আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

শান্তিচুক্তির ১৩ বছর পর কী পেল পাহাড়ের বঞ্চিত মানুষ ? আরো প্রতিশ্রুতি, আচানক ধেয়ে আসা মৃত্যু এবং বিবমিষা!

যে শিক্ষক বুদ্ধিজীবী কবি ও কেরানী প্রকাশ্য পথে হত্যার প্রতিশোধ চায়না আমি তাদের ঘৃণা করি

গত ২ ডিসেম্বর ছিল পার্বত্য শান্তিচুক্তির ১৩ তম বার্ষিকী। তেরটি বছর বড় দীর্ঘ সময়। পেছন ফিরে দেখা : পার্বত্য শান্তিচুক্তি স্বাক্ষরের পর এক যুগ পার হয়ে গেলেও এর কোন কিছুই এখনো বাস্তবায়িত হয়নি। আর সে কারণে আদিবাসীদের মধ্যে হতাশার সৃষ্টি হয়েছে। তারা চান দ্রুত চুক্তি বাস্তবায়নের মাধ্যমে পার্বত্য এলাকায় শান্তি প্রতিষ্ঠা।

আদিবাসীরা মনে করেন, মৌলিক অধিকার বঞ্চিত পাহাড়ি জনগোষ্ঠী জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রেই নানাভাবে বৈষম্যের শিকার। একদিকে চরম দারিদ্র্য আর অন্যদিকে অব্যাহতভাবে দখলদারদের দৌরাত্ম্যে মাথা গোঁজার ঠাঁই আদি ভিটা হারানো তাদের জন্য নিত্যনৈমিত্তিক বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। পেশা, ভাষা, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য বিলুপ্ত হওয়াসহ অস্তিত্বের সংকটে ভুগছে দেশের সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠী আদিবাসী সম্প্রদায়। যুগ যুগ ধরে তারা নানাভাবে নির্যাতিত ও নিপীড়িত। এখনো হচ্ছে প্রায় প্রতিদিনই।

ক্রমেই অধিকার হারা নিঃস্ব মানুষে পরিণত হচ্ছে। তারা আজ নিজ দেশে পরবাসী ও উদ্বাস্তু। জুম্ম জনগোষ্ঠীর মুক্তির সনদ শান্তিচুক্তি বাস্তবায়নের মাধ্যমে তাদের অধিকার আর গৌরব ফিরিয়ে দিলেই কেবলমাত্র তারা না মের বেঁচে থাকার কোন একটা পথ পেতে পারে। পাবর্ত্য চট্টগ্রামের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট : ঐতিহাসিক ও ভৌগোলিকভাবে পার্বত্য চট্টগ্রাম বিভিন্ন ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র আদিবাসী পাহাড়ি বা জুম্ম জনগোষ্ঠী অধ্যুষিত অঞ্চল। প্রাক-ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক আমলে এ অঞ্চলের জুম্ম জনগণ স্বজাতীয় আদিবাসী স্বাধীন রাজ্যের অধীনে ছিলেন।

১৫৫০ খ্রিস্টাব্দে পর্তুগিজ মানচিত্রকর জো ডি ব্যারেজের আঁকা মানচিত্র অনুযায়ী চাকমা রাজ্যের সীমানা ছিল উত্তরে ফেনী নদী, দক্ষিণে নাফ নদী, পূর্ব লুসাই হিলস এবং পশ্চিমে সমুদ্র। এ হিসেবে বর্তমান চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার জেলা এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম জেলা নিয়ে বিস্তৃত ছিল আদিবাসী রাজ্য। ১৮৫৮ সালে ব্রিটিশ সরকার ভারত শাসন আইন তৈরির মাধ্যমে সমগ্র ভারতের শাসনভার গ্রহণ করে। পরে ১৮৬০ সালের অ্যাক্ট অনুযায়ী চাকমা রাজার দেশ পার্বত্য জেলা হিসেবে গঠন করে ভারত সরকারের আওতাধীন করা হয়। ১৮৭০ সালে ব্রিটিশ ভারত সরকার তুলনামূলকভাবে অনগ্রসর আদিবাসীদের ভূমির অধিকার ও স্বশাসনের অধিকার রক্ষার জন্য ব্রিটিশ পার্লামেন্টে আইন পাস করে।

