আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

হেলিকপ্টার

একবার আপনারে চিনতে পারলে রে , যাবে অচেনা রে চেনা

এ সপ্তাহে আখাউড়ায় আসতেই ডাঃ শাহআলম ভাই বললেন তোমাকে দিপু মনির(পররাষ্ট্র মন্ত্রী) প্রোগ্রামে যেতে হবে। পররাষ্ট্র মন্ত্রী এসেছিলেন আগরতলায় । দুই দেশের ব্যবসায়ীদের এক সম্মেলনে। আগরতলা সীমান্তটা পড়েছে আমার থানায়। মন্ত্রী বুধবারে ঢুকেছেন ইন্ডিয়ায়, আজ(বৃহঃবার) বেরুবেন ।

চেকপোস্ট থেকে হেলিকপ্টারে ওঠার আগ পর্যন্ত তার সাথে সাথে থাকবেন প্রশাসনের লোকজন , ডি.সি, এস.পি, পৌরসভার চেয়ারম্যান, উপজেলার চেয়ারম্যান ও আরো কিছু হাবিজাবি মানুষ। আমি ও তাদের একজন । আমার সাথে আমার মেডিকেল এসিস্টেন্ট,দুজন ওয়ার্ডবয়, আমাদের অ্যাম্বুল্যান্স-এর ড্রাইভার । মন্ত্রীর গাড়ী বহরের সদস্য হয়ে অ্যাম্বুল্যান্স নিয়ে ছুটে চলা ও তার সু-স্বাস্থ্য নিশ্চিত করা আমাদের দায়িত্ব। সফেদ এপ্রোন পরে ঘোরাঘুরি করছি ।

ঠিক বর্ডার লাইনের সাথে। মন্ত্রীর জন্য অপেক্ষা। তিনি আসবেন বর্ডার পার হয়ে। আমি তাকিয়ে দেখছি সীমান্তের ওপারের দিকে। ওপারে আমাদের মতই একদল মানুষ।

পেশাগত দায়িত্ব পালনের জন্য এসেছেন। এসে দাঁড়িয়ে দেখছেন এপারের মানুষগুলির দিকে। মাঝখানে নো-ম্যান্স ল্যান্ড । আমাদের সাথে ছিলেন থানার একজন সেকেন্ড অফিসার টাইপ লোক । ভদ্রলোককে মনে হচ্ছে বেশ রসিক।

বার বার আমাকে উদ্দেশ্য করে বলছেন, “স্যার দেখেন আইন কত ন্ষিঠুর !মাত্র বিশগজ দূরত্ব । পাশাপাশি দুটি দেশ ,একইরকম দেখতে দুদেশের মানুষ । কত কাছাকাছি ! অথচ চাইলেই যাওয়া যায় না”। ও পাশের মানুষগুলো ও কি একই রকম ভাবছে ? হয়ত বা। আমাদের জানা হয়না ।

তবে ওদের অভিব্যক্তি দেখলে বোঝা যায়। একজনকে দেখলাম মোবাইল বের করে ছবি তুলছে। আমরা ও ছবি তুলতে লাগলাম। কেমন যেন একটা উত্তেজনা আমাদের মধ্যে কাজ করছিল। আমরা চাইলে আরেকটু পেছনে চেক পোস্টের ক্যাম্পাসে বসতে পারতাম।

বসার মত জায়গা ও ছিল , কিন্তু সবাই ঠিক বর্ডার লাইনে দাঁড়িয়ে । হয়তো সীমান্ত ব্যাপারটাই আমাদের মনকে উত্তেজিত করছিল । সীমান্ত, স্রেফ একটা লাইন কি করে আমাদের আলাদা করে দিল! আমি ভাবছিলাম সীমান্তবর্তী গ্রামগুলির কথা । নিশ্চয়ই দুই গ্রামের মানুষের মধ্যে দেশভাগের আগে কতরকম সম্পর্ক ছিল । বন্ধুত্ব , আত্মীয়তা ,পেশাগত অথবা কিছুই না এমনি যাওয়া আসা।

আজ তারা কত দুরের মানুষ ? যাদের মধ্যে আত্মীয়তা ছিল দেশ ভাগের পর কি জানি কত দূর্ভোগই না হয়েছে। আচ্ছা দুই গ্রামের দুই নর নারীর মধ্যে প্রেম হযনি কখনো? নিশ্চয়ই হয়েছে। হয়তো সেসব নিয়ে অনেক চমকপ্রদ অথবা করুন ঘটনা ও ঘটেছে । সব খবর কি আর মিডিয়ায় আসে! দাঁড়িয়ে এসব ভাবছিলাম হঠাৎএকজন সিভিল ড্রেস পরা আর্মির লোক (চুল দেখে তাই মনে হল ) সম্ভবত ডিজিএফআই জাতীয় কিছু একটা হবে, ভীষণ তটস্থ আর অস্থির হয়ে আমাদের কাছে আসলেন । “এখানে আননেসেসারী ভিড় করবেন না ।

সরে আসেন সরে আসেন”। মাথা মোটা কোথাকার । এখানে দাঁড়ালে কি হবে ? নাশকতা হবে?পেয়েছিস তো একটাই শব্দ। ব্যাটারা কাজের কাজ কিছু পারে না খালি অযথা ফাঁপর? অনেকক্ষণ ধরেই দেখছি সে কেমন উদ্ভ্রান্তের মত ঘোরাঘুরি করছিল । চোখেমুখে আতঙ্ক।

