আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

সুইট রিভেন্জ

একটি ভীষণ না থাকাকে সঙ্গে নিয়ে প্রতি রাতে ঘুমাতে যাই

আমাদের জীবন-বাস্তবতা কখনো গল্প-কাহিনিকেও ছাড়িয়ে যায়। সে রকম দুটি ঘটনার কথা বলি। ১. ১৯৭১ সালে এ দেশের হাজারো তরুণের মতো মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন আনোয়ারা থানার চাতরি গ্রামের দুই যুবক আবদুল কাদের চৌধুরী ও নুরুল আমিন। মার্চ ও এপ্রিল মাসে গুজরা খাসমহাল অপারেশনসহ বেশ কয়েকটি অপারেশনে অংশ নিয়েছিলেন তাঁরা। প্রত্যন্ত গ্রামে আধুনিক মানের অস্ত্র দুষ্প্রাপ্য হয়ে পড়েছিল বলে মে মাসের মাঝামাঝি কয়েকজন সহযোদ্ধা বন্ধুর সঙ্গে যোগাযোগ করে চট্টগ্রাম শহরের জেল রোডে আসেন।

রূপসা বোর্ডিংয়ে এসে উঠেছিলেন তাঁরা। কিন্তু অস্ত্র সংগ্রহের আগেই তাঁদের গতিবিধি নজরে পড়ে যায় রাজাকারদের। রূপসা বোর্ডিং থেকে এ দুই তরুণকে রাজাকারেরা ধরে নিয়ে যায় নগরের রহমতগঞ্জে বহুল পরিচিত নির্যাতনকেন্দ্র এবং মুসলিম লীগের নেতা ফজলুল কাদের চৌধুরীর বাসভবন গুডস হিলে। এ কথা সবারই জানা, ফজলুল কাদের (ফকা) চৌধুরীর (সাকা চৌধুরীর বাবা) গুডস হিলের বাড়িটি ছিল মুক্তিযুদ্ধের সমর্থকদের জন্য হাবিয়া দোজখ। পাহাড়চূড়ার সেই বাড়িটি কত তরুণের মৃত্যু ও লাঞ্ছনা, কত মায়ের সারা জীবনের আহাজারির সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে, সে প্রসঙ্গটি আজকের এ লেখার বিষয় নয়।

শুধু জানাই, তরুণ আবদুল কাদের ও নুরুল আমিনের ওপর ১৫ দিন ধরে যে অকথ্য নির্যাতন চলেছিল, তাতে তাঁরা মরেননি বটে, কিন্তু পুরো শরীরে ছিল কাটা দাগ ও বিভিন্ন স্থানে মাংসে ধরেছিল পচন। আজও তাঁরা শরীরে বয়ে চলেছেন সেই দুঃসহ স্মৃতি, বাকি জীবনও বইতে হবে। মৃত্যু তাঁদের অবধারিত ছিল। কিন্তু আত্মীয়স্বজন ও গ্রামের মানুষের অনুরোধে আনোয়ারা থানার শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান ফজল করিম তাঁদের জীবন ভিক্ষা নেন ফকা চৌধুরীর কাছ থেকে। এত নির্যাতনও মুক্তিযোদ্ধার কাছ থেকে কেড়ে নিতে পারেনি স্বাধীনতার স্বপ্ন।

মুক্তি পেয়ে বেশ কিছুদিন চিকিৎসা নিয়ে দুর্বল শরীরেও এ দুই মুক্তিযোদ্ধা অস্ত্র প্রশিক্ষণের জন্য ভারতের দেবাংগ্রিতে পালিয়ে যান। দেশ স্বাধীন হওয়ার কয়েক দিন আগে তাঁরা ফিরে আসেন আনোয়ারায়, যোগ দেন পুরোনো সহযোদ্ধাদের সঙ্গে। এদিকে বিজয়ের প্রাক্কালে ডিসেম্বরের ১৪ তারিখ সপরিবারে বার্মা পালিয়ে যাওয়ার সময় চট্টগ্রাম মেরিন একাডেমির অদূরে কর্ণফুলী নদীর মোহনায় ধরা পড়েন ফকা চৌধুরী। মুক্তিযোদ্ধারা তাঁকে ধরে এনে রাখেন মুসলিম লীগের আরেক নেতা এয়াকুব আলী চৌধুরীর বাড়িতে। সেই বাড়ির পাহারারত মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে একজন ছিলেন আবদুল কাদের।

