আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

ছাত্রী রুমমেট আবশ্যক

এই ব্লগের কোন লেখা আমার অনুমতি ব্যতীত কোথাও ব্যবহার না করার অনুরোধ করছি

আগামী ২৮ আগস্ট ২০০৯ থেকে একজন ছাত্রী রুমমেট আবশ্যক। (মেস করে খাওয়ার ব্যবস্থা আছে) যোগাযোগ করুন-০১৯২******* শুরু হয়েছিল ফটোকপির দোকানের পাশের এই বিজ্ঞাপনটা থেকে। একবছর আগে যেদিন প্রথম এই বিজ্ঞাপনটা দেখি সেদিন প্রচন্ড বৃষ্টিতে দাঁড়িয়ে ছিলাম। ছাতা ছিল না সঙ্গে, বৃষ্টিতে পথে নামলে জামা-কাপড় সব ভিজে শরীরের সঙ্গে লেপ্টে যাবে, অসংখ্য সুশীল পুরুষের কামুক দৃষ্টির একমাত্র বিষয় হতে চাইনি, তাইনি প্রচন্ড গরমে ঘামতে ঘামতে আর আমার বিবর্ণ গোলাপী রুমালে সেগুলো মুছতে মুছতে ভীড়ের মাঝেই দাঁড়িয়ে ভাবছিলাম আমার অতীতের কথা। গ্রাম থেকে যখন প্রথম ঢাকায় পড়তে আসি, তখন ধারণাই ছিল না কোন দোজখে আসতে যাচ্ছি।

ছাত্রী হিশেবে আমি বরাবরই মোটামুটি ধরণের, টেনেটুনে এসএসসি উতরে গিয়ে খুব উৎসাহ নিয়ে কলেজে ভর্তি হই এবং এইচএসসির গন্ডিও টেনেটুনেই পার হয়ে যাই। আমার ধারণা ছিল বড় আপুর মত বাবা আমাকেও বিয়ে দিয়ে দিবেন, সুতরাং পড়াশোনা নামক যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পাওয়া যাবে। কিন্তু আমার প্রাইমারি স্কুল শিক্ষক বাবা জেদ ধরে বসলেন আমার জন্য বরের চেয়েও তাঁর একটা গ্রাজুয়েশন সার্টিফিকেট অনেক বেশি প্রয়োজন। অগত্যা আবারও টেনেটুনে ভর্তি পরীক্ষায় অংশ নেয়া এবং ঢাকার মাঝারি মানের একটা মহিলা কলেজে অনার্সে ভর্তি হয়ে যাওয়া। ভালোই কাটছিল দিনগুলো।

হলে সিট পাওয়া যায়নি, গণরুমে থাকতে হতো, ক্লাস কখনোই হতো না, এতে অবশ্য আমার চেয়ে আনন্দিত আর কেউ হতো না। সারাদিন বান্ধবীদের সঙ্গে ঘুরঘুর করে সময় কাটতো চমৎকার। গ্রামের আমি খুব সহসাই শিখে ফেলছিলাম শহুরে চালচলন। বাবা মাস গেলে ১৫০০ টাকা পাঠাতেন, খাওয়ার জন্য ৯০০ টাকা দিয়ে বাকিটা নিজের হাতখরচ চালাতাম। বান্ধবীদের কেউ কেউ সবসময়ই বিভিন্ন জায়গায় ঘুরতে যাওয়ার রিক্সাভাড়া-বাসভাড়াটা চালিয়ে দিত, অতএব, ৬০০ টাকায় খারাপ থাকতাম না আমি।

একটা টিউশনি ম্যানেজ করে নিয়েছিলাম বছর না ঘুরতেই, আমার ধারণার বাইরে ছিল ক্লাস ফাইভের একটা বাচ্চাকে পড়ালে কেউ ২০০০ টাকা দিতে পারে। রাজধানী শহর। ভাবসাবই আলাদা। বাবা মারা গেলেন খুব দ্রুতই, বাড়ি থেকে টাকা আসা বন্ধ হল। মা আগেই গিয়েছিলেন, পিছুটান খুব একটা আর রইল না।

চলতে লাগল অচেনা শহরে আমার টেনেটুনে করা পড়াশোনা আর সেইসাথে টিউশনি। এগুলোই ভাবছিলাম ফটোকপির দোকানে দাঁড়িয়ে। হঠাৎই চোখে পড়েছিল বিজ্ঞাপনটা। ভাবলাম, খবর নেয়া যেতে পারে। দুই বছরেও হলে সিট পাইনি, আর ৩ বছরে পাব বলেও মনে হয় না।

