আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

বিপন্ন বনের বিপন্ন মানুষদের উষ্ণতায় (শেষ কিস্তি)

নাম শুনেই যার প্রেমে পড়ি

আচ্চুর বাড়িতে সঞ্জয়সহ আমরা প্রথম যখন এলাম সেদিন কোন চু ছিল না। কিন্তু সকালে যখন দিখ্যা নামাতে চেয়েছিল তখনই বুঝেছি পাড়া-প্রতিবেশি কারো কাছ থেকে হয়ত যোগাড় করেছে। যতই কষ্ট হোক আমরা এলে চু এর ব্যবস্থা করবেই করবে। অনেকবার মানা করা সত্বেও তা রোধ করতে পারিনি। আমরা জানি তাদের সংসার কিভাবে চলে।

স্বামী-স্ত্রী দু'জনেই দিনমজুর। অন্যের বাগানে বা জমিতে সারাদিন হাড়ভাঙ্গা খাটুনির পর দাদা পান ৮০/৯০ টাকা আর দিদি ৬০/৭০টাকা। এদিয়েই কোনরকমে চলে যাচ্ছে দিন। যাই হোক, সন্ধ্যার পর দাদা বাড়ি ফিরলে দিখ্যা নামানো হল। তিরেশ, অলিশন, বচন, বুলবুল, আচ্চু সহ ৬/৭জন আমরা।

দিখ্যা শেষ ও ভাত খেয়ে বচনদার বাড়িতে আবার গেলাম। গিয়ে আবার গিচ্ছাম (দুপুর বেলার রেখে দেওয়া পুরনো মদ) বেলার টানলাম ও আড্ডা দিলাম অনেকক্ষণ। জানলাম অলিশনদা যে নাকি সারাদিন কৃষিকাজ নিয়ে ব্যস্ত থাকেন, সে ইদানিং মান্দি গান লেখা শুরু করেছেন। নাটকও লিখেছেন একটা- সংস্রেকদের ওয়ান্নাকে সামনে রেখে। ২৮ অক্টোবর সকালে আচ্চুর সাথে ওয়ান্না ব্যাপারে আরো কিছু প্রয়োজনীয় আলাপ সেরে বিদায় হলাম বাড়ি ফিরব বলে।

মধ্যদুপুরে পঁচিশ মাইল নেমেই জেরিদের সাথে দেখা হয়ে গেল। চায়ের দোকানে সিগারেট পুড়তে পুড়তে সঞ্জয়ও চলে এলো। ভেবেছিলাম আজ সঞ্জয়কে নিয়ে একটু বেরিবাইদ, মাগন্তিনগর যাব, চলেশ রিছিল আর গিদিতা রেমার বাড়িতে, কিন্তু সঞ্জয় ব্যস্ত থাকায় তা হল না। যাক, সঞ্জয়কে নিয়ে তাদের বাড়িতে গেলাম জয়েনশাহী আদিবাসী উন্নয়ন পরিষদের ভেতর দিয়ে। নেতারা মিটিং এ ব্যস্ত বলে সেদিকে আর ঢুকলাম না।

অজয়দা(অজয় এ মৃ, ইকোপার্ক বিরোধী আন্দোলনের সময়কার নেতা, বর্তমানে জয়েনশাহীর সভাপতি)কে গতকাল দুপুরেই দেখেছিলাম পীরগাছাতে, চা স্টলের সামনে, কথা হয়নি। ইউজিন নকরেক এর সাথে কথা হয়েছে প্রথমদিনই। মধুপুরে ইকোপার্ক বিরোধী আন্দোলনের পরে অনেক কিছুইতেই অনেক পরিবর্তন দেখলাম এ কয় বছরে। তখনকার নেতৃবৃন্দ তাদের আন্দোলন সংগ্রামের সেই মনোভাবটাকে আর পরবর্তী সময়ে সেভাবে ধরে রাখতে পারেননি। নেতৃবৃন্দকে ঘিরে সাধারণ মানুষের মধ্যে হতাশা-অবিশ্বাস বেড়েই চলেছে।

গত মধ্য জানুয়ারিতে জরুরি অবস্থার মধ্যে ইকোপার্কের দেয়াল নির্মাণের কাজ শুরু, ২০০৬ এর আগস্টে শিশিলিয়া স্নালের বনরক্ষীদের গুলিবর্ষণ বা চলেশ রিছিল মারা যাওয়ার পর নেতৃবৃন্দের ভূমিকা এখানকার আদিবাসীদের আস্থা অর্জনে অনেকটাই সফল হতে পারেনি। এই হতাশা বা আস্থাহীনতা অবশ্য একদিনেই তৈরি হয়েছে তা বলা যাবে না। ২০০৪ সালের ইকোপার্ক বিরোধী আন্দোলনের পর ঝাঁকে ঝাঁকে এনজিও/ডোনাররা এখানে এসেছে তাদের হরকসম ধান্দা (প্রজেক্ট) নিয়ে। অমুক গবেষণা, তমুক জরিপ, সেমুক উন্নয়ন, সভা-সেমিনার আর বিদেশভ্রমন দিয়ে তারা নেতৃবৃন্দকে এতটাই ব্যস্ত রেখেছে যে নিজেদের জাতিগত অস্তিত্ব রক্ষার দিকে পুরোমাত্রায় আর মনোযোগ রাখতে পারেন নি। বরং এনজিওদের দেয়া ফান্ডকে ঘিরে নেতৃত্বের মধ্যে তৈরি হয়েছে পারস্পরিক অবিশ্বাস।

