আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

পুলিশি রাষ্ট্রের প্রতিচ্ছবি

নিপীড়নের মাধ্যমে বিরোধী রাজনৈতিক দলকে দমনের যে কৌশল সরকার নিয়েছে তাতে সাধারণ মানুষ এখন অত্যাচার ও নির্যাতনের শিকার হচ্ছে। পুলিশ বিরোধী দল দমনে দক্ষতা দেখাতে গিয়ে হাজার হাজার লোককে গ্রেফতার করছে, যাদের সাথে রাজনীতির সরাসরি কোনো সম্পর্ক থাকছে না। এমনকি পুলিশি নির্যাতনের হাত থেকে রক্ষা পাচ্ছে না শিশু-কিশোরেরা পর্যন্ত। গত সপ্তাহে এই কলামে ছাত্রলীগের একজন অস্ত্রধারী নেতার ও এক কিশোরের ছবি ছাপা হয়েছিল। এই কিশোরকে শিবিরকর্মী পরিচয় দিয়ে বলা হয়েছিল, পুলিশের দিকে ঢিল ছোড়ার অপরাধে তাকে গ্রেফতার করা হয়েছে।

অপর দিকে ছাত্রলীগের অস্ত্রধারী নেতাকে হাসপাতালে দেখতে গেছেন মন্ত্রী, যার বিরুদ্ধে তার দলের একজন কর্মীকে হত্যার অভিযোগে মামলা রয়েছে। কিশোরটি যে মাদরাসার ছাত্র সেই মাদরাসার অধ্যক্ষ জানিয়েছেন, যে কিশোরের ছবি ছাপা হয়েছে সে শিবির বা অন্য কোনো সংগঠনের সাথে জড়িত নয়। মাদরাসার অধ্যক্ষ লিখিতভাবে জানিয়েছেন পুলিশের হাতে ধৃত সাদা পাঞ্জাবি পরিহিত যে কিশোরকে শিবিরকর্মী ও পুলিশের প্রতি ঢিল নিক্ষেপকারী বলে পরিচয় করিয়ে দেয়া হয়েছে, সে কোনো সংগঠনের কর্মী নয় এবং পুলিশের প্রতি কোনো ঢিলও ছোড়েনি। এই কিশোরের নাম ওবায়দুল্লাহ মাসুম। তার বয়স ১৫।

সে ঢাকার উত্তরা ২ নম্বর সেক্টর (র‌্যাব-১ সংলগ্ন) বাইতুস সালাম মাদরাসার চতুর্থ শ্রেণীর ছাত্র। ঘটনার দিন কিতাব কেনার জন্য সে রাজলক্ষ্মী মার্কেটের পেছনে নিগার প্লাজার একটি দোকানের উদ্দেশে রওনা দিয়েছিল। কিছু দূর গিয়ে পুলিশ ও জামায়াত-শিবিরের সংঘর্ষের কথা শুনতে পেয়ে সে আর সামনে না এগিয়ে ফেরার পথে রওনা দেয়। সংঘর্ষের স্থান থেকে সে এবং তার সাথীরা ছিল অনেক দূরে। ফেরার পথে পুলিশ এই নিরীহ নিরপরাধ কিশোরসহ মাদরাসার আরো তিনজন ছাত্রকে সম্পূর্ণ বিনা কারণে ও বিনা অপরাধে গ্রেফতার করে নিয়ে যায় এবং তাদের নামে কোর্টে চারটি মামলা ঠুকে দেয়।

এ হলো প্রকৃত ঘটনার বিবরণ। মাদরাসার অধ্যক্ষ বলছেন, তাকে শিবিরকর্মী এবং পুলিশের প্রতি ঢিল নিক্ষেপকারীরূপে পরিচিত করার বিষয়টিতে তারা অত্যন্ত মর্মাহত। আমরাও মাদরাসার অধ্যক্ষের মতো একজন নির্দোষ কিশোর এভাবে নির্মম পরিস্থিতির শিকার হওয়ার জন্য মর্মাহত। জামায়াত ও শিবিরের মিছিলে পুলিশের আক্রমণের পর এই গ্রেফতারের ঘটনার কারণে ছবিটিতে ভুলবশত শিবিরকর্মী হিসেবে পরিচয় দেয়া হয়েছে। এ ঘটনার মধ্য দিয়ে আমরা পুলিশি নিপীড়নের একটি চিত্র দেখতে পেলাম।

