে দিতে দেখেছে। প্রায় প্রতি বছর বন্যা হতো। ১৯৫০ সালের বন্যার কথা এবং ভূমিকম্পে আমাদের গাছপালা সব পদ্মা নদী দিয়ে বাংলাদেশে আসার দৃশ্য দেখেছি। আমাদের কাজের লোকরা সেই কাঠ নদী থেকে কুড়িয়ে স্তূপ করে রেখেছেন।

৭-৮ বছর ওই কাঠ জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে। বন্যার সময় সব বাড়িতে পানি উঠত। আমাদের বাড়িতে চারবার পানি উঠেছে। দু’বার ঘরের ভেতরে। সে এক সাংঘাতিক অবস্থা।

ঘরের মধ্যে সাপ নড়াচড়া করে। মাছ লাফায়। এক ঘর থেকে আরেক ঘরে যেতে হয় পুল দিয়ে। অথবা ছোট ডিঙিতে। পঞ্চাশের দশকে খাদ্যাভাব দেখা দিয়েছে কয়েকবার।

সরকারি রিলিফের চাল আমাদের বাংলাঘর থেকে বিতরণ করা হতো। সেই যে ক্ষুধার্ত মানুষকে দেখেছি দু’সের চাল নিতে এসে সকাল থেকে দাঁড়িয়ে যেত। সে চালও অন্য রকম। সাদা ধবধবে। বার্মা বা মিয়ানমার থেকে আমদানি করা বরফের মতো সাদা।

হাড় জিরজিরে সব মানুষ দেখে আমার জীবন সম্পর্কে একটা ধারণা হয়। পরে যে সমাজতান্ত্রিক ভাবধারায় ঝুঁকি তা ওইসব দেখে। সাপ্তাহিক : সমাজতন্ত্রের দিকে ঝুঁকলেন কখন, কিভাবে? সৈয়দ আবুল মকসুদ : পঞ্চাশের দশকে এখনকার মতো মিডিয়া ছিল না। দু’তিনটি দৈনিক ছিল তা খুব অল্প লোকে পড়ত। মানুষের রাজনৈতিক সচেতনতা ছিল না।

কিন্তু অভাব থাকায় মানুষের মধ্যে সরকারের প্রতি ক্ষোভ ছিল। অন্যদিকে সেই ক্ষোভকে পুঁজি করে বিরোধী নেতারা রাজনীতি করতেন। ক্ষমতার রাজনীতির কামড়াকামড়ি। পাকিস্তানে প্রথম দিন থেকেই সেনাবাহিনী রাজনীতিতে সক্রিয় ছিল। সেই সুযোগের সদ্ব্যবহার করে সেনাবাহিনী।

তার পেছনে ছিল মার্কিন-ব্রিটিশ নয়া-সাম্রাজ্যবাদী শক্তি। তারা জেনারেল আইয়ুব খানকে দিয়ে সামরিক অভ্যুত্থান ঘটায়। ১৯৫৮-র ৭ অক্টোবর। কয়েকদিন ইস্কানদার মির্জা ক্ষমতায় ছিলেন। তারপর ২৭ অক্টোবর তাঁকে ছুড়ে ফেলে দিয়ে আইয়ুব নিজেই সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী হন।

সে যে কী ক্ষমতা তা এখন বোঝানো সম্ভব নয়। আমাদের বাড়ির সংলগ্ন বিঘা দুই জমিতে শ’খানেক বছরের জঙ্গল ছিল। ওতে কেউ কোনো দিন হাত দেয়নি। সেই জঙ্গল সাফ করে ফেললাম আমরা তিন দিনে। কারণ মার্শাল ল’ শাসকদের থেকে জঙ্গল পরিষ্কারের হুকুম ছিল।

যার বাড়িতে জঙ্গল ও যার পুকুরে ডোবায় কচুরিপানা পাওয়া যাবে তাকে বেত্রাঘাত। সারা দেশের কচুরিপানা সাত দিনে পরিষ্কার। অনেক রাজনৈতিক নেতাও বেত্রাঘাত খেয়েছেন। নারায়ণগঞ্জে কারও মাথায় গোবর গুলিয়ে ঢেলে রাস্তা দিয়ে হাঁটিয়েছে আর্মির লোক। কিন্তু এত অগণতান্ত্রিক আচরণের পরেও অল্পদিনেই আইয়ুব জনপ্রিয় হয়ে উঠলেন।

