আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

বিপন্ন বনের বিপন্ন মানুষদের উষ্ণতায় (দ্বিতীয় কিস্তি)

নাম শুনেই যার প্রেমে পড়ি

পরাগ রিছিল ফোনে বলেছিল যে, ২৬ তারিখে নাকি সাইন্যামারি গ্রামে ওয়ানগালা হবে। জলছত্রে এব্যাপারে কেউ তেমন কিছু জানে বলে মনে হলো না। ওয়ানগালা হলো জুমচাষী মান্দিদের ঐতিহ্যবাহী এক ধর্মীয় ও সামাজিক উৎসব। সাংসারেক (মান্দিদের আপন ধর্মের নাম) মান্দিরা একে বলেন ওয়ান্না। এক সময় হাবা বা জুমে উৎপাদিত ফসলাদি দেবতা মিসি আর সালজং এই দুইভাইকে উৎসর্গ করার পরই মান্দিরা তা খেতে পারতেন।

সাধারণত কার্তিক মাসে এই ওয়ান্না শুরু হতো। আনন্দ-উৎসব আর আপন বিশ্বাসের চর্চার মধ্যদিয়ে নিজেদের জাতিগত সংহতিকে শাণিত করে নেয়ার এক অন্যতম মাধ্যম ছিল এই ওয়ান্না। একেক গ্রামে একেক দিনে আয়াজন করা হতো এই কৃত্যের। গ্রামের নকমার সামর্থ্যের উপর ভিত্তি করেই কোন কোন গ্রামে ৩ দিন/৫দিন/৭দিন ধরে চলত এই উৎসবের। তবে তিন দিনের নিচে ওয়ান্না করা যেত না কোনভাবেই।

১৯৫০ সালে শালবনের মান্দিরা জুমচাষের অধিকার হারানোর পর থেকে বন্ধ হয়ে যায় এই ওয়ান্না। অবশ্য কেবল জুমচাষ বন্ধ হওয়াই নয়, মিশনারীদের কর্মতৎপরতাও এর জন্য দায়ী। ব্রিটিশদের বদান্যতায় মিশনারীরা যখন মান্দি এলাকাগুলোতে তাদের বিশ্বাস চাপানোর কাজটি মোটমুটি পর্যায়ে নিয়ে আসে তখনই তারা ফতোয়া দেয় যে, তাতারা, সুসিমি, মিসি, সালজং, চুরাবুদি প্রভৃতি দেব-দেবতার পূজা আসলে শয়তানের পূজা(!)। আর ওয়ান্নাতে মিসি সালজং এর উদ্দেশ্য যেহেতু জুমের শস্য-ফসলাদি উৎসর্গ করা হয় সেহেতু এটা কোন ভাল(?) কিছু হতে পারে না। প্রভু যিশুতো আর এতে সন্তুষ্ট হতে পারে না(!)।

খ্রিষ্টভক্ত হিসেবে এই অজাচারতো(?) আর চলতে দেয়া যায় না। অতএব বন্ধ করে দাও ওয়ান্না, রংচুগালা, গালমাকদুয়া, মানসাসহ সাংসারেকদের সকল কৃত্য। শুধু তাই নয়, মান্দিদের ঐতিহ্যবাহী বাদ্যযন্ত্র আদুরি,দামা, রাং, বলথং, নাগাড়া ইত্যাদি বাজানোর উপরও তারা ধর্মীয় নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেন। নিজেদের বিশ্বাসের আগ্রাসনকে আরো শক্তিশালী করার জন্য তারা মান্দি বাড়ি থেকে ঐসব বাদ্যযন্ত্র কিনে নিয়ে যায় মিশনে, তারপর সেগুলোকে ঊঁই পোকা দিয়ে খাইয়ে বা পুড়িয়ে ফেলার মাধ্যমে মান্দি সমাজকে শুদ্ধ(!?) করে নেন খ্রিস্টান মিশনারিরা। সময়ের ধারাবাহিকতায় মান্দিরা আপন ধর্ম-আপন সংস্কৃতি ছিন্ন হয়ে যখন প্রায় ৯৯.৯৯%(আরো বেশি হবে) খ্রিষ্টান ধর্মে দীক্ষিত হন তখন এই মিশনারিরাই আবার নতুন করে ফতোয়া জারি করেন।

মান্দিদেরকে নতুন করে বুঝানো হয় যে, তাদের আপন সংস্কৃতিকে রক্ষা করতে হবে। আদুরি, দামা, রাং, বলথং, আম্বেংগি এগুলোকে রক্ষা করতে হবে; ওয়ানগালা (মিশনারিরা ওয়ান্নাকে এই নামেই ডাকে) পালন করতে হবে। ধন্দে পড়ে যান মান্দিরা। মিশনের ফাদারের উদ্যোগে আবারো শুরু হয় ওয়ানগালা। তবে এটা মিসি-সালজংকে উৎসর্গ করার ওয়ান্না নয়, এটা হচ্ছে "যিশুনা ওয়ানগালা"।

