আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

কবিতা দিয়ে মুগ্ধ করল তারাপদ রায় (সংকলিত কবিতাপোস্ট )

মন বসে না পড়ার টেবিলে
কবিতা তেমন একটা পড়িনি কখনো । ওই ম্যাট্রিক ইন্টারের বাইরে হয়ত কালেভদ্রে দুচারটে বিখ্যাত কবিতার সাথে সাক্ষাৎ হয়েছে । তারাপদ রায়ের কবিতা প্রথম চোখে পড়ল আজকে কবি রাজের ব্লগে (কবিরাজ নয় ) । এরপর মুহম্মদ জুবায়ের এর ব্লগে জানতে পারলাম কবি তারাপদ রায় ২০০৭ সালে আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন । একটা সাইটে তারাপদ রায়ের বেশ কয়েকটি কবিতা পড়লাম ।

৩ টি কবিতা বেশ মনে ধরেছে । এক জন্ম -তারাপদ রায় অনেকদিন দেখা হবে না তারপর একদিন দেখা হবে। দু'জনেই দুজনকে বলবো, 'অনেকদিন দেখা হয়নি'। এইভাবে যাবে দিনের পর দিন বৎসরের পর বৎসর। তারপর একদিন হয়ত জানা যাবে বা হয়ত জানা যাবে না, যে তোমার সঙ্গে আমার অথবা আমার সঙ্গে তোমার আর দেখা হবে না।

দিন আনি দিন খাই - তারাপদ রায় আমরা যারা দিন আনি, দিন খাই, আমরা যারা হাজার হাজার দিন খেয়ে ফেলেছি, বৃষ্টির দিন, মেঘলা দিন, কুয়াশা ঘেরা দিন, স্টেশনের প্ল্যাটফর্মে অধীর প্রতীক্ষারত দিন, অপমানে মাথা নিচু করে চোরের মত চলে যাওয়ার দিন, খালি পেট, ছেঁড়া চটি, ঘামে ভেজা দিন, নদীর জলের আয়নায়, বড় সাহেবের ফুলের বাগানে দিন, নৌকার সাদা জালে ঢেউয়ের চুড়ায় ভেসে যাওয়া দিন, রোদে পোড়া, আগুনে জ্বলা রাস্তায় রাস্তায় ঘোরা দিন, হৈ হৈ অট্টহাসিতে কলরোল কোলাহল ভরা দিন, হঠাত্ দক্ষিণের খোলা বারান্দার আলো ঝলমলে দিন - এই সব দিন আমরা কেমন করে এনেছিলাম, কিভাবে, কেউ যদি হঠাত্ জানতে চায়, এ রকম একটা প্রশ্ন করে, আমরা যারা কিছুতেই সদুত্তর দিতে পারবো না, কিছুই বলতে পারবো না, কোনো ব্যাখ্যা দিতে পারবো না কি করে আমরা দিন এনেছিলাম, কেন আমরা দিন আনি, কেন আমরা দিন খাই কেমন করে আমরা দিন আনি, দিন খাই। পুরনো শহরতলিতে -তারাপদ রায় আবার ফিরে এলাম, আর একটু খোঁজ নিয়ে এলেই ভাল হত। বাড়ির সামনের দিকে একটা কয়লার দোকান ছিল কাঠ, কয়লা, কেরোসিন – খুচরো কেনা বেচা, কেউ চিনতে পারল না দু’জন রাস্তার লোক বলল, ‘এদিকে কোনো কয়লার দোকান নেই গলির এপারে রাধানাথ দত্তের গ্যাসের দোকান সেখানে খোঁজখবর নিয়ে দেখুন। ‘মনে আছে কয়লার দোকানের পিছনে ছিল বড় উঠোন, কয়েকটা আম কাঁঠাল গাছ, ভাঙা বারান্দা, ঘর দোর। এখন তো কিছুই নেই, শুধু একটা নেমপ্লেট, ‘নাগরিক’।

চারতলা বাড়ি, ষোলটা ফ্ল্যাট, এরই মধ্যে কোনওটায় আমি ফিরে এসেছি। কিন্তু কয়তলায়, কাদের ফ্ল্যাট? স্বর্গীয় রূপকবাবুর পদবিটা যেন কী ছিল, তাঁদের নতুন বাসাবাড়িতে এখন কে থাকে - কোনও খোঁজখবর রাখি না, শুধু মনে আছে তাঁর ভাইঝি টুলটুলি। না। সেই বাড়িটা জগৎসংসারে আর নেই, টুলটুলিকে কেউ চেনে না। পুরনো শহরতলির নতুন পাড়ায় বোকার মতো ঘুরি।

