আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

ত্যাগ (ছোটগল্প)



সময়টা ১৯৭১। বিজু। খুব ছোটবেলায় মা-বাবাকে হারায়। তারপর থেকে সে এতিম। এ গ্রামে তার আপনজন বলতে আর কেউ নেই।

তারপরেও সবাই যেন তার আপন। । এক্কেবারে ছোট্টবেলা তার ভালো নাম হয়তো ছিলো বিজয় হয়তো অন্যকিছু, খেয়াল নেই তার ভালোভাবে। কালক্রমে সবার মুখে মুখে বিজু নামেই পরিচিত এখন। এখন তার বয়স বারো কি তেরো।

সারাদিন কাটে এ ঘরে ও ঘরে এর ওর গৃহস্থালী ও নানাবিধ কাজ করে। পরোপকার যাকে বলে আরকি। গাঁয়ের সবার যেকোন ধরণের কাজ সে বিনা পারিশ্রমিকে করে দেয়। বিনিময়ে সে শুধু তার পেটটুকু ভরে নেয়। গাঁয়ের লোকেরাওে এই বাপ-মা মরা এতিম ছেলেটাকে ভীষণ স্নেহ করে।

বিজু তার ইচ্ছেমত স্বাধীনভাবে চলাফেরা করে। সারাদিন সবার পরোপকার করে মরে আর যখন তার পেট আহারের জন্য সিগন্যাল পাঠায় তখন সে তার ইচ্ছেমত যেকোন এক বাড়িতে গিয়ে সেই সিগন্যালের সাড়া দেয়। সবাই অবশ্য তাকে খুশি মনেই খাওয়ায়। প্রতিদিনের মত আজকেও সকাল সকালই ঘুম থেকে ওঠে বিজু। প্রতিদিনের মতো সকালে ঘুম থেকে উঠলেও আজকের দিনটি কিন্তু অন্যরকম একটা দিন।

আজকে তার জীবনের একটি বিশেষ দিন। আজকে একটা বিশেষ কাজ করবে বলে সে আগে থেকেই ঠিক করে রেখেছে। পুরো কাজের একটা খসড়াও তার মাথায় রয়েছে। বিজু যদিও অনেক ছোট কিন্তু বাস্তব অভিজ্ঞতার কারণে সে তার বয়সের তুলনায় অনেক বেশি Matured. আর তাই সে জানে এই কাজটি করার জন্য হয়তো তার ছোট্ট জীবনটাকে বিনিময় করতে হবে। কিন্তু তারপরেও সে দৃঢ়প্রতীজ্ঞ।

এই কাজটি তাকে করতেই হবে। সে এরইমধ্যে জানে যে অনেকেই অনেক কিছু করছে গোপনে। সে না হয় এই ক্ষুদ্র কাজটুকুই করলো। সন্তুদা তাকে বলেছে, ‘বুঝছস বিজু, বাংলাদেশ অখন স্বাধীন না, ইতার লাগি বাংলাদেশের পতাকারে আমরা স্বাধীনভাবে উড়াইতাম পারি না। যেসময় দেখবে বাংলাদেশও ঐ পাকিস্থানিগুলার পতাকার জায়গাত বাংলাদেশের পতাকা উড়তাছে হেইসময় বুঝবে যে বাংলাদেশ স্বাধীন।

বুজছস । ’ বিজু বিজ্ঞের মতো মাথা নাড়ে। সে তার মতো করে সন্তুর কথার অর্থ বুঝে নেয়। সেদিনই সে সন্তুর কাছ থেকে বাংলাদেশের একটা পতাকা চেয়ে নিয়েছিল। এরপর থেকে প্রতিদিনই ঘুম থেকে উঠে সে প্রথমেই এই পতাকাটির দিকে মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকত।

