আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

শ্রীমদভগবদগীতাঃ গীতা পর্ব ৩ - প্রথম অধ্যায় – অর্জুনবিষাদযোগ

মানুষের জীবনে রোগ-শোক-জরা-ব্যাধি-মৃত্যু-হারানো থাকবেই... কিন্তু সবকিছু থেকে বড় হলো 'বেচেঁ থাকা' ... এই বেচেঁ থাকা দিয়ে সব কিছু জয় করতে হবে ।

ধৃতরাষ্ট্র উবাচ ধর্মক্ষেত্রে কুরুক্ষেত্রে সমবেতা যুযুৎসবঃ। মামকাঃ পাণ্ডবাশ্চৈব কিমকুর্বত সঞ্জয়। । ১ সঞ্জয় উবাচ দৃষ্ট্বা তু পাণ্ডবানীকং ব্যূঢ়ং দুর্যোধনস্তদা।

আচার্যমুপসঙ্গম্য রাজা বচনমব্রবীৎ। । ২ পশ্যৈতাং পাণ্ডুপুত্রাণামাচার্য মহতীং চমূম্। ব্যূঢ়াং দ্রুপদপুত্রেণ তব শিষ্যেণ ধীমতা। ।

৩ অত্র শূরা মহেষ্বাসা ভীমার্জুনসমা যুধি। যুযুধানো বিরাটশ্চ দ্রুপদশ্চ মহারথঃ। । ৪ ধৃষ্টকেতুশ্চেকিতানঃ কাশীরাজশ্চ বীর্যবান্। পুরুজিৎ কুন্তিভোজশ্চ শৈব্যশ্চ নরপুঙ্গবঃ।

। ৫ যুধামন্যুশ্চ বিক্রান্ত উত্তমৌজাশ্চ বীর্যবান্। সৌভদ্রো দ্রৌপদেয়াশ্চ সর্ব এব মহারথাঃ। । ৬ অস্মাকং তু বিশিষ্টা যে তান্নিবোধ দ্বিজোত্তম।

নায়কা মম সৈন্যস্য সংজ্ঞার্থং তান্ ব্রবীমি তে। । ৭ ভবান্ ভীষ্মশ্চ কর্ণশ্চ কৃপশ্চ সমিতিঞ্জয়ঃ। অশ্বত্থামা বিকর্ণশ্চ সৌমদত্তির্জয়দ্রথঃ। ।

৮ অন্যে চ বহবঃ শূরা মদর্থে ত্যক্তজীবিতাঃ। নানাশস্ত্রপ্রহরণাঃ সর্বে যুদ্ধবিশারদাঃ। । ৯ অপর্যাপ্তং তদস্মাকং বলং ভীষ্মাভিরক্ষিতম্। পর্যাপ্তং ত্বিদমেতেষাং বলং ভীমাভিরক্ষিতম্।

। ১০ অয়নেষু চ সর্বেষু যথাভাগমবস্থিতাঃ। ভীষ্মমেবাভিরক্ষন্তু ভবন্তঃ সর্ব এব হি। । ১১ তস্য সংজনয়ন্ হর্ষং কুরুবৃদ্ধঃ পিতামহঃ।

সিংহনাদং বিনদ্যোচ্চৈঃ শঙ্খং দধ্মৌ প্রতাপবান্। । ১২ ততঃ শঙ্খাশ্চ ভের্যশ্চ পণবানকগোমুখাঃ। সহসৈবাভ্যহন্যন্ত স শব্দস্তুমূলোঽভবৎ। ।

১৩ ততঃ শ্বেতৈর্হয়ৈর্যুক্তে মহতি স্যন্দনে স্থিতৌ। মাধবঃ পাণ্ডবশ্চৈব দিব্যৌ শঙ্খৌ প্রদধ্মতুঃ। । ১৪ পাঞ্চজন্যং হৃষীকেশো দেবদত্তং ধনঞ্জয়ঃ। পৌণ্ড্রং দধ্মৌ মহাশঙ্খং ভীমকর্মা বৃকোদরঃ।

। ১৫ অনন্তবিজয়ং রাজা কুন্তীপুত্রো যুধিষ্ঠিরঃ। নকুলঃ সহদেবশ্চ সুঘোষমণিপুষ্পকৌ। । ১৬ কাশ্যশ্চ পরমেষ্বাসঃ শিখণ্ডী চ মহারথঃ।

ধৃষ্টদ্যুম্নো বিরাটশ্চ সাত্যকিশ্চাপরাজিতঃ। । ১৭ দ্রুপদো দ্রৌপদেয়াশ্চ সর্বশঃ পৃথিবীপতে। সৌভদ্রশ্চ মহাবাহুঃ শঙ্খান্ দধ্মুঃ পৃথক্ পৃথক্। ।

১৮ স ঘোষো ধার্তরাষ্ট্রাণাং হৃদয়ানি ব্যদারয়ৎ। নভশ্চ পৃথিবীঞ্চৈব তুমুলোঽভ্যনুনাদয়ন্। । ১৯ অথ ব্যবস্থিতান্ দৃষ্ট্বা ধার্তরাষ্ট্রান্ কপিধ্বজঃ। প্রবৃত্তে শস্ত্রসম্পাতে ধনুরুদ্যম্য পাণ্ডবঃ।

হৃষীকেশং তদা বাক্যমিদমাহ মহীপতে। । ২০ অর্জুন উবাচ সেনয়োরুভয়োর্মধ্যে রথং স্থাপয় মেঽচ্যুত। । ২১ যাবদেতান্নিরীক্ষেঽহয়ং যোদ্ধুকামানবস্থিতান্।

