আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

হুমায়ুন আজাদের প্রবচনগুচ্ছ

শান্তমনের শান্ত ব্লগ

প্রথমেই অধ্যাপক ড: হুমায়ুন আজাদ-এর সম্পর্কে দু একটি কতা বলে নেওয়া যাক। কবি, ঔপন্যাসিক, সমালোচক, ভাষাবিজ্ঞানী, কিশোর সাহিত্যিক এবং কলাম লেখক অধ্যাপক ড: হুমায়ুন আজাদ ২৮শে এপ্রিল, ১৯৪৭ সালে (১৪ই বৈশাখ, ১৩৫৪ বঙ্গাব্দ), মুন্সিগঞ্জ জেলার বিক্রমপুরে জন্মগ্রহণ করেন। এই বিক্রমপুরে বাংলার বহু কীর্তিমান ব্যক্তির জন্ম হয়েছে। এখানকার কৃতী সন্তানের মধ্যে রয়েছেন অতীশ দীপঙ্কর, জগদীশ চন্দ্র বসু, ব্রজেন দাস, হুমায়ুন আজাদ ইত্যাদি। ড: হুমায়ুন আজাদ রাড়িখালের স্যার জগদীশ চন্দ্র বসু ইন্সটিটিউশন১৯৬২ সালে মাধ্যমিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে ১৯৬৪ সালে ঢাকা কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করেন।

মেধাবী ছাত্র আজাদ ১৯৬৭ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলায় স্নাতক ডিগ্রি এবং ১৯৬৮ সালে একই বিভাগ থেকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন; উভয় ক্ষেত্রেই তিনি প্রথম শ্রেণীতে প্রথম হন। ১৯৭৬ সালে তিনি এডিনবরা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ভাষাবিজ্ঞানে পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করেন। তাঁর গবেষণার বিষয় ছিল বাংলা ভাষায় সর্বনামীয়করণ। তাঁর স্ত্রী লতিফা কোহিনুর। তাঁর দুই কন্যা মৌলি আজাদ, স্মিতা আজাদ এবং একমাত্র পুত্র অনন্য আজাদ।

হুমায়ুন আজাদের প্রবচনগুচ্ছ ১.মানুষ সিংহের প্রশংসা করে, কিন্তু আসলে গাধাকেই পছন্দ করে। ২.পুঁজিবাদের আল্লার নাম টাকা, মসজিদের নাম ব্যাংক। ৩.সুন্দর মনের থেকে সুন্দর শরীর অনেক আকর্ষনীয়, কিন্তু ভন্ডরা বলেন উল্টো কথা। ৪.হিন্দুরা মূর্তিপূজারী, মুসলমানেরা ভাবমূর্তিপূজারী। মূর্তিপূজা নির্বুদ্ধিতা আর ভাবমূর্তিপূজা ভয়াবহ।

৫.শামসুর রাহমানকে একটি অভিনেত্রীর সাথে টিভিতে দেখা গেছে। শামসুর রাহমান জানেন না কার সাথে পর্দায়, আর কার সাথে শয্যায় যেতে হয়। ৬.আগে কারো সাথে পরিচয় হলে জানতে ইচ্ছা হতো সে কী পাশ? এখন কারো সাথে দেখা হলে জানতে ইচ্ছা হয় সে কী ফেল? ৭.শ্রদ্ধা হচ্ছে শক্তিমান কারো সাহায্যে স্বার্থোদ্ধারের বিনিময়ে পরিশোধিত পারিশ্রমিক। ৮.আজকাল আমার সাথে কেউ একমত হলে নিজের সম্বন্ধে গভীর সন্দেহ জাগে। মনে হয় আমি সম্ভবত সত্যভ্রষ্ট হয়েছি, বা নিম্নমাঝারি হয়ে গেছি।

৯.মিনিষ্টার শব্দের মূল অর্থ ভৃত্য। বাঙলাদেশের মন্ত্রীদের দেখে শব্দটির মূল অর্থই মনে পড়ে। ১০.আগে কাননবালারা আসতো পতিতালয় থেকে, এখন আসে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। ১১.জনপ্রিয়তা হচ্ছে নেমে যাওয়ার সিঁড়ি। অনেকেই আজকাল জনপ্রিয়তার পথে নেমে যাচ্ছে।

১২.উন্নতি হচ্ছে ওপরের দিকে পতন। অনেকেরই আজকাল ওপরের দিকে পতন ঘটছে। ১৩.ব্যর্থরাই প্রকৃত মানুষ, সফলেরা শয়তান। ১৪.আমাদের অঞ্চলে সৌন্দর্য অশ্লীল, অসৌন্দর্য শ্লীল। রূপসীর নগ্ন বাহুদেখে ওরা হৈ চৈ করে, কিন্তু পথে পথে ভিখিরিনির উলঙ্গ দেহ দেখে ওরা একটুওবিচলিত হয় না।

১৫.পরমাত্মীয়ের মৃত্যুর শোকের মধ্যেও মানুষ কিছুটা সুখ বোধ করে যে সে নিজে বেঁচে আছে। ১৬.একটি স্থাপত্যকর্ম সম্পর্কে আমার কোনো আপত্তি নেই, তার কোনো সংস্কারও আমি অনুমোদন করি না। স্থাপত্যকর্মটি হচ্ছে নারীদেহ। ১৭.প্রতিটি দগ্ধ গ্রন্থ সভ্যতাকে নতুন আলো দেয়। ১৮.বাঙলার প্রধান ও গৌণ লেখকদের মধ্যে পার্থক্য হচ্ছে প্রধানেরা পশ্চিমথেকে প্রচুর ঋণ করেন, আর গৌণরা আবর্তিত হন নিজেদের মৌলিক মূর্খতার মধ্যে।

১৯.মহামতি সলোমনের নাকি তিনশো পত্নী, আর সাত হাজার উপপত্নী ছিলো। আমারমাত্র একটি পত্নী, তবু সলোমনের চরিত্র সম্পর্কে কারো কোনো আপত্তি নেই, কিন্তু আমার চরিত্র নিয়ে সবাই উদ্বিগ্ন। ২০.বাঙালি মুসলমানের এক গোত্র মনে করে নজরুলই পৃথিবীর একমাত্র ও শেষ কবি। তাদের আর কোনো কবির দরকার নেই। ২১.বাঙালি যখন সত্য কথা বলে তখন বুঝতে হবে পেছনে কোনো অসৎ উদ্দেশ্য আছে।