আসলে প্রভু যিশুর তরে নিজেকে সমর্পণ করার এক নতুন তরিকা। বিভিন্ন গ্রাম থেকে মান্দিরা জমিতে উৎপাদিত ফসলাদি এনে ফাদারের নেতৃত্বে খ্রিস্টযোগের মাধ্যমে তা প্রভু যিশুকে উৎসর্গ করেন। এখানে সাংসারেক খামালের কোন দরকার হয় না। কেবল মঞ্চ অনুষ্ঠানের সময় ৫ মিনিটের জন্য গ্রামের বুড়োদের দিয়ে আগের দিনের ওয়ান্নার রীতিনীতির কিছু অংশ মঞ্চায়ন করা হয়। যাই হোক বেশ কয়েকবছর টানা চলার পর নানান অজুহাতে মিশন এবার ওয়ানগালা পালন করছে না।

তো সাইন্যামারিতে গ্রামবাসীরা ওয়ানগালা করবে তা বেশ উৎসাহ তৈরি করেছিল আমাদের মধ্যে। দুপুর বারোটার মধ্যেই কিছু মান্দি যুবকদের সাথে মিটিং সেড়ে পঁচিশ মাইল থেকে সঞ্জয়কে নিয়ে রওনা দেই সাইন্যামারির উদ্দেশ্য। দোখলা এসে খোঁজ নিয়ে জানতে পারলাম ওয়ানগালা হবে তবে তা আজকে নয়, নভেম্বরের ৪ তারিখে। কী আর করা, সাইন্যামারিতে না গিয়ে চলে আসলাম বচনদার (মান্দি কবি বচন নকরেক) বাড়িতে। গাছগাছালিতে ভরা সুন্দর-ছিমছাম বাড়িতে পাওয়া গেল তাকে।

বাড়িতে বরাবরের ন্যায় একাই ছিলেন। বড় মেয়ে সুসিমি বাড়িতে ছিল না, বারোমারি তীর্থে গেছে; ছোট রিম্মত বাড়িতে। আমাদের দেখেই মাসির বাড়িত ভোঁ দৌঁড়। ঝর্ণাদি কর্মস্থল দূর্গাপুরে। যাই হোক, তিনজন চলে এলাম পীরগাছা চায়ের দোকানে।

চা-সিগারেট আর আড্ডার ফাঁকেই সেখানে দেখা হয়ে গেল তিরেশ নকরেক এর সাথে। তিরেশদা হলেন একাধারে মান্দি গীতিকার, সুরকার, গায়ক। ১৯৮৪ সাল থেকে আজও পর্যন্ত বাংলাদেশ বেতারে সালগিত্তাল নামক মান্দিদের এক অনুষ্ঠানে কাজ করে যাচ্ছে না। তার লেখা-সুর করা ও গাওয়া অসংখ্য গান প্রচারিত হয়েছে সেখান থেকে। যে কারণে বাংলাদেশের মান্দি সমাজে উনার রয়েছে বিশাল পরিচিতি।

গারো হিলসেও তাঁর নাম পরিচিত। খাবাকনি খাবাক নামের মান্দি টেলিফিল্ম পরিচালনা করে এই পরিচিতির পরিধি আরো বেড়ে গেছে ইদানিং। পীরগাছা থেকে বচনদাসহ আমরা চলে এলাম জনিক আচ্চুর (জনিক নকরেক-সাংসারেক খামাল)। আচ্চুকে বাড়িতেই পেলাম। কিছুক্ষণ আগেই ফিরেছেন সঞ্জীব দ্রংদের কনফারেন্স থেকে।

মান্দি সংস্কৃতির উপর দুই ঘন্টা বক্তৃতা করেছেন। শালবনে আচ্চুর বাড়িই আমাদের মূল ঠিকানা। গত পাঁচবছর ধরে প্রতিনিয়ত জ্বালাতন করে চলেছি এই পরিবারের সকলকে তাদের অকৃত্রিম ভালবাসাকে পূঁজি করে। আচ্চুর সাথে প্রাথমিক কথাবার্তা শেষে ব্যাগটা বিজন্তীদির ঘরে ব্যাগ রেখে আমরা চলে এলাম দোখলা বাজার। এখান থেকেই সঞ্জয়কে বিদায় জানাতে হয়।

সন্ধ্যার দিকে বচনদা তার মায়ের বাড়িতে নিয়ে যান, তার গুমী (দুলাভাই) বারোমারি তীর্থ থেকে ফিরেছেন, কাজেই ও বাড়িতে চু আজকে নামবেই। সাথে অলিশনদা(জনিক আচ্চুর বড় ছেলে), তিরেশদা। আমরা গিয়ে আসন গাড়লাম উঠোনে। বারন্দায় কিছু চাচ্চ্রি (আত্মীয়) নিজেদের ভেতর কথাবার্তা বলছেন। উনাদেরকে বিদায় করেই আমাদের প্রত্যাশিত চু নামানো হল।

অলিশনদা চু ছাঁকতে বসে গেলেন। মিঠুর (বচনদার ছোটভাই) এসে আমাদের গ্লাস ভর্তি করতে লাগল। কথা হচ্ছে অনেক, প্রাসঙ্গিক-অপ্রাসঙ্গিক সব রকমের। তরল পেটে যত জমা হচ্ছে, বচনদা ততই নিজেকে খুলে চলেছেন, বলে চলেছেন নিজের গহীনে জমে থাকা অনেক পুরনো অথচ জীবন্ত নানান কথা....(অসমাপ্ত)

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.