বিদায় - পথের নয়, পথিকের...
সংকট
অনেকদিন বাড়ি ফিরি না। আমি নিশ্চিত জানি আমার ঘরটি অনেক জঞ্জাল-বন্দী হয়ে আছে, আমি নিশ্চিত জানি বাড়িটি আমার জন্য অপেক্ষা করে আছে, তবু অনেকদিন যাওয়া হয় না নিজের বাড়িটিতে। আমি উদভ্রান্ত হয়ে গিয়েছিলাম, তাই ঘরটিকে ছেড়ে দিয়ে পথে নেমেছি। অসার সব ঠিকানাবিহীন সরনী ধরে হেঁটে চলতে চলতে ক্লান্ত হয়েছি। আশ্রয়হীন হয়েছিলাম,কারন আশ্রয় পাওয়ার যোগ্য আমি ছিলাম না।
আপন ঘরে টিকে থাকতে হলে নিজের অস্তিত্বকে সুদৃঢ় করতে হয়, ঘরটিকে জানাতে হয় "আমি আছি!" না হলে নিজেকেই বিবর্ণ মনে হয়, অস্তিত্বহীন মনে হয়, তেমন অস্তিত্বহীন হয়ে গেলাম আমি আর ঘরকে ছেড়ে ধীর পায়ে হেটে এলাম অজানা গন্তব্যে। এখনো আমি নিজের ঘরটিতে ফিরিনি। আমি ঠিক জানি ঘরটি আমার জন্য অপেক্ষা করছে আর আমি অপেক্ষা করছি অস্তিত্বের জন্য।
প্রতিটি মানুষ নিজের অবস্থানে উজ্জ্বল থাকতে চাওয়ার সীমাহীন আকাঙ্খায় ভোগে। এটাই হয়তো তার অস্তিত্বের সংকট।
নিজেকে আবিস্কারের উন্মাদনা নয় নিজেকে পাওয়ার প্রত্যাশা। তুমি যদি হারিয়ে যেতে চাও, তাহলে নিজেকে খুঁজো । আপনালয় থেকে সেদিনই বেরিয়ে এসেছিলাম যেদিন আমি নিজেকে খুঁজে পাচ্ছিলাম না, আমি তখন হারিয়ে যেতে চাই নি, আমি শুধু একটি অস্তিত্ব চেয়েছিলাম, আজও যেমনটি চাইছি। আমার ঘরটি তার প্রতিটি চৌকাঠের অধিকার আমায় দিয়েছিলো, কখনো সে আবদার করেনি আমার কাছে কোন অধিকারের। একটি ঘরের পরিপূর্ণতাই হলো তার বাসিন্দায়, না মূলত বাসিন্দায় নয়, বাসিন্দার অস্তিত্বে, আমি তেমন কোন অস্তিত্বই চেয়েছি, যে অস্তিত্ব নিয়ে নিজের ঘরের কাছে আমি উজ্জ্বল হতে পারি, পূর্ণতা দিতে পারি।
এই 'আমিত্ব'ই আমার অস্তিত্বের বৈপরিত্য ছিলো!
ঘরের জানালা-দরজা বন্ধ ছিলো। যদিও খোলা ছিলো ভেন্টিলেশন সিস্টেম, কারন আমাকে শ্বাস নিতে হতো, আমি অক্সিজেন বিহীন বাঁচতে পারি না। শুধু এই নিঃশ্বাসটুকুই কোন একটা কিছুর অস্তিত্ব টের পাইয়ে দিচ্ছিলো, জানিয়ে দিচ্ছিলো "আমি এখনো বেঁচে আছি!" সেটা কি শুধুই জৈবনিক আবেদন?! সে আবেদনের গভীরে কেউ একজন বলে বসতো "আমি আছি!" আমি জিজ্ঞেস করতাম নৈঃশব্দিক চিৎকারে! "কে তুমি?" ,"কে তুমি??" উত্তরটা খুব মৃদু ছিলো, আমি শুনতে পাইনি তার কিছুই। এমন অতৃপ্ত, অসহ্য অস্তিত্বহীনতা দিয়ে ঘরের পূর্ণতাকে অবজ্ঞা করার শাস্তি স্বরুপ নির্বাসিত করলাম নিজেকে। আমি এখন শুধুই জানি, ঘরটি আমার জন্য অপেক্ষা করছে আর আমি অস্তিত্ব এখনো খুঁজে পাই নি!
