আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

ভাতের অধিকার চাই



ক্লান্ত শহর যেন ঘুমিয়ে পড়েছে নিত্যদিনের মতো, লক্ষ লক্ষ দুর্দশাগ্রস্থ অনাহারী মানুষের আহাজারিতে বিন্দুমাত্র সহানুভূতি নেই এ শহরের। মাঝে মাঝে দু’য়েকটি শিশুর ক্রন্দন ধ্বনি ভেসে আসছে, কে জানে রাতে ওদের পেটে ভাত জুটেছে কী না? আবুল একবার ঘড়ি দেখার জন্য ম্যাচ জ্বালায় কিন্তু পরে মনে পড়ে কয়েকদিন আগে ঘড়িটা পাশের মুদির দোকানে বিক্রি করে চাল কেনার কথা। সে ঘুমাবার চেষ্টা করে কিন্তু ঘুম তো নয়, শুধু অতীতের স্মৃতিগুলোই যেন বার বার চোখের সামনে ভেসে উঠছে, আজকের এ লাগাতার আন্দোলনের মতো সে দেখেছে ৬৯-এর গণআন্দোলন, দেখেছে মুক্তিযুদ্ধ। তখন আবুল ছোট ছিল তবু মনে পড়ে এদেশের মানুষ জুলুম, শোষণ, বঞ্চনা এবং বিদেশি শত্রুর হিংস্র থাবা থেকে মুক্তির জন্য মুক্তিযুদ্ধ করেছে, ত্রিশ লক্ষ মানুষ জীবন দিয়ে দেশকে স্বাধীনকরেছে। সবার আশা ছিল স্বাধীনদেশের মানুষ দু’মুঠো ভাত পাবে, পরনের বস্ত্র পাবে, কথা বলার স্বাধীনতাপাবে।

কিন্তু মানুষ কি তা পেয়েছে? সদ্য স্বাধীনএকটি দেশে আইন-শৃংখলা অবস্থার উন্নতি, মানবাধিকার এবং গণতন্ত্রের বিকাশের আগেই দেশে শুরু হলো হত্যা, ক্যূ ও ষড়যন্ত্রের রাজনীতি। ক্ষমতার পালাবদলের এক পর্যায়ে ক্ষমতা গ্রহণ করে স্বৈরাচার সরকার। স্বৈরাচারশাসকের প্রায় শুরু থেকেই শুরু হয়েছিল সরকার হটাও আন্দোলন। শুরু হয়েছিল মিছিল, মিটিং, হরতাল, অবরোধ ইত্যাদি, ইত্যাদি। এ আন্দোলনে শহীদ হয়েছেন অনেকে।

স্বৈরাচারসরকারেরও পতন হয়েছে, দেশে গণতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। কিন্তু রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা আসেনি। প্রথম থেকেই বিভিন্ন ইস্যুতে শুরু হয়েছে হরতাল, ভাংচুর, অবরোধ ইত্যাদি। এমনিভাবে দেশে একের পর এক আন্দোলন লেগেই আছে। নতুন সরকার ক্ষমতা গ্রহনের পর প্রথম দু’য়েক বছর কখনো কখনো ভালোভাবেই চলে তারপর শুরু হয় আন্দোলন, শুরু হয় পাল্টাপাল্টি অভিযোগ, অধিকার রক্ষার নামে সরকারী দল এবং বিরোধী দলের মধ্যে জনগণকে নিয়ে টানাটানি।

গত বেশ কিছুদিন ধরে দেশে দেখা দিয়েছে রাজনৈতিক সংকট, এখন ধারণ করেছে আরো চরম আকার। সংকটের প্রথম দিকে মাঝে মাঝে মিছিল, মিটিং, মানববন্ধন হতো কিন্তু এর শেষ পরিনতি যে হরতাল তা বুঝতে আর আবুলের বাকি নেই। শুধু একদিন/দুইদিন হরতাল নয়, জনগণের অধিকার রক্ষার নামে দেশে টানা হরতালেরও নজির আছে। আর হরতালের কথা মনে হলেই আবুল আঁতকে উঠে। কয়েকবছর আগের কথা তখনো এরকম হরতাল শুরু হয়েছিল।

