আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

জীবনের আরো একটি বছর শেষ, পাশাপাশি শুরুও। ..........আমার জন্ম দিনে আমার শৈশব বয়ান



মা যখন পৃথিবীর দরজা হয়ে আমাকে আলোর মুখ দেখালো তখনও কি ভেবেছি যে এতগুলো বছর এখানে কাটি য়ে দিব। ভাবিনাই, আজো ভাবিনা যে আরো একটি বছর এই পৃথিবীতে কাটাতে পারব। ভেবে লাভ নাই, কারন আজ আছি তো কাল নাই। আমার কখনো সেভাবে জন্মদিন পালন করা হয়নাই , যেভাবে পালন করলে কেক কাটতে হয়, মোমবাতি নিভাতে হয়। সম্ভবত জীবনের অর্ধেকের বেশি পার করে এখনো পর্যন্ত কোন হিসাবের ইতি টানতে পারলাম, আর পারবো বলেও মনে হয়না।

তবে আমার পূর্বের জীবনখানি ভিন্ন ভিন্ন স্থানে কাটানোর ফলে বৈচিত্রও কম আসেনি। শৈশবটাই কেটেছে সবচেয়ে বেশি আনন্দের। আনন্দের শৈশব, জীবনের শ্রেষ্ঠ সময় জন্মের কিছুকাল পরেই আব্বার চাকরি সূত্রে কেন্দুয়ায় যেতে হয়েছে, নেত্রকোণা অঞ্চলের প্রায় সব জায়গা হচ্ছে মাছের রাজ্য(এখন কেমন জানিনা), কেন্দুয়াও তেমনি একটা উপজেলা। মাছের রাজ্য হলে কি হবে আমি খাওয়াদাওয়ার ব্যাপারে ছিলাম খুবই ভদ্রগোছের পুলা, স্বাস্থ্য ছিল বকের মত। চড়–ইপাখির ডিম থেকে উটপাখির ডিম পর্যন্ত লকমা বানিয়ে মুখে তুলে দিতেন আমার সুফিবু, আর আমি হাজার রকমের কসরত করে তা উগরে দিতাম।

একদম পিচ্চিকালটা আমার কেটেছে এই সুফিবুর কাছে। ছোটবেলা থেকেই দড়িবাজ পুলা ছিলাম, এক নম্বর কাজটা ছিল স্কুল পালানো। স্কুলে যাওয়ার সময় হলেই পেটে ব্যাথা শুরু হয়ে যেত, না যাওয়া পর্যন্ত সেটা থামতোইনা। নার্সাারটাা এভাবেই কেটেছে, ছোট ওয়ান, বড় ওয়ান বলে যে কিছু ক্লাস ছিল সেখানেও একই অবস্থা। অবশ্য কিছুটা বড় হলে আসার পথে আব্বার অফিসের নাইটগার্ডের দোকান থেকে মাগনা মাগনা চকলেট ধান্দা করে নিয়ে আসতাম।

বাসায় এসেও পড়ায় ফাকিঁ দিতাম, আম্মা রান্না ঘরে থাকলে অথবা অন্ন ঘরে থাকলে পড়ার নামে এ্যা উ আ করতাম, দুর থেকে যে কেউ শুনলে বুঝতো, আমি মনোযোগ সহকারে অনেক পড়া পড়ছি। তারপরও দেখা যেত আমার রোলখানি ৩য় শ্রেণী পর্যন্ত তিন (৩) ছিল, জানিনা কেন। আকাঁআকিঁর অভ্যাসটা ভালোই ছিল তখন,া পড়ার সময় বইয়ে যে চিত্রগুলো থাকতো তা কাঠপেন্সিল দিয়ে আকঁতে আকঁতে বই খাতা সব ভরে ফেলতাম, ঐসময় আমার জিহ্বা খানি কখনযে নাকের কাছে চলে যেত অন্য কেউ না বললে বুঝতে পেতামনা। তবে আকাঁও হতো বেশ ভালো। আহারে , তখন আমার মাঝে অনেকেই জয়নুল আবেদীনের ছায়া দেখতে পেয়েছিল।