কৈর্ময়া সহ যোদ্ধব্যমস্মিন্ রণসমুদ্যমে। । ২২ যোৎস্যমানানবেক্ষেঽহয়ং য এত্রেঽত্র সমাগতা। ধার্তরাষ্ট্রস্য দুর্বুদ্ধের্যুদ্ধে প্রিয়চিকীর্ষবঃ। ।

২৩ সঞ্জয় উবাচ এবমুক্তো হৃষীকেশো গুড়াকেশেন ভারত। সেনয়োরুভয়োর্মধ্যে স্থাপয়িত্বা রথোত্তমম্। । ২৪ ভীষ্মদ্রোণপ্রমুখতঃ সর্বেষাং চ মহীক্ষিতাম্। উবাচ পার্থ পশ্যৈতাম্ সমবেতান্ কুরুনিতি।

। ২৫ তত্রাপশ্যৎ স্থিতান্ পার্থঃ পিতৃনথ পিতামহান্। আচার্যান্ মাতুলান্ ভ্রাতৃন্ পুত্রান্ পৌত্রান্ সখীংস্তথা। । শ্বশুরান্ সুহৃদশ্চৈব সেনয়োরুভয়োরপি।

। ২৬ তান্ সমীক্ষ্য স কৌন্তেয়ঃ সর্বান্ বন্ধূনবস্থিতান্। কৃপয়া পরয়াবিষ্টো বিষীদন্নিদমব্রবীৎ। । ২৭ অর্জুন উবাচ দৃষ্ট্বেমান্ স্বজনান্ কৃষ্ণ যুযুৎসুন্ সমবস্থিতান্।

সীদন্তি মম গাত্রাণি মুখঞ্চ পরিশুষ্যতে। । ২৮ বেপথুশ্চ শরীরে মে রোমহর্ষশ্চ জায়তে। গাণ্ডীবং স্রংসতে হস্তাৎ ত্বক্ চৈব পরিদহ্যতে। ।

২৯ ন চ শক্নোম্যবস্থাতুং ভ্রমতীব চ মে মনঃ। নিমিত্তানি চ পশ্যামি বিপরীতানি কেশব। । ৩০ ন চ শ্রেয়োঽনুপশ্যামি হত্বা স্বজনমাহবে। ন কাঙ্ক্ষে বিজয়ং কৃষ্ণ ন চ রাজ্যং সুখানি চ।

। ৩১ কিং নো রাজ্যেন গোবিন্দ কিং ভৌগৈর্জীবিতেন বা। যেষামর্থে কাঙ্ক্ষিতং নো রাজ্যং ভোগাঃ সুখানি চ। । ৩২ ত ইমেঽবস্থিতা যুদ্ধে প্রাণাংস্ত্যক্ত্বা ধনানি চ।

আচার্যাঃ পিতরঃ পুত্রাস্তথৈব চ পিতামহাঃ। মাতুলাঃ শ্বশুরাঃ পৌত্রাঃ শ্যালাঃ সম্বন্ধিনস্তথা। । ৩৩ এতান্ন হন্তুমিচ্ছামি ঘ্নতোঽপি মধুসূদন। অপি ত্রৈলোক্যরাজ্যস্য হেতোঃ কিং নু মহীকৃতে।

। ৩৪ নিহত্য ধার্তরাষ্ট্রান্ নঃ কা প্রীতিঃ স্যাজ্জনার্দন। পাপমেবাশ্রয়েদস্মান্ হত্বৈতানাততায়িনঃ। । ৩৫ তস্মান্নার্হাঃ বয়ং হন্তুং ধার্তরাষ্ট্রান্ সবান্ধবান্।

স্বজনং হি কথং হত্বা সুখিনঃ স্যাম মাধব। । ৩৬ যদ্যপ্যেতে ন পশ্যন্তি লোভাপহতচেতসঃ। কুলক্ষয়কৃতং দোষং মিত্রদ্রোহে চ পাতকম্। ।

৩৭ কথং ন জ্ঞেয়মস্মাভিঃ পাপাদস্মান্নিবর্তিতুম্। কুলক্ষয়কৃতং দোষং প্রপশ্যদ্ভির্জনার্দন। । ৩৮ কুলক্ষয়ে প্রণশ্যন্তি কুলধর্মাঃ সনাতনাঃ। ধর্মে নষ্টে কুলং কৃৎস্নমধর্মোঽভিভবত্যুত।

। ৩৯ অধর্মাভিভবাৎ কৃষ্ণ প্রদুষ্যন্তি কুলস্ত্রিয়ঃ। স্ত্রীষু দুষ্টাসু বার্ষ্ণেয় জায়তে বর্ণসঙ্করঃ। । ৪০ সঙ্করো নরকায়ৈব কুলঘ্নানাং কুলস্য চ।

পতন্তি পিতরো হ্যেষাং লুপ্তপিণ্ডোদকক্রিয়াঃ। । ৪১ দোষৈরেতৈঃ কুলঘ্নানাং বর্ণসঙ্করকারকৈঃ। উৎসাদ্যন্তে জাতিধর্মাঃ কুলধর্মাশ্চ শাশ্বতাঃ। ।

৪২ উৎসন্নকুলধর্মাণাং মনুষ্যাণাং জনার্দন। নরকে নিয়তং বাসো ভবতীত্যনুশুশ্রুম। । ৪৩ অহো বত মহৎ পাপং কর্তুং ব্যবসিতা বয়ম্। যদ্ রাজ্যসুখলোভেন হন্তুং স্বজনমুদ্যতাঃ।