প্রথম প্রথম দু’য়েকদিন হরতাল তারপর একটানা। সেদিনের কথা স্পষ্ট মনে আছে আবুলের। বুধবার দিন ছিল অবরোধ, রিক্সা করেছে কিন্তু শহরের অবস্থা ছিল একেবারে থম্থমে লোকজনের চলাচলও ছিল স্বাভাবিকেরচেয়ে অনেক কম। তাই আবুল তেমন টাকা-পয়সা রোজগার করতে পারেনি। বৃহষ্পতিবার দিন অর্ধদিবস হরতাল, শুধু বিকেল বেলা রিক্সা নিয়ে বেরিয়েছিল কিন্তু একবার মিছিলের সামনে পড়তেই কারা যেন রিক্সার চাকায় আঘাত করেছিল।

ফলে সেদিন তো আর রিক্সা চালানো হয়নি বরং রিক্সা মেরামত করতেই পরদিন দুপুর পর্যন্ত সময় লেগেছিল। শুক্রবার এমনিতেই রোজগার কম হয়, তারপর শুধু বিকেলবেলা সামান্য ক’টাকা রোজগার হয়েছে মাত্র। শুধুমাত্র শনিবার দিন কোন কর্মসূচী ছিল না, রবিবার হরতাল, আবুলের কাছে যেন অসহ্য মনে হয়েছিল, সেদিন তার কাছে একটি টাকাও ছিল না, ঘরে একমুঠো চালও ছিল না। আবুলের স্ত্রী রহিমাকে তার মা মৃতুর সময় এক জোড়া কানের দুল দিয়েছিল। আবুল অগত্যা মায়ের শেষ স্মৃতি রহিমার কানের দুল বিক্রি করে চাউল কিনে এনেছিল।

সেই স্মৃতি হারানোর বেদনা রহিমা এখনো ভুলতে পারে না। আবুল এসব স্মৃতি ভুলে যেতে চায়, সে একটু ঘুমাতে চায় কিন্তু তার চোখে ঘুম আসছে না বার বার করে অতীতের স্মৃতিগুলোই ভেসে উঠছে। তার মন যেন বিদ্রোহ করছে। গতকালের যারা বিরোধী দল আজকে তারা ক্ষমতাসীন দল, আজকে যারা ক্ষমতাসীন দল তারাই হয়ত কোন এক সময়ের বিরোধী দল। সব দলই ক্ষমতা গ্রহণের আগে জনগণকে ভাগ্য পরিবর্তনের আশ্বাস দেয়।

কিন্তু আজ যারা হরতাল ডাকে গাড়ী ভাংচুর করে তারা নিশ্চয়ই জানে গাড়ীটি ক্ষমতাসীন দলের নয়, তার দেশের। আজ যারা হরতাল ডাকে, গাড়ী ভাংচুর করে তারা কি দেশের ভালো চায় নাকি তারাও ক্ষমতা চায়! জনগণকে শাসন-শোষনের ক্ষমতা! দেশকে কুকুর-শেয়ালের মতো ছিঁড়ে খাওয়ার ক্ষমতা!! তাদের ডাকে সাড়া নয় বরং এখনি প্রতিহত করতে হবে। বিভিন্ন দল রাজনীতির নামে বিভিন্ন সময় আন্দোলন করেছে, তাতে সরকার পরিবর্তন হয়েছে মাত্র, জনগণের ভাগ্যের পরিবর্তন হয়নি। ভোটাধিকারের নামে, গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার নামে বিভিন্ন দল অবরোধ করেছে, হরতাল করেছে, গাড়ী ভাংচুর করেছে, দেশের সম্পদ নষ্ট করেছে, দেশের ক্ষতি করেছে, অনেক শ্রমজীবী মানুষকে অনাহারে রেখেছে। কাজেই আর হরতাল নয়, জনগণের ভাগ্য পরিবর্তনের মিথ্যা আশ্বাস নয়, ভাতের অধিকার চাই, ভাতের অধিকার।

