আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

ধারাবাহিক উপন্যাস- সেদিনও বসন্ত ছিলো



(২) কম্পাস, চব্বিশ ছুঁই ছুঁই টগবগে তরুণ। তারুণ্যের দ্বীপ্তি ছড়াচ্ছে তার অবয়বে। অথচ একটু ভালভাবে লক্ষ্য করলে দেখা যাবে কৈশোরিক চাঞ্চল্যের দুরন্ত আভা এখনো বিদায় নেয় নি তার থেকে। কম্পাসের জন্ম হয় হাসপাতালে। হাসপাতাল /ক্লিনিকের উপর খুব একটা ভরসা নেই কম্পাসের বাবা আমানুল্লাহ কবীরের।

কিন্তু স্ত্রী’র ব্যথাতুর মুখের দিকে তাকিয়ে এবং বিকল্প পথ খোঁজে না পেয়ে স্ত্রী’কে অনিচ্ছা সত্ত্বেও ভর্তি করলেন একটি বেসরকারি ক্লিনিকে। প্রাইভেট এই ক্লিনিকটির নাম ‘মানবসেবা ক্লিনিক। ’ হাসপাতালের মত সারিসারি করে বেড পাতা। অল্প বয়সী নাক উঁচু স্বভাবের নার্স মেয়েরা সাদা অ্যাপ্রোন পরে ব্যস্ত ভঙ্গিতে ছুটাছুটি করছে। আমানুল্লাহর ধারণা দু’একটি ব্যতিক্রম ছাড়া এদেশের সরকারি-বেসরকারি সবগুলো হাসপাতাল/ক্লিনিকের স্বাস্থ্যসেবার মান ভয়াবহ পর্যায়ের।

জীবনে তিনি অনেক কঠিন বাস্তবতার মুখোমুখি হয়েছেন। চিকিৎসা ও চিকিৎসক সংক্রান্ত যে তিক্ত অভিজ্ঞতার কথা উনার পেটে জমা হয়ে রয়েছে, সেগুলো তিনি ফলাও করে প্রকাশও করতে পারছেন না। এর কারণ, খুব পয়সাঅলা না হওয়ায় কেউ তাকে কোনো সামাজিক অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি হবার আমন্ত্রণ জানায় না, যেখানে তিনি কথাগুলো বলতে পারতেন। বিকল্প হলো ‘কলাম’ আকারে লিখে কোনো জাতীয় বা স্থানীয় পত্রিকায় পাঠিয়ে দেয়া নতুবা বই আকারে প্রকাশ করা। এটাও সম্ভব হচ্ছে না।

প্রথমত দেশের ট্রেডিশন অনুযায়ী বড় বড় পত্রিকাগুলো লেখার ওজনের চে’ লেখকের ওজনকেই বেশি গুরুত্ব দেয়। আর তিনি ওজনদার কেউ নন। নামের পেছনে ব্যবহার করার মত তেমন কোনো ডিগ্রী নেই তার। বাকী থাকলো বই আকারে প্রকাশ করা। তো তার মত অখ্যাত কেউ যত ভালই লেখুক, কোনো প্রকাশক সেটা ছাপানোর ভুলটি করবেন না।

প্রকাশকরা সাধারণতঃ রগরগা বর্ণনা অথবা লেখকের নামের পেছনে টাকা ঢালেন। তাঁরা চান তাদের বিনিয়োগকৃত মূলধন মুনাফাসহ ফেরৎ পাবার গ্যারান্টি। প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানগুলো আজকাল আর সাহিত্যসেবা ও সৃজনশীলতার পেছনে দৌড়ায় না। তারা দৌড়ায় ব্যবসার পেছনে। আমানুল্লাহ উনার জীবনের টুকটাক অভিজ্ঞতাগুলো ডায়রীতে লিখে রাখেন।

তিনি ঠিক করছেন কোনো দিন যদি তার টাকা হয়, তাহলে বইটি তিনি নিজেই বের করবেন। এবং সবগুলো কপি বিনামূল্যে বিতরণ করবেন। ক্লিনিক কর্তৃপক্ষ অনিবার্য মুখস্ত বিদ্যা হিসেবে কম্পাসের মায়ের শরীরে একটি গ্লোকোজ স্যালাইন লাগিয়ে দিলেন। আর আমানুল্লাহর হাতে ধরিয়ে দিলেন একটি চার্ট। মানবসেবা ক্লিনিক মালিবাগ, ঢাকা।