শালবনের মান্দিদের কষ্ট পায় এই ভেবে যে, হা.বিমাকে (জননীভূমি)-নিজের জাতির অস্তিত্বকে রক্ষার জন্য পীরেন স্নাল আত্মদান খুব বেশি দিন হয়নি, এর মধ্যেই এত কিছুর পরিবর্তন হয়ে গেল! স্বার্থের কারণেই ইকোপার্কের পক্ষের লোকজনগুলো বিরোধী শক্তির সাথে আপোস করে নিল! ৯ আগষ্ট আদিবাসী দিবসে সেনাবাহিনীর দেয়া যাদুর কেক'র নিশ্চয়ই এমন কোন ক্ষমতা নেই যে তা চলেশ রিছিলের পরিবারের বেদনাকে কিঞ্চিত পরিমানও মুছে দিতে পারে। এই পরিবর্তনকে বনবিভাগ আর প্রশাসনও বেশ কাজে লাগাচ্ছে এখন। চলেশ রিছিল মারা যাওয়ার পরপরই তার গ্রামে শুরু হয় কলাবাগান কেটে উডলট বাগান তৈরির কাজ। দ্রুত গতিতে তা অন্যান্য গ্রামেও চলতে থাকে। মধুপুর বনের অনেক গ্রামেই এখন চোখে পড়বে উদ্ধারকৃত জমিতে সামাজিক বনায়নের সাইনবোর্ড।

এই বাহাদুরি মার্কা সাইনবোর্ডের কাহিনীটা একটু দেখা যাক। শালবনে সোস্যাল ফরেষ্ট্রি প্রকল্প প্রথম চালু হয় ১৯৮৯ সালে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি)-র অর্থায়নে। পাঁচবছর মেয়াদি (১৯৮৯-১৯৯৫) এই প্রকল্পের মোট ৪৬.৮ মার্কিন ডলারের মধ্যে তখন ১১.৬ মিলিয়ন ডলার ব্যয় করা হয় শালবন এলাকায়। সোস্যাল ফরেস্ট্রির উডলট তৈরি করতে সেসময় একরের পর একর প্রাকৃতিক শালবন ধ্বংস করে ফেলে বনবিভাগ। মাটি খুড়ে খুড়ে শালের কপিছ (কপিছ [শেকড়] আর বীজদিয়েই শালের বংশবৃদ্ধি ঘটে) তুলে ফেলা হয়, যা ভবিষ্যতে প্রাকৃতিক শালবন তৈরির সম্ভবনাকেও হুমকির মুখে ফেলেছে।

প্রাকৃতিক শালবন কেটে সেখানে দাতাসংস্থার পরামর্শে লাগানো হল শালবনের বাস্তুতন্ত্র বিনাশী একাশিয়া, ম্যাঞ্জিয়াম,ইউক্যালিপ্টাস ইত্যাদি বিদিশি গাছের চারা। উহ! কী মাথামোটা আমাদের বনকর্তা আর রাষ্ট্রের নীতিনির্ধারকেরা। দফায় দফায় প্রকল্পের মেয়াদ বাড়িয়ে চলল হরিলুটের ব্যবস্থা। বনবিভাগের প্রশ্রয়েই একসময় বাঙালি মহাজনের এই জমিগুলোতে গড়ে তুলল হরমোন আর কীটবিষ সর্বস্ব কলাচাষ। জমজমাট হয়ে গেল বহুজাতিক কোম্পানির বানিজ্যও।

জরুরি অবস্থা জারি হলে বনবিভাগের নতুন প্রকল্প চালানোর জন্য উদগ্রীব হয়ে পড়ল, যত প্রকল্প তত টাকা আর যত টাকা বালিশ-তোশকে ঘুমাতে তত আরাম! যৌথবাহিনীর সহায়তায় চলল শতশত কলাবাগান ধ্বংস। সেখানে করা হল নতুন উডলট বাগান। বনকর্মকর্তাদের টাকা বানানোর নতুন ধান্দা। আর চলেশ হত্যার পর প্রশাসনের পক্ষ আদিবাসীদের সাথে ক্লান্তিহীন লোকদেখানো বৈঠক চলতে থাকে। কী করে বন রক্ষা করা যায়, আদিবাসী উন্নয়ন করা যায় ইত্যাদি নানান বিষয়ে।

এই ধরনের বৈঠকে কয়েকবার অংশগ্রহন করেছেন এমন এক আচ্চুর কাছে জানতে পারলাম, বৈঠকে নানান আলাপের পর বৈঠক কর্তাদের শেষ কথা থাকে- নতুন করে উডলট করা হবেই হবে, এতে আপনাদের আদিবাসীদের সহযোগিতা প্রয়োজন। যাই হোক, সঞ্জয়ের কাছ থেকে বিদায় নেওয়ার মুহুর্তেই ফোন এলো ইদিলপুর গ্রামের যুবক সুলভ সাংমার( মিল্লাম নামের একটা ছোটকাগজের সম্পাদক) ফোন। ওরা জলছত্র বাজারের সামনে আছে। তো, আমি একা সেদিকেই চলে গেলাম হাঁটতে হাঁটতে। গিয়ে দেখি সমাপন, বাপ্পু মৃ'রা সেখানে।

সুলভ তড়িঘড়ি করে ঢাকার উদ্দেশ্য রওনা দিল। সমাপনরা আমাকে ভ্যানে উঠলো ওদের গ্রামে নিয়ে যাবে বলে। ওদের ভালবাসা পাশ কাটনো একটু কঠিনই মনে হলো আমার কাছে। তো, কী আর করা সেদিন ওদের ওখানে রাত কাটিয়ে পর দিন ঢাকায় ফেরা আরকি।


অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.