খুবই কষ্ট হয় থাকতে। খাবার জঘন্যর চেয়েও খারাপ, ৯০০ টাকা এর পিছনে ঢালা অনুচিত। ফোন নাম্বারটা টুকে নিলাম। রাতে অতি জঘন্য খাবার নামের একটা বস্তু সামান্য গলধঃকরণ করে খোলা লনে বেরিয়ে এসে ফোন করলাম ঐ নাম্বারে। একটা নারীকণ্ঠ জবাব দিল অন্যপ্রান্ত থেকে।

কথাবার্তা মোটামুটি ঠিকঠাক করেই ফেললাম, চাইলে কাল থেকেই উঠা যাবে। পরদিন একবার গিয়ে দেখে আসলাম, সুন্দর একটা বাসা। বাইরের দিকের দু'টা ঘর আমাদের মতো ছাত্রীরাই মেস করে থাকে। বাড়িওয়ালা অন্যদিকের দরজা ব্যবহার করে। পুরোনো ধাঁচের বাসা, মনে হয় পুরোনো ঢাকার বাড়িগুলো আগে এমনই ছিল।

দুইদিকে দরজা অবাক করল আমাকে, কিন্তু ঝামেলা কম হবে এই জন্যে এটাই কিন্তু আমাকে পছন্দ করিয়ে দিল। নারীকণ্ঠের সঙ্গে পরিচিত হলাম- আমাদের কলেজেরই ছাত্রী, আমার চেয়ে দুই বছরের সিনিয়র, অর্থাৎ নিউ ফাইনাল ইয়ার। নারীকণ্ঠ নিজের নাম জানাল- অনিতা। আরও একজন রুমমেট ছিল আমাদের সেই রুমে, পরে দেখা হয়েছিল, শাম্মা। একটা ছোট্ট বিজ্ঞাপন থেকে নিজের একটা ঘর; হোক না শেয়ারে, হোক না ভাড়া, তবু আমার ঘর; আমি গ্রাম্য মেয়ে, ওটা আমার ঘর; আমি বোধহয় চলতে শিখে গেছি ইস্পাতদৃঢ় নগরীতে, দাঁড়াতে শিখে গেছি নিজের মতো করে- প্রথম রাতে এসবই ভাবছিলাম শুয়ে শুয়ে।

আর তো পিছুটান নেই কোন, মা নেই, বাবা নেই, বোন ঠিকানা জানে না, জানবেও না; কোন প্রেমিক নেই, কোন স্বপ্ন নেই, কোন ভবিষ্যতও সম্ভবত নেই। টেনেটুনে যোগাড় করে ফেলব এই অনার্স কোর্সের সার্টিফিকেটটা, আরেকটু টেনেটুনে একটা ছোট চাকরিও হয়তো পাব, বিয়ে তো আর কেউ করতে আসছে না, সহজ, সুন্দর এবং স্বাধীন জীবন কাটাব যতদিন সম্ভব। ভালো হয় এই ঘরটা অনেকদিন রাখতে পারলে, এখানে ভালই লাগছে, ওই তো সরু গ্রিলের ফাঁক গলে চাঁদ আসছে শিশুদের তুলতুলে ত্বকের মতো, বেশ দূরে শোনা যাচ্ছে রিকশা আর পথের কোলাহল, আমার নিজের ঘর এটা। গর্ব বোধ করছিলাম অনেকটাই, কপাল ভালো যে বিজ্ঞাপনটা চোখে পড়েছিল। তখনও ভাবতে পারিনি আমার জীবনে কতটা পরিবর্তন আসতে যাচ্ছে এই বিজ্ঞাপনটার জন্যই।

দিন কাটছিল ভালোই। এই বাসায় দুটা রুম কলেজ পড়ুয়া/চাকরিজীবি মেয়েদের কাছে ভাড়া দেয়া, মোট ছয়জন থাকি, তিনজন করে। পাশের রুমের মেয়েদের সাথেও পরিচয় হয়েছিল, কিন্তু আমার ভুবন ঘিরে ছিল অনিতাদি আর শাম্মাপুর উচ্ছলতাই। প্রায়ই আমরা রাত জেগে গল্প গুজব করতাম, লুডু খেলতাম, শাম্মাপুর একমাত্র শাড়িটা পালা করে তিনজন পড়ে ক্যাটওয়াকিং প্র্যাকটিস করতাম। সময় কাটতে লাগল দ্রুত।

