সেবাদাস হচ্ছে এমন একটি শ্রেণী যার মূল কাজ হচ্ছে যে কোন মূল্যে মনিবের সার্বিক সুবিধা নিশ্চিত করা। সেবাদাসগন তার শ্রেণী অপেক্ষাও মনিবের সুবিধাকে অগ্রাধিকার প্রদান করে থাকে। আমাদের সমাজ ব্যবস্থা ও মনমানসিকতাও কি সেদিকেই যাচ্ছে?
নগর পরিকল্পনায় কিছু মানুষের বাহনের সুবিধা নিশ্চিত করাই কি আমাদের মূল লক্ষ্য?
গত ২৪ আগষ্ট ২০০৯ তারিখে পত্রিকায় প্রকাশিত একটি সংবাদের দেখছি সিলেট রেজিষ্ট্রি মাঠ হকারমুক্ত করা হয়েছে। কিন্তু ব্যক্তির সহযোগিতায় এই মাঠটি হকারা ব্যবহার করে আসছিল। ফলে মাঠের পার্শ্বে থাকা পূর্ত ভবনের কর্মকর্তা কর্মচারীদের গাড়ী পার্কিং করতে হতো রাস্তার উপর।
উচ্ছেদের পর মাঠটি এখন ব্যবহার করা হচ্ছে গাড়ী পাকিং করার জন্য।
কারো মতে হয়তো বিষয়টি যৌক্তিক, আর এ প্রেক্ষিতে আমার মনে কিছু প্রশ্নের সৃষ্টি হয়েছে। এইটি মাঠটিতে ৫০টির বেশি হকারের দোকান ছিল। যদি ধরে নেওয়া যায় প্রতিটি দোকানের কর্মচারী ও পরিবারের লোকেজন মিলে দোকান প্রতি ৪ জন করে লোক এই দোকানের উপর নির্ভর ছিল, তবে প্রায় ২০০ লোক এই দোকান হতে তাদের জীবিকা নির্ভাহ করত। কিন্তু হকার উচ্ছেদের পর, গাড়ী পাকিং করার কত লোকের জীবিকার সংস্থা হয়েছে, কতলোক সুবিধা পাচ্ছে? রাষ্ট্র, সরকার এবং সমাজের কাছে প্রশ্ন, গাড়ীর পাকিং ও মানুষের জীবকার মাঝে কোনটির সুবিধাকে অগ্রাধিকার দেওয়া প্রয়োজন?
ঢাকা শহরের বিভিন্ন স্থানে গাড়ীর পার্কিংএর ব্যবস্থা রয়েছে।
ঢাকা সিটি কর্পোরেশন জনগনের টাকায় মাত্র ১০-২০ টাকায় ঘন্টাখানেক এখানে গাড়ী রাখতে পারেন। এই জায়গাগুলো পাবলিক প্রার্পাটি। যদি প্রস্তাব করা এই জায়গায় একই মূল্যে হকারদের বসার জন্য সুযোগ দেওয়া হবে কি না? এ প্রশ্নের উত্তর অবশ্যই না আসবে। ঢাকা শহরের গাড়ী পাকিংকে যেমন একটি সমস্যা মনে করা হয়, তেমটি হকারদের বসার ব্যবস্থা একটি তার চেয়ে দীর্ঘ ও পুরাতন সমস্যা।
গাড়ীর জন্য ঢাকা শহরের বিভিন্ন স্থানে পাকিং সুবিধা নিশ্চিত করা হয়েছে, কিন্তু হকারদের সুবিধার জন্য স্থায়ী ও স্বল্পমূল্যে এ ধরনের কোন উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়নি।
ফুটপাত দখল করে রাখার জন্য প্রতিনিয়ত হকার উচ্ছেদ কার্যক্রম পরিচালিত হয়। কিন্তু ফুটপাত দখল করে রাখার জন্য গাড়ীর উচ্ছেদ কার্যক্রম হয় না। ঢাকা শহরের রাস্তার একটি বড় অংশ দখল করে রাখে প্রাইভেট গাড়ী। যা একটি ব্যক্তিগত পরিবহন এবং একক মানুষের সুবিধাকে নিশ্চিত করে।
ঢাকা শহরের বিভিন্ন রাস্তায় রিকশা চলাচল নিষিদ্ধ করা হয়, বর্তমানে এ সকল রাস্তার একটি বড় অংশ জুড়ে থাকে প্রাইভেট গাড়ীর পাকিং।