বাংলাদেশের সব বিখ্যাত কবি-সাহিত্যিক তাঁকে প্রশংসা করে লিখেছেন। সেসব লেখা আমি পড়েছি। শুধু পড়ি নাই, কেটেও রাখতাম। আমাদের কবি-সাহিত্যিকদের দল বেঁধে পশ্চিম পাকিস্তান ভ্রমণ করিয়েছে আইয়ুব সরকার। তাঁরা খুব খুশি।

এখন যেমন আওয়ামীপন্থি কবি-সাহিত্যিক-বুদ্ধিজীবীরা খুব খুশি। এখনকার অনেকেও তখন আইয়ুব খান থেকে সুবিধা নিয়েছেন। সফরনামা লিখেছেন। শওকত ওসমান, মুনীর চৌধুরী, হাসান হাফিজুর রহমান, আব্দুল গাফ্ফার চৌধুরী প্রমুখ আইয়ুব সরকারের প্রথম দিকে সহযোগিতা দিয়েছেন। লেখালেখি করেছেন।

আমাদের বুদ্ধিজীবীদের চরিত্র চিরকালই এক রকম। এখন যা দেখছেন তখনও তাই ছিল। তখন পশ্চিম পাকিস্তানের করাচি লাহোর সফর করাকে তাঁরা স্বর্গযাত্রা মনে করতেন, এখন ভারতের দিল্লি বোম্বে সফরকে মনে করেন। চরিত্র বদলায় নাই। শুধু ভেন্যু বদল হয়েছে একাত্তরের পর।

সাপ্তাহিক : তা বামপন্থিদের সঙ্গে আপনার যোগাযোগ কিভাবে? সৈয়দ আবুল মকসুদ : সেটা আইয়ুব খানের আমলেই। ষাট-একষট্টিতে আমাদের এলাকায় কয়েকজন কমিউনিস্ট নেতা আত্মগোপন করা অবস্থায় যান। তাঁরা ছিলেন নিষিদ্ধ ঘোষিত পাকিস্তানের কমিউনিস্ট পার্টির নেতা। এক রাতে ঘিওর নন্দীবাড়িতে তাঁদের সঙ্গে কথা হয়। রাশিয়ার ও চীনের সমাজতন্ত্রের ইতিহাস বলেন।

তার আগে আমি ওই দুই সমাজতান্ত্রিক দেশের বিপ্লব সম্পর্কে জানতাম না। শুনে সেই যে সমাজতন্ত্রের প্রতি আকৃষ্ট হই, আজো একই রকম আছি। তারপর ষাটের দশকে খোকা রায়, অনিল মুখার্জি, জ্ঞান চক্রবর্তী প্রমুখ নিবেদিত বাম নেতাদের কাছে থেকে দেখার সুযোগ পাই। আরও পরে দেবেন সিকদার, অমল সেন, মোহাম্মদ তোয়াহা, আবদুল মতিন, আলাউদ্দিন আহমদ প্রমুখের রাজনীতিতে আকৃষ্ট হই। সাপ্তাহিক : বাম ছাত্ররাজনীতিতে কখন থেকে যুক্ত হলেন।

কী ভাবে? সৈয়দ আবুল মকসুদ : আমাদের বড় ভাইদের কেউ কেউ ছাত্র ইউনিয়নের সঙ্গে শুরু থেকেই যুক্ত ছিলেন। তাঁদের কথাবার্তায় অনুপ্রাণিত হয়েছি। এর মধ্যে হামদুর রহমান শিক্ষা কমিশনের রিপোর্ট নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা আন্দোলন শুরু করেন। আমাদের প্রবেশিকা পরীক্ষা সামনে। শুরু হলো আন্দোলন।

ওই আন্দোলনের সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে যুক্ত হই। কয়েক মাস আন্দোলন উত্তেজনা চলেছে। নেতৃত্ব দিলেন কাজী জাফর আহমদ, রাশেদ খান মেনন, মতিয়া চৌধুরীরা বাম ছাত্রদের দিক থেকে। এর মধ্যে আজাদ পত্রিকার বার্তা সম্পাদক এম. আনিসুজ্জামান একদিন কার্ল মার্কসের ক্যাপিটাল বইটি দেখান। তাঁর বাসাও আমাদের বাসার কাছেই শেখ সাহেব বাজার ছিল।