ঈদের ছুটিতে ভাবলাম বাড়ি যাব, পরমূহুর্তেই সেই চিন্তা জোড় করে সরিয়ে দিলাম। কার কাছে যেতে পারি আমি? শাম্মাপুর বাড়ি যেতে অনেক ঝকমারি, সেও যাচ্ছে না, এদিকে অনিতাদির কথা বলাই বাহুল্য। তাকে হাজার প্রশ্ন করেও আমি বা শাম্মাপু কখনো বাড়ির ব্যাপারে একটা কথাও জানতে পারিনি। শুধু একটাই উত্তর তার জানা ছিল- এই প্রসঙ্গটা থাক। বাড়িওয়ালারাও চলে গেল ঈদে, চলে গেল পাশের রুমের মেয়েরাও।

এক অর্থে আমরা ছাড়া আর কেউ নেই। ঈদের ঠিক আগের রাতটিতে বদলে গেল আমার জীবন, আমি ঠিক আর আমার মাঝে রইলাম না, পরিণত হলাম অন্য কিছুতে, বিবর্তনটা ছিল ভয়াবহ নৃশংস এবং নিষ্ঠুর। চানরাতে, আমিও কয়েকটা পুরোনো ঢাকার শব্দ রপ্ত করে নিয়েছিলাম, সকাল থেকেই শাম্মাপু আর অনিতাদি বাইরে ছিল। শাম্মাপু একটা দোকনের সেলস গার্ল ছিল, তার সেদিন ব্যস্ততার শেষ নেই। অনিতাদি বলল, ঈদ কি আমাদের নেই? আমি কিছু খাবার দাবার কিনব, কাল আমাদের তিনজনের ঈদ হবে।

আমি সকাল সকাল টিউশনি সেরে বিকেল শুরুর আগেই চলে এলাম রুমে, গোসল সেরে নিলাম। সন্ধ্যা নাগাদ ফিরে এল অনিতাদি, হাতে ব্রাউন পেপারে মোড়ানো একটা বড় প্যাকেট, সম্ভবত, সেমাই-দুধ-ইত্যাদি হবে। অনিতাদি ফ্রেশ হয়ে আসতে না আসতেই শাম্মাপুও চলে এল। আমি বললাম, শাম্মাপু, তুমি! তোমার না আজকে দোকানে এত ভীড়? না রে, আজকে শরীরটা ভালো লাগছে না, ছুটি নিয়ে চলে এসেছি। কী ব্যাপার, বেশি খারাপ লাগছে না তো? আরে না, ঠিক আছি আমি, সেরে যাবে।

অনিতা এসেছে? হ্যাঁ আমি তোমার আগেই পৌঁছেছি, তোয়ালেতে মুখ মুছতে মুছতে ঘরে ঢুকল অনিতাদি। বাহ। তাহলে তো ভালই। এস, শুরু করি। হুমম, এস।

ব্রাউন পেপারের মোড়ক উন্মোচিত হল, সেখান থেকে একটা পেটমোটা বোতল বের হল, ভেতরে গাড় বাদামী রঙের তরল। মদ! আমি প্রায় চিৎকার করে উঠলাম। শসসসসস। চুপ। কেউ শুনবে।

অনিতাদি ঠোঁটে আঙ্গুল রেখে বলল। কিন্তু তুমি মদ এনেছ কেন? ঈদের দিন কি এই খেতে হবে নাকি? আরে বোকা শোন, আমরা তিনজনই তো আমাদের সুখ দুঃখের ভাগীদার তাই না? দ্যাখ, এই পুরো বাড়িতে কেউ নেই, আমরা আমাদের আনন্দটুকু করতে দোষ কোথায়? অনিতা জানতে চাইল। শাম্মা বলল- কোন দোষই নেই। তুই খাসনি কখনো, তাই খারাপ মনে হচ্ছে। খেয়ে দেখ আজ, ভালোই লাগবে।

অনেক কথায় আমি কয়েক চুমুক খেলাম। মনে হচ্ছিল আমার গলা দিয়ে কিছু একটা পুড়ে যাচ্ছে, কিন্তু সেই যন্ত্রণা কষ্ট দিচ্ছে না, ভয়ংকর রকমের একটা সুখ দিচ্ছে। আমার চিন্তা করার ক্ষমতা লোপ পেল খুব দ্রুত, এবং ঘোরের ভেতর চলে এলাম। আমার চারপাশে যা ঘটছিল তা দেখতে পাচ্ছিলাম, অনুধাবন করতে পারছিলাম, কিন্তু কথা বলতে পারছিলাম না। এমনভাবে কতক্ষণ কেটেছে মনে নেই, হঠাৎ দেখি ঘরের মধ্যে পাঁচ-ছয় জন পুরুষমানুষ ঢুকেছে, অনিতা এগিয়ে আনছে তাদের।

