আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

রাষ্ট্রের বিকাশ নির্ভর করে সঠিক করব্যবস্থার ওপর

প্রতিদিন যা পড়ি পত্রিকার পাতায়, ভাললাগা-মণ্দলাগা সবই শেয়ার করি সবার সাথে।

দি চ্যালেঞ্জ বইয়ে মাহাথির মোহাম্মদ আধুনিক মালয়েশিয়ার রূপকার মাহাথির মোহাম্মদ তাঁর লেখা বই 'দি চ্যালেঞ্জ'-এর দ্বিতীয় অধ্যায়ে দেখিয়েছেন, বস্তুবাদ কিংবা সমাজতন্ত্র নয় বরং একটি রাষ্ট্রের প্রকৃত বিকাশ নির্ভর করে স্বচ্ছ ও জবাবদিহিমূলক করব্যবস্থার ওপর। তাঁর লেখা থেকে আরো জানা যায়, একটি রাষ্ট্রে ধনী ব্যক্তি কখনোই গরিবের শত্রু নয়। বরং দেশ ও সমাজের অগ্রগতির স্বার্থেই ধনী ব্যক্তিদের উপস্থিতি দরকার। তিনি বলেছেন, বস্তুবাদী চিন্তাচেতনায় মানুষের সুখকে সম্পদ দিয়ে বিচার করা হয়।

অন্যদিকে বস্তুবাদের বিরুদ্ধে সমাজতন্ত্রীদের প্রচারণা হলো, 'বস্তুবাদ ধনীকে আরো ধনী আর গরিবকে আরো গরিব করে। ' কিন্তু শেষ বিচারে এর কোনোটিই মালয়েশিয়ার সামাজিক কাঠামোর জন্য সুফল বয়ে আনতে পারবে না বলে মাহাথির এক নতুন ব্যবস্থাপনায় হাত দেন। তিনি সমাজতান্ত্রিক দেশের মতো সবার ওপর করারোপ করেননি। মাহাথির দেখিয়েছেন, তুলনামূলক কম আয়ের ব্যক্তির বার্ষিক আয় কর দেওয়ার পর যা থাকে, তার পরিমাণ ক্ষেত্রবিশেষে বেকার ভাতার চেয়ে কম হয়। ফলে এই জনগোষ্ঠী কাজের প্রতি উৎসাহ হারিয়ে বরং বেকার ভাতা পেতে পছন্দ করছে।

এর একটি সামগ্রিক বিরূপ প্রভাব অর্থনীতিতে পড়ে। এ ছাড়া বস্তুবাদ থেকে বেরিয়ে আসতে চাইলেও সমাজতান্ত্রিক দেশগুলোতেও মানুষ নিজেদের অবস্থা ও অবস্থানের মূল্যায়ন করতে গিয়ে বস্তুর মূল্যকেই গুরুত্ব দিচ্ছে। অন্যদিকে যেহেতু তারা ধর্মকে বর্জন করছে তাই মনের শান্তির জন্য তারা দ্বিতীয় কোনো উপায় খুঁজে পেতেও ব্যর্থ হচ্ছে। আর বস্তুবাদী দেশগুলোর নানা অসঙ্গতিও তাকে সে পথে অগ্রসর হতে বাধা দেয়। মাহাথির দেখেছেন, মালয়েশিয়ায় একজন ব্যক্তি যদি নিয়মিত কাজ করেন, তবে তার পক্ষে গরিব হওয়া কখনো সম্ভব নয়।

তার আয় বাড়বেই। কিন্তু আয় বাড়লেই যে তার ক্রয়ক্ষমতা বাড়বে তা কিন্তু নয়। এর কারণ, মানুষের যখন আয় বাড়ে তখন তার চাহিদাও বাড়ে। চাহিদার সঙ্গে আয়ের সামঞ্জস্য যখন ঘটে না, তখনই তার মধ্যে অতৃপ্তি ঘটে। মাহাথির মালয়েশিয়ায় যেমনটা দেখেছেন, বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এ কথা এখন অনেকাংশে সত্য।

যেমন_আমাদের দেশের গ্রামের মানুষগুলো আগে গ্রামে ডাক্তার দেখাত। এখন তারা সদর হাসপাতালে যায়। একসময় বাড়িতে কেরোসিনের কুপি জ্বালাত, এখন বৈদ্যুতিক বাতি চায়। কিংবা মোবাইল ফোন থাকার কারণে ব্যাটারি চার্জ দেওয়ার জন্যও বিদ্যুতের দরকার হচ্ছে। এমনিভাবে গ্রামের মানুষের চাহিদাগুলো বাড়ছে।

মাহাথির একে বলেছেন 'চাহিদার ক্ষেত্রে বিপ্লব ঘটা'। আর এই বিপ্লবই তার বাড়তি আয়কে অপর্যাপ্ত আয় হিসেবে চিহ্নিত করছে। বাস্তবিক অর্থে তার আয় কিন্তু কমছে না। অতএব ধনী আরো ধনী হচ্ছে কিংবা গরিব আরো গরিব হচ্ছে_এমন একটি সহজ ও শস্তা স্লোগান যাঁরা দেন, তাঁরা আসলে মানুষকে ভুল বোঝাতে চান। মাহাথির বলেছেন, যদি সঠিকভাবে কর আদায় করা যায় তবে ধনী ও গরিবের অর্থের যে বৈষম্য সেটি অনেকাংশে কমে আসে।

