বাংলা আমার দেশ
গোটা পৃথিবীতে আজ মুসলমান বলে পরিচিত জনগোষ্ঠীর সামনে এক কঠিন সময়। দেশ, অঞ্চল ও স্থানভেদে আর্থ-সামাজিক অবস্থার তারতম্য থাকলেও দুর্ভোগ, দুর্যোগ, দুর্ভাবনা, অভিশাপ আর অসহনীয় অশান্তি আজ নিত্যসঙ্গী শান্তি (ইসলাম) ধর্মাবলম্বী কোটি কোটি আদম সন্তানের জীবনে। ইরাক জ্বলছে, আফগানিস্তান পুড়ে ছাই, প্যালেস্টাইনে রক্ত ঝরছে দশকের পর দশক জুড়ে, গোষ্ঠী দ্বন্দ্বে ক্ষত-বিক্ষত পাকিস্তান। ক্ষুধা, দারিদ্র্য আর রক্তপাতের সঙ্গে নিত্য বসবাস ইন্দোনেশিয়া, বাংলাদেশ, সুদান ও ইথিওপিয়া, সংখ্যালঘু হওয়ার অভিশাপে বিভিন্ন সমস্যায় জর্জরিত ভারত, ফিলিপাইন এবং যুগোশ্লাভিয়াসহ আরো কত না দেশের মুসলমানরা। তার সঙ্গে সামপ্রতিক বছরগুলোতে যোগ হয়েছে ইউরোপ-আমেরিকায় বসবাসরত লাখ লাখ মুসলমানের জীবনে নেমে আসা ‘সন্ত্রাস-আতঙ্ক’।
পাশ্চাত্যের দেশগুলোতে প্রতিটি মুসলমান পরিবারের দিন কাটছে আতঙ্কের মাঝে - সন্ত্রস্ত তাদের প্রতিটি মুহূর্ত।
কোটি কোটি মুসলমানের জীবনে বিরাজমান এই অভিশাপের বিপরীতে সীমাহীন বিত্ত-বৈভব আর অকল্পনীয় সুখ ভোগ ও চরম বিলাসিতায় কাটছে আরব দেশগুলোর বাদশাহ ও পদলেহী মুসলমানদের। যারা কিনা নিজেদের দাবি করে ‘প্রথমে আরব, তারপরে মুসলমান’ বলে। এই আরব দেশগুলোরই নেতৃত্বে রয়েছে সৌদি আরব। পবিত্র ভূমি মক্কা আর মদিনা রয়েছে যার রাষ্ট্রীয় সীমানার মধ্যে।
মোট আরব ভূখন্ডের শতকরা ৮০ ভাগ জুড়ে থাকা সৌদি আরব কেবল আরব বিশ্বেরই নেতা নয়, পবিত্র ভূমির জামিনদার-তত্ত্বাবধায়ক হিসাবে সমগ্র বিশ্ব মুসলিমের কাছে হওয়া উচিৎ এর এক বিশেষ পরিচয় মুহাম্মদী আরব এবং মুহাম্মদী ইসলাম। কিন্তু কালের স্রোতে দেড় হাজার বছরে জন্ম নিয়েছে ওহাবী ইসলাম, সৌদী ইসলাম, ইরানি ইসলাম, ইরাকি ইসলাম, পাকিস্তানি ইসলাম, আফগানি ইসলাম, কাদিয়ানি ইসলাম - এরকম কতো মতলবী ইসলাম যাদের আধিপত্যবাদের ক্রীড়াণকরা বিশ্বজুড়ে চালাচ্ছে তাদের প্রচার ও ভায়ে ভায়ে যুদ্ধ। কুরআনিক মুসলিম হওয়ার জন্য যারা নিবেদিতপ্রাণ তারা মুহাম্মদী ইসলাম অন্বেষণে গিয়ে পড়ছে বিভ্রান্তির বেড়াজালে।
স্বাভাবিক ভাবেই প্রশ্ন ওঠে বিশ্ব মুসলিমের এই বিপর্যয় দশায় সৌদি আরবের বর্তমান ভূমিকা কি? বিশ্বের মুসলমানদের বাঁচাতে, তাদের শান্তি, নিরাপত্তা ও আর্থিক স্বচ্ছলতা আনয়নে কি করছে সৌদি নেতৃত্ব? বলা বাহুল্য, সচেতন প্রতিটি মুসলমানের কাছেই এগুলো অবান্তর অপ্রয়োজনীয় প্রশ্ন। কারণ সৌদি নেতৃত্ব বিশ্বের মুসলমানদের কল্যাণের জন্য কি করছে এটা কোনো প্রশ্নই নয় - প্রশ্ন হচ্ছে বিশ্বের মুসলমানদের সর্বনাশের জন্য সৌদি বাদশারা কি না করছে? বিশ্বের মুসলমান তো বটেই বিশ্বের প্রতিটি শান্তিকামী মানুষের জীবনে চরম অভিশাপ রূপে যে মার্কিন-বৃটিশ নেতৃত্ব একের পর এক পদক্ষেপ নিয়ে চলেছে তাতে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ মদদ দিয়ে চলছে আরবের বাদশারা।