বলে চিৎকার করে উঠল আবুল। রহিমার ঘুম ভেঙ্গে যায়, সে জেগে উঠে আবুলকে জিজ্ঞেস করে, কী হয়েছে তোমার? তোমার কি খুব ক্ষিদে পেয়েছে? আবুল একটা শুষ্ক হাসি হেসে বলে, খাবার কি কিছু আছে রহিমা? রহিমা কোন উত্তর দিতে পারে না, তার দু’চোখ দিয়ে কয়েক ফোঁটা তপ্ত পানি গড়িয়ে পড়ে। আবুল রিক্সা চালায়। জীবিকা উপার্জনের জন্য তার একটি রিক্সা ছাড়া আর কিছুই নেই। পরিবারের সদস্য সংখ্যা পাঁচ জন।

দুই ছেলে, এক মেয়ে আর স্বামী-স্ত্রী। বড় ছেলের বয়স বারো বছর, ছোট ছেলের বয়স দশ বছর, সবার ছোট মেয়ের বয়স আট বছর। একটা রিক্সার আয়ে পাঁচ সদস্যের সংসার চালানো বেশ কঠিন হয়ে পড়ে আবুলের পক্ষে। তাই সংসারে সাহায্যে করার জন্য ক্লাস থ্রি পর্যন্ত পড়েই বড় ছেলেটিকে লেখাপড়া বাদ দিতে হয়েছে, সে এখন টেম্পুর হেলপারি করে। বাপ-বেটার আয়ে তবু কোন রকমে সংসার চলে, একদিন অসুস্থ হলেই চুলোয় হাঁড়ি চড়ে না।

সকালবেলা আবুল ফুটপাথে দাঁড়িয়ে ভাবে রিক্সা বের করবে কী না? আরো কয়েকজন রিক্সাওয়ালা এসে দাঁড়ায় আবুলের পার্শ্বে, একজন জিজ্ঞেস করে, ’’ভাইসাব আমরা বাঁচবো কীভাবে? আরো একজন বেশ উত্তেজিত কণ্ঠে জিজ্ঞেস করে, ’’আমরা খাবো কী? ঘরভাড়া দিবো কীভাবে? বাঁচবো কীভাবে? আবুল একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস টেনে বলে, ’’আমিও তাই ভাবছি। ’’ তৃতীয় জন বলল, হ ভাইজান, আমাদের কিছু একটা করা দরকার। কী করবে শুনি? আবুল জিজ্ঞেস করে। আমরা রিক্সা চালাবো, আমরা হরতাল চাই না, আমাদের ভাত চাই, এক যুবক উত্তেজিত কণ্ঠে বলল। একজন বৃদ্ধ প্রতিবাদ করে বলল, এত উত্তেজিত হলে তো চলবে না বাবা, তার চেয়ে চলো আমরা সবাই বসে একটা সিদ্ধান্ত নিই।

সবাই হৈ হৈ করে বৃদ্ধের কথার সঙ্গে একাত্মতা ঘোষনা করলো। কিছুক্ষণ আলাপ-আলোচনার পর সিদ্ধান্ত হলো রিক্সা চালানোর। সবাই যার যার রিক্সা নিয়ে এলো আবুলও রিক্সা নিয়ে রাস্তার মোড়ে এসে দাঁড়ায়। তার সঙ্গে যোগ দেয় মতিন, শফিক, মণ্টু, খলিল, জোবেদ আরো অনেকে। বেশ লম্বাএকটা লাইন হয় রিক্সার।

কয়েকজন সাংবাদিক, ফটোগ্রাফার এসে ছবি তুলতে থাকে। একসময় একজন আবুলকে জিজ্ঞেস করে, আপনারা রিক্সা নিয়ে কোথায় যাচ্ছেন? আপনারার কি হরতাল সমর্থন করেন না? না, আমরা হরতাল মানি না, সবাই সমস্বরে উত্তর দিল। তারপর সবাই রিক্সা চালাতে থাকে। একসময় হঠাৎ কয়েকটা ককটেল বিষ্ফোরিত হয়, সমগ্র এলাকা অন্ধকারাচ্ছন্ন হয়ে যায়। শুরু হয় মারামারি, লাঠির শব্দ, পটকার শব্দ, গোলাগুলি, সমস্ত এলাকা জুড়ে পরিনত হয় রণক্ষেত্রে।

কিছুক্ষণ পরেই থেমে যায় মারামারি, লাঠির শব্দ, পটকার শব্দ, গোলাগুলির শব্দ। রাস্তায় পড়ে থাকে আবুলের স্পন্দনহীন দেহ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।