আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

বিড়াল: প্রাচীন মিশরে

বাংলার মাটি বাংলার জল, বাংলার বায়ু, বাংলার ফল, পুন্য হউক, পুন্য হউক, পুন্য হউক, হে ভগবান। বাংলার ঘর, বাংলার হাট, বাংলার বন, বাংলার মাঠ, পুর্ন হউক, পূর্ন হউক, পূর্ন হ্‌উক, হে ভগবান। রবীন্দ্রনাথ
বিড়ালের বৈজ্ঞানিক নাম: ফেলিস সিলভেসট্রিস কাটুস। অবশ্য প্রাচীন মিশরে বিড়ালকে বলা হত: ‘মাউ। ’ এর মানে, ‘দেখা’।

প্রাচীন মিশরে বিড়ালকে অত্যন্ত পবিত্র মনে করা হত। ছোট-বড় সকলেই সম্মান করত এই ছোট্ট প্রাণিটিকে । বিড়াল মিশরের সমাজে গুরুত্বপূর্ন ভূমিকা পালন করত। যে কারণে বিড়ালকে তারা শিল্পে স্থান দিয়েছিল, মর্যাদা দিয়েছিল দেবতার, মৃত্যুর পর এমন কী বিড়ালের মমিও করা হত। বিড়াল কৃষিক্ষেত্রের অনিষ্টকর জীবজন্তু থেকে রক্ষা করত।

এ কারণে মিশরবাসী বিড়ালের প্রশংসা করত। বিড়াল সাপও মারতে পারত ; বিশেষ করে বিষধর গোক্ষুর। এভাবে বিড়াল প্রাচীন মিশরে সুখ ও শান্তির প্রতীক হয়ে ওঠে। পরবর্তীকালে প্রাচীন মিশরে বিড়ালদেবীর পূজাও আরম্ভ হয়- যা প্রায় ২০০০ বছর টিকেছিল। বিড়ালের দেবীর নাম ছিল বাস্ট বা বাসটেট ... প্রাচীন মিশরের মানচিত্র।

প্রাচীন মিশরের বিস্ময় যেন শেষ নেই। প্রাচীন এই জনপদের পরতে পরতে যেন রহস্য আর রহস্য। প্রাচীন মিশরের অধিবাসীদের বিড়ালপূজা সেই রহস্যময় একটি দিকেরই ইঙ্গিত দেয় যেন... গ্রিক ঐতিহাসিক হিরোডোটাসের একটি লেখায় প্রাচীর মিশরের অধিবাসীদের বিড়াল প্রীতি সম্বন্ধে পাওয়া যায় .... একবার। মিশরে একটি বাড়িতে আগুন লেগেছে। বিড়ালের যেন ক্ষতি না হয় সেজন্য বাড়ির মানুষ বিড়াল ঘিরে দাঁড়িয়ে ছিল ।

গ্রিক ঐতিহাসিক হিরোডোটাস আরও লিখেছেন: পারস্যের সৈন্যবাহিনী মিশর আক্রমন করতে এসেছে। পারসিক সেনাপতি মিশরবাসীর অত্যধিক বিড়ালপ্রেম সম্বন্ধে অবগত ছিলেন। তিনি সৈন্যদের বিড়াল সংগ্রহের নির্দেশ দিলেন। করলেন। সীমান্তের দিকে মিশরীয় সৈন্যরা অগ্রসর হচ্ছে।

পারসিক সৈন্যরা হাজার হাজার বিড়াল ছেড়ে দিল। ভয়ার্ত মিশরীয় সৈন্যরা এদিক ওদিক ছোটাছুটি করা পবিত্র বিড়ালের ক্ষতির করার চেয়ে রণাঙ্গন থেকে পালিয়ে গেল। মিশর পারস্যের অধিকৃত হয়ে যায় ... মিশরীয় মার্জার প্রাচীন মিশরে থিবস বলে এক সমৃদ্ধশালী নগরী ছিল। সেখানকার একটি সমাধিসৌধের দেওয়ালে বিড়াল-বন্দনা সরূপ এই কথাগুলি লেখা ছিল... হে মহৎ মার্জার, দেবগনের প্রতিহিংসক তুমি এবং শব্দসমূহের বিচারক, স্বাধীন নৃপতির অধিশ্বর এবং পবিত্র চক্রের প্রশাসক তুমি প্রকৃতই মহৎ মার্জার ... পরিবারের লোকেরা বিড়াল দেখেশুনে রাখত। বিড়াল নিয়ে তাদের ছিল ভারি অহংকার।