এভাবেই আস্তে আস্তে পরিকল্পনাটি তার মাথায় আসে। এই গ্রামে পাকিস্থানি সেনার ঘাঁটি গাড়ে তা প্রায় ২০ দিন হয়। এরই মধ্যে পুরো গ্রামের চেহারা ঐ ইবলিশগুলা পাল্টে দিয়েছে। পুরা গ্রামটা থমথমে থাকে সারাক্ষণ। রাতের বেলা ভেসে আসে চিৎকার।

সেদিনও সে রাজিয়া আপা, দ্বীপাদির চিৎকার শুনতে পায়। সে চেয়েছিল ছুটে গিয়ে কুত্তাগুলোকে পিটিয়ে রাজিয়া আপা, দ্বীপাদির চিৎকার থামাতে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত যেতে পারেনি। কুত্তাগুলোর হাতে যে বন্ধুক থাকে সারাক্ষণ। সবকিছুই ঐ অর্ধচাঁদ মার্কা পতাকাটির জন্যই হচ্ছে- সে ভাবে মনে মনে।

এটা পাল্টে আমাদের বাংলাদেশের মানচিত্র শোভিত পতাকাটা উত্তোলন করতে পারলেই তো সব ঠিক হয়ে যাবে! আস্তে আস্তে তার পরিকল্পনা মতো এগোতে থাকে। আজ হচ্ছে তার সেই পরিকল্পনা বাস্থবায়নের দিন। সন্তুদার মাধ্যমে সে ইতোমধ্যে অতি গোপণীয় একটা কথা জানতে পেরেছ। সে জানতে পেরেছে আজকে যেকোন সময় মুক্তিযোদ্ধারা পাকিস্থানিদের ক্যাম্পে আক্রমণ চালাতে পারে। বিজুর আজকের দিনটাকে বেছে নেয়ার পিছনে এটিও একটি কারণ।

বিজু বেড়িয়ে পরার প্রস্তুতি নেয়। সে তার সবুজ শার্টটি গায়ে জড়ায়। গত পূজোতে ভৈরবী কাকি বিজুকে এটি কিনে দিয়েছিল। ভৈরবী কাকির ছেলেটাকে ঐ হায়েনাগুলো গতকাল ধরে নিয়ে গেছে। আজকে এই শার্টটি গায়ে দেয়ার পেছনে অবশ্য আরোও একটি উদ্দেশ্যও আছে।

যদি আজকে তার কাজ সমাপ্ত হওয়ার পথে খানসেনারা তাকে গুলি করে তবে তার সবুজ শার্টে লাল রক্ত ছড়িয়ে পরবে। আমাদের পতাকার মতন!! বিজু একটা লাঠির মধ্যে পতাকাটি বেঁধে তা লাঠির মধ্যে মুড়িয়ে ফেলে। তারপর একটা সাদা কাপড় দিয়ে আবার পতাকটিকে মুড়িয়ে নেয় যেন কেউ কিছু বুঝতে না পারে। তারপর হাঁটা শুরু করে তার গন্তব্যের উদ্দেশ্যে। এই গ্রামে পাকিস্থানি সেনাদের ক্যাম্পটি গ্রামের একেবারে শেষমাথায়।

পেছনের দিকে ঘন বন। বিজু আস্তে আস্তে ক্যাম্পের দিকে এগোয়। দূর থেকে সে বদরুলকে দেখতে পায় খানসেনাগুলোর সাথে হাসিমুখে গদগদভাবে কথা বলছে। রাগে বিজুর পিন্ডি জ্বলে যাচ্ছে। বিজুকে দেখে বদরুল হাঁক ছেড়ে ডাকে - ‘ঐ বিজু, ইকান কিতা করছ, তর আত ইডা কিতা? কাছে আয়’ - ‘কিচ্ছু না।

