আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

হঠাৎ পাওয়া এক প্রতিভার খোঁজ

Life is a Target.... Life is a Mission...

বিস্তৃত এই পৃথিবী, বৈচিত্র্যময় চারপাশ। আর এই বিস্তৃত ও বৈচিত্র্যময় পৃথিবীতে আরও বেশি বহুমূখী বৈচিত্র্যপূর্ণতার অবয়ব এ জগতের মানুষ। মেধা, মনন আর সৃজনশীলতার সুনিপুণ কারুকার্যের অপূর্ব রূপায়ণ ও বিনির্মাণের সফল নায়ক এ মানবজাতি। আপন প্রতিভায় চিরভাস্বর এ জাতির পদচারণা সূদীর্ঘ, অন্তহীন। প্রতিভার আঁধার হিসেবে প্রতিভাত মানবজাতি তাঁর স্বীয় মহিমায় নিজ নিজ সমাজ, রাষ্ট্র আর সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলের বাইরে এসেও আজ আন্তর্জাতিক আবহাওয়ায় অশেষ অবদান রেখে চলছে।

অতঃপর প্রতিভার আলোয় উৎসরিত হয় বিশ্ব; সুবাসিত হয় বায়ুমণ্ডল আর নভোমণ্ডল। কালের নিরন্তর পথচলায় তাঁর অবদানকে স্মরণ করে যাবে এ বিশ্ব, এ জগত। এভাবেই পৃথিবীর এই বুকে প্রতিভাবান মানুষের কল্যাণেই রচিত হয় বিশ্বকাব্যের মঙ্গলকাহিনী। যাই হোক, প্রসঙ্গক্রমে অনেক কথাই বলে ফেললাম। বলতে চেয়েছিলাম প্রতিভার কথা।

প্রতিভার কোনো শেষ নেই। বিচিত্রতা আর বহুমূখীতায় টুইটম্বুর প্রতিভার জগত। আমাদের চারপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে নানা বিচিত্র ও বহুমূখী প্রতিভা। অথচ আমরা কেউই কোনোদিন নিজ উদ্যোগে এসব প্রতিভার খোঁজ করিনা বা নিইনা। আমরা যদি একটু সচেতনভাবে এসব প্রতিভার খোঁজ করে তাঁদের প্রতিভা বিকাশের কাজে সহযোগিতা করতাম তাহলে সমাজ ও রাষ্ট্র তাঁদের কাছ থেকে কিছু না কিছু পেত, অনেক কিছুই আশা করতে পারতাম।

আমি সবসময়ই একটা কথা বলি, এই যে প্রতিভা তা সবার মাঝেই আছে। কেউ কাজে লাগায় আর কেউ লাগায় না। প্রতিভা বিকাশের জন্যও কিন্তু টাকার দরকার হয়; দরকার হয় একটা সুস্থ সামাজিক পরিবেশ ও আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপটের। কোনো কোনো প্রতিভা বিকশিত হয় আর কোনো কোনো প্রতিভা ঝরে যায়, ঝরে পড়ে। আজ আমি এমন এক প্রতিভার গল্প শুনাব, যে গল্প আর কাহিনী যা-ই বলুন তাতে হয়তোবা আপনার টনক নড়তে পারে আবার নাও নড়তে পারে; তা একান্তই আপনার ব্যাপার।

তখন প্রায় দুপুর সাড়ে বারোটা হবে, বিশ্ববিদ্যালয়ের হাকিম চত্বরে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে চা পান করছি। চায়ে চুমুক দিতে দিতেই হঠাৎ করেই কেন জানি চোখ পড়লো একটা বট গাছের নিচের দিকে। প্রথমে বুঝতে পারছিলাম না, ক্ষণিক পরে বুঝতে পারলাম যে সেখানে দাঁড়িয়ে কেউ একজন কিছু একটা পড়ছে। পরক্ষণেই কানের মধ্যে যেন কবিতা আবৃত্তির মতো একটা আওয়াজ আসলো। কানের পর্দার মধ্যে বারবার আঘাত করতে লাগলো।

তারপর চিন্তা করলাম, এই ভর-দুপুরে কে আবার পাগলের মতো এ ভরা মজলিসে আবৃত্তি করতে যাবে। কিন্তু না নিজের চোখে বিশ্বাস করতে পারছিলাম না; দেখলাম যে সেখানে একজন রিকশাচালক রিকশা দাঁড় করিয়ে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কবিতা পাঠ করছে। সাথে সাথেই ব্যাগ থেকে ক্যামেরাটা বের করলাম ছবি তোলার জন্য। রিকশাচালকের অনুমতি না নিয়েই একরকম লুকিয়ে-ঝুকিয়েই দু’টা ছবি তুলে ফেললাম। তারপর যখন আরও ক্লোজ ছবি তোলার জন্য কাছে গেলাম তখন তিনি বললেন, ‘মামা ছবি তুইলেন না’।