২২.আধুনিক প্রচার মাধ্যমগুলো অসংখ্য শুয়োরবৎসকে মহামানবরূপে প্রতিষ্ঠিত করেছে। ২৩.অধিকাংশ রূপসীর হাসির শোভা মাংসপিন্ডের কৃতিত্ব, হৃদয়ের কৃতিত্ব নয়। ২৪.পাকিস্থানিদের আমি অবিশ্বাস করি, যখন তারা গোলাপ নিয়ে আসে, তখনও। ২৫.আবর্জনাকে রবীন্দ্রনাথ প্রশংসা করলেও তা আবর্জনাই থাকে। ২৬.নিজের নিকৃষ্ট কালে চিরশ্রেষ্ঠ ব্যক্তিদের সঙ্গ পাওয়ার জন্যে রয়েছে বই; আর সমকালের নিকৃষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গ পাওয়ার জন্যে রয়েছে টেলিভিশন ওসংবাদপত্র।

২৭.শৃঙ্খলপ্রিয় সিংহের থেকে স্বাধীন গাধা উত্তম। ২৮.বাঙলায় তরুণ বাবরালিরা খেলারাম, বুড়ো বাবরালিরা ভন্ডরাম। ২৯.প্রাক্তন বিদ্রোহীদের কবরে যখন স্মৃতিসৌধ মাথা তোলে, নতুন বিদ্রোহীরা তখন কারাগারে ঢোকে, ফাঁসিকাঠে ঝোলে। ৩০.একনায়কেরা এখন গনতন্ত্রের স্তব করে, পুঁজিপতিরা ব্যস্ত থাকে সমাজতন্ত্রের প্রশংসায়। ৩১.বেতন বাঙলাদেশে এক রাষ্ট্রীয় প্রতারণা, এক মাস খাটিয়ে এখানে পাঁচদিনের পারিশ্রমিক দেয়া হয়।

৩২.পুরষ্কার অনেকটা প্রেমের মতো: দু-একবার পাওয়া খুবই দরকার, এর বেশি পাওয়া লাম্পট্য। ৩৩.এক-বইয়ের পাঠক সম্পর্কে সাবধান। ৩৪.অভিনেত্রীরাই এখন প্রাত:স্মরণীয় ও সর্বজন শ্রদ্ধেয়। ৩৫.কবিরা বাঙলায় বস্তিতে থাকে, সিনেমার সুদর্শন গর্দভেরা থাকে শীতাতপনিয়ন্ত্রিত প্রাসাদে। ৩৬.মানুষের ওপর বিশ্বাস হারালে পাপ, তবে বাঙালির ওপর বিশ্বাস রাখা বিপজ্জনক।

৩৭.বুদ্ধিজীবীরা এখন বিভক্ত তিন গোত্রে: ভন্ড, ভন্ডতর, ভন্ডতম। ৩৮.শিক্ষকের জীবনের থেকে চোর, চোরাচালানি, দারোগার জীবন অনেক আকর্ষনীয়। এ-সমাজ শিক্ষক চায় না, চোর-চোরাচালানি-দারোগা চায়। ৩৯.শয়তানের প্রার্থনায় বৃষ্টি নামে না, ঝড় আসে; তাতে অসংখ্য সৎ মানুষের মৃত্যু ঘটে। ৪০.যে-বুদ্ধিজীবী নিজের সময় ও সমাজ নিয়ে সন্তষ্ট, সে গৃহপালিত পশু।

৪১.আর পঞ্চাশ বছর পর আমাকেও ওরা দেবতা বানাবে; আর আমার বিরুদ্ধে কোনো নতুন প্রতিভা কথা বললে ওরা তাকে ফাঁসিতে ঝুলোবে। ৪২.আমি এতো শক্তিমান আগে জানা ছিলো না। আজকাল মিত্র নয়, শত্রুদের সংখ্যা দেখে আত্মবিশ্বাস ফিরে পাই। ৪৩.পা, বাঙলাদেশে, মাথার থেকে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। পদোন্নতির জন্যেএখানে সবাই ব্যগ্র, কিন্তু মাথার যে অবনতি ঘটছে, তাতে কারো কোনো উদ্বেগনেই।

৪৪.হায়! থাকতো যদি একটি লম্বা পাঞ্জাবী, আমিও খ্যাতি পেতাম মহাপন্ডিতের। ৪৫.এখানকার একাডেমিগুলো সব ক্লান্ত গর্দভ; মূলো খাওয়া ছাড়া এগুলোর পক্ষে আর কিছু অসম্ভব। ৪৬.জন্মান্তরবাদ ভারতীয় উপমহাদেশের অবধারিত দর্শন। এ-অঞ্চলে একজন্মেপরীক্ষা দিতে হয়, আরেক জন্মে ফল বেরোয়, দু-জন্ম বেকার থাকতে হয়, এবং ভাগ্যপ্রসন্ন হলে কোনো এক জন্মে চাকুরী মিলতেও পারে। ৪৭.রবীন্দ্রনাথের নোবেল পুরষ্কার পাওয়ার দরকার ছিলো না, কিন্তু দরকার ছিলোবাঙলা সাহিত্যের।

পুরষ্কার না পেলে হিন্দুরা বুঝতো না যে রবীন্দ্রনাথ বড়োকবি; আর মুসলমানেরা রহিম, করিমকে দাবি করতো বাঙলার শ্রেষ্ঠ কবি হিসেবে। ৪৮.বাঙলাদেশে কয়েকটি নতুন শাস্ত্রের উদ্ভব ঘটেছে; এগুলো হচ্ছে স্তুতিবিজ্ঞান, স্তবসাহিত্য, সুবিধাদর্শন ও নমস্কারতত্ত্ব। ৪৯.এখানে অসতেরা জনপ্রিয়, সৎ মানুষেরা আক্রান্ত। ৫০.টেলিভিশন, নিকৃষ্ট জিনিসের এক নম্বর পৃষ্ঠপোষক, হিরোইন প্যাথেডিনেরথেকেও মারাত্মক। মাদক গোপনে নষ্ট করে কিছু মানুষকে, টেলিভিশন প্রকাশ্যেনষ্ট করে কোটি কোটি মানুষকে।

৫১.পৌরাণিক পুরুষেরা সামান্য অভিজ্ঞতা ভিত্তি করে অসামান্য সব সিদ্ধান্তনিতেন। যযাতি পুত্রের কাছে যৌবন ধার করে মাত্র এক সহস্র বছর সম্ভোগের পরসিদ্ধান্তে পৌঁছেন যে সম্ভোগে কখনো তৃপ্তি আসেনা! এতো বড়ো একটিসিদ্ধান্তের জন্যে সহস্র বছর খুবই কম সময়: আজকাল কেউ এতো কম অভিজ্ঞতায় এতোবড়ো একটি সিদ্ধান্ত নেয়ার সাহস করবে না। ৫২.অভিনেতারা সব সময়ই অভিনেতা; তারা যখন বিপ্লব করে তখন তারা বিপ্লবের অভিনয় করে। এটা সবাই বোঝে, শুধু তারাই বোঝে না। ৫৩.বাঙলাদেশের প্রধান মূর্খদের চেনার সহজ উপায় টেলিভিশনে কোনোআলোচনা-অনুষ্ঠান দেখা।