সৌদি নেতৃত্বের এই ‘শয়তানের দোসর’ ভূমিকার কারণ খোঁজার জন্য শুধু একটা প্রশ্ন মনে জাগালেই যথেষ্ট। প্রশ্নটি হচ্ছে পবিত্র ভূমি মক্কা ও মদিনা অবস্থিত যে রাষ্ট্রটিতে তার নামটি সৌদি আরব কেন? কি সম্পর্ক রাসুলের সঙ্গে এই ‘সৌদি’ শব্দের? কি সম্পর্কই বা রয়েছে ইসলামের সঙ্গে এই ‘সৌদি’ নামের? এসব প্রশ্নের উত্তর খোঁজার জন্য দৃষ্টি দেয়া যেতে পারে ইতিহাসের পাতায়। বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান ইসলামিক ফাউন্ডেশন প্রণীত ‘ইসলামি বিশ্বকোষ’-এ সৌদি আরবের যে ইতিহাস তুলে ধরা হয়েছে প্রসঙ্গের প্রয়োজনে এখানে তা থেকে প্রয়োজনীয় অংশ তুলে ধরা হলো বর্তমান সংলাপ-এর পাঠকদের জন্য।
সা’উদ এর বংশের নামে সৌদি আরব!
আজকের সৌদি আরব রাষ্ট্রটির নামের আগে যে শব্দটি পরিচিতিমূলক বিশেষণ হিসেবে এঁটে রয়েছে তার সঙ্গে ইসলামের কোনোই যোগসূত্র নেই। নেই দ্বীনের নবী মুহাম্মদ (সাঃ)-এঁর কোনো যোগাযোগ।
সা’উদ বংশের নামে পরিচয় সেঁটে দেয়া হয়েছে আরব ভূমির! সপ্তদশ শতাব্দির প্রারম্ভে মধ্য আরবের দখলকৃত দার’ঈয়ায় প্রতিষ্ঠিত ক্ষুদ্র গোত্রের শাসনকর্তা সা’উদ ইব্ন মুহাম্মদ ইব্ন মাকরান-এর নামেই নামকরণ করা হয় আজকের সৌদি বংশের। যা থেকে বর্তমান সৌদি আরব! সা’উদীরা ধ্বংস করে দেয় কারবালায় ইমাম হুসেনের (রাঃ) সমাধি!
১৭৬৫ থেকে ১৮০৩ সাল পর্যন্ত ক্ষমতাসীন আব্দুল আযীয (প্রথম) ইব্ন মুহাম্মদ ইব্ন সা’উদ শিয়া সমপ্রদায়ের প্রতি বিদ্বেষ থেকে ১৮০১ সালে কারবালা আক্রমণ করেন এবং দখল করেন। এ সময় তার সৈন্যরা ইমাম হুসেনের (রাঃ) সমাধি ধ্বংস করে দিলে শিয়ারা আযীযের উপর ক্ষুব্ধ হয়ে পড়ে। পরিণামে এক শিয়া ঘাতক ১৮০৩ সালের ৩ নভেম্বর দার’ঈয়ার আল তারাইফ মসজিদে নামাজরত অবস্থায় আব্দুল আযীযকে হত্যা করা হয়। কেবল কারবালা দখলই নয় বর্বরদের মতো দখল করার দস্যুতায় ভরে আছে সা’উদ বংশের ইতিহাস।
সে সময়কার মক্কায় স্বাধীন শাসনকর্তা গালিবের সঙ্গেও যুদ্ধ বাঁধে সা’উদ বংশধর আযীযের। এরই ধারাবাহিকতায় দেখা যায় আযীয নিহত হওয়ার পর ক্ষমতাসীন তার পুত্র সা’উদ ইব্ন আব্দুল আযীয ১৮০৪ সালে মদিনা দখল করেন এবং সেখান থেকে তুর্কী নাগরিকদের তাড়িয়ে দেন। অথচ তারাও ছিলো মুসলমান। তাদের অপরাধ তুর্কী শাসকরা সা’উদ বংশের বিরুদ্ধে ছিলো। এই তুর্কী-সা’উদী বিরোধের জের ধরে ১৮১৮ সালে পরবর্তী শাসনকর্তা আব্দুল্লাহ ইব্ন সা’উদ ইস্তাম্বুলে নিহত হন।