এরপর তাঁকে যখন বললাম মামা আপনাকে নিয়ে একটা লেখা লিখবো। তাই ছবি তুলছি। এই কথার সাথে সাথেই একজন সচেতন মানুষের মতোই ঐ রিকশাচালক মামা বলে উঠলেন, ‘আপনি যে ছবি তুললেন আমার অনুমতি নিছেন’। এরপর কথায় কথায় তার সাথে গল্প শুরু করে দিলাম। গল্প করার সাথে সাথে দেখতে পেলাম মামার রিকশার উপরে কয়েকটা ডায়েরি।

এগুলোর মধ্য থেকে এক এক করে সব ক’টাতেই দেখলাম যে হাতে লিখা অনেকগুলো কবিতা। মোটামুটিভাবে একপ্রকার চোখ বুলিয়ে নিলাম কবিতাগুলোর ওপরে। তারপর জিজ্ঞেস করলাম মামা এই কবিতাগুলো কার লেখা। এরপর রিকশাচালক মামা বললেন, ‘এইগুলা আমার লিখা মামা। ডায়েরি থেকে নিজের কবিতা নিজেই পাঠ করতেছিলাম।

আজকে আমার কবিতার জন্মদিন। ’ অন্য কোনো প্রসঙ্গ না টেনেই বললাম কবিতার জন্মদিন মানে? প্রথমে ভাবলাম হয়তো কবিতা নামের কোনো এক মেয়ের সাথে মামার সম্পর্ক ছিলো, তাই সেই কবিতার স্মরণে নিজের লেখা পাঠ করে উৎসর্গ করছেন বোধ হয়। কিন্তু না এরকম কিছুই না। এরপর রিকশাচালক মামা এক এক করে বলতে শুরু করলেন তাঁর জীবনের নানা কাহিনী- কিভাবে তিনি কবিতা লেখা শুরু করলেন, কিভাবে কোন প্রেরণার বলে তিনি আজ কবিতার জগতে আসলেন তার সব-ই। তারপর জানতে চাইলাম নাম-ধাম, বাড়ি, পরিচয়সহ নানা প্রসঙ্গ।

রিকশাচালক জাকির হোসেনের কবিতা লেখা ও চর্চার শুরু আজ থেকে প্রায় একবছর আগে। অর্থাৎ ২০০৯ সালের মাঝামাঝি থেকে। এ পর্যন্ত তাঁর লেখা কবিতার সংখ্যা প্রায় ৫০০ হবে বলে জানান তিনি। কবিতা লেখা ও চর্চার পাশাপাশি নিয়মিত যোগ দেন বিভিন্ন সাংস্কৃতিক সংগঠন ও আবৃত্তি সভা ও কর্মশালায়। তাছাড়া নিয়মিত পড়াশুনা তো আছেই।

জাকির হোসেন প্রতিদিন রাত ১টা থেকে ভোর পাঁচটা পর্যন্ত বিভিন্ন কবিতার বই, গল্প, উপন্যাসের বই পড়েন। তারপর ভোর পাঁচটা থেকে দুপুর ২টা পর্যন্ত রিকশা চালান। আর বাকি সময়টা ঘুমিয়ে কাটিয়ে দেন। বিয়ে এখনো করেননি। থাকেন রামপুরার বদ্ধ ও ঘুপছি একটা মেসে।

জাকির হোসেনের বাড়ি ময়মনসিংহ জেলার জামালপুরের মেলন্দই গ্রামে। বাবা মৃত ইকবাল হোসেন ও মা রাণী বেগমের দুই পুত্র ও এক কন্যা সন্তানের মাঝে জাকির হোসেন সবচেয়ে ছোট ও বড়ই আদরের ছিলেন। পড়াশুনা করেছেন দশম শ্রেণী পর্যন্ত। দশম শ্রেণীতে পড়া অবস্থায় এক ঝড় নেমে আসে জাকিরের জীবনে। বাবা মারা যাওয়ার কারণে অকালেই পড়াশুনা বন্ধ হয়ে গেল তাঁর।

এদিকে একমাত্র বড় ভাই বিয়ে করে বউ নিয়ে আলাদা হয়ে যায়। আর বড় বোনের বিয়ে হয়ে যাওয়াতে একমাত্র মা ছাড়া জাকিরের পাশে আর কেউ রইল না। পনেরো-ষোলো বছরের কিশোরকে তাই লেখাপড়া বাদ দিয়ে মাকে নিয়ে ছোট্ট সংসারের হাল ধরতে হলো। মাকে কেন্দ্র করেই আবর্তিত হতে লাগলো জাকির হোসেনের জীবন। নানা ঘাত-প্রতিঘাত সহ্য করতে হয়েছে এই কিশোর বালককে।