সামান্য সম্বিৎ ফিরে পেতে চাইলাম, কিন্তু পেলাম না সম্পূর্ণ, দেখলাম লোকগুলোর হাতে টিভি ক্যামেরার মতো ক্যামেরা, উজ্জ্বল আলো। এরপর শুরু হল এক দীর্ঘ দুঃসময়, রাত আর কাটছিল না সেরাতে, আমার একান্ত জীবনের প্রথম চানরাতে। ঘোর লাগা চোখেই দেখলাম অনিতা আর শাম্মাকে নগ্ন করে ফেলছে লোকগুলো, বাধা দিচ্ছে না ওরা, বরং খিলখিল করে হাসছে। একটু পর আমাকেও নগ্ন করে দিতে এল, আমি সর্বশক্তিতে চেঁচাতে চাইলাম, সামান্য শব্দই বের হল আমার মুখ থেকে। চারপাশে উজ্জ্বল আলোর বন্যা।

পাঁচ ছয় জন নগ্ন পুরুষ। তিনজন নগ্ন নারী। পৃথিবীর প্রাচীমতম আদিমতার খোঁজ পেলাম আমি সেরাতে, শুধু এটাই নয়, সেই আদিমতাকে আধুনিকতার ফ্রেমে বন্দী করে নিল ওরা, উপর্যুপরি ব্যবহার করল আমাকে। কতক্ষণ? এক ঘন্টা? দুই ঘন্টা?? জ্ঞান হারানোর আগে অস্পষ্ট শুনতে পেলাম- মাগী একখান ভালা বিছরায়া বাইর করছছ। এই সিডি হিট না হৈলে ব্যবসা ছাইড়া দিমু।

....খিলখিল হাসির শব্দ..... ঈদের সকালটি এসেছিল আমার জন্য পৃথিবীর সমস্ত যন্ত্রণাকে একত্র করে, আমি নিজেকে খুঁজে পেয়েছিলাম বিবস্ত্র এবং রক্তাক্ত, খুঁজে পেয়েছিলাম ঘরের বিছানাতে লেগে থাকা শুকনো রক্তের দাগ, শুধু খুঁজে পাইনি অনিতা আর শাম্মাকে। গত একবছরে খুঁজে পাইনি ওদের আর, যেমন খুঁজে পাইনি ছাত্রী রুমমেট আবশ্যক ধরণের আর একটি বিজ্ঞাপনও। আমি আজীবন টেনেটুনে আনা পড়াশোনা ছেড়েছি গত এক বছরে, রাস্তায় স্কুল পড়ুয়া দুই ছেলের মুখে শুনেছি- দোস্ত দেখ দেখ, বাংলা গ্যাংব্যাং এর মাইয়াটা না এইটা? - হ হ, পুরাই খানকি; কেঁদেছি অসংখ্য অসংখ্য বিনিদ্র রাত্রি, নিজেকে হত্যা করেছি কোটি কোটি বার, পথে বেরুতে ভয় পেয়েছি অনেক অনেক দিন; এবং একদিন বিদ্রোহ করেছি নিজের সাথেই। এখন, সেই রাত থেকে এক বছর পর, আমি সমুদ্রতীরের নামকরা হোটেলের তালিকাভুক্ত দেহপসারিনী, আমি একদিনের সেই গ্রাম্য সহজ সরল মেয়ে, আমি টেনেটুনে পড়াশোনা করা সেই মেয়ে, আমার নিজেরই বিশ্বাস হয় না আর। তবুও বেঁচে আছি, কারণ, এই পথই একমাত্র পথ, যেই পথে আমি খুঁজে পেতে পারি অনিতা ও শাম্মাকে, এবং পূর্ণ করতে পারি আমার সেই মনোবাসনা, যেটা করার জন্য গত এক বছরে লক্ষবার মৃত্যুকে কামনা করেও দূরে ঠেলে দিয়েছি।

আমি এখন একজন প্রস, আমি ভাড়া খাটি, আমি অপাঙক্তেয়া; কিন্তু আমি তো এমন ছিলাম না। বেঁচে আছি শুধু দুটি খুনের জন্য, দুটি খুনের তীব্র বাসনা আমাকে আজও বাঁচিয়ে রেখেছে। /*অনেক দিন পর, প্রায় চারবছর পর গল্প লিখতে ইচ্ছে হল, অভ্যেস না থাকায় অখাদ্য হয়ে দাঁড়াল ব্যাপারটা, পাঠক ক্ষমা করবেন*/

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।