পড়শীর বিড়ালটি দেখতে সুন্দর হলে পাশের বাড়ির লোকেরা ঈর্ষা করত। ঘর সাজাত বিড়ালের ছবি দিয়ে, ঘরের এককোণে রাখত বিড়ালের মূর্তি, শরীরে পরত বিড়ালের ছবিওয়ালা তাবিজ । বিড়ালের নিরাপত্তার জন্য ছিল কঠোর আইন ছিল। ইচ্ছাকৃত কিংবা অনিচ্ছাকৃত বিড়াল হত্যার শাস্তি ছিল মৃত্যুদন্ড। মিশরের বাইরে বিড়াল রপ্তানী ছিল নিষিদ্ধ।

তারপরও লোভী চোরাচালানিরা ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলে বিড়াল পাচার করত ; প্রাচীন মিশরীয় নথিপত্রে দেখা যায় যে- বিড়াল উদ্ধারের জন্য পাশ্ববর্তী অঞ্চলে সামারিক অভিযান পরিচালিত হত! প্রাচীন মিশর জুড়ে বিড়ালের প্রতি কেন এই অসম্ভব গভীর ভক্তি ? এর উত্তর খোঁজা যাক। নীল নদ । জীববিজ্ঞানীরা সুপ্রাচীনকালে নীল নদের পাড়ে বিড়ালের অস্তিত্বের প্রমান পেয়েছেন। ধারণা করা হয় যে প্রাচীন মিশরের অধিবাসীরাই সভ্যতায় প্রথম বিড়াল পুষেছিল। তবে এ ঘটনাটি ২০০০ খ্রিস্টপূর্বের আগে ঘটেনি।

প্রাচীন মিশরে এক ধরনের বুনো বিড়াল ছিল-যার বৈজ্ঞানিক নাম: ‘ফেলিস চাউস’। যা প্রাচীন মিশরবাসীর মনে মুগ্ধ বিস্ময় সৃষ্টি করেছিল। প্রাচীর মিশরে নীল নদের দু’পাড়ে খাদ্যশস্য উৎপাদন হত। সে ফসলের অনিষ্ট করে ইঁদুর । বিড়াল ইঁদুর খায়।

সাপের ছোবলের মৃত্যু হয় মানুষের । ‘ফেলিস চাউস’ সাপ মারতে পারে। এসব কারণেই প্রাচীন মিশরবাসীর মনে বিড়াল সম্বন্ধে শুভ ধারণা জন্মে। বিড়াল ক্রমশ গৃহপালিত হয়ে ওঠে থাকে। বিড়ালের ওপর নির্ভর করতে থাকে গ্রামবাসী ।

তারা চাইত বিড়াল যেন গ্রামেই থাকে। কালক্রমে বিড়াল মানুষের খাদ্যে অভ্যস্ত হয়ে গেলে তাকে আর গ্রামের বাইরে খাদ্যের অন্বেষন করতে হয় না। রীতিমতো পোষা হয়ে ওঠে বিড়াল । কুকুরের বদলে বিড়াল নিয়ে শিকার করতে বেরুত গ্রামবাসী। বিড়াল মাছ কি পাখি খুঁজে নিয়ে আসত।

১৫৪০ থেকে ১০৬৯ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে নির্মিত সমাধিসৌধে বিড়ালের অসংখ্য ছবি পাওয়া গিয়েছে। একটি সুপরিচিত দৃশ্য হল মেয়েদের চেয়ারের নিচে বিড়াল বসে। মনে থাকার কথা- প্রাচীন মিশরে বিড়ালকে বলা হত: ‘মাউ। ’ এর মানে, ‘দেখা’। শিশুদের আদর করে মিত (বিড়াল) বলে ডাকত।

বিপদ-আপদ দূর করার জন্য বাড়ির বাইরে বিড়ালের মূর্তি স্থাপন করত। প্রাচীন মিশরের পারিবারিক জীবনের প্রতিটি স্থরে বিড়াল ছিল অনিবার্য। দেবী মাফডেট। এককালে ন্যায়বিচার ও মৃত্যুদন্ডের দেবী ছিলেন মাফডেট; দেবীর মাথা সিংহের মতো। বিড়ালের দেবী বাস্ট (বা বাসটেট) দেবী ছিলেন মাফডেট এর স্থলাভিষিক্ত হন।

পরে দেবী বাস্ট এর ইমেজ নমনীয় হয়ে আসে। এবং তিনি প্রাচীন মিশরের উর্বরতা ও মাতৃত্বের দেবী হয়ে ওঠেন। তবে বিড়ালদেবী হিসেবে বাস্ট এর উত্থানের প্রক্রিয়াটি সহজ ছিল না, বরং অত্যন্ত জটিল ছিল। প্রাচীন মিশরে বৃহৎ মাতৃদেবী ও রক্ষাকর্ত্রী ছিল মুত; পরে মুত-এর সঙ্গে দেবী আইসিস অঙ্গীভূত হয়ে যান। আরও পরে আইসিস সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়ে উঠেছিলেন বিড়াল দেবী বাস্ট।