প্রতিবাদপত্রটি পাওয়ার পর মাদরাসার অধ্যক্ষ মুফতি আব্দুল হাইয়ের সাথে যোগাযোগ করলে এই শিশুর ওপর অমানবিক আচরণের আরো কিছু তথ্য পাওয়া গেল। শিশু আইন ১৯৭৪ অনুযায়ী বাংলাদেশে ১৬ বছর পর্যন্ত বয়স্কদের শিশু হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। শিশুদের ব্যাপারে আইনি প্রক্রিয়া নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশনা রয়েছে এই আইনে। পুলিশের হাতে আটক ওবায়দুল্লাহ মাসুম আইন অনুযায়ী একজন শিশু। কিন্তু পুলিশ এই শিশুটির বিরুদ্ধে যে চারটি মামলা দায়ের করেছে, তার দু’টি হয়েছে দ্রুত বিচার আইনে।

শিশুটির বিরুদ্ধে বিস্ফোরক বহন, গাড়ি ভাঙচুর এবং পুলিশের কর্তব্যকাজে বাধা দেয়ার মতো গুরুতর সব অভিযোগ আনা হয়েছে। এই শিশুটির আরো দুই সহপাঠী মুশফিকুর রহমান ও লোকমান হাকিমকেও গ্রেফতার করা হয়। এই দু’জনের বয়স যথাক্রমে ১৪ ও ১৫। তিনজনের মধ্যে আবার দু’জন এতিম। গ্রেফতারের পর তাদের ঘাড়ে ও মাথায় লাঠি দিয়ে আঘাত করা হয় এবং পেটানো হয়।

আরো বেদনাদায়ক ব্যাপার হচ্ছে, এই শিশুদের দুই দফায় পুলিশি রিমান্ডেও নেয়া হয়েছে। তাদের ডাণ্ডাবেড়ি পরিয়ে রাখা হয়। গত সোমবার পর্যন্ত এই তিন শিশুছাত্র পুলিশি রিমান্ডে থানায় ছিল। যে শিশুরা মিছিলেই যায়নি, তাদের বিরুদ্ধে এত সব অপরাধের অভিযোগ। এদের মানসিক অবস্থা কল্পনা করতেও কষ্ট হয়।

জীবনের শুরুতে তাদের বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ আনা হয়েছে, যার অনেক কিছুর গুরুত্বই তারা বোঝে না। পুলিশ দেখলে এ বয়সের শিশুরা এমনিতে পালিয়ে যেতে চেষ্টা করে। এদের পাঞ্জাবি ধরে টেনে-হিঁচড়ে যেভাবে থানায় নিয়ে রিমান্ডের নামে নির্যাতন করা হচ্ছে, তা ভাবলেও গা শিউরে ওঠে। সর্বাত্মক প্রতিহিংসার মানসিকতা নিয়ে একটি রাজনৈতিক দলকে দমনের নামে পুলিশ এখন শিশুদের ওপর নিপীড়ন করে বীরত্ব দেখাচ্ছে। অথচ এই পুলিশকে ক্ষমতাসীন দলের অস্ত্রধারী সন্ত্রাসীদের পাশে রেখেই বিরোধী দল দমনের মহড়া দিতে হচ্ছে।

এই শিশুদের গ্রেফতারের পর নির্যাতন, ডাণ্ডাবেড়ি পরানো এবং পুলিশি রিমান্ডে নিয়ে খোদ পুলিশই আইন ভঙ্গ করেছে। বাংলাদেশে শিশুদের জন্য কী আইনি সুরক্ষা দেয়া হয়েছে, আমরা তা দেখে নিই। ১৯৭৪ সালের শিশু আইনের ৪ ধারা অনুযায়ী শিশুদের অপরাধের বিচার কেবল শিশু আদালতেই হবে। ধারা-৬ অনুযায়ী কোনো শিশুকে প্রাপ্তবয়স্কদের সাথে যৌথভাবে বিচার করা চলবে না। ধারা-১৩ অনুযায়ী শিশুকে গ্রেফতার করা হলে থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা শিশুর পিতামাতা বা অভিভাবককে তার গ্রেফতারের বিষয় অবহিত করবেন।