দারিদ্র্য রেখা -তারাপদ রায় আমি নিতান্ত গরীব ছিলাম, খুবই গরীব। আমার ক্ষুধার অন্ন ছিল না, আমার লজ্জা নিবারণের কাপড় ছিল না, আমার মাথার উপরে আচ্ছাদন ছিল না। অসীম দয়ার শরীর আপনার, আপনি এসে আমাকে বললেন, না, গরীব কথাটা খুব খারাপ, ওতে মানুষের মর্যাদা হানি হয়, তুমি আসলে দরিদ্র। অপরিসীম দারিদ্র্যের মধ্যে আমার কষ্টের দিন, আমার কষ্টের দিন, দিনের পর দিন আর শেষ হয় না, আমি আরো জীর্ণ আরো ক্লিষ্ট হয়ে গেলাম। হঠাৎ আপনি আবার এলেন, এসে বললেন, দ্যাখো, বিবেচনা করে দেখলাম, দরিদ্র শব্দটিও ভালো নয়, তুমি হলে নিঃস্ব।

দীর্ঘ নিঃস্বতায় আমার দিন রাত্রি, গনগনে গরমে ধুঁকতে ধুঁকতে, শীতের রাতের ঠাণ্ডায় কাঁপতে কাঁপতে, বর্ষার জলে ভিজতে ভিজতে, আমি নিঃস্ব থেকে নিঃস্বতর হয়ে গেলাম। আপনার কিন্তু ক্লান্তি নেই, আপনি আবার এলেন, আপনি বললেন, তোমার নিঃস্বতার কোনো মানে হয় না, তুমি নিঃস্ব হবে কেন, তোমাকে চিরকাল শুধু বঞ্চনা করা হয়েছে, তুমি বঞ্চিত, তুমি চিরবঞ্চিত। আমার বঞ্চনার অবসান নেই, বছরের পর বছর আধপেটা খেয়ে, উদোম আকাশের নিচে রাস্তায় শুয়ে, কঙ্কালসার আমার বেঁচে থাকা। কিন্তু আপনি আমাকে ভোলেননি, এবার আপনার মুষ্টিবদ্ধ হাত, আপনি এসে উদাত্ত কণ্ঠে ডাক দিলেন, জাগো, জাগো সর্বহারা। তখন আর আমার জাগবার ক্ষমতা নেই, ক্ষুধায় অনাহারে আমি শেষ হয়ে এসেছি, আমার বুকের পাঁজর হাঁপরের মতো ওঠানামা করছে, আপনার উৎসাহ ও উদ্দীপনার সঙ্গে আমি তাল মেলাতে পারছি না।

ইতিমধ্যে আরো বহুদিন গিয়েছে, আপনি এখন আরো বুদ্ধিমান, আরো চৌকস হয়েছেন। এবার আপনি একটি ব্ল্যাকবোর্ড নিয়ে এসেছেন, সেখানে চকখড়ি দিয়ে যত্ন করে একটা ঝকঝকে লম্বা লাইন টেনে দিয়েছেন। এবার বড় পরিশ্রম হয়েছে আপনার, কপালের ঘাম মুছে আমাকে বলেছেন, এই যে রেখা দেখছো, এর নিচে, অনেক নিচে তুমি রয়েছো। চমৎকার! আপনাকে ধন্যবাদ, বহু ধন্যবাদ! আমার গরীবপনার জন্যে আপনাকে ধন্যবাদ, আমার দারিদ্র্যের জন্যে আপনাকে ধন্যবাদ, আমার নিঃস্বতার জন্যে আপনাকে ধন্যবাদ, আমার বঞ্চনার জন্যে আপনাকে ধন্যবাদ, আমার সর্বহারাত্বের জন্যে আপনাকে ধন্যবাদ, আর সবশেষে ওই ঝকঝকে লম্বা রেখাটি, ওই উজ্জ্বল উপহারটির জন্যে আপনাকে ধন্যবাদ। কিন্তু, ক্রমশ, আমার ক্ষুধার অন্ন এখন আরো কমে গেছে, আমার লজ্জা নিবারণের কাপড় এখন আরো ছিঁড়ে গেছে, আমার মাথার ওপরের আচ্ছাদন আরো সরে গেছে।

কিন্তু ধন্যবাদ, হে প্রগাঢ় হিতৈষী, আপনাকে বহু ধন্যবাদ! পোস্টটি উৎসর্গ করলাম ব্লগার কবি রাজ ও ব্লগার মুহম্মদ জুবায়ের এর প্রতি ।
 

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.