কখনো অন্যের জমিতে খেটে কখনো বা রাস্তায় রাস্তায়, বাড়িতে বাড়িতে ফেরি করে জিনিসপত্র বিক্রি করে চলতে হয়েছে তাঁকে। তারপর জীবন ও জীবিকার তাগিদে, পেটের দায়ে একসময় পাড়ি জমান জনবহুল এবং যানজটপূর্ণ এ ঢাকা শহরে। আর পেশা হিসেবে বেছে নিলেন রিকশাচালনা। আর এ সময়টাতেই জাকির হোসেনের জীবনে রচিত হয় এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা। আপনার কবিতা লেখা শুরু কবে থেকে, কিভাবে কবিতা লেখার জগতে আসলেন এসব নানা প্রশ্নের জবাব দিতে গিয়ে আবেগাপ্লুত জাকির হোসেন বললেন, সে এক দীর্ঘ কাহিনী মামা।

আমি তিন বছর যাবত এ শহরে রিকশা চালাই। বছরটা আমার ঠিক খেয়াল নেই। তবে দিনটা ছিলো আজকের এই দিন (অর্থাৎ ৩ নভেম্বর)। এদিনই এক যাত্রীকে নামিয়ে দিলাম কোনো একটা বইমেলার দোকানের সামনে। যাত্রীকে নামিয়ে দিয়ে বইয়ের স্টলগুলো দেখছিলাম।

হঠাৎ এক মেয়েকে বললাম যে, আপু কি কি বই কিনেছেন- কবিতা, গল্প না উপন্যাস। এর উত্তরে ওই মেয়েটা বলেছিলো, তুই বই কবিতা এসবের কি বুঝবি?? কথাটা শুনা মাত্রই মনের মধ্যে বড়ই আঘাত পেয়েছিলাম মামা। ঠিক ওই দিনই আমি শপথ নিলাম যে আমি কবিতা লিখবো। আর একদিন সবাই আমার লেখা সেই কবিতার বই পড়বে। আমার কাছ থেকেও অটোগ্রাফ নেবে সবাই।

এভাবেই জাকির হোসেন বিড় বিড় করে আবেগী ভাষায় নিজের দুঃখের কথাগুলো বলছিলেন আর আবছা কান্নায় ভিজাচ্ছিলেন নিজের দুটো চোখ। আর এ ঘটনার পর থেকেই একটা দৃঢ়তা, একটা মনোবল, একটা স্পৃহা আর একটা জিদ যা-ই বলুন একবোরে ঝেঁকে বসেছিলো জাকির হোসেনকে। তারই পরিণতিতে জাকির আজ এক রিকশাচালক কবি। সেই কবি কি আসলেই বাস্তব জগতে পাবে তাঁর স্বপ্নসিঁড়ির খোঁজ। যে সিঁড়ির পাদপীঠে খুলে যাবে আরেকটি সম্ভাবনার দুয়ার।

মানুষ বাঁচে স্বপ্ন ও এক বুক আশা নিয়ে। আশায় বুক বেঁধে মানুষ এঁকে যায় তার স্বপ্নের আল্পনা। আর স্বপ্নের আল্পনার রঙ্গিন আবেশে পাল তুলে সংসার সাগরে তরী ভাসায় স্বপ্ননীড়ের খোঁজে। ভাসতে ভাসতে তরীতে অনেক ঝড়ো হাওয়ার তাণ্ডব বয়ে যায়। তখনই দেখা দেয় নানা ভয়, সংকট আর ঝঞ্ঝা।

তবুও আশার তরী ছুটে চলে স্বপ্নসাহসের দুর্বার টানে, স্রোতের প্রহরায় জাগে শিহরণ। অবশেষে মেঘলা আকাশ আর দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়াকে পাশ কাটিয়ে মানুষ খুঁজে পায় সেই স্বপ্ননীড়, সেই কাঙ্খিত সাফল্যের ঠিকানা। আমাদের জাকির হোসেনের স্বপ্ন সে একজন কবি হবে, একজন বড় মাপের নামি-দামি কবি। আমরা চাই তাঁর এ স্বপ্ন সত্যি হোক, সফল হোক। অবশেষে শেষ করতে চাই জাকির হোসেনের লেখা প্রথম কবিতা ‘বৃষ্টি’ দিয়ে।

নিচে তাঁর কবিতাটি দেওয়া হলো- বৃষ্টি তোমার চোখে বৃষ্টি এলে আমার চোখে দৃষ্টি তোমার জন্য করবো আমি নতুন গান সৃষ্টি। একদিন তুমি মনের যোগে শুনবে আমার গান তোমার মাঝে আছে যে আমার এই প্রাণ। বৃষ্টি এলে মনে পড়ে তোমার ঐ কথা জীবনে প্রথম আমি পেয়েছি ব্যাথা। ভুলে যাবো বলে আমি সারাক্ষণ ভেবেছি তারচেয়ে বেশি আমি চোখের জল ফেলেছি। আহমেদ সাঈদ ৩ নভেম্বর ২০১০ইং এস এম হল, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।


অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।