আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

বিপন্ন প্রাণীর আশ্রয়স্থল: জাবির ডব্লিউআরসি জীববৈচিত্র্য রক্ষায় মডেল।

...... সৃষ্টিশীলতার সন্ধানে
বিশ্বব্যাপী পরিবেশ আজ বিপর্যয়ের সম্মুখীন। আর পরিবেশ বিপর্যয়ের ফলে নষ্ট হচ্ছে জীববৈচিত্র্য যা মানবসভ্যতাকে ধ্বংসের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। পৃথিবীর অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশে ও পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য আজ হুমকীর সম্মুখীন। অনেক প্রাণীকুল ও উদ্ভিদ হারিয়ে গেছে আমাদের প্রকৃতি থেকে। বর্তমানে সারাদেশে যখন বন্যপ্রাণী ও তাদের আবাসস্থলের দ্রুত বিলুপ্তি ঘটে চলেছে তখন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় জীববৈচিত্র্য রক্ষায় তথা টেকসই উন্নয়নের মডেল হিসেবে আবির্ভুত হয়ে্েছ।

প্রায় ৭০০ একর আয়তনের এই ক্যাম্পাসের বিপুল সংখ্যক গাছপালা ও জলাশয়গুলি পশুপাখির নিরাপদ আশ্রয়ে পরিণত হয়েছে। আর এটি সম্ভব হয়েছে ক্যাম্পাসবাসীর আন্তরিকতাপূর্ণ সচেতনতা ও প্রত্যক্ষ সহযোগিতার কারণে। গত দুই দশর্কেও বেশি সময় ধরে ক্যাম্পাসবাসী এ সহযোগিতা প্রদান করছে। ফলশ্র“তিতে ক্যাম্পাসে অন্যান্য প্রাণীর সাথে সাথে বিলুপ্ত প্রায় বিভিন্ন প্রজাতির পাখির সমাগম বৃদ্ধি পেয়েছে। যার বাস্তব প্রমাণ প্রতিবছর ক্যাম্পাসে পাখি মেলায় দর্শনার্থীরা দেখতে পায়।

বর্তমানে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ১১ প্রজাতির উভচর প্রাণী, ১৯ প্রজাতির সরীসৃপ, ১৩১ প্রজাতির স্তন্যপায়ী প্রাণী রয়েছে। ক্যাম্পাসের জলাশয়গুলি বহুপূর্ব থেকেই অতিথি পাখির প্রধান আশ্রয়কেন্দ্র হিসেবে দেশব্যাপী পরিচিতি লাভ করেছে। জাবি ক্যাম্পাসের স্থলভাগ, গাছপালা, জলাশয়গুলি, সৌন্দর্যমন্ডিত লেক দেশের ২২ প্রজাতির বিলুপ্তপ্রায় বন্যপ্রাণীর আবাসভুমি। এখানে অনেক বিলুপ্তপ্রায় প্রাণী দেখতে প্ওায়া যায় অথচ এটি কোন অভয়ারণ্য নয়। এসব প্রাণীর মধ্যে রয়েছে-পটকা ব্যাঙ, সোনা ব্যাঙ, হলুদ গুঁই সাপ, নাখতা পাখি, হুতুম পেচা, খেকশিয়াল, গন্ধ গোকুল, বনবিড়াল, লালচে লেজি খরগোস, মেছো বাঘ ইত্যাদি।

আর ওয়াইল্ড লাইফ রেসকিউ সেন্টর (ডব্লিউআরসি) এসব বিলুপ্তপ্রায় প্রাণীর রক্ষণাবেক্ষণে অনন্য ভুমিকা পালন করে যাচ্ছে। পূর্ণ প্রাকৃতিক পরিবেশে এ সব বন্যপ্রাণীদের প্রজননের মাধ্যমে প্রায় বিলুপ্ত থেকে রক্ষা করতে গুরুত্বপুর্ণ ভুমিকা পালন করছে ডব্লিউআরসি । এটি বাংলাদেশের একমাত্র বন্যপ্রাণী গবেষণা কেন্দ্র যেখানে একটি বিপন্ন প্রায় প্রাণীর উপর গবেষণা করে পুনরায় পরিবেশের সাথে খাপ খাওয়ানোর উপযোগী করে তোলা হয়। ইতোমধ্যে ডব্লিউআরসি’র মাধ্যমে বন্যপ্রাণী রক্ষণাবেক্ষণের ক্ষেত্রে মডেল হয়েছে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়। ২০০৪ সালে বন্যপ্রাণী গবেষণা কেন্দ্র (ডব্লিউআরসি) আনুষ্ঠানিকভাবে যাত্রা শুরু করলেও এর পটভূমি তৈরি হয়েছিল বহুপুর্বে।