সাদা কাপড়। আইচ্ছা বদরুল ভাই আমারে ক্যাম্পের ঐ টিনের চালের উপরে উডার লাগি দিবায়?’ কি মনে করে যেন বিজু বদরুলকে অনুরোধের সুরে বলে। - ‘তুই টিনের উপরে উইট্টা কিতা করতে?!’ আশ্চর্য হয়ে বদরুল জিজ্ঞেস করে। - ‘না, এমনই। চালের উপরে উইট্টা পুরা গেরামডারে একটু দেখতে ইচ্ছা করতাছে।

আর আমি কিতা এমনই তোমার কাছে কুনোদিন কিচ্ছু ছা্ইছি? দ্যাউনে একটু ব্যবস্থা কইরা। ’ বদরুল কি যেন চিন্তা করে। এটা ঠিক যে বিজু তার কাছে কোনোদিন কিছু চায়নি এমনকি বদরুল নিজে থেকে জিজ্ঞেস করলেও না। এম্নিতে সেও বিজুকে খুব পছন্দ করে। কিছুক্ষণ কি যেন চিন্তা করে তারপর সে এগিয়ে গিয়ে একটা খানসেনার কাছে কি যেন আলাপ করে উর্দুতে।

হাবভাব দেখে বোঝা যাচ্ছে যে সেনাটি রাজি হতে গরিমশি করছে। কিছুক্ষণ এভাবে চলল। বদরুল কি যেন বোঝালো। শেষে বিজু বদরুলকে আসতে দেখল। বদরুল এসে বিজুকে বলল -‘যা, উঠ গিয়া।

বউত কষ্ট কইরা রাজী করাইচি। বেশি সময় তাকতে পারতে না। আর কিতা যে বাইচ্চামি রিকোস্ট করচ রে’ বিজু মুখে হাসি ফোটায়। কিন্তু মনে মনে ভীষণ গালিগালাজ করে সে বদরুলকে। বিজু দুচোখে দেখতে পারে না বদরুলকে।

ওই তো সেদিন রাজিয়া আপা আর দ্বীপা দিদি দের বাড়িতে ঐ পাকিস্থানিগুলোকে নিয়ে গিয়েছিল। আবার গতকাল ভৈরবী কাকিমার বাড়ি থেকে উনার ছেলেকে দরে আনার সময়ও তো এই শয়তানটা সেনাগুলোর সঙ্গে ছিল। -‘শালা হারামি। ’ বিজু গালি দেয় বদরুলকে মনে মনে। অবশেষে অনেক কষ্ট করে সে সেনা ক্যাম্পটির টিনের চালের উপর উঠল।

সূর্যের কড়া উত্তাপে টিনের চাল তেঁতে আছে। টিনের চালের ঐ ছাদের উপরেই উড়ছে পাকিস্থানি পতাকাটি। বিজুর লক্ষ্য সেখানেই। আস্তে আস্তে সে সেই পাকিস্থানি পতাকা দন্ডটির কাছে গেল। সবাই ওর দিকে উৎসুক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে।

এমাথা-ওমাথা করার ফাঁকে বিজু তার হাতের দন্ডের সাদা কাপড়ের বাঁধনটি আলতোভাবে খোলে ফেলল। এরই মধ্যে সে দেখতে পেল বনের মধ্য দিয়ে কয়েকজন যুবক অস্ত্র হাতে হামাগুড়ি দিতে দিতে আস্তে আস্তে এগিয়ে আসছে। ব্যপারটা কি তা বোঝতে বিজুর কোনো সমস্যা হলো না। ওর মুখে হাসি ফোটে উঠল। বাকি কাজগুলো সে খুব দ্রুততার সাথে করলো।

একঝটকায় সে পাকিস্থানি পতাকার দন্ডটি সরিয়ে সেই স্থানে তার হাতের দন্ডটি বসিয়ে দিল এবং সাদা কাপড়টি সরিয়ে দিল। দন্ডটিতে বাংলাদেশের লাল-সবুজ পতাকা উড়তে লাগলো। বাংলাদেশের পতাকাটি পাকিস্থানি সেনাদের ক্যাম্পে উড়তে লাগলো। ছোট্ট বিজু পতাকার দিকে তাকিয়ে থাকল। তার দৃষ্টিতে মুগ্ধতা।