যেমন_আমাদের দেশে মোট আয়ের ওপর ২৫ শতাংশ পর্যন্ত ব্যক্তিগত আয়কর দিতে হয়, অন্যদিকে যার আয় এক লাখ ৫০ হাজার টাকার কম, তাকে কোনো আয়কর দিতে হচ্ছে না। মাহাথির বলেছেন, শুধু আয়কর দেওয়ার ক্ষেত্রেই ধনীদের অবদান সীমিত নয়। একজন ধনী ব্যক্তির জীবনযাপনের খরচও আয়করের আওতাভুক্ত নন এমন একজন মানুষের চেয়ে বেশি হয়। তার জীবনযাপনের ধরনই গরিবের আয়ের উৎসে পরিণত হয়। মাহাথির বলেছেন, ধনবান ব্যক্তিরা যদি সমাজে না থাকে তবে গরিব মানুষগুলো আরো বেশি গরিব হয়ে যাবে।

ধনবান মানুষের কর্মকাণ্ড তাদের জন্য শ্রম বিক্রির উপায় তৈরি করছে। ধরা যাক, একজন বিত্তশালী মানুষ বছরে এক কোটি টাকা আয় করেন। যদি ফ্ল্যাট রেটে তাঁকে বার্ষিক ২৫ লাখ টাকা আয়কর দিতে হয়, তবে তাঁর কাছে যে ৭৫ লাখ টাকা থাকবে সেটি দিয়ে তিনি তাঁর গাড়ির ড্রাইভার, বাগানের মালি, গৃহকর্মীর বেতন ইত্যাদি খাতে ব্যয় করবেন। তার মানে তাঁর আয়ের অর্থে কয়েকজন মানুষের কর্মসংস্থান হলো, অন্যথায় যারা চাকরিবিহীন থাকতে পারত। এরপর তিনি প্রতিমাসে বিলাসদ্রব্য কিনবেন।

তিনি যা কিনবেন সেগুলোর ওপর ভ্যাট ও ট্যাক্স থাকায় রাষ্ট্রের কোষাগারে তিনি অর্থ দিতে বাধ্য। তিনি যে দোকানগুলো থেকে পণ্য কিনছেন সেগুলো আয় করে আবার সরকারকে আয়কর দিচ্ছে। দোকানে কিছু লোকের কর্মসংস্থান হচ্ছে। আবার দোকানদার যে পণ্যটি বিক্রি করছেন সেই পণ্যটি যে কারখানায় তৈরি হয় সেই কারখানায় কর্মসংস্থান হচ্ছে। সেই কারখানার মালিক আবার তাঁর আয়ের ওপর কর দিচ্ছেন।

এভাবে একজন ধনী লোকের অর্থ ব্যয়ের সুবাদে অনেকগুলো অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড চক্রাকারে ঘুরছে, যেখান থেকে সমাজের গরিব মানুষগুলো আর্থিকভাবে লাভবান হচ্ছে। এমনকি ওই ধনী ব্যক্তি সব ধরনের খরচ করার পর যে অর্থ ব্যাংকে রাখবেন, তার লভ্যাংশের ওপরও কর থাকায় রাষ্ট্র আর্থিকভাবে লাভবান হবে। রাষ্ট্র কর হিসেবে অর্জিত অর্থ দিয়ে সামাজিক সুরক্ষামূলক কাজগুলো করতে পারছে। আবার ধনী ব্যক্তির জমাকৃত অর্থ ব্যাংক বিভিন্ন ধরনের কাজে ব্যবহারের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠানগুলোকে সচল রাখছে। মাহাথির বলেছেন, একটি রাষ্ট্রের প্রশাসন যখন স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার মধ্য দিয়ে সঠিকভাবে করারোপ করে এবং কর আদায় করে তখন রাষ্ট্রের ধনী ব্যক্তিরা প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে রাষ্ট্রের দরিদ্র মানুষের উপকারে আসতে বাধ্য হন।

প্রত্যক্ষভাবে তাঁরা অন্যের জন্য চাকরির ক্ষেত্র তৈরি করেন, আবার পরোক্ষভাবে তাঁদের দেয়া অর্থে দেশে হাসপাতাল, বিদ্যালয় ও রাস্তাঘাট তৈরি হয়, যা সরকার বাস্তবায়ন করে থাকে। মাহাথির মালয়েশিয়ায় নিম্ন আয়ভুক্ত মানুুষের ওপর থেকে কর লোপ করে ধনীদের ওপর উচ্চ কর আরোপ করেছেন। ফলে সমাজতান্ত্রিক দেশে যে অসন্তোষ তৈরি হয়ে থাকে সেটি যেমন মালয়েশিয়ায় হয়নি, তেমনি বস্তুবাদী দেশগুলোতে ধনী-গরিবের মধ্যে যে বিপুল বৈষম্য সেটি থেকেও মাহাথির মালয়েশিয়াকে মুক্ত করতে পেরেছিলেন।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.