আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

হ-য-ব-র-ল আইনশৃঙ্খলা



সাকী আহ্সান 'ক্রসফায়ার', 'এনকাউন্টার' বা 'বন্দুকযুদ্ধ' আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় এযাবৎ ব্যর্থই হয়েছে সরকার। ৩টি সরকার (বিএনপি-জামায়াত, সেনাসমর্থিত জরুরি অবস্থার তত্ত্বাবধায়ক এবং মহাজোট) বিচারবহির্ভূত হত্যাকা-কে আইনশৃঙ্খলা রক্ষার মহৌষধ হিসেবে ব্যবহার করেছে। চালু করার পর থেকে এ পর্যন্ত ক্রসফায়ারে হাজারেরও বেশি 'কথিত সন্ত্রাসী'কে হত্যা করা হয়েছে। বিচারবহির্ভূত হত্যাকা- বাস্তবে টোটকা ওষুধের মতো আইনশৃঙ্খলার উপরিতলের সাময়িক উপশম হয়তো ঘটিয়েছে; কিন্তু রোগ উপশমের জন্য দেহের গভীরে পেঁৗছাতে পারেনি কখনো। আইনের শাসনকে এড়িয়ে বিচারবহির্ভূত হত্যাকা-ের ভ্রান্তনীতির ফল আজ দেশবাসী প্রত্যক্ষ করছে।

রাজধানীসহ সারাদেশে হত্যা, সন্ত্রাস, নৈরাজ্য, বখাটেপনায় জনজীবন নিরাপত্তাহীন হয়ে পড়েছে। আক্ষরিক অর্থেই জল-স্থল-অরণ্য সন্ত্রাস আর নৈরাজ্যে আক্রান্ত। গত বুধবার কুয়াকাটার সনি্নকটে বঙ্গোপসাগরে জলদস্যুদের দু'গ্রুপের মধ্যে গুলিবর্ষণ হয়েছে। জেলেদের ট্রলারে ডাকাতির নিয়ন্ত্রণ নিয়ে গোলাগুলির ঘটনা ঘটে। সে ঘটনায় একজন ট্রলার মাঝি নিহত, তিনজন জেলে আহত এবং পাঁচজন জেলে অপহৃত হয়েছে।

জলদস্যুতার অনেক ঘটনার এটি একটা মাত্র উদাহরণ। বনদস্যুদের দাপটে বনজীবী সাধারণ মানুষও খুন ও অপহরণের শিকার হচ্ছে। বাঘ বা অন্য কোন পশুর কারণে নয়, বনস্যুদের কারণে সুন্দরবনে সাধারণ বনজীবীদের জীবন বিপন্ন হয়ে পড়েছে। শুরুতে সমুদ্র আর অরণ্যের সন্ত্রাসের উল্লেখ করা হলো। কারণ সেসব ঘটনা অনেক নাগরিকের চোখ এড়িয়ে থাকতে পারে।

লোকালয়ে সন্ত্রাস-নৈরাজ্য চোখ এড়ানোর সুযোগ নেই। এ সন্ত্রাস-নৈরাজ্যে কেবল পেশাদার-অপেশাদার সন্ত্রাসীরাই জড়িত নয়, সরকারদলীয় একশ্রেণীর নেতা-কর্মী এমনকি এমপিরাও জড়িত হয়ে পড়ছে। সবচেয়ে হতাশ হতে হয় তখন, যখন সরকারিদলের প্রভাবশালী কেন্দ্রীয় নেতা বা এমপি সন্ত্রাস-নৈরাজ্য সৃষ্টি করে বা পেছনে থেকে এসবের মদত দেয়। আর ছাত্রলীগের লাগামহীন সন্ত্রাসের কথা বলাবাহুল্য। ছাত্রলীগের সন্ত্রাসী কর্মকা-ের প্রকারভেদ করা দুরূহ।

হত্যা, হামলা, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, দখল ইত্যাদির সঙ্গে এখন যুক্ত হয়েছে প্রতিপক্ষকে ভবন থেকে নিচে ফেলে দেওয়া। গত ১৫ আগস্ট রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের একপক্ষ শাহ মখদুম হল থেকে অপরপক্ষের একজন কর্মীকে পিটিয়ে দোতলা থেকে ফেলে দিয়েছে। ওই কর্মী শেষ পর্যন্ত মারা গেছে। কিন্তু এ ঘটনায় এখন পর্যন্ত কাউকে গ্রেফতার করা হয়েছে বলে জানতে পারিনি। বিশ্ববিদ্যালয় শাখার ছাত্রলীগ নেতাদের বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।