এই আইনের আওতায় পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে প্রবেশের ক্ষেত্রে বাধানিষেধ, ভূমি অধিকার ও স্বশাসনের নিশ্চয়তার আইনি বৈধতা দেয়া হয়। ১৯৪৭ সালে ভারত স্বাধীনতা আইন অনুযায়ী আদিবাসী অধ্যুষিত অঞ্চল ও তাদের অধিকার রক্ষার বিধান বহাল রাখা হয়। ১৯৫৬ ও ১৯৬২ সালে পাকিস্তানের প্রথম ও দ্বিতীয় সংবিধানে পার্বত্য চট্টগ্রাম শাসনবিধি ১৯০০ বহাল এবং পার্বত্য চট্টগ্রামের পৃথক শাসন ব্যবস্থা অক্ষুণ্ণ রাখা হয়। কিন্তু এক বছর পরে ১৯৬৩ সালে পৃথক শাসন ব্যবস্থা বাতিল করা হয়। এর ফলে সরকারি মদদে পার্বত্য চট্টগ্রামে বহিরাগতদের বসতি স্থাপন ও ভূমি বেদখল বেড়ে যায়।

১৯৭২ সালে স্বাধীন দেশের সংবিধানে পার্বত্য চট্টগ্রাম শাসনবিধি ১৯০০ বহাল রাখা হয়। কিন্তু বন্ধ হয়নি বহিরাগতদের দৌরাত্ম্য ও ভূমি বেদখল প্রক্রিয়া। তৎকালীন গণপরিষদ সদস্য ও পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা এবং পার্বত্য চট্টগ্রামের বিভিন্ন আদিবাসী নেতৃবৃন্দ আদিবাসীদের সাংবিধানিক স্বীকৃতি ও পার্বত্য চট্টগ্রামের আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসনের দাবি তুলে ধরেন। পরবর্তী সময়ে ১৯৭৫ সালে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর তাদের জন্য কোন নতুন বার্তা না আসায় এবং শাসকগোষ্ঠির ক্রমাগত বৈরি মনোভাবের কারণে আদিবাসী জনগোষ্ঠী অধিকার আদায়ে সশস্ত্র আন্দোলনের পথকেই বেছে নেয়। সেই থেকে কমপক্ষে ২০ হাজার মানুষ এই আন্দোলনে বিভিন্ন সময়ে প্রাণ দিয়েছে।

এর পাশাপাশি আইনি উপায়ে দাবি আদায়ের জন্য ১৯৮৫ সালের পর এরশাদ সরকার, খালেদা জিয়া সরকার এবং বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের সঙ্গে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির ২৬ বার বৈঠক হয়। পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যাকে রাজনৈতিক ও শান্তিপূর্ণ উপায়ে সমাধানের জন্য ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর বাংলাদেশ সরকার ও পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির মধ্যে স্বাক্ষরিত হয় ঐতিহাসিক পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তিচুক্তি। বাংলাদেশ সরকারের পক্ষে পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক জাতীয় কমিটির আহ্বায়ক আবুল হাসানাত আবদুল্লাহ এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির পক্ষে সভাপতি জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমা (সন্তু লারমা) চুক্তি স্বাক্ষর করেন। আদিবাসী নেতাদের মতে, পাহাড়িদের দীর্ঘদিনের আন্দোলনের ফসল এই চুক্তি। যদিও এখন অনেক পাহাড়ি নেতাই মনে করেন চুক্তি করে তারা কিছুই পায়নি, বরং তাদের স্বাধীকারের যে ভীন্নমুখি আন্দোলন সংগ্রাম ছিল তাও স্তিমিত করে দেয়া হয়েছে।

শাসকগোষ্ঠির এই "টেবিল টেকনোক্র্যাসি" পাহাড়িরা বুঝে উঠতে পারেনি। শান্তিচুক্তিতে যা আছে : পাহাড়ি জনগণের দীর্ঘদিনের সশস্ত্র আন্দোলনের ফসল পার্বত্য শান্তিচুক্তি। আদিবাসীদের ভাষায়, এই চুক্তি তাদের অধিকার রক্ষার চুক্তি। আদিবাসীদের জীবন বৈচিত্র্য, ভাষা-সংস্কৃতি, ঐতিহ্য, নিজস্ব রীতিনীতি রক্ষাসহ আর্থসামাজিক উন্নয়নের ঐতিহাসিক সনদ। দেশের সংবিধানের আওতায় রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমত্ব ও অখণ্ডতার প্রতি পূর্ণ ও অবিচল আনুগত্য রেখে পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে সকল নাগরিকের রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক, শিক্ষা ও অর্থনৈতিক অধিকার সমুন্নত এবং আর্থসামাজিক উন্নয়ন প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত করার কথা পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তিচুক্তির প্রস্তাবনায় উল্লেখ রয়েছে।

