আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

মগের মুলুকে মানুষের কি দাম আছে?

লেখালেখির কারখানা

মগের মুলুকে মানুষের কি দাম আছে? মৌসুমি সমুদ্রের উপকূল-অভিজিৎ সেন, প্রকাশক-প্রতিভাস, প্রথম প্রকাশ-ডিসেম্বর ২০০৬, প্রচ্ছদ-রোচিষ্ণু সান্যাল। দাম- ৪০০ টাকা। মুবিনুর রহমান ধর্ম কী? বিশ্বাস কী? সত্য কি ধর্ম ও বিশ্বাসের বাইরের কোনো অলীক দর্শন? এমন হাজারো প্রশ্নের উত্তরের জন্য মানুষের অনুসন্ধান দীর্ঘকালের। কেউ কেউ বলেন ধর্ম দুর্বল মানুষের সর্বশেষ অবলম্বন, কিন্তু এও তো সত্য যে, ক্ষমতাবান মানুষেরও প্রধান ও প্রিয় অস্ত্র ধর্ম। জটিল জীবনে মানুষ যখন দিশা খুঁজে পায় না তখনও ধর্ম স্ব স্ব স্থানে স্থির হয়ে থাকে।

তার পরও যেন মানুষ ধর্ম ছাড়া অচল, অনড়। একজন মুসলমান চোরকে যদি জিজ্ঞেস করা হয় যে তোমার ধর্ম কী, সে সোৎসাহে উত্তর দেবে ‘ইসলাম’, আবার হিন্দু বাটপারকে একই প্রশ্ন করলে উত্তর মিলবে ‘সনাতন’, ঠিক সেরকমভাবেই খ্রিস্টান সমুদ্রদস্যু তার বিশ্বাস জাহির করবে, বৌদ্ধ ডাকাতও বলবে না যে জীব হত্যা মহাপাপ নয়। কিন্তু চোরের ধর্ম চুরি করা, বাটপারের বাটপারি, সমুদ্রদস্যু লুণ্ঠনের ধর্মে বিশ্বাসী আর ডাকাত তার ধর্ম রক্ষা করে দুর্ধর্ষ ডাকাতিতে। তাহলে ধর্মটা কী শুধুই বিশ্বাস, চর্চা নাকি জীবন আচরণ? ধর্ম কি মানুষের জন্য নাকি মানুষ ধর্মের জন্য। দুর্ঘটনায় কি মানুষের যার যার ধর্ম পাল্টে যেতে পারে? এমন হাজারো প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে পাঠক আমাদের অবশ্যই যেতে হবে ‘মৌসুমি সমুদ্রের উপকূলে’।

এক বিস্মৃত সময়ের আখ্যান রচনা করেছেন গল্পকার, ঔপন্যাসিক অভিজিৎ সেন। প্রশ্ন উঠতে পারে মগের মুলুকের সঙ্গে ধর্ম নিয়ে উপর্যুক্ত নাতিদীর্ঘ বক্তৃতাবাজির কী মানে? মানে তো আছে, নিশ্চয় তা না হলে কেনই বা ধর্মের দোহাই? মগ ও পর্তুগিজদের দৌরাত্ম্যে বিপর্যস্ত বাংলার শোকগাথা এই উপন্যাস ‘মৌসুমি সমুদ্রের উপকূল’। বাংলা সাহিত্যে এর আগে এই বিষয় নিয়ে সম্ভবত আর কেউ উপন্যাস লেখেননি। ‘রহু চন্ডালের হাড়’-এর লেখক অভিজিৎ সেন নির্মাণ করলেন এক বিশাল পটভূমিতে সতের শতকের বাঙালি, মগ, ফিরিঙ্গি আর হারমাদদের নিয়ে রাজনীতি, ধর্মনীতি, সমাজনীতির মিথষ্ক্রিয়ায় এক মহকাব্যিক কাহিনী। আউলাকেশি দেছেলবা, ইগনেশিয়াস ডি সিলভা, কবিরাজ ক্ষেমংকর সেন, উপকূলের বণিক যুগল সাধু, মিরবহর জাহাঙ্গির ইউসুফ, মারিয়া ল্যাবার্ডো, ওলন্দাজ বণিক ইয়েকব, পর্তুগিজ বণিক মাসকারহেনা, পাদ্রী মেনজেস, বিষ্ণুপ্রিয়, শর্মিষ্ঠা, বোবা, সন্দ্বীপের রাজা সেবাস্তিয়ান গনজালেসসহ অসংখ্য চরিত্র সতের শতকের বাংলা উপকূলে ঘোরাফেরা, বসবাস করছে।