তা নেওয়া হোক। সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়া তাদের অভ্যন্তরীণ ব্যাপার। আমরা দেখতে চাই দোষী ছাত্রলীগ নেতা-কর্মীর বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। সেই আইনি ব্যবস্থা কঠোর কি দৃষ্টান্তমূলক হবে সেটা অপরাধীর ধরন অনুযায়ী আদালতই ঠিক করবেন। সরকার ছাত্রলীগের সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে হুঁশিয়ারির পর হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেই চলেছে, কিন্তু কম ক্ষেত্রেই তারা আইনি পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে।

ছাত্রলীগের সন্ত্রাস দমনে সরকারের আন্তরিকতা নিয়ে কেউ সন্দেহ প্রকাশ করলে তাকে ঢালাওভাবে 'বিরোধী দল' বলা সমীচীন হবে না। সাধারণ মানুষ এখন ছাত্রলীগের রাজনীতি নিষিদ্ধ করার দাবি তুলছে। বিষয়টা যারা বিশ্বাস করবেন না তারা জনমত যাচাই করে দেখতে পারেন। অতীত গৌরব দিয়ে ছাত্রলীগের বর্তমান অন্যায় মোচন করা যাবে না। ক্ষমতাসীন দলের নির্বাচিত অনেক জনপ্রতিনিধির বিরুদ্ধে আইনশৃঙ্খলার ব্যত্যয় ঘটানোর অভিযোগ রয়েছে।

যশোরের এক এমপি গত ১৫ আগস্ট শার্শা থানার ওসিকে চড় মেরেছেন। ঘটনার শিকার ওসি এ নিয়ে একটি জিডি করেছেন। ঢাকা ও কক্সবাজারের দুই এমপির বিরুদ্ধেও পুলিশকে মারধরের অভিযোগ রয়েছে। জননেতারাই যদি পুলিশ পেটায় তবে কর্মীরা আর বাদ থাকবে কেন। গত ১৭ জুলাই রাজধানীর কামরাঙ্গীরচরে একজন এসআইকে পিটিয়েছে ছাত্রলীগের কয়েকজন নেতা-কর্মী।

যদি ধরেও নেই যে ক্ষমতাসীন দলের নেতা-কর্মীদের হামলার শিকার সব পুলিশের কোন না কোন অন্যায় রয়েছে তবুও বলতে হয়, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কোন সদস্যকে মারধরের অধিকার তারা পেলেন কোথায়? পুলিশকে মেরে তারা কি আইন ভঙ্গ করছেন না, খারাপ নজির স্থাপন করছেন না? প্রধানমন্ত্রী গত রোববার বলেছেন, আমরা সব অন্যায়-অবিচারের বিপক্ষে। আওয়ামী লীগের কোন নেতা-কর্মী অন্যায় করলে তিনি তাকেও শাস্তি দেওয়ার কথা বলেছেন। ঘরের ভেতর থেকে শাসন শুরু করার প্রত্যয় ব্যক্ত করেছেন। স্থানীয় সরকারমন্ত্রী বলেছেন, সরকারের ভালো কাজকে আওয়ামী লীগের কিছু নেতা-কর্মী মস্নান করে দিচ্ছে। আমরা প্রধানমন্ত্রীর কথায় ভরসা করতে চাই।

তার কথা অনুযায়ী কাজ হলেই আমরা ভরসা পাব। অনেকে আশঙ্কা প্রকাশ করেছে, 'ঘরের ভেতর থেকে শাসন শুরু' করার ঘোষণা কেবলই কথার কথা। এ আশঙ্কাকে অমূলক প্রমাণ করার দায়িত্ব সরকারের। সরকারি দলের যেসব নেতা-কর্মী সন্ত্রাস-নৈরাজ্যে জড়িত বা মদত দিচ্ছে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে। এবং সেটা শুধু সাংগঠনিক ব্যবস্থার মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখলেই চলবে না।

আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। আশা করি, স্থানীয় সরকারমন্ত্রীর উপলব্ধি এ ব্যবস্থা গ্রহণে পাথেয় হবে। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি লাগামহীন হয়ে পড়েছে। খোদ পুলিশই হত্যা-হামলার শিকার হচ্ছে। বখাটেরা পুলিশে অস্ত্র ছিনিয়ে নিয়েছে।

যারা জনগণের জানমালের নিরাপত্তা দেবে, সন্ত্রাসে তাদেরই ত্রাহি ত্রাহি অবস্থা। পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা আইনশৃঙ্খলার অবনতিকে বিপজ্জনক বলেছেন। বখাটে বলে যাদের মামুলি হিসেবে গণ্য করা হচ্ছিল তাদের ভয়ঙ্কর রূপ দেখেছে মানুষ। গত মঙ্গলবার রাতে রাজধানীর নিকুঞ্জে বখাটেরা পুলিশের অস্ত্র ছিনিয়ে নিয়েছে। ওইদিন স্কুলছাত্রীকে উত্ত্যক্ত করার ঘটনায় দুই পক্ষের সংঘর্ষ হয়।