ঘটনার আকস্মিকতায় সবিাই কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে গেল। হঠাৎ সেনাগুলো উর্দুতে কি যে চেঁচাতে লাগলো। বদরুল এর কন্ঠ শোনা গেলো। সে বিজুকে অশ্লীল গালি মেরে নেমে আসার জন্য বলছে। হঠাৎ কে একজন জোরে চেঁচিয়ে উঠল -‘মুক্তি হ্যায়, মুক্তি হ্যায়।

ফায়ার। ’ চারিদিকে প্রচন্ড গোলাগুলির আওয়াজে বিজু কান চেপে ধরল। মুক্তিযোদ্ধা মুনির চিৎকার করে বিজুকে নিচে নেমে আসার জন্য বলছে। কিন্তু বিজুর কানে কিছুই যাচ্ছে না। সে তার দুকান চেপে ধরে আগের যায়গাটিতেই দাঁড়িয়ে আছে।

তার প্রচন্ড ভয় করছে। হঠাৎ বিজু টের পের কি যেন তার বুকে এসে বিঁধেছে। বুকের সেই যায়গাটতে সে হাত দিল। একি! যায়গাটা ভেজা ভেজা লাগছে কেন? বিজু তাকিযে দেখল বুকের সেই স্থান থেকে লাল রঙের তরল পদার্থ গলগল করে বের হচ্ছে। হঠাৎ বিজুর ভয়টা কেটে গেল।

সে তার চারপাশের আর কিছুই শুনতে পাচ্ছে না। বিজু টিনের চালার উপড় আস্তে আস্তে শুয়ে পড়তে লাগলো। সে তাকালো আবার বাংলাদেশের পতাকাটির দিকে। বিজু খেয়াল করল তার সবুজ শার্টে সেই লাল তরল একটা গোলাকার আকার ধারন করছে! তার শার্টটাও কি বাংলাদেশের পতাকা হয়ে যাচ্ছে? সে আবার ঐ পতাকাটির দিকে তাকালো। আর কোনো চিন্তা নাই।

সন্তুদা বলেছিল যেদিন ঐ পাকিস্থানি পতাকার জায়গায় বাংলাদেশের পতাকা উড়বে তখনই বাংলাদেশ স্বাধীন হয়ে যাবে। এই পতাকাই সব দুঃখ কষ্টের অবসান ঘটাবে, আমাদের স্বাধীনতা এনে দিবে। সে পতাকা স্থাপন করেছে। এখন কি তবে বাংলাদেশ স্বাধীন? বি:দ্র: প্রথমেই ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি কারণ আমার মত ক্ষুদ্র একজন মুক্তিযুদ্ধের মত বিশাল একটা জিনিস নিয়ে লিখার দুঃসাহস দেখিয়েছি এই জন্য। মুক্তিযুদ্ধ আমি নিজের চোখে দেখিনি।

সবকিছুই আমার শোনা এবং পড়ার মধ্যেই স্বীমাবদ্ধ। তবে একটা বিষয় নিয়ে আমি খুব গর্ব করতে পারি। আর তা হলো আমি একজন মুক্তিযোদ্ধার গর্বিত সন্তান। আমার বাবা এই দেশের স্বাধীনতার জন্য মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন। আপনারাই বলুন, এটা কি অঅঅনেক অঅঅঅঅনেক গর্ব করার মত একটা বিষয় নয়।

যাই হোক, এই লেখার যেকোন ধরণের ভুল-ভ্রান্তির জন্য দায়টা সম্পূর্ণ আমার। আপনাদের মহত্ব দিয়ে ক্ষমা করবেন এই আশা রাখি। ধন্যবাদ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।