আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

অসহায় শিশুদের সুখের নীড়ে ২০ মিনিটের প্রশান্তি

১৯৮৯ সাল থেকে ২০১৩। মাঝখানে গড়িয়ে গেছে দুই যুগ। এই দীর্ঘ সময়ের ভাঁজে ভাঁজে লুকিয়ে আছে কত স্মৃতি! কিছুই বিস্মৃতির অতলে হারিয়ে যায়নি। মাঝে মাঝেই পেছনে ফেলে আসা সেসব স্মৃতি মনের দুয়ারে কড়া নাড়ে। ফিরে তাকাই হারানো সেই দিনের দিকে।

শুধু দুই যুগ আগের কোনো এক স্মৃতির কথা মনে করলে অন্যসব স্মৃতি অভিমান করতে পারে। তবে সে অভিমান আজ ভাঙাতে চাই না। আজ শুধু ১৯৮৯ সালের ২৩ নভেম্বরের কথা মনে করতে চাই। এ দিনটার কথা মনে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে তারও আগের একটি ঘটনার কথা মনে পড়ল। ভয়ঙ্কর এবং বেদনাবিধূর সেই স্মৃতি!

শিশুর প্রতি আমার ভালোবাসা আজন্ম কালের।

কোনো অসহায় শিশুর দুঃখ-কষ্টের চেয়ে আমার কাছে নিদারুণ যন্ত্রণা আর কোনো কিছুতেই নেই। পথকলি ট্রাস্ট প্রতিষ্ঠা সেই যন্ত্রণা নিবারণের একটি প্রচেষ্টা ছিল আমার। সফল হয়েছিলাম সেখানে। কিন্তু হারিয়ে গেল সেই সাফল্য রাজনৈতিক প্রতিহিংসার অতলান্তিক সাগরে।

যাই হোক, দুঃখজনক কাহিনীকে আজ মনের পাতায় ঠাঁই দিতে চাই না।

আজ কিছুটা সুখ স্মৃতির কথাই স্মরণ করতে চাই। তবে তার আগের একটি ঘটনার কথা। উড়ির চরের ঝড়ের কথা আমার মতো অনেকেরই স্মৃতিপট থেকে হারিয়ে যাওয়ার কথা নয়। এটাই সেই বেদনাবিধূর স্মৃতিকথা। আমি আমার সব শক্তি দিয়ে সে সময় উড়ির চরের দুর্গত মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছিলাম।

সেই ঝড়ের ভয়াবহতা এমনই প্রচণ্ড ছিল, পরিস্থিতি স্বচক্ষে দেখার জন্য বিভিন্ন দেশ থেকে রাষ্ট্রপ্রধান বা সরকারপ্রধানরা ছুটে এসেছিলেন উড়ির চরে।

সে দিনের সঠিক তারিখটা মনে করতে স্মৃতি কিছুটা বিট্রে করলেও এটা ঠিক মনে আছে যে, ভারতের প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধীকে নিয়ে আমি উড়ির চরে গিয়েছিলাম। মি. গান্ধীকে ঘুরে দেখাচ্ছিলাম ঝড়ের তাণ্ডব দৃশ্য। তখন দূরে চোখ পড়ল দুটি শিশুর দিকে। তারা যেন বাকশক্তি হারিয়ে ফেলেছিল।

অসহায় দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে ছিল। আমি তাদের কাছে এগিয়ে গেলাম। জিজ্ঞাসা করলাম, তোদের নাম কিরে? একজন বলল তার নাম শহীদ, আরেকজন ফয়জুল্লাহ। জিজ্ঞাসা করলাম তোদের মা-বাবা কোথায়? বলল, জানি না। প্রশ্ন করলাম, তোদের ঘর কোথায় ছিল? তাও বলতে পারছে না।

লণ্ড ভণ্ড করা তাণ্ডবে সব জনপদে তখন মরুর হাহাকার। মাঠ, ঘাট, গ্রাম গাছপালা, বাড়িঘর সব একাকার। সেখানে যে কোনো জনবসতি ছিল তার কোনো চিহ্নও নেই। ঝড়ে শিশু দুটির মা-বাবা, ভাই-বোন, আত্দীয়স্বজন কে-কোথায় হারিয়ে গেছে ওরা জানে না।