১৯৯০ সালে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের বন্যপ্রাণী গবেষণা সংক্রান্ত শাখায় বন্যপ্রাণী নিয়ে গবেষণা শুরু হয়। গত দেড় যুগ ধরে এই শাখার শিক্ষার্থীরা দেশের বন্যপ্রাণীর সাথে পরিবেশের সম্পর্ক, এদের আচরণ্ ও সংরক্ষণ, বন্যপ্রাণী নিয়ে থিসিস এবং গবেষণা প্রকল্প সম্পন্ন করেছে। একশত’র বেশি সাইন্টিফিক পেপারস, গবেষণ্ াপ্রতিবদেন ও ব্যবস্থাপনা পরিকল্পনা এই গবেষণা কার্যক্রম থেকে প্ওায়া গেছে। এম.এস.সি’র দুটি থিসিস- ১টি ভাল্লুকের উপর ও ১টি রয়েল বেঙ্গল টাইগারের উপর সম্পন্ন হয়েছে যা ১৯৯২ ও ২০০৪ সালে দি ওয়াল্ড কনজারভেশন ইউনিয়ন কর্তৃক বই আকারে প্রকাশিত হয়েছে। এছাড়াও যুক্তরাষ্ট্রের ফিস এন্ড ওয়াইল্ড লাইফ সার্ভিসেস, এডিবি এবং বাংলাদেশের অন্যান্য বিশেষায়িত সংস্থার অর্থায়নে ডব্লিউ আর সি’র গবেষকদের মাধ্যমে অনেকগুলো গবেষণা প্রকল্প এখানে সম্পন্ন হয়েছে।

ওয়াশিংটন ন্যাশনাল প্রাইমেট রিসার্চ সেন্টার ও জাবি প্রাণিবিদ্যা বিভাগের ডব্লিউআরসি শাখার মধ্যে একটি বিঞ্জান ও শিক্ষা বিনিময়ের একটি চুক্তি হয়েছে যার মাধ্যমে বাংলাদেশের বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ ও ব্যবস্থাপনার বিভিন্ন কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে। এই চুক্তির মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা বাংলাদেশে বন্যপ্রাণী সংরক্ষণের বিভিন্ন দিক এবং ব্যবস্থাপনা নিয়ে লেখাপড়া ও গবেষণা করতে পারবে। ইতোমধ্যেই এই শাখার শিক্ষার্থীরা বিশ্বের বিভিন্ন দেশের বিশ্ববিদ্যালয় হতে উচ্চতর ডিগ্রী অর্জন করেছে এবং এদের মধ্যে অনেকেই দেশের বিভিন্ন স্থানে বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ নিয়ে কাজ করছে। তাই স্থানীয় বন্যপ্রাণী সংরক্ষণে বন্যপ্রাণী গবেষণা শাখা নিবিড়ভাবে কাজ করছে। কিন্তু মাঠপর্যায়ে গবেষণা ছাড়া বন্যপ্রাণী গবেষণা শাখার বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষা সম্ভব নয়।

এর জন্য প্রয়োজন গবেষণারগার। আর বিলুপ্তপ্রায় বা ঝুঁকিপুর্ণ বন্যপ্রাণী সর্ম্পকে গবেষণার জন্য জাবি হচ্ছে উপযুক্ত স্থান। এ বিষয়টি বিবেচনা করে এবং বাংলাদেশে বন্যপ্রাণী সংরক্ষণের স্বীকৃতি হিসেবে জাবি কর্তৃপক্ষ প্রাণীবিদ্যা বিভাগের বন্যপ্রাণী গবেষণা শাখাকে ক্যাম্পাসের দক্ষিণ কোণে ৫ একর জমি বরাদ্দ দেয়। এর নামকরণ করা হয় ওয়াইল্ড লাইফ রেসকিউ সেন্টার। ২০০৪ সালের অক্টোবর মাসে সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ড. খন্দকার মুস্তাহিদুর রহমান এর উদ্বোধন করেন।

মুলত জাবি প্রাণিবিদ্যা বিভাগের শিক্ষক মোহাম্মদ মোস্তফা ফিরোজের উদ্যোগে বন্যপ্রাণী গবেষণার আলাদা শাখা হিসেবে এটি প্রতিষ্ঠিত হয়। ডব্লিউআরসি হচ্ছে সারা দেশের মধ্যে একমাত্র প্রতিষ্ঠান যা বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ নিয়ে কাজ করে। ডব্লিউআরসি’ই একমাত্র বন্যপ্রাণী সংরক্ষণের উপর গবেষণা, বন্যপ্রাণীকে বিপন্ন পরিবেশ থেকে উদ্ধার করে স্বাভাবিক পরিবেশের সাথে পুনরায় পরিচয় করিয়ে দেয়া, ধৃত প্রাণীর ডিম ও বাচ্চা উৎপাদন এবং পরিবেশগত অনানুষ্ঠানিক শিক্ষা দেয়। যে উদ্দেশ্যে বন্যপ্রাণী গবেষণা কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা: অসচেতন মানুষ কর্তৃক যেসব বন্যপ্রাণী ধরা পড়ে, আঘাতের শিকার হয় সেসব প্রাণীকে মুক্ত করে তাদেরকে স্বাভাবিক অবস্থা ফিরে না আসা পর্যন্ত ডব্লিউআরসিতে রাখা এবং আঘাতপ্রাপ্ত ও অসমর্থ্য প্রাণীদের চিকিৎসা দেয়া ডব্লিউআরসি’র অন্যতম উদ্দেশ্য। যেসব প্রাণী হুমকীর সম্মুখীন তাদের বিভিন্ন জায়গা থেকে উদ্ধার করে ডব্লিউআরসিতে রেখে তাদের মুক্ত বাচ্চা উৎপাদন করা।