তৈরি হচ্ছে নানা ধরনের নাটকীয় সংঘাত, প্রেম, বিরহ, ভালোবাসা, ঘৃণা, ট্র্যাজেডি। ধাত্রীনগর গ্রামে মগ আক্রমণকে কেন্দ্র করে লেখক এক ভুলে যাওয়া সময়ের আখ্যান রচনা করেছেন, যার পরিধিতে ষোলো-সতের শতকের ইউরোপ থেকে বাকলা চন্দ্রদ্বীপ-সন্দ্বীপ-আরাকান-চট্টগ্রাম একসূত্রে ধরা পড়েছে। এই বিস্তৃত অঞ্চলে তখন একদিকে দয়ালহরি ও জিতু চক্রবর্তীর মতো কাষ্ঠব্রাক্ষণদের অমানবিক সামাজিক রীতি, জাত্যাভিমানে যাঁতাকলে পড়ে অসংখ্য পরিবার মগস্পৃষ্ট, মগ-ফিরিঙ্গি-মুসলমান লুণ্ঠিত, কুমির-ব্যাঘ্র পরিবাদে, ব্রাহ্মণ্যবিচারে জাতভ্রষ্ট, ধর্মান্তরিত, ধর্ষিত মানুষেরা প্রজন্মান্তরে অভিশাপ বয়ে নিয়ে বেড়ায়। বৈঞ্চব বিষ্ণুপ্রিয়র স্ত্রী সত্যভামা, বিবাহিতা জ্যেষ্ঠ কন্যা শর্মিষ্ঠা আর কনিষ্ঠ কন্যা মঞ্জুরীর মগ-ফিরিঙ্গি কর্র্র্র্র্তৃক লুণ্ঠন, তৎপরবর্তী পালাক্রমে ধর্ষণ, অত্যাচার, জাতভ্রষ্টিত হওয়ার মধ্য দিয়ে একে একে বের হয়ে আসে মানুষ, অমানুষ, নামানুষের চরিত্র। মানুষের ভয়, হিংসাচরিতার্থ পরায়ণতা, সামাজিক গ-ির বাইরে আসতে না পারার সাহসের অভাব আর সবকিছু পেছনে ফেলে শুধু মানুষ বিবেচনায় মানুষের পাশে দাঁড়ানোর এক দুঃসহ, দুর্ধর্ষ, লোমহর্ষক আখ্যান আবর্তিত হয়।

জীবন, নিরাপত্তা আর স্বাধীনতা যখন থাকে না মানুষ তখন হয়ে পড়ে মর্যাদাহীন, অমানবিক। মগ-হার্মাদ-ফিরিঙ্গিদের আক্রমণের ভয়ে ভীত মানুষেরা পশুর মতো জীবনযাপন করত। তাদের বিক্রি করা হতো ক্রীতদাস হিসেবে এ বাজার থেকে ও বাজার, এদেশ ও থেকে অন্যদেশ। বস্তুত মগ লুণ্ঠিত মানুষজনের অন্যের ক্রীতদাস হয়ে জীবন অতিবাহিত করাই একমাত্র উপায়। উপন্যাসটির যে নির্মাণ তা কোনো সরলরৈখিক বয়ানে এগিয়ে যায়নি।

পড়তে পড়তে মনে হয়েছে চোখের সামনে বইয়ের তাকের মতো গল্পের তাক। এক একটি তাক থেকে লেখক এক একটি দৃশ্য বের করে পাঠকের সামনে তুলে ধরছেন। পাঠক দেখে নিচ্ছে ষোলো-সতের শতকের বাংলা-আরকান-চট্টগ্রামের ইতিহাস, সংস্কৃতি, মানুষ, প্রকৃতি। কথায় কথায় সময়ের ক্ষত-বিক্ষত মানুষের চেহারা উন্মেচিত হচ্ছে সহজ ভাষার বয়ানে। মানুষের মর্যাদাহানির এই মিছিলে সবচেয়ে বেশি দুর্ভোগে ছিল নারী ও শিশুরা।