ওই মূর্খ মন্ডলিতে উপস্থাপকটি হচ্ছেন মূর্খশিরোমণি। ৫৪.বাঙলা, এবং যে-কোনো, ভাষার শুদ্ধ বানান লেখার সহজতম উপায় শুদ্ধ বানানটি শিখে নেয়া। ৫৫.পৃথিবী জুড়ে প্রতিটি নরনারী এখন মনে করে তাদের জীবন ব্যর্থ; কেননা তারা অভিনেতা বা অভিনেত্রী হতে পারে নি। ৫৬.মৌলিকতা হচ্ছে মঞ্চ থেকে দূরে অবস্থান। ৫৭.এরশাদের প্রধান অপরাধ পরিবেশদূষণ: অন্যান্য সরকারগুলো পুরুষদের দূষিত করেছে, এরশাদ দূষিত করেছে নারীদেরও।

৫৮.বাঙালি একশো ভাগ সৎ হবে, এমন আশা করা অন্যায়। পঞ্চাশ ভাগ সৎ হলেই বাঙালিকে পুরষ্কার দেয়া উচিত। ৫৯.একজন চাষী বা নদীর মাঝি সাংস্কৃতিকভাবে যতোটা মূল্যবান, সারা সচিবালয় ও মন্ত্রীপরিষদ ও ততোটা মূল্যবান নয়। ৬০.মানুষ ও কবিতা অবিচ্ছেদ্য। মানুষ থাকলে বুঝতে হবে কবিতা আছে; কবিতা থাকলে বুঝতে হবে মানুষ আছে।

৬১.বাঙালি আন্দোলন করে, সাধারণত ব্যর্থ হয়, কখনোকখনো সফল হয়; এবং সফল হওয়ার পর বাঙালির মনে থাকে না কেনো তারা আন্দোলন করেছিলো। ৬২.এদেশের মুসলমান এক সময় মুসলমান বাঙালি. তারপর বাঙালি মুসলমান, তারপরবাঙালি হয়েছিলো; এখন আবার তারা বাঙালি থেকে বাঙালি মুসলমান, বাঙালিমুসলমান থেকে মুসলমান বাঙালি, এবং মুসলমান বাঙালি থেকে মুসলমান হচ্ছে। পৌত্রের ঔরষে জন্ম নিচ্ছে পিতামহ। ৬৩.নিন্দুকেরা পুরোপুরি অসৎ হতে পারে না, কিছুটা সততা তাঁদের পেশার জন্যেঅপরিহার্য; কিন্তু প্রশংসাকারীদের পেশার জন্যে মিথ্যাচারই যথেষ্ট। ৬৪.বাস্তব কাজ অনেক সহজ অবাস্তব কাজের থেকে: আট ঘন্টা একটানা শ্রম গাধাওকরতে পারে, কিন্তু একটানা এক ঘন্টা স্বপ্ন দেখা রবীন্দ্রনাথের পক্ষেওঅসম্ভব।

৬৫.একটি নির্বোধ তরুণীর সাথেও আধ ঘন্টা কাটালে যে-জ্ঞান হয়, আরিস্ততলের সাথে দু-হাজার বছর কাটালেও তা হয় না। ৬৬.প্রতিটি সার্থক প্রেমের কবিতা বোঝায় যে কবি প্রেমিকাকে পায় নি, প্রতিটি ব্যর্থ প্রেমের কবিতা বোঝায় যে কবি প্রেমিকাকে বিয়ে করেছে। ৬৭.বিলেতের কবিগুরু বলেছিলেন যারা সঙ্গীত ভালোবাসে না, তারা খুন করতেপারে; কিন্তু আজকাল হাই ফাই শোনার সাথে সাথে এক ছুরিকায় কয়েকটি গীতিকার, সুরকার, গায়ক/গায়িকাকে খুন করতে ইচ্ছা হয়। ৬৮.এখন পিতামাতারা গৌরব বোধ করেন যে তাঁদের পুত্রটি গুন্ডা। বাসায় একটিনিজস্ব গুন্ডা থাকায় প্রতিবেশীরা তাঁদের সালাম দেয়, মুদিদোকানদার খুশি হয়েবাকি দেয়, বাসার মেয়েরা নির্ভয়ে একলা পথ চলতে পারে, এবং বাসায় একটিমন্ত্রী পাওয়ার সম্ভাবনা থাকে।

৬৯.তৃতীয় বিশ্বে নেতা হওয়ার জন্যে দুটি জিনিশ দরকার: বন্দুক ও কবর। ৭০.প্রতিটি বিজ্ঞাপণে পণ্যটির থেকে পণ্যাটি অনেক লোভনীয়; তাই ব্যর্থ হচ্ছেবিজ্ঞাপণগুলো। দর্শকেরা পণ্যের থেকে পণ্যাটিকেই কিনতে ও ব্যবহার করতে অধিকআগ্রহ বোধ করে। ৭১.কোনো দেশের লাঙলের রূপ দেখেই বোঝা যায় ওই দেশের মেয়েরা কেমন নাচে, কবিরা কেমন কবিতা লেখেন, বিজ্ঞানীরা কী আবিষ্কার করেন, আর রাজনীতিকেরাকতোটা চুরি করে। ৭২.যারা ধর্মের বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা দেয়, তারা ধার্মিক ও নয়, বিজ্ঞানী ওনয়।

শুরুতেই স্বর্গ থেকে বিতাড়িত করা হয়েছিলো, তারা তার বংশধর। ৭৩.যতোদিন মানুষ অসৎ থাকবে, ততোদিন তার কোনো শত্রুথাকে না; কিন্তু যেই সে সৎ হয়ে ওঠে, তার শত্রুর কোনো অভাব থাকে না। ৭৪.নারী সম্পর্কে আমি একটি বই লিখছি; কয়েকজন মহিলা আমাকে বললেন, অধ্যাপকহয়ে আমার এ-বিষয়ে বই লেখা ঠিক হচ্ছে না। আমি জানতে চাইলাম, কেন? তাঁরাবললেন, বিষয়টি অশ্লীল! ৭৫.এদেশে সবাই শিক্ষানুরাগী ও সমাজসেবক: দারোগার শোকসংবাদেও লেখা হয়, তিনি শিক্ষানুরাগী ও সমাজসেবক ছিলেন! ৭৬.শিল্পকলা হচ্ছে নিরর্থক জীবনকে অর্থপূর্ণ করার ব্যর্থ প্রয়াস। ৭৭.কিছু বিশেষণ ও বিশেষ্য পরস্পর সম্পর্কিত; বিশেষ্যটি এলে বিশেষণটি আসে, বিশেষণটি এলে বিশেষ্যটি আসে।

