আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলো

বাংলা আমার দেশ

: একাত্তরে আমার বয়স ছিল ২৪-২৫। একেবারে তরতাজা যুবক। ছাত্ররাজনীতির সঙ্গে জড়িয়ে থাকার সুবাদে দেশের দ্রুত পরিবর্তনশীল পরিস্থিতির ওপর নজর ছিল। মনে হচ্ছিল, দেশটির ওপর এক ঝড় বয়ে যাবে। এ ঝড়ে অনেক কিছু ওলটপালট হবে।

আর এর ফলে আমরা স্বাধীন দেশ পাব। আবার এ পাওয়াটা যে সহজ হবে না, তাও বুঝতে পারছিলাম। কারণ আমি যে রাজনৈতিক সংগঠনের সঙ্গে জড়িয়ে ছিলাম, তারা আসন্ন এই লড়াইকে উগ্র জাতীয়তাবাদী রাজনীতির ফল বলে বোঝাতে চাইছিল। একপর্যায়ে তারা সিদ্ধান্ত নেয়, আমরা (রাজনৈতিক দল) স্বতন্ত্র অবস্থান বজায় রাখব। জাতীয়তাবাদী ঘরানার রাজনৈতিক আন্দোলন ও সশস্ত্র সংগ্রামের মধ্য দিয়ে হয়তো স্বাধীন দেশ পাওয়া সম্ভব, কিন্তু আমাদের লক্ষ্য শ্রমিক-কৃষকের রাজ তথা সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা যাবে না।

এ রাজনৈতিক অবস্থানের সঙ্গে আমিসহ কয়েক বন্ধু একমত হতে পারিনি। আমাদের কথা ছিল, অবশ্যই আওয়ামী লীগের স্বাধীনতার লড়াই-সংগ্রামটি জাতীয়তাবাদী; তারা শ্রমিক-কৃষকের অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে চায় না। তারা সমাজতন্ত্র চায় না। কিন্তু আওয়ামী লীগের আহ্বানে, বিশেষত দলটির নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আহ্বানে মানুষ মাতোয়ারা। মানুষ তাঁর কথা শুনছে, তাঁর কথায় আন্দোলিত, মানুষ তাঁর আহ্বানে মরতে প্রস্তুত।

আমরা আমাদের রাজনৈতিক চিন্তা দিয়ে মানুষকে এতটা প্রভাবিত করতে পারিনি। মানুষ আমাদের কথা শুনছে না। ফলে আমাদের উচিত সাধারণ মানুষের সঙ্গে থাকা। এই মুহূর্তে স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষায় উদ্বেলিত মানুষের কাতার থেকে ফিরে আসা উচিত নয়। এই চিন্তা থেকেই আমি আমার বন্ধুদের সংগঠিত করতে থাকি।

তাদের আত্দরক্ষামূলক নানা কৌশলে উদ্দীপ্ত ও প্রশিক্ষিত করতে থাকি। এখানে আমার একটি সুবিধা ছিল। পাক-ভারত যুদ্ধকালে আইয়ুব খান কিশোর-ছাত্রদের সংগ্রহ করে মুজাহিদ বাহিনী গড়ে তুলেছিল। আমি সেই মুজাহিদ বাহিনীতে অংশ নিই। এ কারণে আমার আগ্নেয়াস্ত্রের প্রশিক্ষণ ছিল, খালি হাতে আত্দরক্ষামূলক নানা কৌশল জানা ছিল।

আমার জানা কৌশলগুলোই আমার বন্ধুদের আয়ত্ত করাই। সেটি একাত্তরের শুরুর পর্বে। এরই মধ্যে শুরু হয়ে যায় পাকিস্তানি সেনাদের নির্মম নিধনপর্ব। আর গ্রামাঞ্চলে পাকিস্তানিদের সহযোগী এবং সুযোগসন্ধানীরা শুরু করে লুটপাট। আর লুটপাটের অন্যতম লক্ষ্য ছিল হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের সম্পদ করায়ত্ত করা।

আমার জন্ম ও বেড়ে ওঠা যে অঞ্চলে সেই ডুমুরিয়ায় হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের সংখ্যা বেশি। আমারও বেড়ে ওঠা তাদের সঙ্গে। বন্ধুদের বেশির ভাগ হিন্দু ঘরের সন্তান। তাদের ওপর আক্রমণে আমরা আরও বেশি সংগঠিত হই। প্রথমদিকে আমরা লুটেরাদের বাধা দেওয়ার চেষ্টা করি, কিন্তু বিফল হই।

সময়টা তখন আমাদের পক্ষে ছিল না; আর আমরা একেবারে নগণ্য কয়েকজন সংগঠিত মানুষ। আর আশ্চর্যজনকভাবে যে আওয়ামী লীগের নেতাদের লুটেরাদের প্রতিরোধে এগিয়ে আসার দরকার ছিল, তারা পালিয়ে আত্দরক্ষা করে। আর অনেকেই এক ধরনের নীরবতার নীতি অনুসরণ করে। ফলে প্রায় বাধাহীনভাবে লুটেরাগোষ্ঠীটি তাদের কর্মকাণ্ড চালিয়ে যেতে থাকে। আমরা সেই অবস্থায় দলবদ্ধভাবে ভারতে পাড়ি জমাই।