চুক্তিটি মন্ত্রিপরিষদে পাস হয় ২২ ডিসেম্বর। ক) সাধারণ, খ) পার্বত্য জেলা পরিষদ, গ) পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ এবং ঘ) পুনর্বাসন, সাধারণ ক্ষমা প্রদর্শন ও অন্য বিষয়াবলী শিরোনামে চার খণ্ডে বিভক্ত এই চুক্তির উল্লেখযোগ্য বিষয়গুলো হচ্ছে, পার্বত্য চট্টগ্রামকে উপজাতি অধ্যুষিত অঞ্চল হিসেবে স্বীকৃতি ও এই বৈশিষ্ট্য সংরক্ষণ সংশ্লিষ্ট আইন, বিধানাবলী ও রীতিসমূহ প্রণয়ন, পরিবর্তন, সংশোধন ও সংযোজন। পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ ও তিন পার্বত্য জেলা পরিষদ গঠন করে বিশেষ শাসন ব্যবস্থার প্রর্বতন, প্রত্যাগত জুম্ম শরণার্থী, অভ্যন্তরীণ জুম্ম উদ্বাস্তু ও জনসংহতির সদস্যদের পুনর্বাসন, ৬টি সেনানিবাস ছাড়া সেনা, এপিবি, আনসার ও ভিডিপির সকল অস্থায়ী ক্যাম্প প্রত্যাহার। পার্বত্য চট্টগ্রামে প্রচলিত আইন, প্রথা ও পদ্ধতি অনুসারে ভূমি কমিশনের ভূমিবিরোধ নিষ্পত্তি, ভূমিবিরোধ নিষ্পত্তির পর ভূমি জরিপ, অস্থানীয়দের ভূমির ইজারা বাতিল। পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয় গঠন এবং একজন আদিবাসীকে মন্ত্রী পদে নিয়োগদান।

জনসংহতি সমিতির সদস্যসহ পার্বত্য চট্টগ্রামের স্থায়ী বাসিন্দাদের বিরুদ্ধে দায়েরকৃত মামলা প্রত্যাহার ও সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা। জনসংহতি সমিতির সদস্যদের অস্ত্র জমাদান। সকল প্রকার চাকরিতে পাহাড়িদের অগ্রাধিকার প্রদান, আদিবাসী কোটা সংরক্ষণ। চুক্তি অনুযায়ী আইনশৃঙ্খলা, ভূমি ও ভূমি ব্যবস্থাপনা, পুলিশ (স্থানীয়), কৃষি ও বন, প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষা, পরিবেশ, স্বাস্থ্য সংস্কৃতি, যুব কল্যাণ ও আদিবাসী আইন, রীতি বা প্রথা ও সামাজিক বিচারসহ ৩৩ বিষয়ের দায়িত্ব দেয়া হয় জেলা পরিষদকে। সাধারণ প্রশাসন, আইনশৃঙ্খলা, জেলা পরিষদ, উন্নয়ন বোর্ড ও স্থানীয় পরিষদের মধ্যে সমন্বয় করার দায়িত্ব থাকে আঞ্চলিক পরিষদের।

চুক্তির পর রাঙ্গামাটি, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবান পার্বত্য জেলা পরিষদ আইন, ১৯৮৯ সংশোধন, পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ আইন, ১৯৯৮ ও পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয় সংক্রান্ত কার্যবিধিমালা ১৯৯৮ প্রণীত হয়। পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদের চেয়ারম্যান হিসেবে জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমা দায়িত্ব গ্রহণ করেন ১৯৯৯ সালের ১২ মে। ২৭ মে অভিষেক অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদের যাত্রা শুরু হয়। চুক্তি বাস্তবায়নের প্রতিবন্ধকতা : এই অংশ ২য় পর্বে পোস্ট করা হবে।


অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।