অস্তিত্ব
যেখানে দাড়িয়ে আছি এটা একটি অনুজ্জ্বল জায়গা, একটি ল্যাম্পপোষ্ট, কিছু হলুদাভ আলো আর গাঢ় অন্ধকার, চারিদিকে শুনশান নিরবতা, অজানা সব অবারিত রাস্তা আর অন্ধকারের দেয়াল।
কোথাও কোন দিক নির্দেশনা মূলক সাইন-বোর্ড নেই, তাই আমি রাস্তাগুলো হারিয়ে ফেলি প্রতিনিয়ত আর ঘুরে ফিরে কেমন করে যেন এই ল্যাম্পপোষ্টের আলোর নিচেই হাজির হচ্ছি, সময়ের হিসেবে হয়তো অনেকদিন আমি এমন অন্ধকারে আটকে গেছি, আমি ঠিক হিসেব করিনি কতদিন হবে। এখন এই ল্যাম্পপোষ্টটিকে মনে হচ্ছে একটি আশ্রয়! এমন ঘুটঘুটে অন্ধকারে যাকে কেন্দ্র করে কিছুটা আশ্বস্ত হওয়া যায়। তাই সারা পথ ঘুরে ফিরে অন্ধকারের মাঝে অসীম বিপন্নতার ভীড়ে এই ল্যাম্পপোষ্টের আলোটুকুই আশ্রয়। এখানে এসে পৌছানোর আগে আমি একটি শহরে ছিলাম তখন এমন অন্ধকার ছিলনা, তখন ছিলো কোলাহল আর চিৎকারের হল্লা, সবাই সেখানে প্রচন্ড ব্যাস্ত ছিলো। রাস্তাটি পাথরের ছিলো আর অলিগলিতে দোকান-পাট, বাড়ী-ঘর আর যানবাহনের হুল্লোড়ে মাতোয়ারা।
এত কিছুর ভীড়ে এক সময় আমি নিজেকেই আর খুঁজে পাচ্ছিলাম না, আমি পালাতে চাইলাম আর ছুট লাগালাম, ছুটতে ছুটতে সন্ধ্যা হলো আমার সামনে দেখলাম দুর্গের মতো করে গড়া একটি পাথরের দেয়াল আর কাঠের অনেক বড় একটি দরজা, আমি আর পিছনে ফিরে যেতে চাইছিলাম না আর ভেবেছিলাম এখানে আশ্রয় নিবো। অবশেষে সেখানে প্রবেশের পর অন্ধকার নামলো আর আমার আশ্রয় হলো এই একাকী ল্যাম্পপোষ্ট!
...........তারপর অনেকদিন কেটে গেলো, আমি এখন ঘরে ফেরার জন্য একটি কম্পাস খুঁজছি, কারন আমি আজ ঘরে ফিরতে চাইছি। ঘরটি আমাকে আগলে রেখেছিলো আর আমি অস্তিত্বহীন হলাম, আজ যখন 'অস্তিত্ব' কি জানলাম তখন আমি বিপন্ন!
অস্তিত্ব খোঁজার প্রয়াসে ঘর থেকে বেরিয়ে এতসব হল্লা-নিস্তব্ধতায় আবিস্কার করলাম, যেটা আমি খুঁজে মরছি সেটা বাইরের কিছু নয় সেটা খুব বেশি ভেতরের আবেদন! যা সব সময়ই অপরিচিত, সব সময়ই নতুন, হয়তো এটি সব সময়েই সংজ্ঞা-বিহীন একটি শব্দ "অস্তিত্ব"।
ঘরটিও আজ জঞ্জাল আর নিস্তদ্ধতায় বিপন্ন!!
বোধ
.......
আলো — অন্ধকারে যাই — মাথার ভিতরে
স্বপ্ন নয়, কোন এক বোধ কাজ করে!
স্বপ্ন নয় — শান্তি নয় — ভালোবাসা নয়,
হৃদয়ের মাঝে এক বোধ জন্ম লয়!
আমি তারে পারি না এড়াতে
সে আমার হাত রাখে হাতে;
সব কাছ তুচ্ছ হয়, পন্ড মনে হয়,
সব চিন্তা — প্রার্থনার সকল সময়
শূন্য মনে হয়,
শূন্য মনে হয়!
সহজ লোকের মতো কে চলিতে পারে!
কে থামিতে পারে এই আলোয় আঁধারে
সহজ লোকের মতো! তাদের মতন ভাষা কথা
কে বলিতে পারে আর! — কোন নিশ্চয়তা
কে জানিতে পারে আর? — শরীরের স্বাদ
কে বুঝিতে চায় আর? — প্রাণের আহ্লাদ
সকল লোকের মতো কে পাবে আবার!
সকল লোকের মতো বীজ বুনে আর
স্বাদ কই! — ফসলের আকাঙক্ষায় থেকে,
শরীরে মাটির গন্ধ মেখে,
শরীরে জলের গন্ধ মেখে,
উৎসাহে আলোর দিকে চেয়ে
চাষার মতণ প্রাণ পেয়ে
কে আর রহিবে জেগে পৃথিবীর পরে?
স্বপ্ন নয়, শান্তি নয়,কোন এক বোধ কাজ করে
মাথার ভিতরে!
