আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

সাদাকালো ক্রিসমাস

...ক্ষুদ্র আশা নিয়ে রয়েছে বাচিয়া,সদাই ভাবনা, যা কিছু পায়, হারায়ে যায়, না মানে স্বান্তনা...
আজকে আমার দারিদ্রতা কিছুটা দূর হয়েছে। এখানে আমি চাকরীর জন্য আসলেও দুর্ভাগ্য যে আমার বেতন হয় দেশে। সুতরাং এখানে চারমাস কাটনোর পর সঙ্গে আনা সবকটি ডলারই খরচ হয়ে গেছে। গত কয়েকদিন নানান রকম কৃচ্ছতা সাধন করে চললাম। দলে বলে সবাই কে এফ সি বা চিকেন রিপাবলিকে গেলেও আমি স্রেফ হোটেল থেকে ফ্রীতে পাওয়া চকলেট খেয়ে দুপুরের লাঞ্চ সাড়তাম।

অনেক হিসেব করে মোবাইল কল করতাম। পারত পক্ষে যেন টাকা খরচ না হয়। তাই যখন আজ যখন দেশ থেকে আর একজনের মাধ্যমে পাঠানো ডলারের খামটা হাতে পেলাম, তখন মনে হলো এই মুহুর্তে সবচেয়ে বড়লোক আমি। প্যাকেটটা বেশ যত্ন করে রাখলাম। কারন তাতে শুধুমাত্র পাঁচশ ডলার আছে তাই না, মিশে আছে দেশের গন্ধ, প্রিয়জনের হাতের ছোঁয়া।

পাঁচশ ডলার হাতে পেয়ে প্রায় স্বর্বশান্ত আমি তাই মুটামুটি নিজেকে মিলিওনিয়ার ভাবতে শুরু করলাম। প্রথমেই অফিসের সবাইকে বলে দিলাম, আমার কাছে এখন যথেষ্ট ডলার আছে (মোটে পাঁচশ, এই দেশে যেটা একমাসেই শেষ হয়ে যেতে বাধ্য ), সুতরাং কারো ধার লাগলে নিতে পারে। এখানে আমরা সবাই দেশের বাইরে অনেকদিন ধরে। তাই সবারই পকেটের অবস্থাই ভয়াবহ। তাই এই হা-ভাতের দলের মাঝে আমিই সবচেয়ে বড়লোক এখন।

এরপর প্ল্যান করে ফেললাম কি কি কেনা যায়। কোথায় কোথায় যাওয়া যায়। এমনি কি হাজারখানেক মাইল দূরের সাহারা মরুভূমিটা একবার দেখে আসা যায় কিনা তাও হিসেব করে ফেললাম। সত্যি কথা বলতে এসব কিছুই করা হবে না। নাইজেরিয়া খুবই ভয়নাক জায়গা বিশেষ করে ক্রিসমাসের সময়।

বিদেশীদের বাইরে ঘুরাঘুরিটা এই সময় বিপদজনক। তারপরও প্ল্যান করি। কিছু একটা নিয়েতো ব্যস্ত থাকতে হবে। শুনেছি দেশে নাকি এখন ভয়াবহ শীত, ইউরোপ আমেরিকার দেশগুলোতে নাকি কোমড় সমান বরফ জমে যাচ্ছে। এখানে এসবের বালাই নেই।

কোন ভাবেই বাইরে বের হওয়া যায় না। গা পুড়ে যায় এতো সূর্যের তাপ। এত গরমের কারনে মনে হয় সবার মাথাটাও একটু গরম। সেদিন অফিসে তিনটা চাইনিজ মিলে প্রায় মারামারি লাগিয়ে দিয়েছিলো। অফিস করছি, হঠাৎ করে শুনি ব্যাপক চেচামেচি।