আব্বার অফিসে বিভিন্ন মানুষ সাইকেল নিয়ে আসতো, সাইকেল চালানোর খুব শখ হতো। কখনো চেয়ে কখনো চুরি করে সাইকেল নিয়ে বেড়িয়ে যেতাম, সিটে বসে পারতামনা, নিচদিয়ে আড়াআড়ি ভাবে সাইকেল চালাতাম। যখন সম্ভব হতোনা, তখন বাজার থেকে দুই টাকা ঘন্টা করে সাইকেল ভাড়া করে চালাতাম। শামীম ছিল এ ব্যাপারে ওস্তাদ। পড়ে গিয়ে শরীরের অনেক স্থানে কেটে রক্ত বের হতো, তবু ক্ষান্ত ছিলনা।

আমার আব্বা ছিলেন সুশীল সমাজের লোক, ইনজিনিয়ারে ছেলে হিসেবে এসব করে বেড়ানোটা মোটেই পছন্দ করতেনা। রেড এলার্ট জারি করতেন। ছোট দিনে বড় দিনে বাইরে খেরাধুলার সময় নির্ধারিত ছিল যথাক্রমে ৪টা এবং ৫টা ছিলেন। আব্বার থেকে সেনামীতে কম ছিলামনা, আব্বা নেত্রকোণা বা ময়মনসিংহে আসলে এমনিতেই স্বাধীনতা ভোগ করতাম, তারপর সৃজনশীল মেধাতো ছিলই। সবচেয়ে বেশি উপভোগ করতাম দিন বড় হয়ে গেলেও আব্বা পুনরায় সময় নির্ধারন করার আগে ৪টা থেকে মুক্ত থাকা।

সেকেন্ড কমান্ডার ছিলেন আম্মা, খেলাধুলার সময় হওয়ার আগেই বাড়ীর আশে পাশে অযথাই ঘুরাঘুরি করতাম আর গান গাইতাম এবং যখনেই দুরে সরে যেতাম গলার ভলিউম দিতাম বাড়িয়ে, যেন মনে হয় ছেলে তার আশেপাশেই আছে। খেলাধুলার বাজারে আমার দাম সব সময়ই চড়া ছিল। তখন বয়স হয়তো চার হবে, আব্বা আমার জন্য প্লাস্টিকের ক্রিকেট ব্যাট বল এনে দিয়েছিল, জানতামনা ক্রিকেট কিভাবে খেলে। সঙ্গীদের সাথে হকি স্টাইলে ক্রিকেট খেলতাম, আমার হাতে থাকতো ব্যাট, অন্যদের হাতে থাকতো লাঠি। খেলার চেয়ে প্যাদানোটাই বেশি হতো।

দৌড়ে আমার সাথে কেউ পারতোনা বিধায় বড়দের গোল্লাছুট খেলায় আমার দাম বয়সের সাথে ক্রমান্বয়ে বাড়তে থাকলো। টানাটানি শুরু হয়ে যেত আমাকে নিয়ে, বেশ উপভোগ করতাম বিষয়টা। অবশ্য কিছুকাল পরে আমারি বন্ধু আমাকে টেক্কা দিতে শুরু করায় রাজত্ব কিছুটা হারাতে হয়েছে। মৌসুম পরিবর্তনের সাথে সাথে খেলাধুলার আকার আকৃতিও পরিবর্তন হতো, একসময় বোম্বাস্টিং খেলাটা দারুন জনপ্রিয় হয়ে যায়, টেনিস বল দিয়ে খেলতে হয়, বিষয়টা তেমন কিছু না, টেনিস বল মিল্লা দিয়ে অন্যকে আঘাত করা। এ ধরনের আরেকটা খেলা ছিল, নাম ভুলে গেছি।

