আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

ধারাবাহিক উপন্যাস- সেদিনও বসন্ত ছিলো (৩)



পূর্ব প্রকাশিতের পর দরজায় ঠক্ ঠক্ করে ঠুকা পড়ছে। এই কাজ একজনই করে, কম্পাস। কলিংবেল আছে কিন্তু ওটা চাপবেনা সে। তাছাড়া এই সাতসকালে এই একজনই আসতে পারে। জিসান জানে, ঘুমোতে যত রাতই হোক, সকাল ছ’টায় কম্পাস উঠবেই।

আবার দরজায় ঠুকা পড়লো। এবারে একটু জোরে। দরজা খুলে দিতেই ধমক দিয়ে উঠলো কম্পাস, ‘কী রে! ক’টা বাজে? এখনো ঘুমোচ্ছিস?’ জিসান আধাখোলা চোখে তাকালো দেয়ালের ঘড়ির দিকে। বললো, ‘মাত্র তো ছ’টা চল্লিশ বাজে!’ ‘ মাত্র ছ’টা চল্লিশ? ছ’টা চল্লিশ তোর কাছে মাত্র মনে হয়?’ জিসান আর তর্কে গেল না। তার আরো কিছুক্ষণ ঘুমোনো দরকার।

বেশি কথা বললে চোখ থেকে ঘুম চলে যাবে। শুধু বললো- ‘ তুই একটু বস বন্ধু। জানালা দিয়ে আজকের পত্রিকা দিয়ে গেছে কি না দেখ। বসে বসে পড়। আমি আরেকটু ঘুমিয়ে নিই।

প্লিজ...’ বলেই হাই তুলতে তুলতে পা বাড়ালো বিছানার দিকে। কম্পাস বললো, ‘আরেকটু ঘুমিয়ে নিবি মানে? ভেজা বিছানায় তুই ঘুমোবি কেমন করে?’ জিসান বললো, ‘বিছানা ভেজা হতে যাবে কেন? আমি কি বাচ্চা ছেলে নাকি যে, রাতে বিছানায় ইয়ে করে দিই? তোর কাছে কি বিছানা ভেজা মনে হচ্ছে?’ ‘ না, এখনো হচ্ছে না। তবে কিছুক্ষণের মধ্যেই হবে। ’ ‘ মানে?’ ‘ মানে তেমন কিছু না। আমি ত্রিশ সেকেন্ড ঘড়ির দিকে তাকাবো।

এর মধ্যে যদি তুই বিছানা না ছাড়িস, তাহলে আমি আধা বালতি পানি এনে তোর উপরে ছেড়ে দেব। পানির পরিমাণ আধা বালতি থেকে বেশিও হতে পারে। ’ ‘ দেখ কম্পাস, গতরাতে চেলসী-লিভারপুলের খেলা দেখে ঘুমোতে ঘুমোতে রাত...’ কম্পাস সোজা পা বাড়ালো বাথরুমের দিকে। জিসান মোটামুটি নিশ্চিত, কম্পাস ঠিকই পানি ভরতি বালতি নিয়ে আসবে। অগত্যা উঠে চোখ ডলতে ডলতে সে-ও পা বাড়ালো বাথরুমের দিকে।

ঠিক দশ মিনিটের মাথায় জিসান ফ্রেশ হয়ে বেরোলো। তার মনে পড়লো আজ শুক্রবার। আজ তাদের বৃক্ষপ্রেম দিবস। প্রতি শুক্রবার সকাল সাতটা ত্রিশ থেকে আটটা ত্রিশ পর্যন্ত একঘন্টা সময় তাকে কম্পাসের সঙ্গে কাটাতে হয় কম্পাসদের বাগানে। এ সময় কম্পাস বেশ ভারি ভারি কথাও বলে।