সংঘর্ষ থামাতে গিয়ে পুলিশের একটি পিস্তল খোয়া গেছে। এ ঘটনার পর বোধকরি বখাটেদের আর মামুলি অপরাধী হিসেবে গণ্য করা ঠিক হবে না। বখাটেদের উৎপাতে এ পর্যন্ত অনেক স্কুলছাত্রী আত্মহননের পথে পা বাড়িয়েছে। বখাটেদের হাত থেকে কোমলমতি শিক্ষার্থীদের রক্ষা করতে কঠোর আইন প্রণয়ন জরুরি হয়ে দাঁড়িয়েছে। আর শুধু আইন প্রণয়ন করলেই চলবে না এর সঠিক প্রয়োগও নিশ্চিত করা দরকার।

র‌্যাব বা পুলিশকে দিয়ে বিচারবহির্ভূত হত্যাকা- ঘটানো হয়েছে, তাদের কর্মকুশলতা বাড়ানো হয়নি। অথচ শেষের কাজটিই ছিল জরুরি। বিষয়টি উপেক্ষা করার কারণেই আজ পুলিশরাই হত্যা-হামলার শিকার হচ্ছে। গত বৃহস্পতিবার মতিঝিলে সন্ত্রাসীদের গুলিতে পুলিশের একজন কনস্টেবল মারা গেছে এবং একজন নায়েক আহত হয়েছে। এর আগে গত ২০ এপ্রিল বংশাল থানার এসআই গৌতম হত্যার শিকার হয়েছে।

বিষয়টি অ্যালার্মিং। সন্ত্রাস-নৈরাজ্য প্রতিরোধে পুলিশের সক্ষমতা কতটুকু, এ প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। শুধু সন্ত্রাস প্রতিরোধে ব্যর্থতাই নয়, অপরাধীকে খুঁজে বের করার ক্ষেত্রেই আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ব্যর্থতা দেখা গেছে। তারা গৌতম হত্যা মামলার একই নামের একাধিক আসামিকে গ্রেফতার দেখিয়ে হাস্যস্পদে পরিণত হয়েছে। আজও তারা বিষয়টির সুরাহা করতে পারেনি।

এর মধ্য দিয়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর দুর্বল কাঠামোই প্রকাশ পায়। সব মিলিয়ে আইনশৃঙ্খলা ক্ষেত্রে হ-য-ব-র-ল পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে। এই অবস্থা দূর করতে পুলিশ বাহিনীতে সংস্কার দরকার। ১৮৬১ সালে করা আইন দিয়ে একুশ শতকে পুলিশ বাহিনী কার্যকর করা যায় না। বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকার আমলে বাংলাদেশ পুলিশ অধ্যাদেশ ২০০৭-এর একটি খসড়া প্রস্তাব তৈরি করা হয়েছিল।

খসড়াটিকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পর্যালোচনা কমিটি অনুমোদনযোগ্য মনে করেনি। অথচ প্রস্তাবিত পুলিশ আইনের ওপর গৃহীত জনমতে দেখা গেছে, অধিকাংশ মানুষ প্রস্তাবিত পুলিশ আইনের পক্ষে। ধারণা করা হচ্ছে, পুলিশের ওপর প্রশাসনিক প্রভাব কমে যাওয়ার আশঙ্কায় সংশ্লিষ্ট আমলারা এর বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছে। বিষয়টি দুঃখজনক। সরকার পুলিশকে জনগণের বন্ধু বানানোর কথা বলছে আর আমলারা সে কাজে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করছেন।

এটা কাম্য নয়। পুলিশকে সঠিক পন্থায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষার কাজে লাগাতে চাইলে তার ওপর থেকে রাজনৈতিক প্রভাব কমাতে হবে। এজন্য পুলিশ আইন সংস্কারের বিকল্প নেই। রাজনৈতিক দলগুলো পুলিশকে কার্যত সরকারি বাহিনীতে পরিণত করেছে। দুর্বল পুলিশ আইনের কারণেই এটা সম্ভব হয়েছে।

পুলিশ সরকারি দলের নয়, জনগণের সেবক হওয়াই বাঞ্ছনীয়। এ ব্যাপারে বর্তমান সরকারেরও প্রতিশ্রুতি রয়েছে। প্রয়োজনীয় সংস্কার সাধন করে 'বাংলাদেশ পুলিশ অধ্যাদেশ ২০০৭'-কে আইনে পরিণত করলে সরকারের প্রতিশ্রুতি পালন করা হবে। আশা করা যায় যুগোপযোগী পুলিশ আইন পাস হলে আইনশৃঙ্খলার ক্ষেত্রে সৃষ্ট হ-য-ব-র-ল পস্থিতির ইতিবাচক পরিবর্তন ঘটবে।


সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।