তারপর একসময় একটি ব্যবহার করলেই অন্যটিবোঝায়, দুটি একসাথে ব্যবহার করতে হয় না। যেমন: ভন্ড বললেই পীর আসে। আবারপীর বললেই ভন্ড আসে। এখন আর ভন্ড পীর বলতে হয় না; পীর বললেই ভন্ডপীর বোঝায়। ৭৮.ভক্ত শব্দের অর্থ খাদ্য।

প্রতিটি ভক্ত তার গুরুর খাদ্য। তাই ভক্তরা দিনদিন জীর্ণ থেকে জীর্ণতর হয়ে আবর্জনায় পরিণত হয়। ৭৯.মূর্তি ভাঙতে লাগে মেরুদন্ড, মূর্তিপূজা করতে লাগে মেরুদন্ডহীনতা। ৮০.আমাদের সমাজ যাকে কোনো মূল্য দেয় না, প্রকাশ্যে তার অকুন্ঠ প্রশংসাকরে, আর যাকে মূল্য দেয় প্রকাশ্যে তার নিন্দা করে। শিক্ষকের কোনো মূল্যনেই, তাই তার প্রশংসায় সমাজ পঞ্চমুখ; চোর, দারোগা, কালোবাজারি সমাজেঅত্যন্ত মূল্যবান, তাই প্রকাশ্যে সবাই তাদের নিন্দা করে।

৮১.সৌন্দর্য রাজনীতির থেকে সব সময়ই উৎকৃষ্ট। ৮২.ক্ষুধা ও সৌন্দর্যবোধের মধ্যে গভীর সম্পর্ক রয়েছে। যে-সব দেশে অধিকাংশমানুষ অনাহারী, সেখানে মাংসল হওয়া রূপসীর লক্ষণ; যে-সব দেশে প্রচুর খাদ্যআছে, সেখানে মেদহীন হওয়া রূপসীর লক্ষণ। এজন্যই হিন্দি আর বাঙলা ফিল্মেরনায়িকাদের দেহ থেকে মাংস ও চর্বি উপচে পড়ে। ক্ষুধার্ত দর্শকেরা সিনেমাদেখে না, মাংস ও চর্বি খেয়ে ক্ষুধা নিবৃত্ত করে।

৮৩.বাঞ্ছিতদের সাথে সময় কাটাতে চাইলে বই খুলুন, অবাঞ্ছিতদের সাথে সময় কাটাতে হলে টেলিভিশন খুলুন। ৮৪.স্তবস্ততি মানুষকে নষ্ট করে। একটি শিশুকে বেশি স্ততি করুন, সে কয়েকদিনে পাক্কা শয়তান হয়ে উঠবে। একটি নেতাকে স্ততি করুন, কয়েকদিনের মধ্যেদেশকে সে একটি একনায়ক উপহার দেবে। ৮৫.ধনীরা যে মানুষ হয় না, তার কারন ওরা কখনো নিজের অন্তরে যায় না, দু:খপেলে ওরা ব্যাংকক যায়, আনন্দে ওরা আমেরিকা যায়।

কখনো ওরা নিজের অন্তরেযেতে পারে না, কেননা অন্তরে কোনো বিমান যায় না। ৮৬.বাঙলাদেশের রাজনীতিকেরা স্থূল মানুষ, তারা সৌন্দর্য বোঝে না বলে গণতন্ত্র বোঝে না; শুধু লাইসেন্স-পারমিট-মন্ত্রীগিরি বোঝে। ৮৭.এমন এক সময় আসে সকলেরই জীবনে যখন ব্যর্থতাগুলোকেই মনে হয় সফলতা, আর সফলতাগুলোকে মনে হয় ব্যর্থতা। ৮৮.রাজনীতি ও সংস্কৃতি সম্পূর্ণ বিপরীত বস্তু: একটি ব্যাধি অপরটি স্বাস্থ্য। ৮৯.মহিলাদের ঘ্রাণশক্তিখুবই প্রবল।

আমার এক বন্ধুপত্নী স্বামীর সাথে টেলিফোনে আলাপের সময়ও তার স্বামীর মুখে হুইস্কির ঘ্রাণ পান। ৯০.আগে প্রতিভাবানেরা বিদেশ যেতো; এখন প্রতিভাহীনেরা নিয়মিত বিদেশ যায়। ৯১.অধিকাংশ সুদর্শন পুরুষই আসলে সুদর্শন গর্দভ; তাদের সাথে সঙ্গমে একটি দুষ্প্রাপ্য প্রাণীর সাথে সহবাসের অভিজ্ঞতা হয়। ৯২.বিশ্বের নারী নেতারা নারীদের প্রতিনিধি নয়; তারা সবাই রুগ্ন পিতৃতন্ত্রের প্রিয় সেবাদাসী। ৯৩.কোনো বাঙালি আজ পর্যন্ত আত্মজীবনী লেখেনি, কেননা আত্মজীবনী লেখার জন্যেদরকার সততা।

বাঙালির আত্মজীবনী হচ্ছে শয়তানের লেখা ফেরেশতার আত্মজীবনী। ৯৪.মানুষের তুলনায় আর সবই ক্ষুদ্র: আকাশ তার পায়ের নিচে, চাঁদ তার এক পদক্ষেপের দূরত্বে, মহাজগত তার নিজের বাড়ি। ৯৫.কারো প্রতি শ্রদ্ধা অটুট রাখার উপায় হচ্ছে তার সাথে কখনো সাক্ষাৎ না করা। ৯৬.চারাগাছে ও মাঝেমাঝে ফোটে ভয়ংকর ফুল। ৯৭.পুরুষ তার পুরুষ বিধাতার হাতে লিখিয়ে নিয়েছে নিজের রচনা; বিধাতা হয়ে উঠেছে পুরুষের প্রস্তুত বিধানের শ্রুতিলিপিকর।

৯৮.হিন্দুবিধানে পুরুষ দ্বারা দূষিত না হওয়া পর্যন্ত নারী পরিশুদ্ধ হয় না। ৯৯.উচ্চপদে না বসলে এদেশে কেউ মূল্য পায় না। সক্রেটিস এদেশে জন্ম নিলে তাঁকে কোনো একাডেমির মহাপরিচালক পদের জন্যে তদ্বির চালাতে হতো। ১০০.সব ধরনের অভিনয়ের মধ্যে শ্রেষ্ঠ হচ্ছে রাজনীতি; রাজ নীতিকেরা অভিনয় করে সবচেয়ে বড়ো মঞ্চে ও পর্দায়। ১০১.সক্রেটিস বলেছেন তিনি দশ সহস্র গর্দভ দ্বারা পরিবিৃত, এখন থাকলে তিনি ওই সংখ্যার ডানে কটি শূন্য যোগ করতেন? ১০২.বাঙালি মুসলমান জীবিত প্রতিভাকে লাশে পরিণত করে, আর মৃত প্রতিভার কবরে আগরবাতি জ্বালে।