সা’উদ বংশের সাম্রাজ্যবাদ ও ক্ষমতা লিপ্সা এবং নীতিহীনতার জন্য উচ্চ মূল্য দিতে হয় এই বংশের আরেক শাসনকর্তা তুর্কী ইব্ন আব্দুল্লাহ্ ইব্ন মুহাম্মদ ইব্ন সা’উদকেও। ১৮৩৩ সালে রিয়াদের কেন্দ্রীয় মসজিদে নামাজরত অবস্থায় প্রাণ দিতে হয় তাকে তারই বংশীয় মুশারী ইব্ন আব্দুর রাহমানের হাতে।
সীমাহীন ভোগ বিলাস, নীতিহীনতা আর ক্ষমতায় মদমত্ত সা’উদ বংশের গুণধর যুবরাজদের অন্তর্কলহ আর খুনোখুনি ছিল এদের ভেতরগত চরিত্রেরই বাহ্যিক প্রকাশ। এই গত সত্তরের দশকেই সৌদি আরবে ক্ষমতাসীন ছিলেন বাদশা নামধারী শাসনকর্তা ফয়সল। ১৯৭৫ সালে প্রাসাদ ষড়যন্ত্রের শিকার হয়ে তারই ভ্রাতষ্পুত্রের হাতে নিহত হন তিনি।
এটাও ছিলো ১৮৩৩ সালে রিয়াদে নিহত তুর্কী ইব্ন আব্দুল্লাহর খুনেরই ধারাবাহিকতা মাত্র। ১৮৪১-৪৩ সাল পর্যন্ত ক্ষমতাসীন আব্দুল্লাহ্ ইব্ন ছুনয়্যানকে ১৮৪৩ সালে স্ববংশীয় ফয়সল ইব্ন তুর্কী বন্দি করে কারাগারে নিক্ষেপ করলে সেখানেই ধুঁকে ধুঁকে মৃত্যু ঘটে তার। ১৮৬৫-৭১ সাল পর্যন্ত ক্ষমতাসীন আব্দুল্লাহ ইবন্ ফায়সালকে ১৮৭১ সালে তার ভাইয়েরা তলোয়ারের মুখে ক্ষমতাচ্যুত করে। সা’উদ বংশের এই অন্তর্কলহের ফলে সৃষ্ট দুর্বলতার সুযোগ নিয়েই বোধ করি ১৮৮৪ সালে তারা ক্ষমতা হারায় পার্শ্ববর্তী হাইমের রাশিদী বংশের কাছে। পরবর্তীতে ১৯০২ সালে সা’উদ বংশীয় আব্দুল আযীয ইব্ন সা’উদ রাতের অন্ধকারে ৬০/৭০ জন অনুসারী নিয়ে রিয়াদ নগরী দখল করেন এবং রাশিদী বংশের ওয়ালী আজলানকে হত্যা করে সাউদ বংশের ক্ষমতা পুনঃপ্রতিষ্ঠা করেন।
রাজবংশ হিসেবে এবং ১৯১০ সালে মক্কা নগরী দখল করেন।
বেশ কয়েক বছর আগে লন্ডনে বোমা বিস্ফোরণের ঘটনার পর লন্ডনের মেয়র লিভিংস্টোন বিবিসি’র সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে বলেন, পাশ্চাত্য দেশগুলো তেলের প্রয়োজনে গত ৮০ বছর ধরে আরবদের মাথার উপর ছড়ি ঘোরাচ্ছে। তিনি বলেন, প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর পশ্চিমা দুনিয়া যদি আরবদের ভাগ্য নিজেদেরই নির্ধারণ করার সুযোগ দিতো তাহলে লন্ডনে বোমা হামলার সুযোগ ঘটতো না।
লিভিংস্টোনের এই উচ্চারণের সত্যতা ধরা পড়ে ইসলামি ফাউন্ডেশন প্রণীত ইসলামি বিশ্বকোষে বর্ণিত ইতিহাসে। এ থেকে কিছু অংশের উদ্ধৃতি দিলে বিষয়টি স্পষ্ট বোঝা যাবে।
‘বর্তমান মধ্যপ্রাচ্য বহুলাংশে ব্রিটেনের সৃষ্টি’ - এ মন্তব্য করা হয় ইসলামি বিশ্বকোষে। এতে উল্লেখ করা হয় ১৯২১ সালে ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী চার্চিল জেরুজালেমে এক নৈশভোজের পর ‘দীর্ঘ আলোচনায় চার্চিল ঠিক করলেন ট্রান্স জর্ডান নামক একটি ছোট দেশ সৃষ্টি করে তার আমীর বানানো হবে আব্দুল্লাহকে। এখানে থাকবে ব্রিটেনের ঘাঁটি। বেদুঈন উপজাতিদের নিয়ে একদল সাহসী সৈনিক গঠিত হবে একজন ইংরেজ সেনাপতির অধীনে। ব্রিটেন আর্থিক সাহায্য দিয়ে রাজকোষের ঘাটতি পূরণ করবে।
