আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

না কষ্ট, না ভালোবাসা


ইদের সময়টায় ব্যাস্ত এই শহরের রাস্তাগুলোর নীরবতা দেখলে মায়া লাগে । শ্রাবণের শেষের দিকে ঝিরিঝিরি এই শ্রাবণধারা কে একটু বেশীই ভালবাসি আমি । ঝিরিঝিরি বৃষ্টিতে নিরব রাস্তায় হেঁটেছি আমি অনেক অনেকবার । কিছু মানুষকে দেখেছি বৃষ্টি নিয়ে আদিখ্যেতা করতে অথবা বৃষ্টি ঝরার এই সময়গুলোতে ফেসবুকে খুব আবেগি স্ট্যাটাস দিতে কিন্তু সেইসব সাময়িক আবেগি মানুষদের কখনো বৃষ্টি বিলাসে উন্মত্ত হতে দেখি নি । জলধারা স্পর্শ করার অনুভুতির সাথে তাদের পরিচয় নেই ।

আমি তাদের দলে পরি না- তা খুব গর্বের ব্যাপার না হলেও অন্তত সুখের ব্যাপারতো বটেই । আমার জন্মও হয়েছিল শ্রাবণ মাসেই । যেদিন আমার জন্ম হয় সেদিন থেকে শুরু করে পরের বেশ কিছুদিন কালো মেঘে আকাশ ঢেকে ছিল । প্রায় দুইদিন পরে নাকি বৃষ্টি হয়েছিল। আকাশের এমন পরিস্থিতি দেখে আমার দাদী আমার নাম রেখেছিলেন "মেঘলা" ।

কিন্তু বিপত্তি ঘটাল আমার নানী । উনার নাম পছন্দ হয় নি । উনি এই নাম রাখতে দেবেন না । এই নামকরণ নিয়ে সেইসময় আরও বড় ঝগড়া হওয়ার আগেই আমার নানুভাই প্রাথমিকভাবে আমার নাম রাখলেন "মেঘ" । কিন্তু আসল ঘটনা হল আমার আকিকার সময় এই নাম বাদ পড়ে "নিরাত্রি" নাম রাখা হল ।

অবাক ব্যাপার হল কোন এক অজানা কারনে আমার দাদী কোন আপত্তি করলেন না । তবে প্রায়ই আদর করে দাদী আমাকে উনার রাখা নামেই ডাকতেন । দাদী নেই । তারপরও মাঝে মাঝে নামটা শ্রবণইন্দ্রিয়ে ঝঙ্কার তোলে । তখন অনুভব করি কিছু কিছু কষ্ট অব্যাক্তই থেকে যায় ।

কাউকেই বলা যায় না । এক নির্ভরযোগ্য কাঁধে মাথা রেখে কাঁদতে ইচ্ছে করে । প্রতিটি মানুষের এমন কিছু কষ্ট নিশ্চয়ই আছে । কষ্টকে ভালবাসতে পারে বলে হয়ত মানুষের মধ্যেই কষ্ট সহ্য করার ক্ষমতা দেয়া হয়েছে । তারপরও কিছু কিছু কষ্ট চোখের আয়নায় ভেসে উঠে ।

অপরিচিত কেউ সেটা বুঝে ফেললে ভাল লাগার চেয়ে ভয় লাগে আরও বেশী । ঐ মুহূর্তে সহমর্মিতার অবয়বে সুযোগ সন্ধানী মনোভাবটা সহসা বোঝা যায় না । আমার জীবনে আমি এমন কিছু মানুষ কে খুব কাছ থেকে জেনেছি যারা আমার কষ্টগুলোকে পুঁজি করে নিজেদের স্বার্থে ব্যাবহার করেছে । আজ একজন সম্পূর্ণ অপরিচিত মানুষকে দেখলাম যে আমাকে না জেনেও আমাকে বুঝতে পেরেছে । এমনটা হওয়ার সম্ভাবনা নেই যে পুরোপুরি আমাকে বুঝতে পারবে তারপরও --যতটুকু বুঝেছে ততটুকুই আশাতিত ছিল আমার জন্য ।

মাঝে মাঝে অসম্ভব মন খারাপ হলে আমি বাসা থেকে বের হয়ে অজানায় হারিয়ে যাই । আজকের দিনটাও তেমনি একটি সময় । বের হলাম । কোথায় যাব জানি না । হেটেই চলেছি ।

রাস্তা বেশ ফাঁকা আর নীরব । হাটতে হাটতে প্রায় রাজারবাগ চলে এসেছি । রাস্তা পার হওয়ার জন্য দাঁড়ালাম । আমি আবার একা একা রাস্তা পার হতে বেশ ভয় পাই । প্রায় ফাঁকা রাস্তায়ও আমি প্রায় মিনিট পাঁচেকের বেশী সময় ধরে দাড়িয়ে আছি ।

তারপরও পার হতে পারছি না অথবা পার হতে চাচ্ছি না । এমন সময় একজন সুপুরুষ এসে সামনে দাড়িয়ে সালাম দিল । সালামটা শুনে একটু বিরক্ত লাগলো । "স্লামালাইকুম" কি সঠিক উচ্চারণ হল !!!! সালামের ভুল উচ্চারণে আমার আবার মেজাজ খারাপ হয়ে যায়। এমনিতেই মন খারাপ ।