১০৩.নজরুলসাহিত্যের আলোচকরা সমালোচক নন, তাঁরা নজরুলের মাজারের খাদেম। ১০৪.ভ্রষ্ট বাঙালিকে ভালোবাসার শ্রেষ্ঠ উপায় তার গালে শক্ত করে একটি চড় কষিয়ে দেয়া। ১০৫.ভিখিরির জীবন মহৎ উপন্যাসের বিষয় হতে পারে, কিন্তু রাষ্ট্রপ্রধানদের জীবন সুখপাঠ্য গুজবনামারও অযোগ্য। ১০৬.বাঙালির জাতিগত আলস্য ধরা পড়ে ভাষায়। বাঙালি-দেরি করে, চুরি করে, আশা করে, এমনকি বিশ্রাম করে।

বিশ্রামও বাঙালির কাছে কাজ। ১০৭.বাঙালি অভদ্র, তার পরিচয় রয়েছে বাঙালির ভাষায়, কেউ এলে বাঙালি জিঞ্জেসকরে, কী চাই? বাঙালির কাছে আগন্তক মাত্রই ভিক্ষুক। অপেক্ষা করার অনুরোধজানিয়ে বাঙালি বলে দাঁড়ান! বসতে বলার সৌজন্যটুকুও বাঙালির নেই। ১০৮.এখানে সাংবাদিকতা হচ্ছে নিউজপ্রিন্ট-বলপয়েন্ট-মিথ্যার পাঁচন। ১০৯.মানুষ মরণশীল, বাঙালি অপমরণশীল।

১১০.এ-সরকার মাঝে মাঝে গোপন চক্রান্ত ফাঁস করে ফেলে। সরকার মাটি আরমানুষের সমন্বয় ঘটানোর সংকল্প ঘোষণা করেছে। আমি ভয় পাচ্ছি, কেননা মাটি ওমানুষের সমন্বয় ঘটে শুধু কবরে। ১১১.আজকাল অধিকাংশ পি এইচ ডি অভিসন্দর্ভ মনে আশার আলো জ্বালায়; মনে হয়এখানেই নিহিত আমাদের শিক্ষাসমস্যা সমাধানের বীজ। প্রথম বর্ষ অনার্সশ্রেণীতেই এখন পি এইচ ডি কোর্স চালু করা সম্ভব, এতে ছাত্ররা আড়াই বছরেএকটি ডক্টরেট ডিগ্রি পেতে পারে।

এখানকার অধিকাংশ ডক্টরেটই স্নাতকপূর্বডক্টরেট; অদূর ভবিষ্যতে উচ্চ মাধ্যমিক ডক্টরেটও পাওয়া যাবে। ১১২.সত্য একবার বলতে হয়; সত্য বারবার বললে মিথ্যার মতো শোনায়। মিথ্যা বারবার বলতে হয়; মিথ্যা বারবার বললে সত্য বলে মনে হয়। ১১৩.ফুলের জীবন কতোই করুণ। অধিকাংশ ফুল অগোচরেই ঝরে যায়, আর বাকিগুলো ঝোলে শয়তানদের গলায়।

১১৪.ঢাকা শহরে, ক্রমবর্ধমান এ-পাগলাগারদে, সাতাশ বছর আছি, ঢাকা এখনবিশ্বের বৃহত্তম পাগলাগারদ; রাজধানী নয়, এটা পাগলাধানী; কিন্তুবদ্ধপাগলেরা তা বুঝতে পারে না। ১১৫.বদমাশ হওয়ার থেকে পাগল হওয়া অনেক মানবিক। ১১৬.টেলিভিশনে জাহাজমার্কা আলকাতরার বিজ্ঞাপণটি আকর্ষণীয়, তাৎপর্যপূর্ণ; তবে অসম্পূর্ণ। বিজ্ঞাপণটিতে জালে, জাহাজে, টিনের চালে আলকাতরা লাগানোরউপকারিতার কথা বলা হয়; কিন্তু বলা উচিত ছিলো যে জাহাজমার্কা আলকাতরালাগানোর-উৎকৃষ্টতম স্থান হচ্ছে টেলিভিশনের পর্দা, বিশেষ করে যখন বাঙলাদেশটেলিভিশনের অনুষ্ঠান দেখা যায়। ১১৭.রবীন্দ্রনাথ যখন বাঙলাদেশের মাটি থেকে নির্বাসিত, তবে আকাশটা তাঁর।

বাঙলার আকাশের নাম রবীন্দ্রাকাশ। ১১৮.গণশৌচাগার দেখলেই কেনো যেনো আমার বাঙালির আত্মাটির কথা বারবার মনে পড়ে। ১১৯.আমাদের অধিকাংশের চরিত্র এতো নির্মল যে তার নিরপেক্ষ বর্ণনা দিলেও মনে হয় অশ্লীল গালাগাল করা হচ্ছে। ১২০.এখনো বিষের পেয়ালা ঠোঁটের সামনে তুলে ধরা হয় নি, তুমি কথা বলো। ১২১.বিনয়ীরা সুবিধাবাদী, আর সুবিধাবাদীরা বিনয়ী।

১২২.মোল্লারা পবিত্র ধর্মকেই নষ্ট করে ফেলেছে; ওরা হাতে রাষ্ট্র পেলে তাকে জাহান্নাম করে তুলবে। ১২৩.জীবন খুবই মূল্যবান: জীবনবাদীরা যতোটা মূল্যবান মনে করে, তার চেয়ে অনেক বেশি মূল্যবান। আর শিল্পকলা জীবনের থেকেও মূল্যবান। ১২৪.দ্বিতীয়, তৃতীয়, চতুর্থ, পঞ্চম প্রেম বলে কিছু নেই। মানুষ যখন প্রেমে পড়ে, তখন প্রতিটি প্রেমই প্রথম প্রেম।

১২৫.মার্ক্সবাদের কথা শুনলে এখন মোল্লারাও ক্ষেপে না, সমাজতন্ত্রের কথাতারা সন্তোষের সাথেই শোনে; কিন্তু শরীরের কথা শুনলে লম্পটরাও ধর্মযুদ্ধেনামে। ১২৬.কোন কালে এক কদর্য কাছিম দৌড়ে হারিয়েছিলো এক খরগোশকে। সে গল্পে কয়েকহাজার বছর ধরে মানুষ মুখর। তারপর খরগোশ কতো সহস্রবার হারিয়েছে কাছিমকে, সে-কথা কেউ বলে না। ১২৭.বিধাতা মৌলবাদী নয়।