জিজ্ঞাসা করলাম, কোথায় যাবি তোরা? কার কাছে থাকবি, কী খাবি? এসব প্রশ্নের কোনোটারই উত্তর জানা নেই ওদের।

আমি ওদের দু'হাতে বুকে জড়িয়ে ধরলাম। বলেছিলাম, তোদের যা কিছু জানা নেই তার সব উত্তর আমি দেব। তারপর সেই শিশু দুটিকে আমি হেলিকপ্টারে করে ঢাকা নিয়ে এসেছিলাম। লালন-পালনের জন্য তাদের আমি ঢাকার এসওএস শিশুপল্লীতে রেখে দিয়েছিলাম। শিশুপল্লী তাদের মা-বাবার আদর-ভালোবাসা দিয়ে বরণ করে নিয়েছিল।

শহীদ ও ফয়জুল্লাহ এখন পরিপূর্ণ যুবক। শুনেছি তারা বেঁচে থাকার মতো চাকরিও পেয়েছে। হয়তো সংসার ধর্মও করছে। তাদের সঙ্গে আর দেখা হয়নি। ওরাও হয়তো ভুলে গেছে সেসব কথা।

ওদের দেখতে খুব ইচ্ছাও হয় মাঝে মাঝে। জানতে ইচ্ছা করে কেমন আছে ওরা। সে দিন এসওএস শিশুপল্লীতে ওদের তুলে দিয়ে মনে হয়েছিল, এই অভাগা দেশে তো দুজন মাত্র শহীদ আর ফয়জুল্লাহ নেই। অগণিত-অজস্র অসহায় শিশু রয়ে গেছে। দেশে এতিমখানার সংখ্যা কম নেই।

তারপরও সেখানে সব এতিমের ধারণা ক্ষমতা নেই। সে দিন দুই অসহায় শিশুকে এসওএস শিশুপল্লীতে তুলে দেওয়ার সময় মনে করেছিলাম, দেশের প্রত্যেক জেলায় এই শিশুপল্লীর মতো প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠার প্রয়োজন আছে। সে দিন সেখানে এটাও প্রত্যক্ষ করেছিলাম যে, এই প্রতিষ্ঠানে অসহায় শিশুদের কত মায়া-মমতায় জড়িয়ে অতি সযত্নে লালন-পালন করা হয়। এরপর ১৯৮৯ সালের ২৩ নভেম্বর চট্টগ্রামের হালিশহরে এসওএস শিশুপল্লীর আরেকটি শাখা উদ্বোধন করলাম। সে দিনের কথাটা মনে করতে গিয়েই এতসব কথা বলে ফেললাম।

ওই শিশুপল্লীটি উদ্বোধনের পর ২৪টি বছর গত হয়ে গেছে, কিন্তু অসহায় শিশুদের সেই আবাসস্থল উদ্বোধনের কথাটি আজও ভুলতে পারিনি। কারণ ওই প্রতিষ্ঠানটি যে অসহায় শিশুদের প্রতি মায়ের মায়া-মমতার ইট-বালু দিয়ে গড়া। সেখানে রয়েছে আমার প্রাণের আবেগ, মনের ভালোবাসা আর হৃদয়ের টান। যা জীবনে কখনো উপেক্ষা করতে পরিনি, আর পারব না কখনো। তাই ২৪ বছর আগের সেই খণ্ডচিত্রটি আমার মনের পর্দায় ভেসে উঠেছিল।

৩ আগস্ট ২০১৩ চট্টগ্রামে গিয়েছিলাম। আমার দলের নেতা সোলায়মান আলম শেঠ চট্টগ্রাম মহানগর জাতীয় পার্টির উদ্যোগে এক ইফতার পার্টির আয়োজন করেছিলেন। তার আমন্ত্রণেই এবার চট্টগ্রামে যাওয়া। পরের দিন ঢাকায় ফিরে আসব। সাড়ে ১১টায় বিমান ছাড়বে।

শহর থেকে বিমানবন্দরে যেতে দুর্বিষহ যানজট পাড়ি দিতে হবে। তবুও ইচ্ছাকে প্রশমিত করতে পারলাম না। ২৪ বছর আগে যে শিশুপল্লীটি উদ্বোধন করেছিলাম সেটি এখন কেমন চলছে, তা জানতে মন ব্যাকুল হয়ে উঠল। সোলায়মানকে বললাম, আমাকে হালি শহরে যেতে হবে। শিশুপল্লীটা দেখতেই চাই।