ঢাকা শহরের নিউমার্কেট এর ভিতরে দিয়ে রিকশা চলাচলের ব্যবস্থা করা হয়েছে। সাথে সাথে নোটিশ প্রদান করা রয়েছে রিকশা পাকিং নিষিদ্ধ, কিন্তু গাড়ী পার্কিং রয়েছে। গাড়ীর পাকিং করার জন্য এখানে সৃষ্টি হচ্ছে যানজট। কয়েক বছরে ধরে এখানে একটি মার্কেট গড়ে উঠছে। এই মার্কেট এ প্রায় ১০০০ টি দোকান রয়েছে।
যেখানে গাড়ী ব্যবহারকারীদের জন্য গাড়ীর পাকিং করার ব্যবস্থা রয়েছে। ভাবছি যখন এই মার্কেট চালু হবে তখন কি অবস্থা হবে। গাড়ীর জটে মানুষ এখানে প্রবেশ করতে পারবে না। তখন নতুন কোন সমস্যা দেখিয়ে এ রাস্তায় শুধু রিকশা নিষিদ্ধ করা হবে। নিশ্চিত করা হবে প্রাইভেট গাড়ীর চলাচল।
ঢাকা শহরের প্রায় ২% শতাংশ মানুষের প্রাইভেট গাড়ী রয়েছে। অবাক বিষয় হচ্ছে প্রতিটি মার্কেট ও বাড়ীতে প্রাইভেট গাড়ীর জন্য জায়গা রাখা বাধ্যতামূলক। এটি হচ্ছে রাজউকের ইমারত বিধিমালার নিয়ম। অথচ শহরের পথচারী, বাস ব্যবহারকারী বা রিকশা ব্যবহারকারীদের জন্য কোন বিশেষ ব্যবস্থা নেই মার্কেট ও রাস্তায়। প্রাইভেট গাড়ী ব্যবহার আজ সমাজের অভিজাত্যের প্রতীকী।
আমাদের চিন্তায় কে কোন ব্রান্ডের গাড়ী ব্যবহার করে তার উপর নির্ভর করে মানুষের কত উচু মানের। যার যত দামী ও আধুনিক গাড়ীর তার দাম তত বেশী। গাড়ীর হচ্ছে মানুষের অবস্থান নির্ণয়ের সুচক।
ঢাকা শহরের শিশুদের একটি বড় সমস্যা হচ্ছে তাদের বিনোদনের অবস্থা। খেলা জায়গার অভাবে তারা বেড়ে উঠছে টিভি, কম্পিউটার, শপিংমল সংস্কৃতিতে।
যা তাদের মানসিক ও শারিরীক বিকাশকে ধ্বংশ করেছে। পরিবেশবাদীরা নিয়মিতই মাঠ পার্কের দাবি করে আসছে। কিন্তু ফলফল শূন্য। বরং মাঠগুলো দখল হয়ে যাচ্ছে মেলা ও গাড়ীর পার্কিং এর নামে। সরকারের কর্তৃপক্ষের কাছে মাঠের আবেদন করা হলে বলে জায়গার সংকট।
একবার পত্রিকায় দেখলাম কাউরান বাজার উচ্ছেদ করে গাড়ীর পাকিং করা হবে। গাড়ীর পাকিং উচ্ছেদ করে শিশুদের খেলার জায়গা করা যায় না?
সরকারে সংস্থাগুলোর মধ্যে নূন্যতম শতাংশের মানুষের জন্য রাজউকের আরো বলিষ্ট উদ্যোগ রয়েছে। বাড়ীতের গাড়ী থাক আর নাই থাকা গাড়ীর জন্য জায়গা রাখতে হবে। ঢাকা শহরের এমন অনেক স্থান রয়েছে, যেখানের রাস্তা সরু থাকার কারণে গাড়ী প্রবেশ করতে পারবে না। কিন্তু রাজউকের নিয়ম অনুসারে এ সকল স্থানে গাড়ীর জন্য জায়গা রাখতে হবে।
রাজউকের ইমারত নির্মাণ বিধিমালা সুপষ্টভাবেই এই নির্দেশনা প্রদান করে। ঢাকা অনুকরণে দেশের অন্যান্য শহরেরও এধরনের নীতি গ্রহণ করা হচ্ছে। কিন্তু প্রতিটি বাড়ীতে শিশু থাকা স্বত্বেও বাড়ীতে শিশুর খেলাধূলা বা বিকাশের জন্য কি ব্যবস্থা থাকতে হবে, তার কোন নির্দেশনা নেই। তবে কি গাড়ী আমাদের শিশু অপেক্ষা জরুরি?
