আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

রবীন্দ্রনাথ ও বিশ্বসুন্দরী

কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে ভাবলে কেন যেন মনে পড়ে সে ছড়াটির কথা। ফারুক নওয়াজের লেখা ছড়াটি হলো_ "আঁকতে আমার ভীষণ ভয়/"আঁকতে থাকি তলস্তয়/ "আঁকতে "আঁকতে থামিয়ে হাত/ তাকিয়ে দেখি রবীন্দ্রনাথ। "আঁকতে আমার ভীষণ ডর/ "আঁকতে থাকি শেঙ্পীয়র/ "আঁকতে "আঁকতে অনেক রাত/ তাকিয়ে দেখি রবীন্দ্রনাথ। "আঁকতে আমার ভীষণ লাজ/ তবু যখন "আঁকাই কাজ/ "আঁকতে "আঁকতে কিস্তিমাত/ তাকিয়ে দেখি রবীন্দ্রনাথ। "

ফারুক নওয়াজ তার প্রতীকী ছড়ায় রবীন্দ্রনাথের অপ্রতিরোধ্য ক্ষমতার কথা তুলে ধরেছেন।

এ ক্ষমতাবলেই 'রবীন্দ্র' নামে যাদের গাত্রদাহ, সেই সাম্প্রদায়িকতাবাদীরাও মাথা নত করেন মহীরুহ অশ্বত্থের কাছে। অতি প্রগতির নামে যারা সব কিছুতেই প্রতিক্রিয়াশীলতা খোঁজেন, তারাও শেষ অবধি ফিরে আসতে বাধ্য হন তার সানি্নধ্যে। পছন্দ-অপছন্দ, প্রগতি প্রতিক্রিয়ার তাত্তি্বকতা_ সব কিছুকেই গ্রাস করেছেন এই মহাপুরুষ। এমনই তার বিশাল ব্যাপ্তি।

রবীন্দ্রনাথ সত্যিকার অর্থেই ছিলেন অসামান্য প্রতিভা।

যার লেখায় মনুষ্য জীবনের দুঃখ, আনন্দ, আবেগ, ভক্তি, সংগ্রাম সব কিছু মূর্ত হয়ে উঠেছে। জীবনবোধ বলতে আমরা যা বুঝি, তা পূর্ণতা পেয়েছে রবীন্দ্র সাহিত্যে। তাই একজন প্রকৃতি প্রেমিক তার উপলব্ধিকে শাণিত করতে ছুটে যান রবীন্দ্রনাথের কাছে। ভক্তিমার্গে যার বসবাস তাকেও আসতে হয় রবিকরোজ্জ্বল রাবীন্দ্রিক জগতে। দেশ-কাল-পাত্রের ঊর্ধ্ব  নিজের বিজয় কেতন উড়িয়েছেন তিনি।

ইউরোপের বহু গির্জায় ঈশ্বর আরাধনায় পরিবেশিত হয় রবীন্দ্রসংগীত। ভাষান্তর নাকি কখনো মূল উৎসের খোঁজ পায় না। তবু রবীন্দ্রসংগীতের ভিন্ন ভাষার আলাপন ঈশ্বর প্রেমিকদের কাছে বর্ণনাতীত তন্ময়তার সৃষ্টি করে। নর-নারীর প্রেম ও বিচ্ছেদের ক্ষেত্রেও রবীন্দ্রনাথের উপস্থিতি মূর্তমান। সাহিত্যের প্রতিটি ক্ষেত্রে, জীবনের প্রতিটি স্তরে রবীন্দ্রনাথ যে সৃষ্টি রেখে গেছেন, তা এককভাবেই পরিপূর্ণতার দাবি রাখে।

অনেক কবি-সাহিত্যিককে তাই বলতে শোনা গেছে_ রবীন্দ্রনাথ নতুন করে কিছু লেখার প্রয়োজনীয়তা ফুরিয়ে দিয়েছেন। দৃশ্যত, যা কিছু নতুন করে বলা, তা শুধু তার কথারই পুনরাবৃত্তি।

বাংলাসাহিত্যে তো বটেই, বিশ্ব সাহিত্যে সম্ভবত রবীন্দ্রনাথই প্রথম ব্যক্তি, যিনি স্পর্ধাভরে নিজের সাহিত্যকর্মের চিরন্তনতা সম্পর্কে নিশ্চিত ছিলেন। তার প্রমাণ কবিগুরুর '১৪০০ সাল' কবিতা। যেখানে কবি উল্লেখ করেছেন, 'আজি হতে শত বর্ষ পরে কে তুমি পড়িছ বসি আমার কবিতা খানি/ কৌতূহল ভরে।