ডেলিভারী সেবার মূল্য তালিকা ডেলিভারী ধরণ সেবার ধরণ সাধারণ সেমি ভিআইপি ভিআইপি ভিভি ইপি নরম্যাল ৪০০০/= ৬০০০/= ৮০০০/= ১১,০০০/= সিজার ৮০০০/= ১১০০০/= ১৫০০০/ = ২১০০০/= # ইনক্লুডিং ডক্টরস চার্জ + ক্লিনিক সার্ভিস চার্জ+ মেডিসিন # সাধারণ ওষুধপত্র ক্লিনিক থেকেই সরবরাহ করা হবে। কিন্তু বিশেষ #জরুরী বা বেশি দামি ওষুধ লাগলে রোগী বহন করবেন। # সকল মূল্যের সাথে ১৫% ভ্যাট প্রযোজ্য। সেবাই আমাদের লক্ষ্য চার্টটি হাতে নিয়ে কয়েক মিনিট ভাবলেন আমানুল্লাহ। তিনি ভেবে পেলেন না ডেলিভারী রোগীর সেবার ক্ষেত্রে সাধারণ ও ভিআইপি ক্যাটাগরির এই বিভাজনের মানে কী? আফটার অল মা হওয়ার ক্ষেত্রে তো ঘটনা অই একই।

অন্য সময় হলে কোমর বেধে তর্ক করতেন তিনি। কিন্তু আজ উল্টা-পাল্টা কোনো প্রশ্ন করলেন না। এখন ঝামেলা করার সময় না। ব্যথায় ছট্ফট্ করছেন তার স্ত্রী। তিনি ৪০০০/= টাকার কোঠায় রাইট চিহ্ন দিয়ে কাগজ ফিরিয়ে দিলেন।

উনার প্রতি ডাক্তাররা কিছুটা সদয় হয়েছেন। পারেশনের কথা বলেন নি। তা না হলে ডেলিভারী রোগীকে ক্লিনিকের হাওলা করার পরপরই কর্তৃপক্ষ বিস্মিল্লাহ বলে মহা উৎসাহে অপারেশনের প্রস্তুতি শুরু করে দেন। ছুরি-চাকু নিয়ে ব্যস্ত ভঙ্গিতে ছুটাছুটি শুরু করেন। কোনো রকম বাড়তি ঝামেলা ছাড়াই কম্পাসের জন্ম হলো।

যেহেতু বাসা পাশেই ছিল, তাই জন্মের একঘন্টা পরেই মা ছেলেকে বাসায় নিয়ে আসা হলো। কম্পাসের পুরো নাম কম্পাস চৌধুরী। এই মাঝারী মানের ভয়াবহ নামটি তার বাবার দেয়া প্রথম উপহার। নামকরণের পঠভূমিও যথেষ্ট ইন্টারেষ্টিং। জন্মের পর শিশু কম্পাসকে নিয়ে সবাই মহা ব্যস্ত।

কে কার আগে কোলে নেবে, এ নিয়ে রীতিমত যুদ্ধ শুরু হয়ে গেল। এই পৃথিবীতে অধিকার চাইলে সেটা আদায় করে নিতে লাগে, কম্পাস তার জীবনের প্রথম শিক্ষাটি পেয়ে গেলো। অই টানা-হেঁচড়ার মাঝে বাচ্চার কানে আযান দেয়ার কথা কারো মনেই ছিল না। একটি মুসলিম শিশু, ছেলে হোক বা মেয়ে, জন্মাবার পর ডান কানে আযান এবং বাম কানে এক্বামত দিতে হয়। হিন্দু হলে দিতে হয় উলূধ্বনি।

আর আযান-এক্বামত দিতে হয় বাচ্চাটিকে এই মহাসত্যটি স্মরণ করিয়ে দেয়ার জন্য যে, আযান-এক্বামত হয়ে গেছে। নামাজের বেশি বাকী নেই। তুমি তোমার চূড়ান্ত নামাজ (জানাযা)’র জন্য প্রস্তুতি শুরু করে দাও। কম্পাসের বয়স চার ঘন্টা তেত্রিশ মিনিট হয়ে গেছে অথচ এখনো আযান দেয়া হয় নি। কেউ সেটা খেয়ালও করছে না।