দেখে আসি সেই শিশুপল্লী আজো আছে কি না। নাকি পথকলি ট্রাস্টের ভাগ্যবরণ করেছে। সময়ের তাড়া আছে, তবু আমাকে যেতে হবে। ৪ আগস্ট ভোরের দিকে পেঁৗছলাম হালিশহরে অবস্থিত এসওএস শিশুপল্লীতে। সেখানে পেঁৗছে দেখলাম, অসহায় শিশুদের জন্য গড়ে তোলা সে যেন ছোট এক টুকরো স্বর্গ।

পরিপাটিভাবে সাজানো। ফুলে সবুজে মোড়ানো বাড়িখানি। সেখানে পেঁৗছতেই শিশুপল্লীর কর্মকর্তারা দেখালেন আমার উদ্বোধন খচিত পাথরখানা। পল্লীর শিশু বাসিন্দাদের মতো আমার নামাঙ্কিত পাথরখানাও সযত্নে যথাস্থানে স্থাপিত রয়েছে। কিছুটা অবাকই হলাম।

যেখানে সারা দেশে আমার হাতে বাস্তবায়িত প্রতিষ্ঠানের হাজার হাজার নামফলক প্রতিহিংসার কুঠারঘাতে ভেঙে চুরমার করে দেওয়া হয়েছে, সেখানে চট্টগ্রাম এসওএস শিশুপল্লীর আমার নাম ফলকটা এখনো অক্ষত রয়ে গেছে। দেখলাম, শুধু অক্ষতই থাকেনি, অতি যত্নে রয়েছে। আমার হাজারো নামফলক উপড়ানো দেখে মাঝে-মধ্যে বলি পাথরে লেখা নাম মুছে দিয়ে কি করবেন_ মানুষের হৃদয়ে যে নাম লেখা হয়ে গেছে, সে নাম কি মুছে দিতে পারবেন? আমি তো মানুষের হৃদয়ে আমার নাম লিখে দেওয়ার জন্য কাজ করেছি। সেখানে আমি সফলও হয়েছি। তাই তো আজ পথে-প্রান্তরে, হাটে-মাঠে-ঘাটে যেখানেই আমি ঘুরে বেড়াই, সেখানেই মানুষের ঢল নামে।

তারা আমার কাছে ছুটে আসে। তারাই আমাকে স্মরণ করিয়ে দিতে চায়_ "এই যে রাস্তাটায় দাঁড়িয়ে আছেন না, এই রাস্তাটা আপনার গড়া। একদা এখানে নৌকা চলত, এখন গাড়ি চলে। এটা আপনারই অবদান। ওই যে ব্রিজটা দেখা যাচ্ছে না ওখানে একদা বাঁশের সাঁকো ছিল।

ব্রিজটা আপনিই বানিয়ে দিয়েছেন। " তখন কাছে গিয়ে হয়তো দেখি নামফলকটি তুলে ফেলা হয়েছে। কিন্তু মানুষের হৃদয়ে স্থাপিত নামফলকটি ঠিকই রয়ে গেছে। কিছু ব্যতিক্রম যে নেই, তাও নয়। অনেক জায়গায় জনগণই আমার নামফলক তুলতে দেয়নি।

চট্টগ্রাম এসওএস শিশুপল্লীর নামফলকটাও তার মধ্যে একটি। এখানকার বাসিন্দারা পাথরে খোদাই আমার নামফলকটা যেভাবে রেখেছে_ মনের মধ্যেও সেভাবে জায়গা দিয়েছে।

চট্টগ্রাম এসওএস শিশুপল্লীর সেই সময়কার স্টাফরা স্মৃতিচারণ করলেন। পল্লীটি উদ্বোধন করতে গিয়ে কী বলেছিলাম, কী করেছিলাম_ সেসব কথা তারা ২৪ বছরেও ভুলে যায়নি। অত্যন্ত সুশঙ্খল ও নিয়মানুবর্তিতার মধ্যে এই পল্লীতে আশ্রিত শিশুদের প্রতিপালন করা হয়।