' রবীন্দ্র সাহিত্যের মানগত উৎকর্ষতা সমকালীন অনেক কবি-সাহিত্যিকের ঈর্ষা সৃষ্টি করেছিল। তার জীবদ্দশায় কেউ কেউ রবীন্দ্রনাথের কবিতা নিয়ে বিদ্রূপ করতেও পিছপা হননি। কিন্তু ইতিহাস প্রমাণ করেছে, বিদ্রূপকারীদের অস্তিত্ব যখন সাহিত্যাঙ্গনে ক্রমশ নিষ্প্রভ, কালের বিবর্তনেও রবীন্দ্রনাথ স্বমহিমায় উজ্জ্বল। রবীন্দ্রনাথের সাহিত্য ভাবনার পাশাপাশি তার রাজনৈতিক ও সামাজিক ভাবনা এমন প্রভাব বিস্তার করেছে যে, তা অনেকেরই মাথাব্যথার কারণ। এমনকি একবিংশ শতাব্দীতেও রবীন্দ্রনাথের প্রভাব দেশি ও আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে সমান গুরুত্বের সঙ্গে অনুভূত হচ্ছে।

নোবেল পুরস্কার লাভের পর রবীন্দ্রনাথ রাশিয়া সফরে যান। সোভিয়েত সমাজ ব্যবস্থা তাকে মুগ্ধ করলেও তিনি অন্ধতায় ভোগেননি। সোভিয়েত সমাজের যান্ত্রিকতার যথাযথ সমালোচনা করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। এ অপরাধেই স্তালিন রবীন্দ্রনাথের রাশিয়ার চিঠি নিষিদ্ধ করেন। পরে গর্বাচেভের আমলে এ নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়া হয়।

বলা হয়, সোভিয়েত নেতা গর্বাচেভ যে পেরেস্ত্রাইকা বা খোলামেলা নীতি গ্রহণ করেন তা মূলত রবীন্দ্র ধ্যান-ধারণারই অনুসৃত। আমাদের দেশে এবং প্রতিবেশী পশ্চিম বাংলার উগ্র বামপন্থিদের কাছে রবীন্দ্রনাথ প্রতিক্রিয়াশীল কবি হিসেবে বিবেচিত হতেন। এই অপরাধের জন্য তারা রবীন্দ্র মূর্তি ভাঙাকে নিজেদের বৈপ্লবিক দায়িত্ব বলে মনে করতেন। কিন্তু এই বিপ্লবীরাও যখন কর্মসূচি বাস্তবায়নের প্রতিকূল অবস্থায় পড়তেন, তখন নিজেরাও গুনগুনিয়ে গাইতেন রবীন্দ্রনাথের সেই বিখ্যাত গানের কলি_

'যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে তবে একলা চলো রে'। আমাদের দেশের মুক্তি সংগ্রামেও গানটি ছিল অনুপ্রেরণার উৎস।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ঐতিহাসিক ছয়দফা প্রণয়নের পর বার বার এ গানটির কলি উচ্চারণ করে প্রতিকূলতাকে জয় করার শক্তি অর্জন করতেন। মজলুম জননেতা মওলানা ভাসানীও ছিলেন এ গানের অনুরক্ত। যে বিপ্লবীরা কবিগুরুকে প্রতিক্রিয়াশীল প্রমাণ করতে তত্ত্বকথার কপচানি পাড়তেন, তাদের স্লোগানে ব্যবহৃত হতো রবীন্দ্রনাথের কবিতার অনুসৃতি_ 'বাধা দিলে বাঁধবে লড়াই সে লড়াইয়ে জিততে হবে, এই লড়াই বাঁচার লড়াই এ লড়াই করতে হবে। ' রবীন্দ্রনাথকে অস্বীকার করতে চাইলেও যে পারা যায় না, অলক্ষ্যে যেতে হয় রবীন্দ্রনাথেরই কাছে_ এ তারই প্রমাণ।

রবীন্দ্রনাথ ছিলেন মুক্তবুদ্ধি ও মুক্তবিবেকের প্রতীক।

তার রাজনৈতিক চিন্তাধারা ছিল গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের পক্ষে। আর তাই অন্ধ তাত্তি্বক, ধর্মান্ধ শক্তি ও স্বৈরতন্ত্রের উপাসকরা রবীন্দ্রনাথকে শত্রু বলে ভেবেছে। পাকিস্তান আমলে মোনায়েম খানরা রবীন্দ্র সাহিত্যের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেন। নিষিদ্ধ হন রবীন্দ্রনাথ। এক শ্রেণীর বুদ্ধিজীবী, এমনকি সাংবাদিকরাও কোরাস গেয়েছেন স্বৈরাচারের সঙ্গে।

আইয়ুব-মোনায়েমের মোসাহেবীতে আত্দনিবেদিত বুদ্ধিজীবী ও সাংবাদিকরা রবীন্দ্রবিরোধী বিবৃতি দেওয়ারও ধৃষ্টতা দেখিয়েছিল। তারা রবীন্দ্রনাথকে হিন্দু কবি ও মুসলিমবিদ্বেষী প্রমাণ করতে কল্পিত কাহিনী প্রচার করতেও কসুর করেনি। এ ব্যাপারে কিছু আত্দবিক্রীত সাংবাদিক শরণাপন্ন হন জ্ঞানতাপস ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহর কাছে। উদ্দেশ্য যে করেই হোক, রবীন্দ্রবিরোধী সার্টিফিকেট আদায় করা।