সাতচারা খেলতাম, এটাও টেনিস বল দিয়ে খেলতে হতো। সে সময় একাধিক টেনিস বলে গর্বিত মালিক ছিলাম( খেলতে গিয়ে একটার পর একটা চুরি করে নিয়ে যেত )। এক সময় আব্বা আমার জন্য কেরাম বোর্ড কিনে আনে, সেটাও ঐ এলাকায় প্রথম। আমার দাম আরো যেতে বেড়ে, সঙ্গীরা আমাকে আলগা খাতির করতো। বেশ বুঝতে পারতাম, আমাকে না, আমার খেলা সামগ্রীই তাদের বেশি প্রিয়।

বেশ মনে আছে, সিগারেটের খোল জমিয়ে চাড়া খেলতাম। একেক জনের একেক রকম হাড়ি ভাঙ্গা চাড়া, কেউ কেউ আবার কামার বাড়ী গিয়ে লোহার পাতের কোনা বাকিয়ে চাড়া বানিয়ে আনতো, এই কারনে তাদের সাথে খেলাটা ছিল অনেক ব্যয়বহুল। ইঞ্জিনিয়ারের পুলা হিসেবে অনেক কাজই নিজের মত করতে পারতামনা, নিজেকে অনেক কিছু থেকেই বঞ্চিত করেছি। এক সময় মাছ ধরার খুব খায়েশ হলো সবার। সবাই কি সুন্দর সুন্দর বড়শি দিয়ে মাছ ধরতো, আমি বড়শি কোথায় পাই? মনে আছে আলপিন বাকিয়ে বড়শি বানাতাম, এ নিয়ে অন্যরা হাসাহাসি করতো।

অবশ্য, সেই আলপিনেও একটা মাছ ধরেছিলাম একদিন অনেক দিনের সাধনায়। তখন আমার আনন্দ দেখে কে, সারাদিন বাদে সেই মাছ নিয়ে বাসায় ফিরলে আম্মার লাঠির বারি পড়েছিল পিঠে। মাছটারাও নাম ডাক ছিল, রাউগ্যা মাছ। এমন একটা ভালো কাজের পুরস্কার হিসেব লাঠির বাড়ি? কোন ভাবেই কিসেটা মানা যায়? কোয়ার্টারে থাকতাম, ৮৩/৮৪ সালের দিকে, কোয়ার্টারে প্রথম টিভি কিনে এনেছিল আব্বা, সারা এলাকার মানুষ তখন টিভি দেখতে আসতো আমাদের বাসায়। ঐ অঞ্চলে সম্ভবত ২ কি ৩টা টিভি ছিল তখন।

ঐ সময়ে নাইট রাইডার নামে একটা জনপ্রিয় ইঙলিশ ছবি দেখাতো টিভিতে, রেসলিঙ ও দেখাতো সপ্তাহে একদিন। স¤ভবত এক/দুই মাস পর পর একটা করে বাংলা সিনেমা দেখাতো, আহারে............ ঐ সময়ে যদি টিকিটের ব্যবস্থা করতে পারতাম, তো বেশ টাকা পয়সার মালিক হয়ে যেতাম। সেটা করলে একদিক দিয়ে ভালোই হতো, কারন লোকজন টিভি দেখে চলে যাওয়ার পর সাদা দেয়ালে লাল লাল পানের পিক দেখা যেত অনেক। আজকালতো সেন্ট দেওয়ার মত মশার অষুধ ছিটানো হয়, তখন আমাদের ছিল সাইকেল পাম্প করার মত একটা যন্ত্র যেটার মাধ্যমে মশার অষুধ ছিটানো হতো। টিভি দেখতে এসে কেউ যদি বাড়াবাড়ি করতো, ঐ যন্ত্র দিয়ে তাকে বাড়ি ছাড়া করতাম।