কাদেরকে দেখে চিনতে পারেন ফকা চৌধুরী। তাঁকে যে প্রাণে না মেরে ছেড়ে দিয়েছিলেন, সে কথা মনে করিয়ে দিয়ে বারবার নিজের প্রাণ রক্ষার অনুরোধ জানিয়েছিলেন তিনি। বিজয়ী মুক্তিযোদ্ধা প্রকৃত বিজয়ীর মতো তাঁর জীবন রক্ষা করেছিলেন। প্রিয় পাঠক, এ পর্যন্ত গল্পটির মধ্যে স্বাভাবিকতা আছে। মুক্তিযোদ্ধা আবদুল কাদের ও নুরুল আমিন নানা সময়ে স্মৃতিচারণা করতে গিয়ে এসব কথা বলেছেন পত্রপত্রিকায়।

নুরুল আমিন এখন বিদেশে, আর আবদুল কাদেরের মুখ বন্ধ। এখন এসব বিষয়ে কারও সঙ্গে কথা বলেন না তিনি। কেন বলেন না? সেই ঘটনাটা বলি। আশির দশকে এরশাদ সরকারের স্বাস্থ্যমন্ত্রী হওয়ার পর ফজলুল কাদের চৌধুরীর ছেলে সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী আনোয়ারায় তাঁর বাবার শেষ সময়ের ঘটনাবলি ও স্মৃতি সংগ্রহের চেষ্টা করেন। শোনা যায়, এ সময় তিনি তাঁর বাবার একটি দিনপঞ্জি (ডায়েরি) খুঁজে পান, যেখানে চরম বিপদের সময় মুক্তিযোদ্ধা আবদুল কাদেরের অনুকম্পা পাওয়ার কথা উল্লেখ করেছিলেন।

মন্ত্রী সালাউদ্দিন কাদের লোক মারফত বারবার খবর দিয়ে আবদুল কাদেরের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু কাদের কিছুতেই তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করতে রাজি হচ্ছিলেন না। কিন্তু ক্ষমতার কেন্দ্রে থাকা ব্যক্তিটি অবশেষে এই মুক্তিযোদ্ধাকে কবজা করতে সক্ষম হন। কাদেরকে গুডস হিলে আসতে হয় আরও একবার। কিন্তু প্রথমবার এসেছিলেন বীর বন্দী হিসেবে, দ্বিতীয়বার জীবনযুদ্ধে পরাজিত একজন হিসেবে।

সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী মুক্তিযোদ্ধা আবদুল কাদেরকে দিয়েই চাতরি গ্রামে জমি কেনেন, সেখানে প্রতিষ্ঠা করেন তাঁর বাবার নামে ফজলুল কাদের চৌধুরী প্রাথমিক বিদ্যালয়। বিদ্যালয়টি দেখাশোনার দায়িত্ব দেন আবদুল কাদেরের ওপর। একজন স্বাধীনতাবিরোধীর নামে প্রতিষ্ঠিত স্কুলের দেখভাল করছেন তাঁরই হাতে নির্যাতিত একজন মুক্তিযোদ্ধা! ২. ১৯৭১ সালের ৯ নভেম্বর ছিল প্রাকৃতিক দুর্যোগপূর্ণ এক রাত। বেতারে প্রচারিত হচ্ছিল ৯ নম্বর মহা বিপৎসংকেত। সেই রাতে সার্জেন্ট মহিউল আলমের নেতৃত্বে একদল মুক্তিযোদ্ধা আক্রমণ করেছিলেন সমুদ্র-উপকূলীয় পশ্চিম আনোয়ারার রাজাকার ক্যাম্পগুলোতে।