এই অভ্যেস সে পেয়েছে তার বাবার কাছ থেকে উত্তরাধিকার সূত্রে। তার বাবা চৌধুরী আমানুল্লাহ কবীরও গাছ এবং বাগান বিষয়ে অদ্ভুত অদ্ভুত কথা বলেন। মানুষ বাগান করে বাড়ির সামনে, তিনি করেছেন পেছনে। এ ব্যাপারে উনার একটা যুক্তিও আছে। এবং সেটা যথেষ্ট আগ্রহের সাথে লোকজনকে ব্যাখ্যাও করেন- ‘ বুঝলেন ভাই, বাগান প্রদর্শনীর জিনিস না।

বাগান হলো মানুষের সেবাকারী। বাগানের কাজ হলো মানুষের মন ভাল করে দেয়া। আর এই কাজটি করবার জন্য বাগানের গাছগুলোকে একটু রিলাক্সেবল হয়ে একটু নিজের মত করে থাকতে দিতে হয়। বাড়ির সামনে বাগান করা হলো, আর কেউ একজন বাড়িতে ঢুকার সময় কান ছিড়ে ফেলার মত একটানে একটি গোলাপ ছিড়ে ফেললো, বাড়ন্ত জারুল গাছটির কিশোর ডালটি ভেঙ্গে ফেললো, আর না হয় সদ্য যৌবনা কৃষ্ণচুড়ার ডাল ধরে কোনো কারণ ছাড়াই ঝাঁকুনী দিল। তাহলে তো হবে না।

গাছের মনোসংযোগে বিঘ্ন ঘটবে। ’ কম্পাস জিসানকে নিয়ে বের হয়েছে বাগানে। সুর্যটা মুখ বের করে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে গেছে। চমৎকার রৌদ্রোজ্জ্বল সকাল। তবে পুরো দিন কেমন যাবে-বুঝা যাচ্ছে না।

গুণীজনেরা বলে থাকেন-. Morning shows the day সকাল দেখলেই বুঝা যায় সারাদিন কেমন কাটবে। কম্পাসের ধারণা এই সূত্রটি সবসময় সঠিক না। এমনও দেখা গেছে যে, সকালবেলা প্রচন্ড উত্তাপ নিয়ে সূর্য উঠেছে অথচ সকাল এগারোটা বাজতে না বাজতেই আকাশ অন্ধকার করে নেমেছে মূষলধারে বৃষ্টি। কথাটি রূপক অর্থে ব্যবহৃত হলেও একই অবস্থা। দেখা গেছে ছোটবেলার দুরন্ত দুষ্টু ছেলেটি বড় হয়ে বিনয়ী ও শান্ত একজন মানুষ হিসেবে সমাজে সমাদৃত।

এর বিপরীতও ঘটছে। তাই বলা উচিৎ ছিল Sometime morning shows the day পাশাপাশি হাটছে দু’জন। কম্পাস ও জিসান। নিরবে। ক’দিনের টানা বর্ষণে স্যাঁতস্যাঁতে হয়ে যাওয়া ঘাস মাটিতে কেমন জানি প্রাণ ফিরে আসতে শুরু করেছে।

ঝাঁকে ঝাঁকে গাঙচিল আজকের এই ভোরের সুন্দর আবহাওয়াকে সেলিব্রেট করছে উড়ন্ত অবস্থায় বিভিন্ন শারীরিক কসরত প্রদর্শনের মাধ্যমে। বসন্তের বিদায়ী সুর বেজে গেছে। পরিবেশটা বেশ ভারি। দেখতে দেখতে আরেকটি বছর চলে গেল। নিরবতা ভঙ্গ করে কথা বললো জিসান- ‘ কিরে! কী ভাবছিস?’ ‘ না, তেমন কিছু না।

ভাবছি বছরটি শেষ হয়ে গেল!’ ‘ তাতে কি? সময় তো চলে যাবেই। আবার সকল সময়ই তো সমান। কিছু সময় চলে যাবে, নতুন সময় আসবে। এটাই তো নিয়ম। তাতে তো কিছু যায় আসে না।

’ উদাস ভঙ্গিতে তাকালো কম্পাস। তারপর বললো- ‘ আচ্ছা জিসান। তুই জানিস, সময় কেন চলে যায়?’ ‘ সময় কেন চলে যায় মানে কি? সময় তো চলে যাবেই। এটাই তো প্রকৃতির নিয়ম। আদিকাল থেকেই তো এই নিয়ম চলে আসছে।