কে প্রার্থনা করলো, কে করলো না; কে কোন তরুণীরগ্রীবার দিকে তাকালো, কোন রূপসী তার রূপের অংশ দেখালো, এসব তাকেবিন্দুমাত্র উদ্বিগ্ন করে না। কিন্তু বিধাতার পক্ষে এতে ভীষণ উদ্বিগ্ন বোধকরে ভন্ডরা। ১২৮.খুব ভেবেচিন্তে মানুষ আত্মসমর্পণ করে, আর অনুপ্রাণিত মুহুর্তে ঘোষণা করে স্বাধীনতা। ১২৯.মানুষ যখন তার শ্রেষ্ঠ স্বপ্নটি দেখে তখনি সে বাস করে তার শ্রেষ্ঠ সময়ে। ১৩০.এ-বদ্বীপে দালালি ছাড়া ফুলও ফোটে না, মেঘও নামে না।

১৩১.আমার লেখার যে-অংশটি পাঠককে তৃপ্তি দেয়, সেটুকু বর্তমানের জন্যে; আর যে-অংশ তাদের ক্ষুব্ধ করে সেটুকু ভবিষ্যতের জন্যে। ১৩২.পৃথিবীতে একটি মাত্র দক্ষিণপন্থি সাম্যবাদী দল রয়েছে। সেটি আছে বাঙলাদেশে। ১৩৩.আমাদের প্রায় প্রতিটি মার্ক্সবাদী তাত্ত্বিকের ভেতরে একটি করেমৌলবাদী বাস করে। তারা পান করাকে পাপ মনে করে, প্রেমকে গুণাহ্J মনে করে, কিন্তু চারখানা বিবাহকে আপত্তিকর মনে করে না।

১৩৪.শ্রেষ্ঠ মানুষেরাও কতোটা নিকৃষ্ট হতে পারে চারদিকে তাকালেই তা বোঝা যায়। ১৩৫.ঋষি রবীন্দ্রনাথের ছবি দেখলে বাল্যকাল থেকেই তাঁর জন্মাব্দ ১৮৬১র আগেদুটি বর্ণ যোগ করতে আমার ইচ্ছে হয়। বর্ণ দুটি হচ্ছে খ্রি পূ। ১৩৬.বাঙলার প্রতিটি ক্ষমতাধিকারী দল সংখ্যাগরিষ্ট দুর্বৃত্তদের সংঘ। ১৩৭.কবিতা এখন দু-রকম: দালালি ও গালাগালি।

১৩৮.বাঙলাদেশের সাহিত্যে আধুনিকতাপর্বের পর কি আসবে আধুনিকতা-উত্তর-পর্ব? না। আসতে দেখছি গ্রাম্যতার পর্ব। ১৩৯.পাকিস্থানের ইতিহাস ঘাতক আর শহীদের ইতিহাস। বাঙলাদেশের ইতিহাস শহীদ আর ঘাতকদের ইতিহাস। ১৪০.বাঙলার বিবেক খুবই সন্দেহজনক।

বাঙলার চুয়াত্তরের বিবেক সাতাত্তরে পরিণত হয় সামরিক একনায়কের সেবাদাসে। ১৪১.বাঙলাদেশ অমরদের দেশ। এ-দেশের প্রতি বর্গমিটার মাটির নিচে পাঁচজন করে অমর ঘুমিয়ে আছেন। ১৪২.একবার রাজাকার মানে চিরকাল রাজাকার; কিন্তু একবার মুক্তিযোদ্ধা মানে চিরকাল মুক্তিযোদ্ধা নয়। ১৪৩.পৃথিবী জুড়ে সমাজতন্ত্রের সাম্প্রতিক দুরবস্থার সম্ভবত গভীর ফ্রয়েডীয়কারণ রয়েছে।

সমাজতন্ত্রের মার্ক্সীয়, লেনিনীয়, স্তালিনীয় আবেদন ছিলো, কিন্তু যৌনাবেদন ছিলো না। ১৪৪.স্বার্থ সিংহকে খচ্চরে আর বিপ্লবীকে ক্লীবে পরিণত করে। ১৪৫.অপন্যাস হচ্ছে সে-ধরনের সাহিত্য, যা বছরে লাখ টন উৎপাদিত হলেওসাহিত্যের কোনো উপকার হয় না; আর আধ কেজি উৎপাদিত না হলেও কোনো ক্ষতি হয়না। ১৪৬.আঠারো তলা টাওয়ারের থেকে শিশির বিন্দু অনেক উঁচু। চিরকাল শিশির বিন্দুর পাদদেশে দাঁড়িয়ে আছি, কিন্তু অনেক টাওয়ারের চূড়োয় উঠেছি।

১৪৭.সৎ মানুষ মাত্রই নি:সঙ্গ, আর সকলের আক্রমণের লক্ষ্যবস্তু। ১৪৮.বিপ্লবীদের বেশি দিন বাঁচা ঠিক নয়। বেশি বাঁচলেই তারা প্রতিক্রিয়াশীল হয়ে ওঠে। ১৪৯.পুঁজিবাদী পর্বের সবচেয়ে বড়ো ও জনপ্রিয় কুসংস্কারের নাম প্রেম। ১৫০.জীবনের সারকথা কবর।

১৫১.শাড়ি পরে শুধু শুয়ে থাকা যায়; এজন্যে বাঙালি নারীদের হাঁটা হচ্ছে চলমান শোয়া। ১৫২.শাশ্বত প্রেম হচ্ছে একজনের শরীরে ঢুকে আরেকজনের স্বপ্ন দেখা। ১৫৩.প্রেম হচ্ছে নিরন্তর অনিশ্চয়তা; বিয়ে ও সংসার হচ্ছে চূড়ান্ত নিশ্চিন্তির মধ্যে আহার, নিদ্রা, সঙ্গম, সন্তান ও শয়তানি। ১৫৪.মধ্যবিত্ত পতিতাদের নিয়ে সমস্যা হচ্ছে তারা পতিতাদের সুখ ও সতীর পূণ্য দুটিই দাবি করে। ১৫৫.ইতিহাস হচ্ছে বিজয়ীর হাতে লেখা বিজিতের নামে একরাশ কুৎসা।