মেনন ভাইয়ের শ্বশুরের কয়েকজন আত্মীয় খুলনা থেকে প্রায়ই আসতেন। তাদের সঙ্গে আমরা বারান্দায় বসে সমাজতান্ত্রিক আন্দোলন নিয়ে আলোচনা করতাম। এইভাবেই ওই রাজনীতির একজন কর্মীতে পরিণত হই। ১৯৬৪-তে একবার ছাত্র ইউনিয়নের এক মিছিল থেকে অনেকের সঙ্গে আমি গ্রেফতারও হয়েছিলাম। আমাদের মামলার জামিনের ব্যবস্থা করেছিলেন আইনজীবী জহীর উদ্দিন, খন্দকার দেলোয়ার হোসেন প্রমুখ।

জহীর উদ্দীনকে স্বাধীনতার পরে বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানে বাংলাদেশের প্রথম হাইকমিশনার নিয়োগ দেন। সাপ্তাহিক : যা আপনার প্রধান কাজের ক্ষেত্র সেই সাহিত্য সম্পর্কেই জানা হলো না। কখন থেকে সাহিত্যচর্চা করছেন। কখন প্রথম লেখা ছাপা হয়? সৈয়দ আবুল মকসুদ : কবে থেকে লিখছি তা স্মরণ নেই। অতি ছোটবেলায় লেখালেখি শুরু করি।

কবিতা-টবিতা লিখেছি। একটু বড় হয়ে গল্প লিখি। যখন ক্লাস সেভেনে পড়ি তখন রবীন্দ্রনাথের চৈতালি কাব্যগ্রন্থের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে ওই ধরনের একটি কবিতার বই লিখেছিলাম। তখন থাকতাম ইছামতি নদীর তীরে। প্রথম কবিতা ছাপা হয় সাপ্তাহিক পাক জমহুরিয়াত পত্রিকায়।

একটি কবিতা। সেটা ১৯৬১-র অক্টোবরে। সাপ্তাহিক : গণতান্ত্রিক আন্দোলনে কখন যুক্ত হলেন? সৈয়দ আবুল মকসুদ : ষাটের দশকে আইয়ুব খানের শাসনামলে। পাকিস্তানে তখন দুটি ধারায় আন্দোলন হচ্ছিল। একটি শেখ মুজিবের নেতৃত্বে বাঙালি জাতীয়তাবাদী আন্দোলন।

আর একটি মওলানা ভাসানী ও বামদের নেতৃত্বে সমাজতান্ত্রিক আন্দোলন। আমি বাঙালি জাতীয়তাবাদী আন্দোলন সমর্থন করতাম। তাতে ছয় দফারও সমর্থনের প্রশ্ন আসত। তবে প্রধানত ছিলাম বাম সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনে, স্বপ্ন ছিল বাংলাদেশে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হবে। তোয়াহা সাহেবের সঙ্গে কাজ করি কিছুদিন।

’৬৮-৬৯-এর দিকে। এই করতে করতেই এলো ঊনসত্তরের গণআন্দোলন। তারই ধারাবাহিকতায় একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধ। আমাদের কমান্ডার ক্যাপ্টেন আবদুল হালিম চৌধুরী বাম চিন্তাধারার ছিলেন। মস্কোপন্থি ন্যাপ করতেন।

বাহাত্তরে অনেকেই খেতাব পেলেন। হালিম চৌধুরীকে কোনো খেতাব দেয়া হলো না। কারণ তিনি আওয়ামী লীগ করতেন না। তিনি মনে কষ্ট পান। আমরাও পাই।

তাঁর সঙ্গে বাহাত্তরে বত্রিশ নম্বরে বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে গেছি। বঙ্গবন্ধু তাঁকে মূল্যায়ন করলেন না। সাপ্তাহিক : নারীর নির্যাতন, নিপীড়ন, ধর্ষণ, এসিড নিক্ষেপ প্রভৃতির বিরুদ্ধে আমাদের নারী নেত্রীদের সঙ্গে আপনাকেও প্রতিবাদ মানববন্ধন সভা-সমাবেশ করতে দেখা যায়। কখনো নির্যাতিতের বাড়িতেও ছুটে যান। আমাদের নারীবাদীদের সম্পর্কে কিছু বলুন।