মনে হচ্ছিল যেন এক্ষনি বোমা ফাটবে । সরে এলাম । মাথামোটাদের সাথে কে তক্ক করে ? সাংবাদিক সমীর বাবুর সাথে দেখা। নিউজ কভার করতে এসেছেন আমাকে জানালেন এখানে একটু সামনে ,নো ম্যান্সল্যান্ডে মুক্তিযোদ্ধাদের গণকবর আছে। দু দেশের কেউই ওখানটায় যেতে পারে না।

আহারে দেশ মাতৃকার সবচেয়ে সাহসী সন্তানরা শুয়ে আছে এক অচ্ছুত,নিষিদ্ধ মাটিতে। সেখানে কারো প্রবেশাধিকার নেই । তাদের স্বজনরাও প্রিয় মানুষের কবরের পাশে একটু দাঁড়াতে পারে না। দুদেশের মধ্যে এ নিয়ে কি কোন সমঝোতা হতে পারে না? অন্তত এ জায়গাটা যেন নো-ম্যান্সল্যান্ডের আওতার বাইরে রাখে। কি এমন ক্ষতি হতো! সমীর বাবুকে জিজ্ঞেস করলাম “লিখতে পারেন না এসব নিয়ে”? সমীর বাবু বললেন – “লিখেছি তো ।

কোন কাজ হয়নি। ” আমি বললাম “পররাষ্ট্র মন্ত্রীকে আজ একটু রিকোয়েস্ট করলে হয় না? তিনি যেন এ বিষয়টা নিয়ে একটা বৈঠক করেন”। সমীর বাবু হাসলেন। এ রকম ছোটখাটো বিষয় নিয়ে মিটিং করার সময় কোথায়? দুদেশের মধ্যে অনেক গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু আছে। হঠাৎ লক্ষ্ করলাম, আজকের মিটিং টা যেন কি নিয়ে? তোরণের গায়ে লেখা দেখে বুঝলাম ইন্দো-বাংলা চেম্বার অব ইন্ডাস্ট্রিজ এর ডেলিকেটদের নিয়ে ।

এরকম সময় আমাদের অবাক করে দিয়ে নো-ম্যান্সল্যান্ড পার হয়ে এলেন ত্রিপুরার আগরতলার এসপি । বর্ডার লাইনে দাড়িয়ে প্রথমে কুশল বিনিময় করলেন । বললেন বাংলাদেশে যেতে তার খুবই ইচ্ছা করে। কিন্তু পারেন না। বাংলাদেশের ব্রাহ্মণবাড়ীয়া জেলায় তার বাপ-দাদার বাড়ী ছিল।

আমাদের পুলিশ অফিসারটি বললেন “ভাই সামনেই আমাদের থানা, আইসেন, চা খেয়ে যাইয়েন”। ওপারের অফিসাররা বললেন আসবো । আপনারা ও আসবেন । বলেই দু’পক্ষ হেসে ফেললো । আমরা ও হাসলাম ।

আমাদের ডিজিএফআই অবশ্য হাসেন নি । একটু মনে হল কনফিউজড। ‘হাসি’ ‘না-হাসি’র মাঝামঝি। ওর জন্য এটাই অনেক। যা তোকে মাফ করে দিলাম।

কিছুক্ষণের মধ্যে আমাদের মন্ত্রী হেঁটে এলেন চেকপোস্ট পার হয়ে । সাথে ত্রিপুরার রাজ্যসরকারের কোন এক মন্ত্রী , মূখ্যমন্ত্রীও হতে পারে। চেহারায় মণিপুরী ভাব। ওকে দেখে রাজা বীরচন্দ্র মাণিক্যের কথা মনে পড়লো। মন্ত্রীকে আমাদের বর্ডার গেট পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে গেলেন।

বললেন “আপনাদের মানুষ আপনাদের কাছে ফিরিয়ে দিয়ে গেলাম”। আমাদের সাথে ছিলেন ব্রাহ্মণবাড়ীয়া জেলার ডিসি সাহেব। ভদ্রলোক তেলে বিগলিত হয়ে উত্তর দিলেন “আমরা অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছি আমাদের মানুষের জন্য”। ডিসি সাহেবের বলার ভঙ্গি শুনে মনে হল উনি কবিতার একটি লাইন আবৃত্তি করলেন এবং এই কবিতার আবৃত্তি যত সুললিত হবে ততই তার উন্নতি। এরা কত ঢং যে জানে! গাড়ী বহর নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছি গ্রামের পথ ধরে।

সামনেই একটি উন্মূক্ত মাঠে হেলিপ্যাড বসানো হয়েছে। ওখানে একটি হেলিকপ্টার অপেক্ষা করছে মন্ত্রীর জন্য। গ্রামের অসংখ্য নারী-পুরুষ-শিশু দাঁড়িয়ে আছে রাস্তার দুধারে, খোলামাঠটিকে ঘিরে। এই গ্রামে আজ একটা হেলিকপ্টার এসেছে। কত বড় ঘটনা! ইন্দোবাংলা চেম্বার অব ইন্ডাস্ট্রিজ কি জিনিস এরা কি বোঝে? ফরেন মিনিস্টারই বা কি জিনিস? হেলিকপ্টারটি উড়ে গেল।

একদল বাচ্চাকাচ্চা নিরাপত্তার বেষ্টনী ভেংগে আনন্দে চিৎকার করতে করতে দৌড়ে ছুটে গেল হেলিকপ্টারের পেছন পেছন। দৌড়ে গেল মাঠ পেরিয়ে ধানী জমির সরু আলপথ ধরে ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।