আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

বন্ধু নিরু আর আমার হারিয়ে যাওয়া সুর...

I am what I am and that's how I would be. No I am not stubborn. I just want to be myself.

খুব মন খারাপ ছিল। কেন খারাপ ছিল তার চেয়ে বড় কথা অনেক লম্বা সময়ের জন্যেই মনটা খারাপ ছিল। ভোরে ফেসবুকে ঢুকে আরো আপসেট হয়ে পড়লাম, মনে হলো জগৎসংসারে আমি ছাড়া সবাই দুর্দান্ত সুখী। ব্লগে ঢুকে দেখি আমার বন্ধু আনারকলি নিরু আমার ব্লগ দেখে গিয়েছে। ওর ব্লগে ঘুরে আসলাম।

এত ভালো হয়ে গেলো মনটা, যে লিখতে বসে গেলাম। নিরু গাইতো। আবার গাইতো না। হলে অনেকেই খালি স্টেজেই গাইতো, আর কেউ কেউ গাইতো সারাদিন। গুনগুন।

আমার মনে পড়ে বেগম রোকেয়ার সেই স্ট্যাচুর পাশে বড়গাছটার তলায় একটানা গান গেয়ে যাওয়া। নাহিদের সাথে পরিচয় এভাবে গান গাইতে গিয়েই। খুব কষ্ট লাগে যখন হলের ছবিগুলো এত স্পষ্ট মনে পড়ে কিন্তু এত কাছের অনেক মানুষগুলোর নাম আর মনে পড়েনা। অথচ কত আনন্দের সময় ছিল সেসব দিনগুলো!! মনে পড়ে হলের নাটক সংগঠনের কথা। সাগরিকা আপা আর সেলিনা ম্যাডামের উদ্যোগে আমরা গড়ে তুলেছিলাম "রোকেয়া নাটক"।

নাটক নামাতে হবে। হলের ফান্ড থেকে তেমন টাকা পাওয়া যেতনা। জোড়াতালি দিয়ে চারটা নাটক নামিয়েছিলাম! ববকাট চুল হওয়াতে আমার প্রথম নাটকে আমি ছিলাম ভিলেইন, আর নিরু ছিল নায়িকা। একটা ডায়ালগ ছিল নিরু আমাকে বলছে "শয়তান, তুই আমার দেহ পাবি, কিন্তু মন পাবিনা!" আমি বলেছিলাম "ওটাই তো চাই সুন্দরী, তাতেই আমার চলবে, মুহাহাহাহাআআ!!" পরের নাটকে হয়েছিলাম নায়ক। হায় খোদা, বহ্নির করা এমন ফাটাফাটি মেকাপ, হলের অর্ধেক মেয়ে আমার প্রেমে পড়ে গেল!! গান শিখিনি কখনো।

আমার বড়বোনদের গান শেখানোর জন্যে মাস্টার আসতো। সেসময় তাদের দেখলে মনে হতো গান গাওয়াটা একটা যন্ত্রণা-বিশেষ। আমি নিশ্চিত মাস্টারের কাছে অ-আ-ক-খ গান শিখলে আমার ভেতরের সুরের পাগলামিটা হয়তো এতটা প্রকট হতোনা। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাকে বরাবরই আমার বড়ো ভয়। আম্মুর কাছ থেকেই হয়তো কন্ঠে সুরটা আমরা পেয়েছি উত্তরাধিকার সুত্রে।

গান গাইতে প্রচন্ড ভালবাসতাম। এখনও বাসি। সেলিনার বাসার ছাদে আমি জোর করে স্কুলজীবনের বন্ধুদের গান শুনাতাম। হা হা, শুনতে না-চাইলেও শোনাতাম। সেলিনার বাসার পাশেই কর্ণফুলী।

নৌকায় চড়ে ঘুরতে যেতাম বন্ধুরা সবাই মিলে। আমার সেই কৈশোরের একটা আকূল স্বপ্ন ছিলো একদিন নৌকায় চড়ে কোন-একজন ভালোবাসার মানুষের কাঁধে মাথা রেখে আমি গান শোনাবো। সেসময়গুলো এত দ্রূত পার হয়ে গিয়েছে, ভাবলেই কেমন হাহাকার করে ওঠে মনটা। চট্টগ্রাম কলেজের মেইন গেইটদিয়ে ঢুকলেই একটা সিমেন্ট বিছানো লম্বা রাস্তা ছিল। দু'পাশে লম্বা লম্বা গাছ।

আমরা পাঁচজন দল বেঁধে হাটছি। আমি আর লোপা কোরাসে গাইছিলাম, চায়ের কাপে পরিচয় তোমার সাথে, এমন সময় একজন মুরুব্বি ভাইজান এসে বকা দিয়ে গেলো। কলেজের সেইসব গাঁয়ে মানেনা আপ্নি মোড়ল টাইপ শিবিরের ভাইজানগুলোর কথা আগে শুনেছিলাম। সেইবার প্রত্যক্ষ করলাম। কিন্তু আমাদের কে থামায়।