এর মধ্যে এই যন্ত্রণা । বললাম "বলুন, আসসালামুআলাইকুম" !!! ভদ্রলোক হেসে আবার সঠিক উচ্চারণে সালাম দিলেন । এবার ভাল লাগলো । উত্তর দিলাম । -" চিনতে পেরেছেন আমাকে ?" --একটু ভাল করে তাকালাম ।

কিন্তু চিনতে না পেরে একটু ভয় পেলাম মনে মনে । ভাবলাম "ছিনতাইকারী" নাতো !! আমার অভিব্যাক্তি দেখেই কিনা জানি না নিজে থেকেই উনি বললেন -- -- আমি অনিক । আপনার কলেজের বন্ধু শাহেদের বৌ রিনি-র এর কাজিন । ওদের বিয়েতেই দেখা হয়েছিল । আমি শুধু "ও" বলতেই পারলাম ।

কারন আমার কিছুই মনে পড়ছিল না আর মনে করতেও ইচ্ছে করছিল না । ভাল লাগছিল না কিছুই । আমাকে চুপ থাকতে দেখে নিজেই বললেন "কোথায় যাচ্ছেন ?" কি বলব আমি ?? আমি নিজেই জানি না কোথায় যাচ্ছি । অনিক নিজেই বলল --" আসুন, আপনাকে পৌঁছে দেই" -- কোথায় ?? --যেখানে আপনার গন্তব্য ! --আমি জানি না । --- আমি জানি ।

চলুন । আমি মোটেও অবাক না হয়ে লক্ষ্মী মেয়ের মত গাড়িতে উঠে বসলাম । গাড়িটা শান্তিনগর হয়ে রূপসীবাঙলার পাশ দিয়ে ফার্মগেট হয়ে ক্যান্টনমেন্টের সুশোভিত অরণ্যের ভেতর আমাকে নিয়ে যাচ্ছিল আর আমি মুগ্ধ হচ্ছিলাম । ঝিরিঝিরি বৃষ্টিতে ছোট ছোট জলরাশি উইন্ডো গ্লাসে হেসে লুটোপুটি খাচ্ছে । আমার ছুয়ে দেখতে ইচ্ছে করছে ।

কিন্তু আমি ছোঁব না । আজ আমার ইচ্ছে অ-পূর্ণের দিন । আমি চেয়ে আছি দিগন্তে । কখন বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা নেমে এসেছে তা নিয়ে আমি যখন ব্যাস্ত তখন আমার পাশের মানুষটি খুব সাবধানে ড্রাইভ করে আমাকে আমার অজানা গন্তব্যে নিয়ে যাচ্ছে । একটা জায়গায় এসে গাড়ি থেমে গেল কয়েক মুহূর্তের জন্য ।

দেখলাম সামনে একটা বন্ধ গেট যেটার ঐ পাশে যাওয়া জনসাধারণের জন্য নিষিদ্ধ । অনিক গাড়ি থেকে নেমে গেটের গার্ডের কাছে থাকা ফোনে কার সাথে যেন কথা বলল এবং ওয়ালেট থেকে কি একটা কার্ড বের করে কি যেন করলো । আর ম্যাজিকের মত গেট খুলে দেয়া হল । গেটের ঐ পাশে একটি অসম্ভব সুন্দর রাস্তা । পিচঢালা পথ ।

এয়ারপোর্ট রোডের সেই নিষিদ্ধ পথ । এত চমৎকার যে আমার মন হাল্কা হয়ে গেল । আমি গাড়ি থেকে বের হয়ে হেটে চলেছি । এই পথের শেষ দেখতে চাই । কিন্তু পথ আর শেষ হয় না ।

আমি ক্লান্ত হয়ে বসে পড়ি । পাশেই অনিক কে পাই । --"এটা আমার পছন্দের একটা জায়গা । এটা আমার গন্তব্য । " --আপনি প্রায় এখানে আসেন কিভাবে ??? ---ড্রাইভ করে চলে আসি ।

--আপনাকে ঢুকতে দিল কেন ?? ঐখানে সাইন বোর্ডে লিখা ছিল "জনসাধারণের প্রবেশ নিষেধ" --আমরা জনসাধারণ নই । জনসাধারণের সেবক । তাই আমরা ঢুকতে পারি । --আপনাকে একটা প্রশ্ন করি ? --- জি করুন ! --আপনি সবসময় টিপ বাঁকা পড়েন কেন ?? কিছুটা স্তম্ভিত হয়ে গেলাম । কি বলব জানি না ।

এই বাঁকা হয়ে থাকা টিপ নিয়ে আমার একটা গোপন ইচ্ছে আছে । এই বাঁকা টিপটা কেউ যেন সবসময় সোজা করে দেয়ার বাহানায় আমার কপাল স্পর্শ করে । তার স্পর্শ যেন আমি পাই । এই গোপন ইচ্ছের কথা সবাইকে বলা যায় না । আমি সবসময়ের মত নিরব ছিলাম।

আমার নীরবতার পর কথা আর বাড়ায় নি অনিক। কতক্ষণ বসেছিলাম জানি না । তবে আকাশে মেঘের আড়ালে ইদের চাঁদের উঁকিঝুঁকি দেখতে ভাল লাগছিল। একটা সময়ে অনিকের সাড়াতেই আবার গাড়িতে উঠে বসা । বাসায় ফেরা ।

বাসার সামনে এসে অনিক একটা কথাই বলল " আপনি কিছুই লুকাতে পারেন না । না কষ্ট , না ভালোবাসা " ।
 

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে ১০ বার

এর পর.....

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।