। ৪৪ যদি মামপ্রতীকারমশস্ত্রং শস্ত্রপাণয়ঃ। ধার্তরাষ্ট্রা রণে হন্যুস্তন্মে ক্ষেমতরং ভবেৎ। । ৪৫ সঞ্জয় উবাচ এবমুক্ত্বার্জুনঃ সঙ্খ্যে রথোপস্থ উপাবিশৎ।

বিসৃজ্য সশরং চাপং শোকসংবিগ্নমানসঃ। । ৪৬ বঙ্গানুবাদ ধৃতরাষ্ট্র জিজ্ঞাসা করলেন – হে সঞ্জয়, ধর্মক্ষেত্র কুরুক্ষেত্রে যুদ্ধাভিলাষী আমার পুত্রগণ ও পাণ্ডবগণ সমবেত হয়ে কি করল ? ১ সঞ্জয় বললেন – তখন পাণ্ডবসৈন্যদের ব্যূহবদ্ধ দেখে রাজা দুর্যোধন দ্রোণাচার্যের সমীপে উপস্থিত হয়ে বললেন – ২ হে আচার্য, ব্যূহের আকারে অবস্থিত পাণ্ডবদের এই বিপুল সৈন্যসমাবেশ দর্শন করুন। এই ব্যূহ আপনারই বুদ্ধিমান শিষ্য দ্রুপদপুত্র ধৃষ্টদ্যুম্ন কর্তৃক রচিত হয়েছে। ৩ এই পাণ্ডবসেনার মধ্যে রয়েছেন ভীম ও অর্জুনের সমকক্ষ মহাধনুর্ধর বীর সাত্যকি, রাজা বিরাট ও মহাযোদ্ধা দ্রুপ।

৪ রয়েছেন ধৃষ্টকেতু, চেকিতান, মহাবীর কাশীরাজ, পুরুজিৎ, রাজা কু্ন্তীভোজ ও নরশ্রেষ্ঠ শৈব্য। ৫ আর রয়েছেন মহাপরাক্রমশালী যুধামন্যু ও শক্তিমান উত্তমৌজা এবং সুভদ্রাতনয় অভিমন্যু ও দ্রৌপদীর পঞ্চপুত্র। এঁরা সকলেই ‘মহারথ’, অর্থাৎ একাকী দশ হাজার ধনুর্ধরের সঙ্গে যুদ্ধ করতে সক্ষম এবং শস্ত্রবিদ্যায় প্রবীণ। ৬ কিন্তু হে দ্বিজোত্তম, আমাদের পক্ষেও যে সকল বিশিষ্ট যোদ্ধা ও সেনানায়কগণ রয়েছেন, তাঁদের কথা স্মরণ করুন। আপনার অবগতির জন্য তাঁদের নাম বলছি।

৭ আমাদের পক্ষে আছেন আপনি, ভীষ্ম, কর্ণ, সমরজয়ী কৃপ, অশ্বত্থামা, বিকর্ণ, সোমদত্তের পুত্র ভূরিশ্রবা ও জয়দ্রথ। ৮ এছাড়াও আছেন আমার জন্য প্রাণত্যাগ পর্যন্ত করতে প্রস্তুত অন্যান্য অনেক মহাবীর। এঁরা সকলেই শস্ত্রনিপূণ যুদ্ধবিশারদ। ৯ ভীষ্মকর্তৃক সুরক্ষিত আমাদের সৈন্যবল অপরিমিত ও অপরাজেয়। কিন্তু ভীমরক্ষিত পাণ্ডবসেনাদের বল পরিমিত ও যুদ্ধজয়ে অসমর্থ।

১০ সকল ব্যুহদ্বারে যথাস্থানে অবস্থিত আপনারা সকলেই ভীষ্মকে সর্বপ্রকারে রক্ষা করুন। ১১ তখন কুরুকুলের প্রবীণ পিতামহ প্রতাপশালী ভীষ্ম দুর্যোধনের হর্ষ উৎপাদন করে উচ্চ সিংহনাদপূর্বক শঙ্খধ্বনি করতে লাগলেন। ১২ তারপর অসংখ্য শঙ্খ, ভেরী, ঢাক, মৃদঙ্গ ও রণশিঙা একযোগে বেজে উঠল। রণবাদ্যের সেই তুমুল শব্দ ভয়ানক প্রতিভাত হল। ১৩ তারপর বহু শ্বেত অশ্বযুক্ত রথে আরূঢ় মাধব শ্রীকৃষ্ণ ও পাণ্ডুপুত্র অর্জুন দিব্য দুই শঙ্খ বাজালেন।

১৪ হৃষীকেশ শ্রীকৃষ্ণ পাঞ্চজন্য, ধনঞ্জয় অর্জুন দেবদত্ত ও ভীষণ কর্মকারী বৃকোদর ভীম পৌণ্ড্র নামক মহাশঙ্খ বাজালেন। ১৫ কুন্তীপুত্র রাজা যুধিষ্ঠির বাজালেন অনন্তবিজয় নামক শঙ্খ। নকুল সুঘোষ ও সহদেব মণিপুষ্পক নামক শঙ্খদ্বয় বাজালেন। ১৬ হে পৃথিবীপতি ধৃতরাষ্ট্র, মহাধনুর্ধর কাশীরাজ, মহারথী শিখণ্ডী ও ধৃষ্টদ্যুম্ন, অপরাজেয় সাত্যকি, রাজা দ্রুপদ ও দ্রৌপদীতনয়গণ তথা সুভদ্রানন্দন অভিমন্যু প্রত্যেকেই নিজ নিজ শঙ্খ বাজালেন। ১৭-১৮ আকাশ ও পৃথিবী নিনাদিত করে প্রতিধ্বনিত হল সেই শঙ্খরব।