’ ‘ কিন্তু কেন এই নিয়ম?’ জিসান বিব্রত ভঙ্গিতে তাকালো কম্পাসের দিকে। ‘ কেন?’ চেহারায় সেই চিরচেনা বিজয়ীর ভাব ফুটিয়ে তুলে কম্পাস গম্ভীর ভঙ্গিতে বললো, ‘একটি বছরের চলে যাওয়া মানে জীবন থেকে ৩৬৫টি দিনের বিদায় নেয়া। এর মানে জীবন ও মৃত্যুর মধ্যকার দূরত্বের ৩৬৫টি সিঁড়ি অতিক্রম করা। হাসি-কান্না, আনন্দ-বেদনা, ভালবাসা-ঘৃণা এবং প্রাপ্তি ও বঞ্চনার অসম্ভব সুন্দর এই পৃথিবীটাকে ছেড়ে চলে যেতে হবে। ইচ্ছে না করলেও যেতে হবে।

কোথাও বেশিদিন থাকলে মায়া জন্মে যায়। প্রকৃতি চায় না তার অতিপ্রিয় মানব স¤প্রদায় সীমিত কোনো জগতের মায়ার জালে জড়িয়ে পড়–ক। মানুষকে নিয়ে প্রকৃতির অতি গোছানো একটি পরিকল্পনা রয়েছে। আর সেই পরিকল্পনা বাস্তবায়িত করবার জন্য অসীম সময়ের বেষ্টনীতে আবদ্ধ কোনো জগতের দরকার...’ ‘ তোর বক্তৃতা কি শেষ হয়েছে?’ বিরক্তি ভাব নিয়ে জিজ্ঞেস করলো জিসান। ব্যঙ্গাত্বক হাসি দিল কম্পাস।

এই হাসির অর্থ-আমার আরো অনেক কথাই বলবার ছিল কিন্তু কী করবো, উলোবনে মুক্তা ছড়িয়ে তো কোনো আনন্দ নেই। কম্পাস ও জিসান এখন বসে আছে একটি পুরোনো কাঠাল গাছের নিচে। হঠাৎ কম্পাস বললো, ‘ আচ্ছা জিসান, কাঁঠাল তো আমাদের জাতীয় ফল, তাই না?’ ‘ হ্যাঁ তাই, তো?’ ‘ না, মানে, আমি ভাবছি দেশে এত সু-স্বাদু ফল থাকতে কাঁঠালকে কেন জাতীয় ফল বলা হয়?’ জিসান বললো, ‘তাতে তোর সমস্যা কোথায়?’ ‘ আমার কোনো সমস্যা নেই। ঘোষণায় কী আসে যায়। দোয়েলকে জাতীয় পাখি ঘোষণা দেয়ায় তো আর দোয়েলের র‌্যাংক বেড়ে যায় নি।

দোয়েল ফ্লাটে উঠে যায় নি। ডালেই থাকে। ’ জিসান বললো, ‘অনর্থক প্রসঙ্গে কথা না বললে হয় না?’ কম্পাস বললো, ‘হবে না কেন? হয়। তবে কথা হচ্ছে জগতের কোনো কিছুই অনর্থক সৃষ্টি করা হয় নি। তাই আমাদের কোনো কাজও অনর্থক হওয়া উচিৎ নয়।

আবার কে জানে সৃষ্টির উদ্দেশ্য ভুলে গিয়ে বাঁকা পথে হাটলে হয়ত পুরো জীবনটাই আবার অনর্থক হয়ে যাবে। ’ জিসান আর কিছু জিজ্ঞেস করল না। সে জানে আর কোনো প্রশ্ন করলে আরো কিছুক্ষণ জ্ঞান বিতরণের কাজটি মহা উৎসাহে চালিয়ে যাবে কম্পাস। মানুষ বড়ই বিচিত্র প্রাণী। দু’টি জিনিষ নিতে চায় না, শুধু দিতে চায়, জ্ঞান ও উপদেশ।