যে আদালতে শিশুটিকে হাজির করা হবে, আদালতে হাজির হওয়ার তারিখ পিতামাতা বা অভিভাবককে জানিয়ে ওই সময় ও স্থানে হাজির থাকতে বলবেন। ধারা-৩৪ অনুযায়ী যার হেফাজত, দায়িত্ব বা তত্ত্বাবধানে কোনো শিশু রয়েছে এরূপ কোনো ১৬ বছরের ওপর বয়স্ক ব্যক্তি যদি অনুরূপ শিশুকে এরূপ পন্থায় আক্রমণ, উৎপীড়ন, অবহেলা, বর্জন অথবা অরতি অবস্থায় পরিত্যাগ করে অথবা করায় যা দ্বারা শিশুটির অহেতুক দুর্ভোগ কিংবা তার স্বাস্থ্যের তি হয় এবং তার দৃষ্টিশক্তি ও শ্রবণশক্তি নষ্ট হয়, শরীরের কোনো অঙ্গ বা ইন্দ্রিয়ের তি হয় এবং কোনো মানসিক বিকৃতি ঘটে তাহলে ওই ব্যক্তি দুই বছর পর্যন্ত মেয়াদে কারাদণ্ড অথবা এক হাজার টাকা পর্যন্ত অর্থদণ্ড অথবা উভয় দণ্ডে দণ্ডনীয় হবে। ধারা-৪৮ অনুযায়ী যে েেত্র আপাতদৃষ্টিতে ১৬ বছরের কম বয়স্ক কোনো ব্যক্তিকে জামিন অযোগ্য অপরাধের দায়ে গ্রেফতার করা হয় এবং অবিলম্বে আদালতে হাজির করা না যায়, সে েেত্র থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা তাকে জামিনে খালাস দিতে পারেন। ধারা-৫১(২) অনুযায়ী কারাদণ্ডে দণ্ডিত কোনো কিশোর অপরাধীকে বয়স্ক আসামির সাথে মেলামেশা করতে দেয়া যাবে না। ধারা-৫৫ কোনো শিশু অপরাধ করেছে বা করতে পারে এরূপ মনে করলে তাকে নিরাপদ স্থানে নেয়া যাবে, কিন্তু এরূপ আটক রাখার মেয়াদ ২৪ ঘণ্টার বেশি হবে না।

ধারা-৫৭ শিশু কোনো অপরাধ করলে অবশ্যই তাকে শিশু আদালতে প্রেরণ করতে হবে। যেখানে শিশু আদালত নেই, সেখানে ৪ ধারার অধীনে মতাপ্রদত্ত আদালতে হাজির করতে হবে। এই শিশুদের গ্রেফতারের পর পুলিশের নির্যাতন, মামলা দায়ের, রিমান্ডে নেয়া এবং জামিন না দেয়ার মাধ্যমে শিশুদের জন্য বাংলাদেশের বিদ্যমান আইন লঙ্ঘন করা হয়েছে। বাংলাদেশে এখন আইন যারা প্রয়োগ করবেন তারাই আইন লঙ্ঘন করছেন। আইনের রক্ষক হয়ে উঠেছেন ভক্ষক।

গণতান্ত্রিক বলে দাবিদার সরকারের আমলেও বাংলাদেশ যেন হয়ে উঠেছে একটি পুলিশি রাষ্ট্র। বিশেষ করে বিরোধী রাজনৈতিক দলকে দমনের রাষ্ট্রীয় কর্মসূচি গ্রহণের পর থেকে সারা দেশে যে গণগ্রেফতার শুরু হয়েছে তাতে সাধারণ মানুষের জীবন অনিরাপদ হয়ে উঠেছে। কে কোথায় জামায়াত-শিবির হিসেবে গ্রেফতার হচ্ছেন, তার কোনো ইয়ত্তা নেই। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও এলজিআরডি মন্ত্রী বলছেন, জামায়াত-শিবিরকে নিষিদ্ধ করা হবে না বা সে ধরনের কোনো পরিকল্পনা সরকারের নেই। অথচ পুলিশকে এমন নির্দেশনা দেয়া হয়েছে যাতে মনে হয়, জামায়াত-শিবিরের রাজনীতি যারা করছেন তারা অপরাধী।

ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের একজন কর্মকর্তা টেলিভিশনের সামনে প্রায়ই জামায়াত-শিবির ধরার কৃতিত্ব জাহির করেন। কী অপরাধে তাদের ধরা হয় তার কোনো সুস্পষ্ট বক্তব্য নেই। সেই পুরনো রেকর্ড বাজে, ‘নাশকতার আশঙ্কা’। আবার কোনো মেস বা বাসাবাড়িতে বই পেলে বলা হচ্ছে জিহাদি বইসহ গ্রেফতার। জিহাদ বা এই জিহাদি বইয়ের সংজ্ঞা কী? ইসলামের ওপর লেখা বই বা কুরআন-হাদিস পাওয়া গেলে তাকে জিহাদি বই বলার কী উদ্দেশ্য তা আজো স্পষ্ট নয়।

সরকার তো ইচ্ছে করলেই নিষিদ্ধ বইয়ের তালিকা প্রকাশ করতে পারে। এ দেশে ইসলামসংক্রান্ত কোনো বই পড়া আইনের দৃষ্টিতে অপরাধ নয়। যতক্ষণ পর্যন্ত কোনো বই আইনের পরিপন্থী হওয়ায় নিষিদ্ধ করা না হচ্ছে ততক্ষণ পর্যন্ত কোনো বই পড়া বা সংগ্রহে রাখা বেআইনি নয়। অথচ কথিত জিহাদি বইয়ের এমন প্রচারণা চালানো হচ্ছে যেন ইসলামসংক্রান্ত কোনো বই রাখা অপরাধ। জামায়াত-শিবিরের বিরুদ্ধে সরকারের ক্র্যাকডাউন শুরু হওয়ায় এই মাদরাসার শিশুদের মতো অনেক বৃদ্ধ লোকও নির্যাতন ও হয়রানির শিকার হয়েছেন ও হচ্ছেন।

অনেক লোককে নামাজের সময় বা দাড়ি-টুপি দেখে গ্রেফতার করা হয়েছে। অনেক ছাত্রাবাস থেকে ভিন্ন ছাত্রসংগঠনের বা সাধারণ ছাত্রদের গ্রেফতার করা হয়েছে। এর মধ্যে ছাত্রলীগের নেতা ও ওয়ার্কার্স পার্টির কর্মীও রয়েছে। এ ধরনের দমননীতির মাধ্যমে ক্ষমতাসীন দল বা সরকারের কী লাভ হচ্ছে আমাদের জানা নেই। তবে এ কথা হলফ করে বলা যায়, পুলিশ বা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাবাহিনীর প্রতি মানুষের ক্ষোভ ও ঘৃণাই শুধু বাড়ছে।

পুলিশ সদস্যদের বলব, যে শিশুদের গ্রেফতার করে ডাণ্ডাবেড়ি পরিয়ে নির্যাতন চালানো হলো, সেই শিশুরা আমৃত্যু পুলিশ সম্পর্কে কী ধারণা পোষণ করবেÑ তা যেন একবার ভেবে দেখেন। অথবা নিরপরাধ যে প্রবীণ লোকটিকে মসজিদে যাওয়ার সময় গ্রেফতার করা হচ্ছে, পুলিশ সম্পর্কে তার কী মনোভাব দাঁড়াবে। পুলিশকে সরকারি নির্দেশ মানতে হয়। কিন্তু এ কথাও ভুলে গেলে চলবে না, পুলিশ বা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাবাহিনী রাষ্ট্রের চাকরি করে, সরকারের নয়। তারাও আইনের ঊর্ধ্বে নয়।

নাগরিকদের মর্যাদা ও অধিকার রক্ষা করার দায়িত্ব তাদের। অতি উৎসাহী নিপীড়নমূলক তৎপরতা তাদের ভাবমর্যাদা শুধু ুণœই করবে না, তাদের প্রতি জনগণের ঘৃণা ও বিরূপ মনোভাবও বাড়াবে। রাষ্ট্রের নাগরিকদের এ ধরনের মনোভাব তাদের পেশাগত দায়িত্ব পালনে শুধু প্রতিবন্ধক নয়, সামগ্রিকভাবে রাষ্ট্রের জন্যও বিপজ্জনক। পুলিশ যেন কোনো সরকারের রাজনৈতিক এজেন্ডা বাস্তবায়ন করতে গিয়ে রাষ্ট্রের জন্য বিপদ ডেকে না আনে। ।

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.