যে দেবীর ছিল সিংহমস্তক । যা হোক। রা ছিলেন প্রাচীন মিশরে উচ্চতম সূর্যদেব-আশ্চর্য এই, প্রথমদিকে সে দেবতারও ছিলেন মার্জারমূর্তি। রা-এর এক ভয়ালদর্শন সিংহমস্তক এক কন্যার নাম শেকহমেট। রা-এর বিরুদ্ধে যারা বিদ্রোহ করত- শেকহমেট তাদের সমূলে ধ্বংস করত।

এই শেকহমেট-এরই ছোট বোন বাস্ট। ৩০০০ খ্রিস্টপূর্বে দেবী বাস্টকে সিংহমস্তক হিসেবে চিহ্নিত করা গেছে। পরে অবশ্য দেবী পরিপূর্ণ বিড়ালের রূপ ধারণ করেন এবং গৃহপালিত বিড়াল দেবী বাস্ট-এর পবিত্র প্রতীক হয়ে ওঠে। বিড়াল দেবী বাস্ট। বাস্ট লেডি অভ দ্য ইস্ট নামে পরিচিত ছিল।

অপরদিকে শেকহমেট পরিচিত ছিল লেডি অভ দ্য ওয়েস্ট নামে। মিশরের মানচিত্রে বুবাসটিস নগরের অবস্থান। দেবী বাস্ট এর প্রধান উপাসনালয় ছিল এই বুবাসটিস-এ। ৯৫০ খ্রিস্টপূর্ব নাগাদ মিশরের রাজধানী হয়ে উঠেছিল। আর বাস্ট হয়ে ওঠেন জাতীয় দেবী।

সেই সঙ্গে উর্বরতা ও যৌনতার দেবী। কেননা যৌনতার জন্য প্রাচীন মিশর জুড়ে বিড়ালের সুখ্যাতি ছিল। দেবী বাস্ট বিড়ালের দেখাশোনা করতেন। সংগীত ও নৃত্যেরও দেবী ছিলেন বাস্ট। বুবাসটিস নগরের দেবী বাস্ট এর প্রধান উপাসনালয় বুবাসটিস-এর পবিত্র উপাসনালয়ে পুরোহিতরা দেখাশোনা করত।

বিড়ালের প্রতিটি অঙ্গভঙ্গি তারা লক্ষ করত। বিড়াল মারা গেলে অত্যন্ত জাঁকজমক পূর্ণভাবে বিড়ালের শেষকৃত্য পালন করা হত। মানুষের মতোই বিড়ালেরও মমি করা হত। ৬টি ধাপে মমি করা হত ... ১ অঙ্গপ্রত্যঙ্গের অপসারণ। ২ দেহ বালি কিংবা অন্য কিছু দিয়ে স্টাফ করা।

৩ বসা অবস্থায় রাখা। ৪ দেহ শক্ত করে বাঁধা। ৫ কালো কালি দিয়ে মুখসহ শরীরের অন্যান্য জায়গায় অলংকরণ করা। ৬ রাসায়নিক দ্রব্য বাদে প্রাকৃতিক মালমশলা ব্যবহার। বিড়াল দেবী বাস্ট।

মমিকৃত বিড়াল দেবী বাস্ট কে উৎসর্গ করা হত। ১৮৮৮ খ্রিস্টাব্দে একজন মিশরীয় কৃষক বড় একটি সমাধিক্ষেত্রে অসংখ্য মমিকৃত বিড়াল ও ছানা আবিস্কার করে। শিল্পীর কল্পনায় বুবাসটিস-এ বিড়ালদেবী বাস্ট। বুবাসটিস-এ ৩০০,০০০ বিড়ালের মমি পাওয়া গিয়েছে। কোনও কোনও মমিতে মাথায় ও ঘারে আঘাতের চিহ্ন।

হয়তো দেবীর উদ্দেশ্যে বলি দেওয়া হয়েছিল কিংবা বিড়ালের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছিল। প্রাচীন মিশরের সমাজজীবনে বিড়ালের স্থান ছিল অনন্য। লোকে ভাবত বিড়ালই জীবন রক্ষা করে। এ কারণে প্রাচীন মিশরের অধিবাসীরাও বিড়ালকে সম্মানের সঙ্গে রক্ষা করত। বিড়াল মারা গেলে শোকে অভিভূত হয়ে ক্ষোভের চিহ্ন হিসেবে ভ্রুঁ চেছে ফেলত! পরবর্তীকালে বিড়াল মিশর থেকে রোমে যায়।

বিড়াল ইঁদুর ধরে বলে রোমের অধিবাসীরা বিড়ালকে সম্মান করত এবং বিড়ালকে আদর করে ডাকত- ‘ফেলিস’। এর অর্থ,‘মঙ্গলময় অশুভ ইঙ্গিত’! পরে বিড়ালদেবী বাস্ট রোমান চন্দ্রদেবী ডিয়ানার সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়ে যান। তথ্য ও ছবি : ইন্টারনেট।
 

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.