চৈত্রের শেষ সপ্তাহ শুরু হয়েছে। এই সময়ে আকাশের গর্জন, আগাম বার্তাবিহীন ঝড়ো হাওয়া, আবার যে কোনো সময় মেয়েদের কান্নার মত কোনো কারণ ছাড়াই বৃষ্টি,-সাধারণত চৈত্রমাসের চেহারা এমনই হয়ে থাকে। আবার গত রাতের আবহাওয়ার পূর্বাভাসে একটু ব্যতিক্রমও লক্ষ্য করা গেছে। কম্পাসের ধারণা এদেশের আবহাওয়ার পূর্বাভাস বলে দেবার জন্য খুব একটা আবহাওয়া বিজ্ঞানী হবার দরকার হয় না। ছড়ি হাতে ডিজিটাল স্কীনের সামনে দাঁড়িয়ে ছবির সাথে টাইমিং করে কথা বলার ঝামেলায় না গেলেও চলে।

‘হতে পারে, সম্ভাবনা রয়েছে’-টাইপ পূর্বাভাস এদেশের যে কেউ বলে দেবার পারে। “ আগামীকাল দেশের দু’এক জায়গায় হালকা থেকে মাঝারী ধরণের বৃষ্টি অথবা বজ্রসহ বৃষ্টি হতে পারে। সেই সঙ্গে--- অঞ্চলের উপর দিয়ে ঘন্টায় ঊনাশি মাইল বেগে ঝড়ো হাওয়া বয়ে যেতে পারে। সেই সঙ্গে কালবৈশাখীরও সম্ভাবনা রয়েছে”- এমন পূর্বাভাস যে কারো পক্ষেই দেয়া সম্ভব। সম্ভব কারণ নিশ্চিত করে কিছু বলতে হয় না।

কম্পাস বিস্মিত হয়ে গত পরশু টেলিভিশনে শুনেছে রাষ্ট্রের টাকায় ছড়ি ঘোরানো একজন আবহাওয়াবিদ বলছেন-“আগামী কাল যশোর অঞ্চলের উপর দিয়ে কালবৈশাখী বয়ে যাবার প্রবল সম্ভাবনা রয়েছে। ” কম্পাসের খুব ইচ্ছে করছিল জিজ্ঞেস করতে- জনাব, কিছু মনে করবেন না। চৈত্রের শেষ বিকেলে কালবৈশাখী বয়ে যাবে-কথাটা ঠিক বুঝলাম না? যদি বলতেন কাল বসন্তী, তবুও না হয় মেনে নিতাম। ব্যাপারটি কি একটু বুঝিয়ে বলবেন? তবে গতকালের আবহাওয়ার পূর্বাভাসের ঘোষণাটি ছিল সম্পূর্ণ ব্যতিক্রম। অভার কনফিডেন্সের কারণে হোক আর যে কারণেই হোক, গতকাল কোনো রকম কনফিউশনে না ভোগে সরাসরি বলে দেয়া হয়েছে- “ ঢাকার মালিবাগ অঞ্চলের ঠিক উপরে মাঝারী আকৃতির একখন্ড মেঘ জমে থাকতে দেখা গেছে।

মেঘখন্ডটির আকার ও আয়তন সম্বন্ধে নিশ্চিত হবার চেষ্টা চলছে। রাডারের সাহায্যে গত সাড়ে তিন ঘন্টা ধরে আমরা মেঘখন্ডটি পর্যবেক্ষণ করেছি। সে অনুযায়ী আমরা নিশ্চিত, আগামীকাল সারাদিন অই অঞ্চলে প্রচুর বৃষ্টিপাত হবে...” অথচ রোদে খাঁ খাঁ করছে চারদিক! বৃষ্টি যে কেবল হচ্ছেই না, তা না, নিকট ভবিষ্যতে হবে, এমন কোনো সম্ভাবনাও আপাতত দেখা যাচ্ছে না। হায়রে দেশ! হায়রে পূর্বাভাস!! ...চলবে

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।