ধৃতরাষ্ট্রপুত্র দুর্যোধনাদির হৃদয় সেই তুমুল শব্দে হল বিদীর্ণ। ১৯ হে মহীপতি ধৃতরাষ্ট্র, তখন কপিধ্বজ রথারূঢ় অর্জুন ধৃতরাষ্ট্রের পুত্রগণকে যুদ্ধার্থে সমবেত দেখে শস্ত্রনিক্ষেপে উদ্যত হলেন। ধনুক উত্তোলন করে শ্রীকৃষ্ণকে বললেন – অর্জুন বললেন, যতক্ষণ আমি যুদ্ধার্থে সমবেত এই সকল ব্যক্তিবর্গকে নিরীক্ষণ করি এবং এই যুদ্ধোদ্যোগে কাদের সঙ্গে আমায় যুদ্ধ করতে হবে তথা কারা দুষ্ট ধৃতরাষ্ট্রপুত্রগণের হিতৈষণায় এখানে সমবেত হয়েছেন, তাঁদের প্রত্যক্ষ করি, হে কৃষ্ণ, উভয় সেনার মধ্যে ততক্ষণ আমার রথ আপনি সংস্থাপিত করুন। ২১-২৩ সঞ্জয় বললেন – হে ভরতবংশীয় সন্তান ধৃতরাষ্ট্র, জিতনিদ্র অর্জুন শ্রীকৃষ্ণকে এই কথা বললে, তিনিও ভীষ্ম, দ্রোণ ও অন্যান্য রাজন্যবর্গের সম্মুখে তাঁদের উত্তম রথ স্থাপন করলেন। তারপর অর্জুনকে বললেন – হে পার্থ, যুদ্ধার্থে উপস্থিত কৌরবগণকে অবলোকন কর।

২৪-২৫ অর্জুন সেখানে পিতৃব্য, পিতামহ, আচার্য, মাতুল, ভ্রাতা, পুত্র ও পৌত্র তথা বন্ধু শ্বশুর প্রমুখ মিত্রগণকে উভয় সেনার মধ্যে অবস্থিত দেখলেন। ২৬ বন্ধুগণকে যুদ্ধক্ষেত্রে উপস্থিত দেখে করুণায় অভিভূত হয়ে বিষন্ন চিত্তে অর্জুন বললেন – ২৭ অর্জুন বললেন – হে কৃষ্ণ, সমবেত যুদ্ধাভিলাষী এই স্বজনবর্গকে দেখে আমার দেহ অবসন্ন হচ্ছে, মুখ শুষ্ক হয়ে আসছে। ২৮ আমার শরীর কম্পিত ও রোমাঞ্চিত হচ্ছে। হাত থেকে খসে পড়ছে গাণ্ডীব ধনুক। দগ্ধ হচ্ছে যেন দেহচর্ম।

২৯ হে কেশব, আমি আর স্থির থাকতে পারছি না। আমার মন যেন ঘুর্ণির মতো আবর্তিত হচ্ছে। আমি সকল অমঙ্গলসূচক লক্ষণ স্বচক্ষে দেখতে পাচ্ছি। ৩০ হে কৃষ্ণ, যুদ্ধে আত্মীয়বধ যে মঙ্গলজনক, তা মনে করি না। চাই না এ যুদ্ধে জয়, কামনা করি না রাজ্য ও সুখভোগ।

৩১ যাঁদের নিমিত্ত এই রাজ্য, ভোগ ও সুখ আমরা কামনা করছি, সেই আচার্য, পিতৃব্য, পুত্র, পিতামহ, মাতুল, শ্বশুর, পৌত্র, শ্যালক ও স্বজনবর্গই তো ধনপ্রাণাদির আশা ত্যাগ করে এই যুদ্ধে সমবেত হয়েছেন। তবে হে গোবিন্দ, আমাদের রাজ্য, সুখভোগ বা জীবনধারণে কি প্রয়োজন ? ৩২-৩৩ হে মধুসূদন, এঁরা যদি আমাকে বধও করেন, তবু পৃথিবী কেন সমগ্র ত্রিলোকরাজ্যের নিমিত্তও এঁদের আমি বধ করতে চাই না। ৩৪ হে জনার্দন, ধৃতরাষ্ট্রের পুত্রগণকে বধ করে আমরা কি এমন সুখ পাব ? বরং এই সকল আততায়ীদের হত্যা করলে পাপ আমাদেরকেই আশ্রয় করবে। ৩৫ তাই কৌরব ও তাদের বন্ধুদের হত্যা করা উচিৎ নয়। হে মাধব, স্বজনবর্গকে হত্যা করে আমরা কিরূপে সুখী হব ? ৩৬ যদিও এই লুব্ধচিত্তগণ বংশনাশ ও মিত্রের প্রতি শত্রুতাজনিত পাপ দেখছে না, তবু হে জনার্দন, বংশনাশের দোষ উপলব্ধি করেও কেন আমরা এই পাপ হতে নিজেদের নিবৃত্ত করার উপায় জানব না ? ৩৭-৩৮ কুলক্ষয়ে সনাতন ধর্মের নাশ হয়।