বাংলাদেশের নারীবাদী আন্দোলন সম্পর্কে আপনার ধারণা কী? সৈয়দ আবুল মকসুদ : নারীর সামাজিক অর্থনৈতিক প্রভৃতি অধিকার নিয়ে কথা বলা আর নারীবাদী আন্দোলন এক জিনিস নয়। পশ্চিমের নারীবাদী আন্দোলনের দার্শনিক ভিত্তি রয়েছে। পশ্চিমেও নারী হাজার হাজার বছর গৃহবন্দী ছিল। অধিকারবঞ্চিত ছিল। ইউরোপের সাম্রাজ্যবাদী শক্তিসমূহ পৃথিবীর দুর্বল জনগোষ্ঠী থেকে শোষণ করে সম্পদ লুণ্ঠন করে নিয়ে তাদের দেশকে সমৃদ্ধ করেছে।

সেখানে জ্ঞান-বিজ্ঞান-দর্শনের চর্চা হয়েছে। বিজ্ঞানীরা একের পর এক যন্ত্র আবিষ্কার করেছেন। মহাবিশ্বের রহস্য উন্মোচন এবং জীবন ও জগৎ নিয়ে দার্শনিকরা অবিরাম কাজ করেছেন। রচিত হয়েছে মহান সাহিত্য। চিত্রকলা সঙ্গীতে চূড়ায় উঠে গেছে পশ্চিম ইউরোপ।

আবির্ভাব ঘটেছে আইজাক নিউটনের মতো মহান দার্শনিকের। শেক্সপীয়ার, মিল্টন, এডমুণ্ড স্পেন্সার, ক্রিস্টোফার মার্লো, জন ড্রাইডেন, জনাথন সুইফ্ট, আলেকজাণ্ডার পোপ, বায়বন, শেলী, কীট্স জন্মগ্রহণ করেন ব্রিটেনে। জার্মানিতে তারকার শেষ নেই। সেই ষোল শতকে নিকোলা কপার্নিকাসের মতো বিজ্ঞানী, মার্টিন লুথারের মতো সংস্কারক, জোহানেস কেপলারের মতো জ্যোতির্বিজ্ঞানী, বাখ্ বা বিথোফেনের মতো সঙ্গীতজ্ঞ; গোয়েটে ও শিলারের মতো কবি-সাহিত্যিক-নাট্যকার; কান্ট, হেগেল, লেসিং, লাইবনিজ, শোপেনহাওয়ার বা নীৎসের মতো দার্শনিক। ব্রিটেনে কত বড় বড় দার্শনিক।

বেকন, বার্কলি, হিউম, মিল, বেনথাম, লক্ প্রমুখ। আবির্ভাব ঘটেছে হল্যান্ডে যুগান্ত সৃষ্টিকারী দার্শনিক দেকার্তে-এর। আরও অগণিত প্রতিভা। ইতালীয় রেনেসাঁর কথা বাদই দিলাম, আঠার শতকের জ্ঞানবিভাসিত যুগ বা এজ অব এনলাইটেনমেন্টের পরেও ইউরোপে নারীর অবস্থা শোচনীয়ই ছিল। তাদের অধিকার ছিল না।

শিল্পবিপ্লব হলো কিন্তু নারী তার আগের অবস্থানেই পড়ে রইল। দেশে দেশে নির্বাচিত গণতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠিত হলো। কিন্তু সেখানে নারীর মতামতের মূল্য ছিল না। তাদের ভোট দেয়ার অধিকার ছিল না। অর্থনৈতিক স্বাধীনতা ছিল না।

সামাজিক স্বাধীনতা ছিল না। ওই প্রেক্ষিতে ইউরোপে নারীর মানবিক অধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে আবির্ভাব ঘটে নারীবাদীদের। তাঁরা বললেন, নারীর প্রধান পরিচয় সে মানুষ। তার যোগ্যতা লিঙ্গনিরপেক।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।