জানলাম, ওখানে এখন ১১৯টি শিশু রয়েছে। প্রতি ১০ জনের জন্য তাদের একটি করে ঘর আছে এবং তাদের জন্য আছে একজন করে মা। এই মা সত্যিই তাদের মা। আশ্রিত শিশুরা তার কাছ থেকে মায়ের আদর-স্নেহ-ভালোবাসা কোনো কিছু থেকেই বঞ্চিত হয় না। শিশুগুলোকে দেখে আনন্দে মন ভরে গেল।

অনেক শিশুই জানে না- কে তাদের মা, কে বাবা! পল্লীর মা-ই তাদের মা। এই পল্লীই তাদের ঠিকানা। একটু পেছনের কথা ভাবলে মনটা হু হু করে কেঁদে ওঠে। যদি ওরা এখানে আশ্রয় না পেত, তাহলে সত্যিই কি ওরা বাঁচতে পারত! ওদের খাওয়া-পরা জুটত? ওরা কি শিক্ষার আলো পেত?

জানলাম, এই পল্লীতে যারা আশ্রয় পেয়েছে_ তাদের মধ্যে কয়েকজন এখন ইউনিভার্সিটি পর্যন্ত পেঁৗছে গেছে। শুনে মনটা ভরে গেল।

ওই শিশুপল্লীর নিবিড় পরিবেশের মধ্যে দাঁড়িয়ে কতগুলো অসহায় শিশুর সুখের নিঃশ্বাসের শব্দ যেন শুনতে পেলাম। প্রশান্তিতে মনটা মোহবিষ্ট হয়ে গেল। তবে এই সুন্দর সময়ের স্থায়ীকাল ছিল ২০ মিনিটের মতো। ঠিক যেন জীবন-প্রবাহের মতো। সুখের সময়ের স্থায়িত্বকাল হয় স্বল্প।

দুঃখ-যন্ত্রণা, সমস্যা-দুর্ভাবনা, দুঃসময় ইত্যাদি নেতিবাচক দিকগুলোই বেশি সময় আয়ত্তে রাখে। খুবই ভালো লেগেছিল শিশুপল্লীর শিশুদের মাঝে। কিন্তু সময়ের তাড়ায় ছুটে যেতে হলো বিমানবন্দরে। ফিরতে হবে ঢাকায়। ফিরে আরও কত কাজ! বিমানবন্দরে পেঁৗছে জানলাম, বিমান আসতে ও ছাড়তে দেরি হবে।

বসে থাকতে হলো ঘণ্টা দুয়েক। চরম বিরক্তিকর সেই অপেক্ষা। প্রশান্তির সময়টা শেষ হয়েছে ক্ষণিকের মধ্যে। আর অস্বস্তিতে কাটাতে হলো দীর্ঘক্ষণ। এটাই বোধ করি জীবনের রুটিন।

আমি জানি, সমাজে অজস্র বিত্তবান-বিবেকবান কিংবা মানুষের প্রতি সহানুভূতিশীল মানুষ রয়েছেন। কাজী নজরুলের মতো তারাও বুকে ধারণ করেন এই কথা_ 'মানুষের চেয়ে বড় কিছু নাই_ নহে কিছু মহীয়ান। ' ওমর খৈয়ামের ভাষায়_ 'ধূসর মাটির ঊষর বুকে বিশাল যদি প্রসাদ গড়ো/ একটি জীবন সফল করা তার চেয়ে যে অনেক বড়ো। ' এই কঠিন পৃথিবীর মধ্যেও মানুষকে বড় করে দেখা কিংবা মানব সন্তানের জীবন সফল করার চিত্রও অনেক রয়েছে। এসওএস শিশুপল্লীর মতো প্রতিষ্ঠান কিংবা এতিমখানাগুলো পরিদর্শন করলে মানুষের প্রতি মানুষের ভালোবাসা আরও জাগ্রত হতে পারে।

কোনো অসহায় শিশুর প্রতি আমাদের মানবীয় কর্তব্যবোধের উদার মন প্রসারিত হতে পারে। আমার আবেদন সব হৃদয়বান মানুষের কাছে_ ঘুরে দেখুন, দেশের সব অসহায় এতিম শিশুর আশ্রয় কেন্দ্র। সেসব শিশুর জীবন সম্পর্কে জানুন। তাদের প্রতি আপনার সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিন। দেখবেন, ঠিকই আপনার মনে হবে মানবসেবা- এ কত বড় এবাদত।

 

 

সোর্স: http://www.bd-pratidin.com/

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.