নারীদের শুধু যৌন সম্ভোগের মূল্যবান আইটেম ছাড়া আর কোনো মানবিক দৃষ্টিতে দেখা হতো না। ফলে শর্মিষ্ঠা-মঞ্জরীদের মগ-ফিরিঙ্গি দস্যুদের হাতে ধর্ষণ কিংবা পশ্চাৎদেশের বিকৃত সুখ সম্ভোগের শিকার হওয়া বিচিত্র কিছু নয়। কিন্তু এই যে মগের মুলুকের অত্যাচার, ধর্ষণ, খুন তার পেছনে মগদের পেছনে কোনো ইতিহাস প্রভাব রাখেনি। শ্বেতহস্তীর জন্য যুদ্ধ করা মানুষেরা এমন জুলুমবাজ যে কখনোই ছিল না তা উপন্যাসের কথামুখে স্পষ্ট বিধৃত। বরং বাণিজ্য ও পর্যটনের ছদ্মবেশে আসা বণিক-সমুদ্র দস্যুরাই এই অনাচারের ¯্রষ্টা।

বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী ব্রহ্মদেশের মানুষেরা নিজেদের মধ্যে ক্ষমতা ও রাজত্ব নিয়ে কলহে লিপ্ত থাকলেও তা কোনোভাবেই সাধারণ মানুষের অসহ্য যন্ত্রণার কারণ হয়ে ওঠেনি। বরং বাণিজ্য বিস্তারের লক্ষ্যে আগুয়ান পর্তুগিজ বণিকরা বাণিজ্য, দস্যুবৃত্তি, রাজনীতি এমন কি ধর্মপ্রচারের আড়ালে দখল করে নিতে থাকে শান্তিপ্রিয় বাংলাদেশের মানুষের সুখ-সমৃদ্ধি-ঐতিহ্য। বিভিন্ন দেশ থেকে ধরে আনার ভয়ঙ্কর দুর্ধর্ষ সন্ত্রাসী দাস আর আরাকানের স্থানীয় মগদের যৌথ প্রযোজনায় গড়ে ওঠে মগের মুল্লুকের ত্রাস মগ-ফিরিঙ্গি-হার্মাদ বাহিনী। এই লেখার শিরোনামে একটি ছুড়ে দেয়া হয়েছে যে, মগের মুলুকে কি মানুষের মূল্য আছে? সহজ ও সরাসরি উত্তর- না নেই। শায়েস্তা খাঁর আমলে বাংলার মানুষ যে সুখ ও সমৃদ্ধি ভোগ করেছিল তার অনেকটা সুখনিদ্রা কেড়ে নিয়েছিল মগসন্ত্রাসীরা।

যাপিত জীবনের বদলে শর্মিষ্ঠাকে জীবনের জন্য ধর্ম বদলাতে হয়। ভালোবাসার জন্য ধর্মান্তরী হয়ে কবিরজা ক্ষেমংকর হয়ে ওঠেন মহম্মদ নাসির, বিষ্ণুপ্রিয় পথ ধরেন গয়া কাশির। তবুও ব্রাহ্মণ্য অবিচার অব্যাহত থাকে। অভিজিৎ সেনের গভীর বিশ্লেষণ, পর্যবেক্ষণ আর কল্পনাশক্তির সম্মিলনে ‘মৌসুমি সমুদ্রের উপকূল’ লেয়ারে লেয়ারে বিবৃত আখ্যান। সমুদ্রের ঢেউয়ের মতোই উপন্যাস পাঠককে এবার গল্পের উপরে তোলে আবার ইতিহাসের গভীরে নিমজ্জিত করে।

আমরা পাঠক ভেসে যাই সতের শতকের উপকূলীয় বাংলায়। - See more at: Click This Link

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।