ধর্মনাশ হলে সমগ্র কুল অনাচার সমগ্র কুলকে গ্রাস করে। ৩৯ হে কৃষ্ণ, অধর্ম কুলগ্রাস করলে কুলস্ত্রীগণ দুষ্টা হন। হে বৃষ্ণিবংশজ কৃষ্ণ, কুলস্ত্রীগণ দুষ্টা হলে উৎপন্ন হয় বর্ণসঙ্কর। ৪০ বর্ণসঙ্কর উৎপন্ন হলে কুলনাশীগণ নরকগামী হয়। পিণ্ডদান ও তর্পনক্রিয়া লুপ্ত হওয়ায় তাঁদের পিতৃপুরুষগণও নরকে পতিত হন।

৪১ এই সকল বর্ণসঙ্কর দোষে কুলনাশীদের সনাতন জাতি ও কুলধর্ম বিনষ্ট হয়। ৪২ হে জনার্দন, শাস্ত্র ও আচার্যদের নিকট শুনেছি, যাদের কুলধর্ম বিনষ্ট হয়, তারা অনন্তকাল নরকে বাস করে। ৪৩ হায়, রাজ্যসুখের লোভে স্বজনবর্গকে হত্যা করতে উদ্যত হয়ে এ কি মহাপাপে প্রবৃত্ত হয়েছি আমরা। ৪৪ আত্মরক্ষায় নিস্পৃহ ও নিরস্ত্র অবস্থায় যদি আমাকে ধৃতরাষ্ট্রপুত্রগণ যুদ্ধে হত্যা করেন, তা আমার পক্ষে অধিকতর মঙ্গলজনক হবে। ৪৫ সঞ্জয় বললেন, এই বলে অর্জুন ধনুর্বাণ পরিত্যাগ করে রণস্থলেই রথের উপর শোকমগ্ন হৃদয়ে উপবিষ্ট হলেন।

৪৬ যুদ্ধারন্তের পূর্বে ব্যসদেব অন্ধরাজকে যুদ্ধদর্শনার্থ দিব্যচক্ষু প্রদান করিতে চাহিলেন। ধৃতরাষ্ট্র তাহাতে অসম্মত হইয়া বলিলেন- আমি জ্ঞাতি-কুটুম্বের নিধন দেখিতে চাই না, আপনার তপঃপ্রভাবে যাহাতে যুদ্ধের সমস্ত বৃত্তান্ত শ্রবণ করিতে পারি, আপনি তাহাই করুন। তখন ব্যসদেব রাজ-অমাত্য সঞ্জয়কে বর প্রদান করেন। সেই বরপ্রভাবে তিনি দিব্যদৃষ্টি লাভ করিয়া যুদ্ধাদি সন্দর্শন ও উপস্থিত ব্যাক্তিবর্গের বাক্যাদি শ্রবণ ও মনোভাব সমস্ত পরিজ্ঞাত হইতা ধৃতরাষ্ট্রের নিকট বর্ণনা করিয়াছিলেন। গীতার সমস্তই সঞ্জয়-বাক্য।

সঞ্জয়ের দিব্যচক্ষু প্রাপ্তি "পরম যোগশক্তির আধায় মহামুনি ব্যাস যে এই দিব্য সঞ্জয়বে দিতে সক্ষম্‌ ছিলেন, তাহা অবিশ্বাস করিবার কোনো কারণ দেখিতে পাই না" - শ্রীঅরবিন্দ। যাঁহারা ইহাকে "আষাঢ়ে গল্প" বলিয়া উড়াইয়া দিতে চান, তাঁহারা মহাযোগী শ্রীওরবিন্দের 'গীতার ভূমিকা' নামক উপাদেয় গ্রন্থে ইহার বিভূত অলোচনা পাঠ করিবেন। প্রশ্নঃ এখানে যুদ্ধের কথা হইতেছে, কুরুক্ষেত্রও যুদ্ধক্ষেত্র। এস্থলে 'ধর্মক্ষেত্র' বিশেষ্ণটি আবার কেন? উত্তরঃ কুরুক্ষেত্র চিরকালই পর পুণ্যুভুমি বলিয়া প্রিচিত। জাবাল উপনিষদে ও শতপথব্রাহ্মণে ইহাকে দেবষজন অর্থ্যাৎ দেবতাদের 'যজ্ঞস্থান' বলিয়া উল্লেখ করা হইয়াছে।

ইহার প্রচীন নাম সমস্তপঞ্চক। পরশুরাম একুশ বার পৃথিবীনিঃক্ষত্রিয় করিয়া এই স্থানে পিতৃ-তর্পণ করিয়াছিলেন। দুর্যোধনাদির পূর্বপুরুষ বিখ্যাত কুরু রাজা এই স্থানে হ্ল চালনা করিয়া এই বর লাভ করিয়াছিলেন যে, যে ব্যক্তি এই স্থানে তপস্যা করিবে অথবা যুদ্ধে প্রাণত্যাগ করিবে, সে স্বর্গে গমন করিবে। তদবধিই ইহার নাম কুরুক্ষেত্র। প্রাচীন গ্রন্থদিতে সর্বত্রই কুরুক্ষেত্রকে ধররমক্ষেত্র বলিয়া উল্লেখ করা হইয়াছে।