ড. শহীদুল্লাহকে স্ব-স্ব পত্রিকার কপি দিয়ে কথিত সাংবাদিকরা তাদের অভিলাষ পেশ করেন।

ঘটনাক্রমে সেদিন সব কটি কাগজেই ছাপা হয়েছিল বিশ্ব সুন্দরীর ছবি। তিনি কথিত সাংবাদিকদের প্রত্যাশা অনুযায়ী কিছু বলার বদলে মনোযোগ দিয়ে দেখছিলেন সে ছবি। তাদের জিজ্ঞেস করলেন, বাছারা, এ মহিলাটি বিশ্বের সেরা সুন্দরী কি না? সমস্বরে সবাই জবাব দিলো হ্যাঁ, এই মহিলাটিই বিশ্ব সুন্দরী। ড. শহীদুল্লাহ হঠাৎ জিজ্ঞেস করলেন, 'আচ্ছা বলত এই সুন্দরীর অঙ্গে এমন কোন অংশ আছে কিনা যেখানে তোমার নাসিকা স্থাপন করলে কিঞ্চিত দুর্গন্ধ পেতে পার? উপস্থিত সাংবাদিকরা জবাব দিলেন, নিশ্চয়ই আছে। ড. শহীদুল্লাহ বললেন, এ সুন্দরীর বিশ্বজনীন সৌন্দর্য সুধা পান না করে তোমরা ওই দুর্গন্ধযুক্ত স্থানটিতে নাসিকা স্থাপন করছ কেন?

রবীন্দ্রনাথ ছিলেন মহীরুহ।

যার সঙ্গে নিজেদের তুলনা করতে গেলে হীনমন্যতা দেখা দেওয়া স্বাভাবিক। আর এ কারণেই সংকীর্ণমনারা বারবার আঘাত করতে চেয়েছে রবীন্দ্রনাথকে। তাকে ভেবেছে প্রতিপক্ষ হিসেবে। পরাধীনতার নাগপাশ ছিঁড়ে বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পরও তার ব্যত্যয় ঘটেনি। বিশেষ মহলের রবীন্দ্র আতঙ্ক তারই প্রমাণ।

মনে পড়ছে একজন ধর্মান্ধ সাতিহ্যিক সাংবাদিকের কথা। তিনি একদিন এক সভায় রবীন্দ্রনাথের লেখা জাতীয় সংগীত পরিবর্তনের দাবি করেন। এই মরহুম বুদ্ধিজীবীর যুক্তি ছিল রবীন্দ্রনাথ একজন ভারতীয়। অতএব তার লেখা কোনো কবিতা বা গান স্বাধীন বাংলাদেশের জাতীয় সংগীতের মর্যাদা পেতে পারে না। তার যুক্তি যে কতটা ভোঁতা সে কথা পরে বলছি।

তবে এই ধৃষ্টতার জবাব তিনি পেয়েছেন। ছড়াকার লুৎফর রহমান রিটন সম্ভবত এ ধৃষ্টতাপূর্ণ বক্তব্যের প্রতিবাদে লেখেন তার সেই বহুল আলোচিত ছড়াটি : লোকটি ছিল বুদ্ধিজীবী শ্রমিক কিংবা চাষী না,/ একাত্তরের দালাল ছিল খেলতো কতই তাস-ই না/ লোকটি সেদিন সভাপতির আসনে/ জানিয়ে দিল সুচিন্তিত ভাষণে/ আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি না। / ছড়াটি ছাপা হয় এক প্রগতিশীল দৈনিকে। ছড়ার সঙ্গে যে ইলাস্ট্রেশন ছাপা হয় তাতে বুদ্ধিজীবী ভদ্রলোককে চিনতে কারও অসুবিধা হয়নি। জানা যায়, ছড়াটি পড়ে তিনি বেশ রুষ্ট হন।

তবে একই সঙ্গে খামোশও বনে যান। এমন ভোঁতা যুক্তির বুদ্ধিজীবীদের সংখ্যা এখনো যে নেই, তা নয়। মৌলবাদী পত্রপত্রিকায় রবীন্দ্রনাথের বিরুদ্ধে যুদ্ধংদেহী লেখাটি যে কারও চোখে পড়বে। আজও বাংলাদেশের অধিকাংশ মাদ্রাসায় ক্লাস শুরুর আগে জাতীয় সংগীত গাওয়া হয় না। কোথাও কোথাও নাকি জাতীয় পতাকাও উড়ানো হয় না।

অথচ এসব প্রতিষ্ঠান সরকারি অনুদানের ওপর নির্ভরশীল। শিক্ষকরা নিয়মিত সরকারি ভাতাও পেয়ে থাকেন।

লেখক : সাংবাদিক ও রবীন্দ্র গবেষক

ই-মেইল : sumonpalit@gmail.com

 

 

সোর্স: http://www.bd-pratidin.com/

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.