আমাদের এই দলে ছিল ২০ থেকে ২৫ জন। বয়সের কারণে স্মৃতি বেশ ঝাপসা হয়ে আসায় দিন-তারিখ ও সংখ্যা স্পষ্ট মনে নেই। আমরা ভারতে গিয়ে টাকীতে ঠাঁই নেই। প্রথমদিকের চেষ্টা ছিল অস্ত্র জোগাড় করা এবং বাংলাদেশের মধ্যে প্রবেশ করে সাতক্ষীরার সীমান্তজুড়ে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর ঘাঁটিগুলোতে আক্রমণ করা। প্রথম প্রথম সহযোগিতা পেতে খুব কষ্ট হয়।

একপর্যায়ে ভারতীয় বিএসএফের (বর্ডার সিকিউরিটি ফোর্স) সঙ্গে আমাদের সমঝোতা গড়ে ওঠে। এই সমঝোতার বুনিয়াদে আমরা কিছু অস্ত্র-গোলাবারুদ জোগাড় করতে সক্ষম হই। বিএসএফের সঙ্গে আমাদের অলিখিত সমঝোতা হয়, আমরা বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিওপিগুলোতে আক্রমণ করব। বিএসএফ আমাদের পেছনে থেকে সহযোগিতা করবে। এতে আমরা আক্রমণের পুরোভাগে থাকলেও বিএসএফ আমাদের প্রতি-আক্রমণ থেকে রক্ষার জন্য কভারেজ দেবে।

এই সমঝোতায় আমরা শমসেরনগর, বৈকারী, হিঙ্গলগঞ্জ, কাকডাঙ্গা, হাকিমপুর, ভাদলি প্রভৃতি জায়গায় আক্রমণ করি। সেপ্টেম্বর, অক্টোবর, নভেম্বর মাসের দিকে মুখোমুখি লড়াইগুলো ছিল ভয়ঙ্কর। এ সময় পাইকগাছায় বেশ কয়েকটি মুখোমুখি যুদ্ধ হয়। এর মধ্যে বারোয়ারিয়া রাজাকার ঘাঁটি দখলে নেওয়ার যুদ্ধ এবং কপিলমুনির যুদ্ধ সবচেয়ে বড়। কপিলমুনিতে রাজাকারদের ঘাঁটি ছিল সবচেয়ে বড়।

রায়সাহেব বিনোদ বিহারী সাধুর ভবনটি ঘিরে তারা এই ঘাঁটি গড়ে তুলেছিল। এর প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ছিল অনেক বেশি সুরক্ষিত। এ কারণে এই ঘাঁটি আক্রমণের জন্য এখানকার ছোট ছোট দলের সব মুক্তিযোদ্ধাকে এক জায়গায় জড়ো করা হয়। এখানে আমার নেতৃত্বে পরিচালিত দল, কামরুজ্জামান টুকু ভাইয়ের নেতৃত্বে পরিচালিত দল এবং স ম বাবর আলীর নেতৃত্বের দল সবাই মিলে একত্রিত হয়ে সেখানে আক্রমণ করি। তিন দিন চার রাত যুদ্ধ শেষে আমরা কপিলমুনির যুদ্ধে জয়লাভ করি।

তখনো খুলনা শহর ছিল পুরোপুরি শত্রুদের নিয়ন্ত্রণে। খুলনার গল্লামারী রেডিও স্টেশন ছিল পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সবচেয়ে বড় সুরক্ষিত ঘাঁটি। সেটি একটি বড় বধ্যভূমি কেন্দ্রও ছিল। যুদ্ধের একেবারে শেষদিকে ১৫ ডিসেম্বর আমরা সেই ঘাঁটিতে আক্রমণ করি। তখন গল্লামারী এলাকাটি ছিল একেবারে নিচু জলাভূমি।

পাশের গল্লামারী নদীতে জোয়ার এলে সেই জোয়ারের পানি ওই নিচু ভূমিতে চলে আসত। এ বিষয়টি আমাদের মাথায় ছিল না। আমরা যখন আক্রমণ করি তখন সম্ভবত ভাটা ছিল। বিলের মধ্য দিয়ে আমরা রেডিও স্টেশনে (বর্তমানে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য যে ভবনে বসেন। তবে তখন সেটি ছিল একতলা ভবন, বর্তমানে ভবনটি দোতলা।

) বেশ প্রস্তুতি নিয়ে আক্রমণ করলেও প্রতি-আক্রমণ ছিল অনেক বেশি জোরালো। প্রতি-আক্রমণে আমরা রেডিও স্টেশনের কাঁটাতারের সীমানাপ্রাচীর ভেদ করে ভেতরে যেতে পারিনি। তারা সার্চলাইটের আলো ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে আমাদের দেখে দেখে গুলি করতে শুরু করল। একপর্যায়ে জোয়ারের পানিতে আমরা ভাসতে শুরু করি। এতে তাদের আরও সুবিধা হয়।

পরে আমরা সেখান থেকে একজন একজন করে পশ্চাদপসরণ করি। একাত্তরে ডুমুরিয়ার নেতৃস্থানীয় আওয়ামী লীগাররা কেউই মুক্তিযুদ্ধ করেননি। তাঁরা নিরাপদে ভারতে ছিলেন অথবা এ দেশে রাজাকারদের সঙ্গে মিলেমিশে ছিলেন। এখন সেই আওয়ামী লীগাররা অথবা তাঁদের উত্তরসূরিরা নিজেদের বড় মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে দাবি করছেন। আর প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের হেয় করছেন।

প্রকৃতপক্ষে তাঁরা যে যুদ্ধ করেননি সেই হীনম্মন্যতা থেকে প্রকৃত অস্ত্রধারী মুক্তিযোদ্ধাদের অবদানকে খাটো করে নিজেদের মহান করতে চাইছেন। এটি কখনো হয় না। এটি অন্যায়।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.