বনপর্বের তীর্থযাত্রা পর্বাধ্যারে কুরুক্ষেত্রকে তিন লোকের মধ্যে শ্রেষ্ঠ তীর্থস্থান বলিয়া বর্ণনা করা হইয়াছে। সুতরাং 'ধর্মক্ষেত্র' এই বিশেষণ্টি একান্ত সুসঙ্গত ও প্রয়োজনীয়। অনেক টীকাকারের মতে, এই শব্দটি গূঢ় তাৎপর্যো আছে। তাঁহারা বলেন, ধৃতরাষ্ট্র মনে করিয়াছিলেন যে, ধর্মক্ষেত্রের প্রভাবে উভয় পক্ষের অন্তঃকরণে সাত্ত্বিক ভাবের উদয় হইলে একটা সন্ধি হওয়াও বিচিত্র নহে। তাঁহার মনে যুদ্ধ সম্বন্ধে এইরূপ সংশয়ের উদয় হওয়াতেই তিনি প্রশ্ন করিলেন- "যুদ্ধর্থী ইহারা কি করিতেছে?" নচেৎ যুদ্ধর্থী যুদ্ধই করিবে- এস্থলে "কি করিতেছে" এরূপ প্রশ্ন সঙ্গত হয় না; প্রশ্ন হইতে পারে 'কিরূপে যুদ্ধ করিতেছে।

" ইত্যাদি। এইরূপে ইহারা 'ধর্মক্ষেত্র' বিশেষণের সার্থকতা ও আপাত-অসঙ্গত "কি করিতেছে" প্রশ্নের সুসঙ্গত ব্যাখ্যা করিয়াছেন। তাঁহারা বলেন, ধর্মক্ষেত্রের প্রভাবে অর্জুনের মনে সাত্ত্বিক ভাবের প্রবাল্য তওয়াতেই তিনি "যুদ্ধরূপ নৃশংস ব্যাপাতে অনিচ্ছা প্রকাশ করিয়াছিলেন। কিন্তু অর্জুনের মনে স্বজনাদি বধের আশঙ্কায় যে কাতরতা ও বিষাদ উপস্থিত হইয়াছিল, শ্রীভগবান্‌ বলিয়াছেন উহা হৃদয়-দৌর্বল্য, স্মৃতিবিভ্রম, অজ্ঞাঞ্জনিত মোহ। এই মোহ দূরীকরণার্থই গীতার অপূর্ব-ধর্মব্যাখ্যা।

এই ব্যাখ্যা শেষ হইলে অর্জউন স্বয়ং বলিলেন- "নষ্টো মোহঃ স্মৃতিলব্ধা ত্বৎপ্রসাদাষ্মচ্যুত (১৮। ৭৩)। " তমোভাবপ্রসূত এই মোহকে সত্ত্বভাব বলিয়া বর্ণনা করিলে মূলেই ভুল করা হয় না কি? বস্তুতঃ ধৃতরাষ্ট্রের মনে যুদ্ধ সমন্ধে এরূপ কোনো সংশয় আসিতেই পারে না, কারণ এই প্রশ্ন হইয়াছিল ভিষ্মদেবের পরনের পর, যুদ্ধরাম্ভের পূর্বে নহে। (মছা, ভিষ্ম, ২৫ অঃ)। অথচ, অনেকই পূর্বোক্তরূপ ব্যাখ্যা পতানুগতিক ভাবে আবৃতি করিয়াছেন, এখনও করিতেছেন।

৩য় শ্লোকঃ "আপনার ধীমান শিষ্য"এ কথাটি দুর্ষোধন শেযাত্মক ভাবেই ব্যবহার করিয়াছেন। আবার 'ধৃষদ্যুয়' না বলিয়া 'দ্রুপদপুত্র' বলিয়া দ্রোণাচার্যের পূর্বশত্রুতা স্মরণ করাইয়া দিয়াছেন। 'আপনার বুদ্ধিমান্‌ শিষ্যটি যুদ্দার্থে সসৈন্য আপনার সম্মুখে দন্ডায়মান, দেখুন'- এই ভাবে। মহারথঃ- একো দশসহস্রাণি যোধয়েদ্‌ যস্তু ধম্বিনাম্‌। শস্ত্রশাস্ত্রপ্রবীণশ্চ মহারথ ইতি স্মৃতঃ।

। যিনি একাকী দশ সহস্র ধনুর্থারীর সহিত যুদ্ধ করেন এবং যিনি শস্ত্রশেস্তে প্রবীণ, তিনিই মহারথ। কুন্তিভোজ পুরুজিৎ- একই ব্যক্তি, বিভিন্ন ব্যক্তি নহেন। কুন্তিভোজ কৈলিক নাম। ইনি ভিষ্মসেনাদির মাতুল।

ধৃষ্টকেতু, শিশুপালের পুত্র। মহাভারতের উদ্যোগপূর্বে ১৯৪-১৯১ অধ্যায়ে উভয় পক্ষীয় রথী, মহারথী, অতিরথী প্রমূখের বিবরণ দ্রষ্টব্য। সমিতিঞ্জয়ঃ- সমিতি (সংগ্রাম) জয় করে যে যুদ্ধজয়ী। অদ্ম্যে এই পদটিকে কেবল কৃপের বিশেষণ না করিয়া দ্রোণাদি সকলেরই বিশেষণ করা হয়। কৃপ- দ্রোণাচার্যের শ্যালক, ইনি কৌরব্দিগের অস্ত্রগুরু।

সৈমদত্তি-সোমদত্ত-পুত্র বিখ্যাত ভূরিশ্রাবা। জয়দ্রথ-সিন্ধুদেশের রাজা, দুর্যোধনের ভগিনীপতি। ভীষ্মের পুর্বে দ্রোণের নাম, বাক্‌চাতুর্য লক্ষ করুন। এই শ্লোকের 'সৈমদত্তিস্তথৈব চ" এইরূপ পাঠাস্ত্র আছে। পর্যাপ্ত ও অপর্যাপ্ত শব্দের দুইটি অর্থ আছে।