১৫৬.এখানে কোনো কিছু সম্পর্কে কিছু লেখাকে মনে করা হয় গভীর শ্রদ্ধারপ্রকাশ। গাধা সম্পর্কে আমি একটি বই লিখেছি, অনেকে মনে করেন আমি গাধারপ্রতি যারপরনাই শ্রদ্ধাশীল। গরু সম্পর্কে আমি একটি বই লিখেছি, অনেকে মনেকরেন গরুর প্রতি আমি প্রকাশ করেছি আমার অশেষ শ্রদ্ধা। নারী সম্পর্কে আমিএকটি বই লিখেছি। একটি পার্টটাইম পতিতা, যার তিনবার হাতছানিতে ও আমি সাড়াদিই নি, অভিযোগ করেছেন, নারী সম্পর্কে বই লেখার কোনো অধিকার আমার নেই, যেহেতু আমি পতিতাদের শ্রদ্ধা করি না, অর্থাৎ তাদের হাতছানিতে সাড়া দিই না।

১৫৭.পুরুষতান্ত্রিক সভ্যতার শ্রেষ্ঠ শহীদের নাম মা। ১৫৮.গত দু-শো বছরে গবাদিপশুর অবস্থার যতোটা উন্নতি ঘটেছে নারীর অবস্থার ততোটা উন্নতি ঘটে নি। ১৫৯.মসজিদ ভাঙে ধার্মিকেরা, মন্দিরও ভাঙে ধার্মিকেরা, তারপরও তারা দাবিকরে তারা ধার্মিক, আর যারা ভাঙাভাঙিতে নেই তারা অধার্মিক বা নাস্তিক। ১৬০.মসজিদ ভাঙলে আল্লার কিছু যায় আসে না, মন্দির ভাঙলে ভগবানের কিছু যায়আসে না; যায় আসে শুধু ধর্মান্ধদের। ওরাই মসজিদ ভাঙে, মন্দির ভাঙে।

১৬১.মসজিদ তোলা আর ভাঙার নাম রাজনীতি, মন্দির ভাঙা আর তোলার নাম রাজনীতি। কিন্তু ওরা তাকে চালায় ধর্মের নামে। ১৬২.মসজিদ ও মন্দির ভাঙার সময় একটি সত্য দীপ্ত হয়ে ওঠে যে আল্লা ও ভগবান কতো নিষ্ক্রিয়, কতো অনুপস্থিত! ১৬৩.পৃথিবীতে রাজনীতি থাকবেই। নইলে ওই অপদার্থ অসৎ লোভী দুষ্ট লোকগুলো কী করবে? ১৬৪.ক্ষমতায় যাওয়ার একটিই উপায়: সমস্যা সৃষ্টি করা। সমস্যা সমাধান করে কেউ ক্ষমতায় যায় না, যায় সৃষ্টি করে।

১৬৫.পশু আর পাখিরাই মানবিক। ১৬৬.অন্যদের কাহিনীর ক্ষীণসূত্র নিয়ে হ্যামলেট বা ওথেলো বা ম্যাকবেথ লেখা, আর বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের পথের পাঁচালী কেটে, নষ্ট করে, সত্যজিতেরপথের পাঁচালী তৈরী করা সম্পূর্ণ ভিন্ন কথা। অন্যের কাহিনীসূত্র নিয়েহ্যামলেট লেখা মানবপ্রজাতির একজনের বিস্ময়কর প্রতিভার লক্ষণ, আরবিভূতিভূষণের পথের পাঁচালী ছিঁড়ে সত্যজিতের পথের পাঁচালী তৈরীচিত্রগ্রহণদক্ষতার পরিচায়ক। আরেকটি উৎকৃষ্টতর হ্যামলেট বা ওথেলো বাম্যাকবেথ, বা মেঘনাদবধ মানুষের ইতিহাসে আর লেখা হবে না; কিন্তু সত্যজিতেরপথের পাঁচালীর থেকে উৎকৃষ্ট পথের পাঁচালী হয়তো তৈরী হবে আগামী দশকেই। ১৬৭.সত্যজিত যদি ভারতরত্ন হন, তবে বিভূতিভূষণ বিশ্বরত্ন, সভ্যতারত্ন; কিন্তু অসভ্য প্রচারের যুগে মহৎ বিভূতিভূষণকে পৃথিবী কেনো ভারতও চেনে না, চেনে গৌণ সত্যজিতকে।

১৬৮.বিভূতিভূষণের পথের পাঁচালীর পাশে সত্যজিতের চলচ্চিত্রটি, খুবই শোচনীয়বস্তু, ওটি তৈরী না হলেও ক্ষতি ছিলো না; কিন্তু বিভূতিভূষণ যদি পথেরপাঁচালী না লিখতেন তাহলে ক্ষতি হতো সভ্যতার। ১৬৯.সৌন্দর্য যেভাবেই থাকে সেভাবেই সুন্দর। ১৭০.শরীরই শ্রেষ্ঠতম সুখের আকর। গোলাপের পাপড়ির ওপর লক্ষ বছর শুয়ে থেকে, মধুরতম দ্রাক্ষার সুরা কোটি বছর পান করে, শ্রেষ্ঠতম সঙ্গীত সহস্র বছরউপভোগ করে যতোখানি সুখ পাওয়া যায়, তার চেয়ে অর্বুদগুণ বেশি সুখ মেলে কয়েকমুহুর্ত শরীর মন্থন করে। ১৭১.মানুষের উৎপত্তি সম্পর্কে দুটি তত্ত্ব রয়েছে: অবৈজ্ঞানিকটিঅধ:পতনতত্ত্ব, বৈজ্ঞানিকটি বিবর্তনতত্ত্ব।

অধ:পতনতত্ত্বের সারকথা মানুষস্বর্গ থেকে অধ:পতিত। বিবর্তনতত্ত্বের সারকথা মানুষ বিবর্তনের উৎকর্ষেরফল। অধ:পতনবাদীরা অধ:পতনতত্ত্বে বিশ্বাস করে; আমি যেহেতু মানুষের উৎকর্ষেবিশ্বাস করি, তাই বিশ্বাস করি বিবর্তনতত্ত্বে। অধ:পতনের থেকে উৎকর্ষসবসময়ই উৎকর্ষ। ১৭২.শোনা যায় পুরোনো কালে ঘটতো নানা অলৌকিক ঘটনা, তবে পুরোনো কালের অলৌকিকঘটনাগুলো বানানো বা ভোজবাজি।

প্রকৃত অলৌকিক ঘটনার কাল হচ্ছে বিশশতক। পুরোনো কালের কোনো মোজেজ লাঠিকে সাপ বানাতে, বা সমুদ্রের ওপর সড়ক তৈরীকরতে পারতেন-ক্ষণিকের জন্যে। ওগুলো নিম্নমানের যাদু। সত্য স্থায়ী অলৌকিকতাসৃষ্টি করতে পেরেছে শুধু বিশশতকের বিজ্ঞান। বিদ্যুৎ, বিমান, টেলিভিশন, কম্পিউটার, নভোযান, এমনকি সামান্য শেলাইকলটিও অতীতের যে-কোনো অলৌকিক ঘটনারথেকে অনেক বেশি অলৌকিক।