চাইনিজ ভাষায় চাইনিজগুলো ক্যাঁচম্যাচ শুরু করেছে। ওদের ভাষা তো বোঝার উপায় নেই। এগিয়ে গেলাম ব্যাপারটা কি দেখার জন্য। দেখলাম একটা চাইনিজ একটা হোয়াইট বোর্ডের দিকে হাত তুলে ইঙ্গিত করে কিছু একটা বলছে আর বাকি দুইটা বার বার মাথা নাড়ছে আর কোন কিছু নিয়ে তীব্র প্রতিবাদ করছে। জানি বুঝবো না, তারপরও দেখার চেষ্টা করলাম কি লেখা আছে বোর্ডে।

দেখালাম পুরো সাদা, কিছুই লেখা নেই। একটা সম্পূর্ণ খালি বোর্ড নিয়ে কি কারনে তারিঁএরকম ভয়াবহ ঝগড়া করছে কিছুই বুঝলাম না। ততক্ষনে ঝগড়া পুরো হাতাহাতির পর্যায়ে পৌঁছে গেছে। আমাদের একজন তিনটাকেই রুম থেকে বের করে দিয়ে আসলো। আমাদের ও অবস্থা খুব একটা সুবিধার না।

এই গরমে আমারো মাঝে মাঝেই মাথা গরম হয়ে যাচ্ছে। আহা দেশে কি দারুন শীত পড়েছে। কুয়াশা দেখি না কতদিন। ক্রিসমাস জিনিসটা যে এতো ভালো তা আগে জানতাম না। দেশে থাকলে পঁচিশে ডিসেম্বর মানেই হলো বিটিভির জন্মদিন।

দশ বছর আগেও যখন এতো এতো চ্যানেল ছিলো না, তখন সবাই হা করে বসে থাকতাম কবে পঁচিশে ডিসেম্বরের আসবে। কত ভালো অনুষ্ঠান দেখাবে। তাই ক্রিসমাসের মজা কোনদিনই পাই নি। এখানে এসে বুঝলাম ক্রিসমাস মানে বিশাল ব্যাপার। ডিসেম্বরের প্রথম থেকেই জায়গায় জায়গায় ক্রিসমাস ট্রি বসে গেছে।

যতোই দিন যাচ্ছে শহরটা আলো আলোতে ভরে উঠছে। প্রায় রাতেই রাতের আকাশ আলো করে ফায়ারওয়ার্কস হয়। তবে সবচেয়ে বড় আনন্দের ব্যাপার হলো বিশাল একটা ছুটি পেতে যাচ্ছি। দুই সপ্তাহ আগে থেকেই কাজ কর্ম কমে গেছে। সবাই ছুটিতে চলে যাচ্ছে।

বাইরের দুনিয়ার কাছে নাইজেরিয়া গরীব দেশ হলেও এদের কিন্তু ভালোই টাকা পয়সা আছে। এরা ক্রিসমাস করতে যায় হয় ইউ কে না হয় ইউ এস এ। সুতরাং সবাই ধীরে ধীরে ছুটিতে চলে যাচ্ছে। লাগোস শহর ফাঁকা হচ্ছে। ঠিক ঈদের আগে আমোদর ঢাকার মতো।

তাই জীবনে প্রথমবারের মতো দিন গুনছি কবে আসবে ক্রিসমাস। জানি দীর্ঘ ছুটিটা হোটেলের রুমে বসেই কেটে যাবে। দেখা হবে না বিটিভির বর্ষপূর্তি, দেখা হবে না দেশের ইংরেজি নিউ ইয়ার। রংবেরং এর আলোয় সাজানো ক্রিসমাস ট্রি এর নিচে জমে থাকা গিফটগুলোর একটা হয়তো আমি পাবো হোটেলের দীর্ঘ দিনের বাসিন্দা হিসেবে। ক্রিসমাসে রঙিন হয়ে উঠা এই শহরে ঘুরে বেড়াবো সাদাকালো এই আমি।

কারন আমার মন পড়ে আছে হাজারা হাজার মাইল দূরের কোন দেশে। বাংলাদেশে।
 

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।