- ১ পর্যাপ্ত (পরি+আপ্‌ +ক্ত) শব্দের ধাত্বর্থ, যাহা আস্তে করা যায়; পরিমাণ করা যায়, পরিমিত, সীমাবদ্ধ; আর 'অপর্যাপ্ত' অর্থ- অপরিমিত, অসংখ্য। অনুবাদে এই অর্থ গ্রহণ করা হইয়াছে। (২) পর্যাপ্ত শব্দের অপর অর্থ প্রয়োজনের পক্ষে যথেষ্ট, সমর্থ এবং 'অপর্যাপ্ত' অর্থ অপ্রচুর, জ্ঞসমর্থ। শ্রীধর স্বামীর টীকায় শেদ্বোক্ত ব্যাখ্যাই আছে এবং অনেকেই উহার অনুবর্তন করিয়াছেন। ইহাদের মন্তে, পরের শ্লোকে 'সকলে ভীষ্মকে রক্ষা করুন' এ কথায় বুঝা যায় যে, দুর্যোধনের মনে কিছু ভয়ের উদ্রেক হইয়াছিল এবং তিনি নিজের সৈন্যবল অপ্রচুর বা অসমর্থ মনে করিতেছেন।

কিন্তু দুর্যোধনের ভয় পাওয়ার কথা মহাভারতের কোথাও নাই। বরং ইহার বিপরীত কথাই আছে। ইহার পুর্বে দুর্যোধন পিতাকে বলিতেছেন- 'আমার সৈন্যবল পান্ডবদের সৈন্যবল অনেক্ষা অনেক বেশী, স্বয়ং ভীষ্ম আমার সেনাপতি, প্রধান প্রধান রাজস্যবৃন্দ আমার জন্য প্রাণদানে প্রস্তুত, আপনি ভয় করিবেন না' ('ন ভেতব্যং মহারাজ' ইত্যাদি-- মভা উ ১-৬৯)। আবার পরেও দ্রোণাচার্যের নিকট নিজ নিজ সৈন্য বর্ণনায় সৈন্যবলকে উৎসাহিত করিবার জন্য এইরূপ কথাই বলিয়াছেন এবং অবিকল এই শ্লোকটিই করিবার জন্য এইরূপ কথাই বলিয়াছেন এবং অবিকল এই শ্লোকটিই তথায় আছে (মভা ভীষ্ম ৫১। ৬।

৯) সুতরাং এস্থলেও এ সকল কথা যে সকলকে উৎসাহ-দানার্থই বলা হইয়াছিল তাহাতে সন্দেহের অবকাশ নাই। এই কারণে লোকমান্য তিলক প্রমুখ অনেকে পূর্বোক্ত প্রথম অর্থই গ্রহণ করিয়াছেন। তবে 'সকলে ভীষ্মকে রক্ষা করুন' এ কথা বলা হইল কেন? পরবর্তী শ্লোকের ব্যাখ্যা দ্রষ্টব্য। ভীষ্ম সমরে অপরাজের, তাহার জন্য দুর্যোধনের এত আশঙ্কা কেন এবং 'স্কলে ভীষ্মকে রক্ষা করুন' একথা বলেন কেন? - আশঙ্কার কারণ আছে এবং সে কথা দুর্যোধন পূর্বে স্পস্টই বলিয়াছেন। সে স্থলে দুর্যোধন বলিতেছেন- 'ভীষ্ম একয়াই সসৈন্য পান্ডবগণকে বধ করিতে পারেন, কিন্তু তিনি শিখন্ডীকে বধ করিবেন না, সুতরাং সকলে সতর্ক হইয়া সর্ব দিক হইতে ভীষ্মকে রক্ষা করিবেন, আমরা যেন জম্বুক-শিখন্ডী দ্বারা 'অতর্কিতভাবে' ভীষ্মসিংহকে বধ না করাই' ('মাং সিংহং জম্বুকেনেব থার্তয়ামঃ শিখন্ডিন্য')।

[পণব=মৃদঙ্গ, আনক= ঢাক, গোমুখ= রঙশঙ্খ] সেকালেও যুদ্ধসময়ে নানাবিধ রণবাদ্য হইত। সেকালেও বিউগৃল্‌ (bugle) ছিল শঙ্খ। ভারত- (এখানে) ধৃতরাষ্ট্র। অন্যত্র অর্জুনকেও 'ভারত' বলিয়া উল্লেখ করা হইয়াছে। কাওরণ ইহারা উথয়েই দুষ্মস্য রাজার পুত্র ভারতের বংশধর।

গুড়াকেশ- গুড়াকা (নিদ্রা, আলস্য) তাহার ঈশ, অর্থাৎ যিনি নিদ্রা ক্ষয় করিয়াছেন, নিদ্রালস্যজয়ী অর্জুন। হৃষীকেশ- হৃষীক ইন্দ্রীয়, তাহার ঈশ, ইন্দ্রিয়গণের প্রভু, শ্রীকৃষ্ণ। সখা- সমান প্রকৃতিবিষিষ্ট বয়স্যস্থানীয় আত্মীয়; সুহৃদ্‌- শুভাসুধ্যায়ী সাহায্যকারী আত্মীয়। একাকী কেহ রাজভোগ করিতে পারে না। আত্মীয়-স্বজন বন্ধু-বান্ধব লইয়াই রাজভোগ করিয়া থাকে।