হঠাৎ তার নানী সবাইকে ডেকে বললেন- ‘এ্যাই! দেখো, দেখো, এই ছেলে কেমন করে দু’হাতের তর্জনী কানে ঢুকিয়ে রেখেছে! মনে হচ্ছে না যেন আযান দিচ্ছে?’ শাশুড়ীর কথায় কম্পাসের বাবা আমানুল্লাহ কবীরের খেয়াল হলো-এখনো বাচ্চার কানে আযান দেয়া হয় নি! তিনি সবাইকে ডেকে বললেন, ‘দেখেছো তোমরা! আমরা তো সবাই আযান দেয়ার কথা ভুলেই গিয়েছিলাম। ছেলে আমাদেরকে সঠিক কাজটির কথা বলে দিল। আমরা পথ হারিয়ে ফেলেছিলাম। সে আমাদেরকে পথ বাত্লে দিল। আশ্চর্য না?আমি এই ছেলের নাম রাখলাম ‘কম্পাস’।

তোমরা দেখে নিও, আমার এই ছেলেটি একদিন বড় হয়ে সবাইকে সঠিক পথের দিশা দেবে। ’ বলেই তিনি আযান দিতে শুরু করে দিলেন। কম্পাসের মা জাহানারা বেগম বললেন, ‘তোমার যে কি কান্ডজ্ঞান না! কম্পাস আবার কারো নাম হয় নাকি? এটা তো ছোট্ট একটা দিকদর্শন যন্ত্র। স্কুলের মেয়ে-ছেলেরা জ্যামিতি বক্সে নিয়ে ঘুরে বেড়ায়। আমার ছেলে কি জ্যামিতি বক্সে ঢুকে বসে থাকবে না কি?’ আমানুল্লাহ কপালে ভাঁজ ফেলে বিরক্তির সাথে তাকালেন স্ত্রী’র দিকে।

বললেন, ‘দেখো জাহানারা, যা বুঝো না, তা নিয়ে তর্ক করতে এসো না। তোমার যা বুদ্ধি, তাতো জ্যামিতি বক্স পর্যন্তই। তা না হলে তুমি জানতে, কম্পাস শুধু স্কুলের ছেলে-মেয়ের জ্যামিতি বক্সেই থাকে না। সফরকারীরা কম্পাসের সাহায্যে পথ খোঁজে বের করেন। তাছাড়া এই যে হাজার হাজার ফুট উপর দিয়ে বিমান চলাচল করে, ওরা রাস্তা খোঁজে পায় কী করে? তুমি কি মনে করেছো জাপান-বাংলাদেশের যৌথ বিনিয়োগে মহাকাশে আলাদা রোড তৈরি করে রাখা আছে? পাইলটরা কিন্তু কম্পাসের সাহায্যেই কাজ করে।

মাথায় ঢুকলো কিছু?’ কম্পাসের দাদী ধমক দিয়ে উঠলেন, ‘কী শুরু করেছিস কবীর? জ্ঞান ঝাড়ার জায়গা পাচ্ছিস না? যা, বেরিয়ে যা ঘর থেকে। বৌ’মার কাছে বক্তৃতা না করে উঠোনে গিয়ে লোকজন জড়ো করে বক্তৃতা দে। তোর ছেলের নাম কম্পাস-চুম্বক যা ইচ্ছা রাখিস, আমাদের কারো কোনো আপত্তি থাকবে না। ’ এই হলেন মিস্টার আমান। কম্পাসের বাবা চৌধুরী আমানুল্লাহ কবীর।

অবশ্য নামের সাথে তিনি চৌধুরী ব্যবহার করেন না। গরীবদের নামের সাথে চৌধুরী বেমানান লাগে। কিছু কিছু ব্যাপার আছে যেগুলো অর্থনৈতিক অবস্থার সাথে সংশ্লিষ্ট। এর মধ্যে একটি হলো এই চৌধুরী। এটা যতটা না বংশ পরিক্রমার সাথে সংশ্লিষ্ট, তারচে’ অনেক বেশি সংশ্লিষ্ট টাকা পয়সার সাথে।

এই যেমন ডায়াবেটিস হচ্ছে বড় লোকের বেমার। গরীবের কখনও ডায়াবেটিস হয় না। গরীবের হয় বহুমূত্র। প্রচন্ড আবেগী একজন মানুষ হলেন কম্পাসের বাবা। কিন্তু প্রকৃতি আবেগ পছন্দ করে না।

যে কারণে তিনি দেখে যেতে পারেন নি, যে ছেলের অন্যকে পথ দেখানোর কথা, সে আজ---- ...। চলবে

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।