মুক্তিযোদ্ধাদের লক্ষ্য (টার্গেট) ছিল আবদুল গণি ও আবদুল জলিল নামে চিহ্নিত দুই রাজাকার, যারা তখন ওই এলাকায় পাকিস্তানি সেনাদের সহযোগী হিসেবে হত্যা, লুণ্ঠন, নারীনির্যাতনসহ হেন কোনো দুষ্কর্ম নেই যা করেনি। মুক্তিযোদ্ধাদের আক্রমণে বেশ কয়েকজন রাজাকার মারা গেলেও আবদুল গণি ও জলিল মাছ ধরার নৌযানে চেপে পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়। এই মুক্তিসেনা দলের একজন ছিলেন ২০-২১ বছরের তরুণ রুস্তম আলী। সে রাতের অপারেশন শেষে বারশত কালীবাড়ি এলাকার সুরমা পুকুরপাড়ে পালিয়ে যেতে থাকা রাজাকারদের গুলিতে মারা যান রুস্তম। সহযোদ্ধারা সেই ঝড়-বৃষ্টির রাতে রুস্তমকে সুরমা পুকুরপাড়ে দাফন করে ফিরে যান ক্যাম্পে।

পরদিন খবর পেয়ে রাজাকার কমান্ডার জলিল ও গণির নেতৃত্বে স্থানীয় রাজাকাররা ছুটে আসে সুরমা পুকুরপাড়ে। তারা কবর খুঁড়ে বের করে রুস্তমের লাশ। সেই লাশ দড়ি দিয়ে বেঁধে টানতে টানতে নিয়ে যায় প্রায় তিন মাইল দূরে মেরিন একাডেমির পাকিস্তানি সেনাদের ক্যাম্পে। প্রত্যক্ষদর্শীরা এখনো শিউরে ওঠেন সেই ঘটনার বর্ণনা দিতে গিয়ে। বারশত কালীবাড়ি হয়ে মেরিন একাডেমির দীর্ঘ সড়কটিতে রুস্তমের মৃতদেহটি রক্ত-কাদায় একাকার হয়ে গিয়েছিল, খসে পড়েছিল মাংস।

শোনা যায়, খোদ পাকিস্তানি মেজর এই বীভৎস দৃশ্য দেখে ভর্ৎসনা করেছিলেন রাজাকারদের, লাশটি পুনরায় একই স্থানে কবর দেওয়ারও নির্দেশ দিয়েছিলেন। শহীদ রুস্তমের লাশের লাঞ্ছনা ও অবমাননা হয়েছিল যে রাস্তায়, স্বাধীনতার পর সেই রাস্তাটি তাঁর নামে নামকরণের দাবি তুলেছিলেন স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধারা। সে দাবি বাস্তবায়িত হয়নি, সেই দুঃখ সতীর্থদের মনে দীর্ঘশ্বাস হয়ে আছে। এ পর্যন্ত ঘটনাটির স্বাভাবিকতা আছে। এখন অবিশ্বাস্য ও অস্বাভাবিক বাস্তবতার কথা বলি।

সেই সড়কটি উন্নয়নের উদ্যোগ নিয়েছে প্রশাসন। গত ২৩ সেপ্টেম্বর এলজিইডি এক্সিকিউটিভ ইঞ্জিনিয়ারের দপ্তর, চট্টগ্রামের বরাতে একটি দৈনিক পত্রিকায় দরপত্র আহ্বান করা হয়েছে। প্রাক্কলিত ব্যয় ধরা হয়েছে ৪০ লাখ ৫৫ হাজার টাকা। সড়কের নাম দেওয়া হয়েছে ‘আবদুল গণি চৌধুরী বারশত গোবাদিয়া লিংক রোড’। তার চেয়ে নির্মম হলো, গত ষোলোই ডিসেম্বর বিজয় দিবসের দিনে ওই সড়কের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেছেন মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক, আওয়ামী লীগের স্থানীয় সাংসদ আখতারুজ্জামান চৌধুরী।

প্রিয় পাঠক, আবদুল গণিকে চিনতে পেরেছেন? এভাবেই ক্ষমতার পালাবদল, বিত্তবৈভবের দাপট আর ভোটের রাজনীতির কাছে পরাভব মানছে ইতিহাস। আমরা শুধুই তার নীরব দর্শক! (তথ্য দিয়ে সহায়তা করেছেন লেখক-সাংবাদিক জামাল উদ্দিন এবং চট্টগ্রাম জেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের ডেপুটি কমান্ডার রশিদ আহমদ। ) মূল লেখা : যেভাবে পরাজিত হয় ইতিহাস (প্রথম আলো) বিশ্বজিৎ চৌধুরী | তারিখ: ৩১-১২-২০১০

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.