একবার কেন্দুয়া মেলা হলো, বন্ধুদের মধ্যে সেই বেশি পপুলার, যে বেশি বেশি মেলা থেকে খেলনাপাতি চুরি করে আনতে পারে। সাহসে কুলায় না, তারপরও মেলা শেষ হওয়ার একদিন আগে আমিও একটা চশমা , একটা বাশি চুরি করে তাদের কাতারে নাম লিখিয়েছিলাম। আফসুস লেগেছিল তখন, মেলাটা কেন আরো বেশিদিন থাকলোনা। অবশ্য আম চুরি করার অভিজ্ঞতা আগে থেকেই ছিল এলাকায়, সেটাতো কোন পাপ হতোনা আমাদের। সবার বাড়ীর আম গাছে আমাদের অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে সময় বেশি লাগেনি।

আম চুরি করে সেই আম কাটতাম ঝিনুক ঘষা ছুরি দিয়ে। ঝিনুক ছুরি দিয়ে আম কাটার সুখ পরে আর কোনদিনও পাইনি। এ ছুরি দেখেছেন কি আপনারা কখনো? পুকুরে সাতার কাটার সখ ছিল প্রচুর, সাতার কি এমনি এমনি শিখেছিলাম? না, তারজন্য অনেক সাধনা করতে হয়েছে, লাল-কালো পিপড়া খেতে হয়েছে , তারপরই সাতার শিখতে পেরেছি। যারা সাতার জানেন না, তারা পিপড়া ভক্ষন পদ্ধতি অনুসরন করতে পারেন। বিকালে খেলাধুলার পর অনেকেই পুকুরে নেমে যেত, আমি পাড়তামনা।

মাইরের উপরে অষুধ নাই, কথাটা মনে হলেই দুচোখ বেয়ে জল আসতো। অনেক সময় বাসা থেকে বের হওয়ার সময় গামছা চুরি করে নিয়ে আসতাম। কাউকে কাউকে দেখেছি কাপড়চোপড় ছাড়াই উলঙ্গ হয়ে পুকুরে ঝাপ দিত। আমাদের একজন সঙ্গী ছিল, তার প্যান্টের রঙ ছিল কালো এবং পিচ্ছিল, সে পুকুরে গোসল করে উঠলে প্যান্ট যে ভেজা তা বুঝা যেতনা। অনেক দিন পর্যন্ত এ ধরনের একটা প্যান্টের খুব শখ ছিল আমার।

এই শখ কোনদিনই পূরণ হয়নি আমার। মনে আছে, একবার চেয়ারম্যান নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলো, সেকান্দারের সাথে মিছিল করেছিলাম। এই সেকান্দার ছিল আব্বার অফিসের ৪র্থ শ্রেণীর কর্মচারীর ছেলে, তার সাথে অনেকটা সময় কাটাতাম। ঐসময় আব্বা কোন এক কাজে ময়মনসিংহে বা নেত্রকোণা ছিল, সেকান্দার আমাকে মিছিলে নিয়ে গিয়ে ছিল। মিছিল শেষে হাতে বিড়ি পেয়েছিলাম, আমার কোন ধরনের বদভ্যাস ছিলনা, অতএব বিড়িগুলো সেকান্দরেরই প্রাপ্য, তখন বুঝতামনা সেকান্দারের লোভ ছিল, ঐ বিড়ির প্রতি, আর এ কারনেই আমাকে নিয়ে গিয়েছিল।

ফলাফল স্বরুপ, কোন এক শুভাকাঙ্খী আব্বার কাছে এই খবর পৌছানোর ফলে আব্বার মারের ভয়ে প্যান্ট ভিজে গিয়েছিল। যাইহোক, এই সেকান্দারকে অনেক মিস করি , আজো। শৈশবে অনেক কথাই মনে পড়ে গেল। লেখাটাও বড় হয়ে গেল। কিন্তু আজো আমি আমার শৈশব খুজি সেই কেন্দুয়ায়, যাকে কখনো ভুলা যাবেনা।

কখনই না।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.