বিনিময়ে আব্দুল্লাহ ইংরেজের বিশ্বস্ত ও বশংবদ মিত্রে পরিণত হবে। ’
বৃটিশরা আব্দুল আযীয ইব্ন সা’উদকে মাসিক মাসোহারা দিতো মাত্র পাঁচ হাজার পাউন্ড! বিনিময়ে ব্রিটেন নির্ধারণ করতো তাদের বৈদেশিক নীতি! ‘১৯৭৩ সালের মে মাসে ব্রিটেন সাউদি আকাশসীমা বিপদমুক্ত রাখবার ব্যাপারে দুই দেশের মধ্যে একটি চুক্তির কথা ঘোষণা করে। ’
অপরদিকে, ১৯৫১ সালে এক চুক্তির বলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র দাহরান বিমান ঘাঁটি ব্যবহারের অধিকার পায়। ১৯৭৪ সালের এপ্রিল মাসে ঘোষিত এক যৌথ ঘোষণায় বলা হয়, ‘সাউদি আরবের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা শক্তিশালী করবার জন্য সাউদি জাতীয় রক্ষীবাহিনী আধুনিকীকরণের দায়িত্ব মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের উপর দেয়া হচ্ছে। ’
বলা বাহুল্য, আল্লাহকে ভুলে গিয়ে এবং নবী মুহাম্মদ (সাএঁর শান্তির (ইসলাম) জোস ভুলে গিয়ে ইসলামকে আনুষ্ঠানিকতায় রূপ দিয়ে মার্কিন-বৃটিশ প্রভুদের হাতে নিজেদের ভাগ্য সঁপে দেয়ার এই সাউদি নীতিরই ধারাবাহিকতায় ইরাক-আফগানিস্তানে নির্বিচারে মুসলমান নিধনে মার্কিন-বৃটিশ পশু শক্তি ব্যবহার করছে।
পাচ্ছে প্রাকৃতিক সম্পদের যাবতীয় সমর্থন-সহায়তা। সাউদি তথাকথিত বাদশাদের এই মার্কিন-বৃটিশ পদলেহী স্বভাবের পরিবর্তন ব্যতিত এ অবস্থার পরিবর্তন এক দুঃসাধ্য ব্যাপার। এ প্রশ্নে তাই আজ বিশ্বের মুসলমানদের প্রয়োজন সোচ্চার হয়ে ওঠা। জোরালো চাপ প্রয়োগ করা দরকার বর্তমান সৌদি নেতৃত্বের উপর। দরকার এই আওয়াজ তোলা - ‘পবিত্র ভূমির নাম বদলাও।
সৌদি আরব নয়, পবিত্র ভূমির নাম হতে হবে মুহাম্মদী আরব। আরো আওয়াজ তুলতে হবে মুহাম্মদী চরিত্রের নেতৃত্ব চাই পবিত্র ভূমির মাটিতে। ’
বর্তমানে সৌদির গদিতে আসীন বাদশাহ বিশ্ব মুসলমানের প্রাণের দাবি মেনে নিয়ে কি দেশের নাম পরিবর্তন করে ‘মুহাম্মদী আরব’ রেখে আল্লাহর কুরআনিক ‘মুসলিম’ হওয়ার জন্য বিশ্ব-মুসলিমকে আহ্বান জানিয়ে নতুন ইতিহাস সৃষ্টি করতে পারেন???!!!
প্রশ্ন উঠছে বিশ্বজুড়ে একটি গোত্রের দখলকৃত করদ মক্কা-মদিনায় গিয়ে কি হজ্ব হয়? আল্লাহর রহমত কি পাওয়া যায়? তাহলে মুসলমানেরা প্রতি বছরে কেন যান? কেউ কি আছেন বাংলাদেশ তথা বিশ্বে এর উত্তর দিতে পারবেন!!!
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।