জীববৈচিত্র্য সর্ম্পকে সচেতনতা বৃদ্ধি বিশেষ করে শিশুদের সচেতন করে তোলা। পশুপাখিদের প্রতি নির্দয় আচরণ বন্ধ করা, অবৈধ চোরাচালান বন্ধ করা এবং বন্যপ্রাণীর দ্বারা আনন্দ বন্ধ করা। বন্যপ্রাণী পরিবেশ সর্ম্পকিত গবেষণায় দেশ-বিদেশের বিভিন্ন সংস্থার সাথে সহোযাগিতামুলক কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করার উদ্দেশ্যনিয়ে প্রতিষ্ঠা লাভ করে ডব্লিউআরসি । বর্তমান কার্যক্রম: বর্তমানে ডব্লিউআরসি ভোঁদড়, লক্ষি পেচা, খুরুলে পেচা, গ্রিফন ঈগল, কালো ডানা, শুদ্ধি কাচিম প্রভৃতি বিলুপ্তপ্রায় হুমকির সম্মুখীন প্রাণীকে উদ্ধার করে এদের রক্ষণাবেক্ষণ করছে এবং ভোদড়, গুঁইসাপ, কানিবক, সবুজ ঘুঘু, হিল ময়না প্রভৃতি প্রাণীর বাচ্চা উৎপাদনে কাজ করছে। এছাড়্ওা পরিবেশ বিষয়ক শিক্ষা, পাখিমেলা, জীববৈচিত্র্য নিয়ে কাজ করছে এবং বিভিন্ন বন্যপ্রাণীর সাথে পরিবেশের সম্পর্ক নিয়ে গবেষণামূলক কাজ করছে।

সাথে সাথে বিভিন্ন সময় বন্যপ্রাণী সম্পর্কে মানুষকে সচেতন করতে নানা ধরনের কর্মসূচি চালিয়ে যাচ্ছে ডব্লিউআরসি। ভবিষ্যত কার্যক্রম: খবর পাওয়ামাত্র হুমকীপ্রাপ্ত বা আঘাতপ্রাপ্ত প্রাণীকে উদ্ধার করে প্রয়জোনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা, বাংলাদেশে বিপন্ন প্রজাতির কচ্ছপের প্রজনন সুবধিা বৃদ্ধি ও উভচর প্রাণীর প্রজনন বৃদ্ধির লক্ষে আরোও জলাশয় প্রতিষ্ঠা ডব্লিউআরসি’র ভবিষ্যত কার্যক্রমের অন্তভুক্ত। জীববৈচিত্র্য সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য নতুন নতুন কর্মসূচির আয়োজন করবে ডব্লিউআরসি। দেশব্যাপী বিভিন্ন স্কুল-কলেজে পরিবেশ ও বন্যপ্রাণীগত সচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষে কাজ কাজ করবে ডব্লিউআরসি। যেভাবে চলছে ডব্লিউআরসি: বন্যপ্রাণী গবেষণা কেন্দ্র পরিচালনার জন্য প্রচুর অর্থের প্রয়োজন।

কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় বাজেটে এর জন্য কোন অর্থ বরাদ্দ নেই। প্রাণিবিদ্যা বিভাগের শিক্ষকদের অর্থায়নে এটি পরিচালিত হচ্ছে। বিশেষ করে প্রাণিবিদ্যা বিভাগের শিক্ষক ডব্লিউআরসি’র প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি অধ্যাপক মোহাম্মদ মোস্তফা ফিরোজ, ড. মোঃ মফিজুল কবির, মিসেস সাজেদা বেগম, এ এইচ এম আলী রেজা, ড. মোহাম্মদ মনিরুল হাসান খান, মোঃ কামরুল হাসান, মোহাম্মদ আব্দুল আজিজ প্রমুখ শিক্ষকের আর্থিক ও মানসিক সমর্থনে এটি পরিচালিত হচ্ছে। এছাড়্ওা এই বিভাগের সাবেক ও বর্তমান শিক্ষার্থীরা এর পরিচালনায় সহায়তা করছে। তবে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ডব্লিউআরসি’র প্রাণীগুলো তত্ত্বাবধানের জন্য একজন কর্মচারী এবং একজন ল্যাব এ্যসিসটেন্ট নিয়োগ দিয়েছে।


 

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.