তাঁহারাই যখন যুদ্ধার্থে উপস্থিত, তখন আর রাজ্যের কি প্রয়োজন? যদিও ইহারা আততায়ী (এবং আততায়ী শাস্ত্রমতে বধ্য), তথাপি এই আচার্যয়াদি গুরুজকে বধ করিলে আমরা পাপভাগীওই হইব। অতএব আমরা সবাদ্ধব ধৃতরাষ্ট্রপুত্রতিগকে বধ করিতে পারি না। হে মাধব, স্বজন বধ করিয়া আমরা কি প্রকারে সুখী হইব? আততায়ী- আগ্নিদো গরদশ্চৈচ শস্ত্রপাণির্ধনাপন্থঃ। ক্ষেত্রদারাগহারী চ বড়েতে আততায়িনঃ। অগ্নিদ (যে ঘরে আগুন দেয়), গরদ (যে বিষ দেয়), যধার্থ অস্ত্রধারীম ধনাপহারী, ভূমি-অপহারী, দারাধরণকারী- এই ছয় জন আততায়ী।

দুর্যোধনাদি প্রায় এ সমস্ত কর্মই করিয়ছেন; সুতরাং তাহারা আততায়ী। শাস্ত্রমতে আততায়ী বধে পাপ নাই (মনু ৮। ৩৫-৫১)। কিন্তু অর্জুন বলিতেছেন, আততায়ী হইলেও ইহাদিগের বধে পাপ হইবে। কেন? টীকাকারগণ নলেন, শাস্ত্র দুই প্রকার- অর্ধশাস্ত্র (law) ও ধর্মশাস্ত্র (morality)।

অর্থশাস্ত্রে আছে, আততায়ী বধ্য, কিন্তু ধর্মশাস্ত্রে আবার আছে 'অহিংসা পরম ধর্ম', 'গুরুজনাদি অবধ্য', 'ন পাপে প্রতিপাপঃ স্যাৎ' ইত্যাদি। 'অর্থশাস্ত্রক্তু বলবধমশাস্থ্রম্‌'- অর্থশাস্ত্র হইতে ধর্মশাস্ত্রে বলব। সুতরাং আততায়ী হইলেও গুরুজনাধি বধে পাপ্ত্যাগী হইতে হইবে, ইহাই অর্জুনোক্তির মর্ম। সনাতন কুলধর্ম- পূর্বপুরুষ-পরস্পরাখত ধর্ম। বংশের বয়স্ক পুরুষগণ সমস্য বিনষ্ট হইলেও কুলাগত আচার-নিয়মাদি রক্ষা করা হয় না।

সুতরাং বংশের স্ত্রী ও বালকগণ ক্রমশ উন্মর্গগামী হওয়াতে বংশ অধর্মাক্রান্ত হইয়া উঠে। বার্ষ্ণয়- তৃষ্ণিবংশসংস্কৃত (কৃষ্ণ)। বর্ণসঙ্কর- বিভিন্ন বর্ণের স্ত্রী-পুরুষ সংযোগে সন্তান-উৎপত্তি। জাতিধর্ম- বর্ণধর্ম, যথা- ব্রাহ্মণের অধ্যাপনাদি, ক্ষত্রিয়ের প্রজারক্ষাদি, বৈশ্যের কৃষি-বাণিজ্যাদি, শূদ্রের পরিচর্যাদি। কুলধর্ম- কৈলিক উপাসনা পদ্ধতি ও আচার-নিয়মাদি।

আশ্রমধর্ম- ব্রহ্মচর্য, গার্হত্ম্য, বাঁনপ্রস্থ, সন্যাস। প্রথম অধ্যায়- বিশ্লেষণ ও সার-সংক্ষেপ এই অধ্যায়ের নাম 'সৈন্যদর্শন' বা 'অর্জুন-বিষাদ যোগ'। ইহাতে তত্ত্ব কথা কিছু নাই, কিন্তু কাব্যাংশে ইহা অতুলনীয়। কুরুক্ষেত্রে মহাযুদ্ধ আরম্ভপ্রায়, উভয়পক্ষীয় সুসজ্জিত সৈন্যগণ ব্যুগবদ্ধ হইয়া পস্পন্ন সম্মুখীন, ঘোড়্গণ মহোৎসাহহে সিঙ্ঘনাদ করিয়া শঙ্খধ্বনি করিলেন- রণবাদ্য বাজিয়া উঠিল- শস্ত্রসস্পাত আরম্ভ বইল। তখন অর্জুনের মহানির্বেদ উপস্থিত ।

তাঁহার শরীর কাঁপিতে লাগিল, মুখন শুকাইল, দেহ অবসস্ত্র হইল, হস্ত হইতে গান্ডব খসিয়া পড়িল। কৃপাবিষ্ট অর্জুনের মোহভাব কাব্যভুমিকায় নিঃস্বার্থ উদার করুণ্যসে অনুরঞ্জিত, যেমন চিত্তমোহতেমন প্রাণস্পর্শী। ইতি শ্রীমহাভারতে শতসাহস্র্যাং সংহিতায়াং বৈয়াসিক্যাং ভীষ্মপর্বণি শ্রীমদ্ভগবদ্গীতাসূপনিষৎসু ব্রহ্মবিদ্যায়াং যোগশাস্ত্রে শ্রীকৃষ্ণার্জুনসংবাদে অর্জুনবিষাদযোগো নাম প্রথমোঽধ্যায়ঃ। ব্যাসদেব রচিত লক্ষশ্লোকী মহাভারতের ভীষ্মপর্বের অন্তর্গত শ্রীমদ্ভগবদ্গীতারূপ উপনিষদে ব্রহ্মবিদ্যাবিষয়ক যোগশাস্ত্রে শ্রীকৃষ্ণার্জুন-সংবাদে অর্জুনবিষাদযোগ নামক প্রথম অধ্যায় সমাপ্ত।


সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।