বিজ্ঞান অলৌকিকতাকে সত্যে পরিণত করেছে বলে গাধাওতাতে বিস্মিত হয় না, কিন্তু পুরোনো তুচ্ছ অলৌকিকতার কথায় সবাই বিহ্বল হয়েওঠে। ১৭৩. পুরোনো কালের মানুষ যদি দৈবাৎ একটি টেলিভিশনের সামনে এসে পড়তো, তাহলে তাকে দেবতা মনে করে পুজো করতো। আজো সেই পুজো চলতো। ১৭৪.ধর্মের কাজ মানুষের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করা; তাই এক ধার্মিকের রক্তেসব সময়ই গোপনে শানানো হতে থাকে অন্য ধার্মিকের জবাই করা ছুরিকা। ১৭৫.ধার্মিক কখনোই সম্পূর্ণ মানুষ নয়, অনেক সময় মানুষই নয়।

১৭৬.মৃত সিংহের থেকে জীবিত গাধাও কতো জ্যোতির্ময় উজ্জ্বল! ১৭৭.আমার অনুরাগীরা চরম অনুরাগ প্রকাশের সময় খুব আবেগভরে বলেন যে আমার মতোপন্ডিতও প্রতিভাবান লোক আর নেই; তাই আমার অনেক কিছু হওয়া উচিত। যেমনঅবিলম্বে আমার হওয়া উচিত কোনো একাডেমির মহাপরিচালক, বা কোনোবিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ইত্যাদি। শুনে আমি তাঁদের ও নিজের জন্যে খুবকরুণা বোধ করি। আমি হতে চাই মহৎ, আর অনুরাগীরা আমাকে করে তুলতে চানভৃত্য। ১৭৮.আপনি যখন হেঁটে যাচ্ছেন তখন গাড়ি থেকে যদি কেউ খুব আন্তরিকভাবে মিষ্টিহেসে আপনার দিকে হাতনাড়ে, তখন তাকে বন্ধু মনে করবেন না।

মনে করবেন সে তারগাড়িটার দিকে আপনার দৃষ্টি আকর্ষণ করে আপনাকে কিছুটা পীড়ন করে সুখী হতেচায়। ১৭৯.শিশু, সবুজ ও তরুণীরা আছে বলে বেঁচে থাকা আজো আমার কাছে আপত্তিকর হয়ে ওঠে নি। ১৮০.টাকাই অধিকাংশ মানুষের একমাত্র ইন্দ্রিয়। ১৮১.শিল্পীর কতোটা স্বাধীনতা দরকার? নির্বোধেরা মনে করে এবং দাবি করে যেশিল্পীর দরকার অবাধ স্বাধীনতা। যেনো শিল্পীকে সমাজরাষ্ট্র অবাধ স্বাধীনতাদিয়ে দেবে, আর সে মনের আনন্দে শিল্পকলা সৃষ্টি করে চলবে।

এটা শিল্পকলা ওস্বাধীনতা সম্পর্কে এক মর্মস্পর্শী ভ্রান্তি। সত্য এর বিপরীত। সাধারণমানুষের থেকে একবিন্দুও বেশি স্বাধীনতা দরকার নয়; সাধারণ মানুষেরই দরকারঅবাধ স্বাধীনতা, কেননা তারা স্বাধীনতা সৃষ্টি করতে পারে না। শিল্পীর কাজইস্বাধীনতা সৃষ্টি করা, আর স্বাধীনতা সৃষ্টি করার প্রথাগত নাম হচ্ছেশিল্পকলা। ১৮২.মানুষ মরলে লাশ হয়, সংস্কৃতি মরলে প্রথা হয়।

১৮৩.ক্ষমতায় থাকার সময় যারা সত্য প্রকাশ করতে দেয় না, ক্ষমতা হারানোর পর তারা অজস্র মিথ্যার প্রকাশ রোধ করতে পারে না। ১৮৪.আমি বেঁচে ছিলাম অন্যদের সময়ে। ১৮৫.পৃথিবীর প্রধান বিশ্বাসগুলো অপবিশ্বাসমাত্র। বিশ্বাসীরা অপবিশ্বাসী। ১৮৬.শয়তানই আজকাল আল্লা আর ঈশ্বরের নাম নিচ্ছে প্রাণ ভরে।

আদিম শয়তান আরযাই হোক রাজনীতিবিদ ছিলো না, কিন্তু শয়তান এখন রাজনীতি শিখেছে; আল্লা আরঈশ্বর আর জেসাসের নামে দিনরাত শ্লোগান দিচ্ছে। ১৮৭.মৌলবাদ হচ্ছে আল্লার নামে শয়তানবাদ। ১৮৮.একটি ধর্মান্ধের মুখের দিকে তাকালেই বোঝা যায় আল্লা অমন লোককে পছন্দ করতে পারে না। ১৯০.গাধা একশো বছর বাঁচলেও সিংহ হয় না। ১৯১.একটা আমলা আর একটা মন্ত্রীর সাথে পাঁচ মিনিট কাটানোর পর জীবনের প্রতিঘেন্না ধরে গেলো; তারপর একটি চড়ুইয়ের সাথে দু-মুহুর্ত কাটিয়ে জীবনকে আবারভালোবাসলাম।

১৯২.আমি ঈর্ষা করি শুধু তাদের যারা আজো জন্মেনি। ১৯৪.মুসলমানের মুক্তি ঘটে নি, কারণ তারা অতীত ও তাদের মহাপুরুষদের সম্পর্কে কোনো সত্যনিষ্ঠ আলোচনা করতে দেয় না। ১৯৫.গান্ধি দাবি করেন যে তিনি একই সাথে হিন্দু, খ্রিস্টান, মুসলমান, বৌদ্ধ, ইহুদি, কনফুসীয় ইত্যাদি। একে তিনি ও তাঁর অনুসারীরা মহৎ ব্যাপার বলে মনে করেছেন। কিন্তু এটা প্রতারণা, ও অত্যন্ত ভয়ঙ্কর ব্যাপার,-তিনিনিজেকে করে তুলেছেন সব ধরনের খারাপের সমষ্টি।

এমন প্রতারণা থেকেই উৎপত্তিহয়েছে বাবরি মসজিদ উপাখ্যানের। তিনি যদি বলতেন আমি হিন্দু নই, খ্রিস্টাননই, মুসলমান নই, বৌদ্ধ নই, ইহুদি নই, কনফুসীয় নই; আমি মানুষ, তাহলে বাবরি মসজিদ উপাখ্যানের। তিন।

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।