একটি মানুষের জীবনে গাড়ী না থাকলেও চলে, কিন্তু একটি মানুষের শিশু না থাকলে কি সে শান্তি পায়? যদি গাড়ী শিশু অপেক্ষা আমাদের এত প্রিয় হয়ে থাকে, তবে সেই সকল ব্যক্তিদের জন্য উপদেশ শিশু গ্রহণ না করে একটি আধুনিক গাড়ীকে দত্তক হিসেবে গ্রহণ করুন। শিশুদের শারিরীক ও মানসিক বিকাশের সুবিধার ক্ষেত্রে বিভিন্ন সীমাবদ্ধতা দেখিয়ে, প্রাইভেট গাড়ীর জন্য সুবিধা নিশ্চিত করা কোন সভ্য সমাজের চিন্তা ও মানসিকতা হতে পারে না।
যদি শিশুরা আগামী দিনের বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ হবে বলে আমরা বিশ্বাস করি, তবে প্রাইভেট গাড়ীর সুবিধা নিশ্চিত না করে, শিশুদের পরিবেশ কিভাব নিশ্চিত করা যায় তা চিন্তা করা উচিত।
বাংলাদেশের সংবিধানের ১৪ এবং ১৫ অনুচ্ছেদর অনুসারে শ্রমিক ও অগ্রসর জনগোষ্ঠীকের শোষণ হতে মুক্তি প্রদান এবং মৌলিক প্রয়োজনের ব্যবস্থা নিশ্চিত করা রাষ্ট্রের অন্যতম দায়িত্ব্। অনুচ্ছেদ ২০ (১) অনুসারে কর্ম হচ্ছে কর্মক্ষম প্রত্যেক নাগরিকের পক্ষে অধিকার, কর্তব্য এবং সম্মানের বিষয়। আর যদি সংবিধান আমাদের রাষ্ট্রনীতিতে প্রাধন্য পায়, তবে অধিকাংশ জনগনের চলাচলের ব্যবস্থা, শিশুদের শারিরীক ও মানসিক বিকাশ এবং হকারদের কর্ম করার ব্যবস্থা অগ্রাধিকার পাবে।
বাংলাদেশ সরকার শিশু অধিকার সনদ, মানবাধিকার সনদসহ বিভিন্ন সনদের স্বাক্ষর করেছে।
এ সকল সনদের মানুষকে রাষ্ট্র কর্তৃক বিভিন্ন সুবিধা নিশ্চিত করার কথা বলা হয়েছে। সংবিধান ও এ সকল আন্তর্জাতিক সনদের কোথাও প্রাইভেট গাড়ীকে সুবিধা প্রদানের কাজ উল্লেখ্য নেই। কিন্তু অবাক হলেও জন্য রাষ্ট্রীয় কোষাগার হতে অর্থ নিয়ে, ঋণ গ্রহণ করে, বিভিন্ন পরিকল্পনার মাধ্যমে প্রাইভেট গাড়ীর জন্য পার্কিং, ফ্লাইওভার, বিশাল রাস্তার করার পরিকল্পনা মস্ত সরকারী সংস্থাগুলো। কিন্তু অধিকাংশ মানুষের চলাচল, শিশুদের বিনোদন, দরিদ্র হকারদের কর্মসংস্থান, রিকাশ চলকদের ক্ষেত্রে সংস্থাগুলোর চিন্তা ও কর্মের সীমাবদ্ধতা বিস্ময়ের।
যানবাহন ও নগর পরিকল্পনার যে কোন সিদ্ধান্তে প্রথমেই চিন্তুা করা হয় জড় মনিব প্রাইভেট গাড়ী কিভাবে যাবে।
প্রাইভেট গাড়ীর কিভাবে নিভিগ্নে চলাচল করবে? প্রাইভেট গাড়ীকে কোথায় থাকবে। গুটি কয়েক প্রাইভেট গাড়ীর মালিকের জন্য অধিকাংশ মানুষের অর্থ খরচ করে এত পরিকল্পনা কেন?
রাষ্ট্রীয় ও আন্তর্জাতিক নীতি অনুসারে অধিকাংশ মানুষের কেন অগ্রাধিকার পাবে না। তাই মনে হয় অভিজাত্য আর অহংকারে প্রতীকী দেখাতে গিয়ে আমরা হয়ে পড়েছি গাড়ীর সেবাদাস। সত্যিই ভাবতে আবাক লাগে একটি জড়বস্তু কিভাবে সভ্য ও জ্ঞানী সমাজের প্রতিনিধি মানুষকে সেবাদাসে পরিণত করতে পারে। হয়তো এ লেখা পড়ে কেহ কেহ প্রতিবাদ করবে এবং প্রাইভেট গাড়ীর পক্ষে যুক্তি দিতে চেষ্টা করবেন।
এ কাজের পূর্বে বিনীত একটি অনুরোধ একবার ভাবুন আপনি কি অধিকাংশ মানুষের যাতায়াত সুবিধা, শিশুদের বিনোদন, হকারদের ব্যবসার সুবিধা, রিকাশ চলাচলের নিশ্চিত জন্য এভাবে যুক্তি উপস্থাপন করবেন।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।