কিছুদিন পরে আমি আর রুমানা আবার গাইলাম, নওজোয়ান নওজোয়ান বিশ্বে জেগেছে নওজোয়ান...আরো কত যে এটাসেটা গাইতাম, তার কোনও ফর্মূলা ছিলনা। কেমিস্ট্রী গ্যালারটা আমার খুব প্রিয় ছিল। আমি গ্যালারির নীচে বন্ধুদের বসিয়ে একেবারে উপরে চলে যেতাম। সেখান থেকে চিৎকার করে গাইতাম। গ্যালারিতে প্রতিধ্বনি হতো, খুব মজা লাগতো এভাবে গাইতে।

একদিন গাইছিলাম বেলিন্ডা কার্লাইলের সামার রেইন, কেমিস্ট্রী গ্যালারিতে। এমন আকুল হয়ে গাইছিলাম, বন্ধুরাও তাকিয়ে ছিল আমার দিকে। খেয়ালই করিনি পেছনে একজন স্যার এসে দাঁড়িয়েছেন। ওনার নাম মনে নেই, খুব সম্ভব্তঃ সুবীর অথবা সুধীর স্যার। (আসলে ক্লাস করতাম না বলে টিচারদের নামও জানতাম না)।

ওনাকে দেখে আমার গানটা লো-ভলিউমে নামতে নামতে থেমে গেল। "ভালই তো চলছিল, থামলে কেন?" এই বলে স্যার আমাকে ওনার রুমে ডেকে নিয়ে গেলেন। এরপর কিছু ধমকাধমকির মাধ্যমে আমার গ্যালারির একক সংগীতানুষ্ঠানের ইতি। রোকেয়া হলে আমি ছিলাম বড়বোনের ডাবলিং। আমার মত গাড্ডু ছাত্রীর মেইন বিল্ডিং এ জায়গা পাওয়ার কথা নয়।

বোনের ডাবলিং হওয়ার সুবাদে সে সুযোগ হলো। আমি তো ছিলাম লাগামছাড়া। সারাদিন টৈটৈ করে বেড়াতাম। রান্না করা, বিছানা গোছানো, কাপড় ধোয়া সবই বোন করতো। আমি খালি রুমে ফিরে খেতাম আর ঘুমাতাম।

পাশের রুমে একজন আপা (ইস্‌, কেন যে নাম মনে পড়ছেনা!!) হারমোনিয়াম বাজিয়ে গাইতেন। মাঝে মাঝে ওনার হারমোনিয়ামটা রুমে নিয়ে এসে শুরু করতাম অনুরোধের আসর। আমাকে অবশ্য অনুরোধ করা লাগতো না, মোটামুটি জোর করে না-থামালে একটানা গেয়েই যেতাম, গেয়েই যেতাম!! আমাদের রুমের পাশের বারান্দায় মাঝে মাঝে রুমমেট শেলীআপার সাথে রাত জাগতাম। শেলীআপার প্রায়ই মন খারাপ থাকতো। ততদিনে বাংলা বিভাগের এই ছাত্রীর কল্যাণে আমার বিচিত্রা-সঞ্চয়িতা পড়া শেষ।

গীতবিতান তো আমার কাছে ছিল বাইবেলের মত। শেলী আপা আমার প্রিয় কবিতা আবৃত্তি করে শোনাতেন। আমি শোনাতাম গান। পূর্ণিমার চাঁদ যদি থাকতো সেসময়ে, তাহলে তো আর কথাই নেই! আমরা দুজনেই খুব স্বপ্ন দেখতাম। আমি শেলী আপাকে বলতাম "দেখো যদি কোনোও ছেলে পাও যে আমাকে এমন পূর্ণিমার রাতে তোমার মত আবৃত্তি করে শোনাবে আর আমি গাইবো গান, তবে তাকে নিয়ে এসো আমার কাছে।

আমি ভালোবাসবো। " শেলী আপা শব্দ করে হাসতো। বলতো আমি নাকি একটা পাগল। কলেজে থাকতে বিএনসিসি করতাম। ক্যাম্পিং এ গেলাম।

শেষদিনে যখন ক্যাম্পফায়ার হলো, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান শুরু হলো। একটা সিনিয়র ভাইয়া (যথারীতি নাম মনে নেই, চেহারাও মনে নেই) খুব দারুণ গান গেয়েছিল। পাব্লিক ডিমান্ড, একটা দুটো নয়, অনেকগুলো! আমি তো টপাস্‌ করে তার প্রেমে পড়ে গেলাম! তারপরদিনই ফিরে গেলাম বাসায়। সেই ভাইয়াটাকে মনে নেই আর। কিন্তু তার গান মনে আছে আর আমার সেই বিহ্বল হওয়াটাও মনে আছে! আসলেই কী পাগল ছিলাম।

তেমন পাগলই তো থাকতে চেয়েছিলাম সারাজীবন। কিন্তু তা-কি আর হয়? তাই মাঝে মাঝে মন খারাপ হয়। চারপাশের রিয়্যালিটির কড়া শিকলে পাগলটা মাঝে মাঝে ছটফট করে ওঠে। মন খারাপ হয়। দমবন্ধ হয়ে আসে।

সেরকম একটা সময়ে নিরুর এই ব্লগটা ঘুরে আসা আমার খুব দরকার ছিল। বন্ধুরা তো এজন্যই। ওরাই তো আমার "আমি"টাকে খুঁজেপেতে এনে দেয় বারবার, নিজে যখন হারিয়ে ফেলি নিজেকে!

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.