পথে চলে পারে — পারাপারে
উপেক্ষা করিতে চাই তারে:
মড়ার খুলির মতো ধ’রে
আছাড় মারিতে চাই, জীবন্ত মাথার মতো ঘোরে
তবু সে মাথার চারি পাশে!
তবু সে চোখের চারি পাশে!
তবু সে বুকের চারি পাশে!
আমি চলি, সাথে সাথে সেও চলে আসে!
আমি থামি —
সেও থেমে যায়;
সকল লোকের মাঝে বসে
আমার নিজের মুদ্রাদোষে
আমি একা হতেছি আলাদা?
আমার চোখেই শুধু ধাঁধা?
আমার পথেই শুধু বাধা?
জন্মিয়াছে যারা এই পৃথিবীতে
সন্তানের মতো হয়ে —
সন্তানের জন্ম দিতে দিতে
যাহাদের কেটে গেছে অনেক সময়
কিংবা আজ সন্তানের জন্ম দিতে হয়
যাহাদের ; কিংবা যারা পৃথিবীর বীজক্ষেতে আসিতেছে চলে
জন্ম দেবে — জন্ম দেবে বলে;
তাদের হৃদয় আর মাথার মতন
আমার হৃদয় না কি? — তাহাদের মন
আমার মনের মতো না কি?
–তবু কেন এমন একাকী?
তবু আমি এমন একাকী!
হাতে তুলে দেখি নি কি চাষার লাঙল?
বালটিকে টানি নি কি জল?
কাস্তে হাতে কতবার যাই নি কি মাঠে?
মেছোদের মতো আমি কত নদী ঘাটে
ঘুরিয়াছি;
পুকুরের পানা শ্যালা — আঁষটে গায়ের ঘ্রাণ গায়ে
গিয়েছে জড়ায়ে;
–এই সব স্বাদ
–এ সব পেয়েছি আমি — বাতাসের মতন অবাধ
বয়েছে জীবন,
নক্ষত্রের তলে শুয়ে ঘুমায়েছে মন
একদিন;
এই সব সাধ
জানিয়াছি একদিন — অবাধ — অগাধ;
চলে গেছি ইহাদের ছেড়ে —
ভালোবেসে দেখিয়াছি মেয়ে মানুষেরে,
অবহেলা করে আমি দেখিয়াছি মেয়ে মানুষেরে,
ঘৃণা করে দেখিয়াছি মেয়েমানুষেরে;
আমার সে ভালোবাসিয়াছে,
আসিয়াছে কাছে,
উপেক্ষা সে করেছে আমারে,
ঘৃণা করে চলে গেছে — যখন ডেকেছি বারেবারে
ভালোবেসে তারে;
তবুও সাধনা ছিল একদিন — এই ভালোবাসা;
আমি তার উপেক্ষার ভাষা
আমি তার ঘৃণার আক্রোশ
অবহেলা করে গেছি; যে নক্ষত্র — নক্ষত্রের দোষে
আমার প্রেমের পথে বারবার দিয়ে গেছে বাধা
আমি তা ভুলিয়া গেছি;
তবু এই ভালোবাসা — ধুলো আর কাদা — ।
মাথার ভিতরে
স্বপ্ন নয় — প্রেম নয় — কোনো এক বোধ কাজ করে।
আমি সব দেবতার ছেড়ে
আমার প্রাণের কাছে চলে আসি,
বলি আমি এই হৃদয়েরে;
সে কেন জলের মতো ঘুরে ঘুরে একা কথা কয়?
অবসাদ নাই তার? নাই তার শান্তির সময়?
কোনোদিন ঘুমাবে না? ধীরে শুয়ে থাকিবার স্বাদ
পাবে না কি? পাবে না আহ্লাদ
মানুষের মুখ দেখে কোনোদিন!
মানুষীর মুখ দেখে কোনোদিন!
শিশুদের মুখ দেখে কোনোদিন!
এই বোধ — শুধু এই স্বাদ
পায় সে কি অগাধ — অগাধ!
পৃথিবীর পথ ছেড়ে আকাশের নক্ষত্রের পথ
চায় না সে? করেছে শপথ
দেখিবে সে মানুষের মুখ?
দেখিবে সে মানুষীর মুখ?
দেখিবে সে শিশুদের মুখ?
চোখে কালোশিরার অসুখ,
কানে যেই বধিরতা আছে,
যেই কুঁজ — গলগন্ড মাংসে ফলিয়াছে
নষ্ট শসা — পচা চালকুমড়ার ছাঁচে,
যে সব হৃদয়ে ফলিয়াছে
— সেই সব।
---জীবনানন্দ দাশ
*** ছবিসূত্রঃ গুগল.কম
***চতুর্মাত্রিক.কম এ পূর্ব প্রকাশিত
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।