আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

আয়েশা

নীল মানব

আয়েশা, বয়স ১৮। এক বছর আগে মা-বাবার নির্দেশে তাঁর বিয়ে হয়েছিল, কিন্তু শ্বশুরবাড়িতে তাঁর পক্ষে টিকে থাকা অসম্ভব হয়ে পড়ে। স্বামী তো ছিলই, শ্বশুর-শাশুড়ির হাতেও তাঁকে নিত্য নির্যাতন সইতে হতো। অবস্থা যখন সহ্যের বাইরে চলে গেল, মেয়েটি একদিন পালিয়ে চলে আসে বাবারবাড়িতে। আশা ছিল, সেখানে আশ্রয় পাবেন।

আশ্রয়ও পেয়েছিলেন তিনি। কিন্তু স্বামীর আদেশ অমান্য করে ঘরের বউ পালিয়েছে—এ কথা রাষ্ট্র হতে সময় লাগেনি। গ্রামের মোল্লাদের কানেও কথাটা পৌঁছে যায়। ডাকা হলো সালিশ। সেখানে যথারীতি সাব্যস্ত হলো, এমন ভয়াবহ পাপাচারের শাস্তি হিসেবে আয়েশার নাক কেটে দেওয়া হোক।

এরপর তাঁকে দেখে অন্য বেয়াড়া মেয়েরা এমন কিছু একটা করার আগে দুবার ভাববে। সেই থেকে মেয়েটির নাক কাটা। গল্প নয়, সত্যি ঘটনা। ঘটেছে আফগানিস্তানের উরুজগানে। এখন সেখানে আফগান তালেবানদের অবাধ রাজত্ব।

আয়েশার কাহিনি শুনে আমার আরেক অভাগা মেয়ের কথা মনে পড়ল। তাঁর নাম খনা। জ্যোর্তিবিদ্যায় তাঁর অসাধারণ ব্যুত্পত্তি ছিল। মুখে মুখে প্রবচন রচনার জন্য তাঁর খ্যাতি ছিল দেশজোড়া। খনার স্বামী ও শ্বশুর দুজনই জ্যোর্তিবিদ্যায় পারদর্শী ছিলেন।

একবার রাজা বিক্রমাদিত্য আকাশের নক্ষত্রের সংখ্যা কত জানতে চাইলেন, কিন্তু বাপ-বেটা চেষ্টা করে ব্যর্থ হলে খনার শরণাপন্ন হন। খনার কাছ থেকে সঠিক সংখ্যা জেনে তবে তাঁদের সম্মান রক্ষা হয়। রাজা যখন জানতে পারলেন উত্তরটা এসেছে খনার কাছ থেকে, তিনি আমন্ত্রণ জানালেন সেই মেয়েকে রাজসভায় তাঁর সঙ্গে সাক্ষাতে। অপমানিত ও ক্রুদ্ধ পিতা ও পুত্র তখন খনার জিহ্বা কেটে ফেলেন। খনার এই কাহিনি সত্যি না, গালগল্প, তা আমরা জানি না।

কিন্তু আয়েশার কাহিনি সত্যি, তা আমরা নিশ্চিতভাবে জানি। তাঁর কথা জেনেছি গত মাসে টাইম ম্যাগাজিনের প্রচ্ছদে ছবি ছাপা হওয়ার পর। নাক কাটা মেয়েটির ছবি, তাঁর পাশে সোজাসাপটা শিরোনাম: আমেরিকা আফগানিস্তান ছেড়ে চলে আসার পর অবস্থা কী দাঁড়াবে। কোনো প্রশ্নবোধক চিহ্ন ছাড়া একটি সরল স্টেটমেন্ট। এই প্রচ্ছদচিত্র ও কাহিনি নিয়ে এ দেশে বামপন্থী মহলে এখন তীব্র বাদানুবাদ শুরু হয়েছে।

কেউ কেউ সরাসরি বলেছেন, এটা এক ধরনের পর্নোগ্রাফি—আফগান মেয়েদের বিষাদ ও করাল নিয়তি নিয়ে পর্নো ব্যবসা। এ কথা বলার কারণ? তাঁর এই হূদয় বিদারক ছবি ছাপিয়ে টাইম ম্যাগাজিন এ কথাটিই বলার চেষ্টা করছে, আফগানিস্তান থেকে আমেরিকা চলে এলে সমস্যা ভয়াবহ আকার ধারণ করবে। সবচেয়ে খারাপ অবস্থা হবে মেয়েদের। বামপন্থীরা, যাঁরা আফগানিস্তানে বিদেশি সেনার উপস্থিতির প্রবল বিরোধী, তাঁদের যুক্তি, আয়েশার নাক কাটা হয়েছে এমন সময় যখন আফগানিস্তানে আমেরিকার লাখ খানেক সেনা তালেবানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত। কই, তাঁরা তো আয়েশার ওপর এই বর্বর আক্রমণ ঠেকাতে পারেনি? অন্য কথায়, টাইম ম্যাগাজিন একটি সরলমতি আফগান মেয়ের করুণ কাহিনি ব্যবহার করে আসলে আফগানিস্তানে বিদেশি সেনার অবস্থান ও মার্কিন অধিগ্রহণ প্রলম্বিত করার পক্ষে যুক্তি খাড়া করার চেষ্টা করেছে।

ব্যস, আর কিছু নয়। কথাটা হয়তো একদম মিথ্যা নয়। প্রায় ১০ বছর হতে চলল আফগানিস্তানে আমেরিকার সামরিক অভিযান। এ সময় কোটি কোটি ডলারের শ্রাদ্ধ তো হয়েছেই, দুই পক্ষের মানুষও মারা গেছে দেদার। তাদের অধিকাংশই নিরীহ ও বেসামরিক মানুষ।

এই মুহূর্তে আমেরিকার ভেতর এই যুদ্ধের পক্ষে সমর্থন মারাত্মক কমে এসেছে। ক্ষমতাসীন ডেমোক্র্যাটদের মধ্যেই বেশির ভাগ কংগ্রেস সদস্য এখন এ প্রশ্নে দ্বিধাগ্রস্ত। বিরোধী ও আমেরিকার সামরিক আধিপত্যে আমুণ্ডু বিশ্বাসী-রিপাবলিকানদের ঘাড়ে বন্দুক রেখে আফগানিস্তানের যুদ্ধে টাকার জোগান নিশ্চিত করতে পেরেছেন প্রেসিডেন্ট ওবামা। কিন্তু তিনিও জানেন, অনন্তকাল আফগানিস্তানে থাকা যাবে না। তিনি বলেন, ২০১১ সাল নাগাদ আমেরিকান সৈন্য আফগানিস্তান থেকে ফেরা শুরু করবে।

তার মানে আজ হোক আর কাল, মার্কিন সেনা ঘরে ফিরবেই। আর তারা ফিরতে না ফিরতেই হা-রে-রে করতে করতে হুমড়ি খেয়ে পড়বে তালেবান। মার্কিন সেনা ছাড়া আফগান সরকারের সাধ্য নেই তালেবানদের ঠেকায়—এ কথায় কোনো বিতর্ক নেই। এই তালেবান ক্ষমতায় ফিরে এলে অন্য কিছুর আগে তারা যে পুনরায় মেয়েদের ওপর চড়াও হবে, তাতেও কোনো সন্দেহ নেই। কেন জানি, কী কারণে মৌলবাদী মাত্রই, তা আফগানিস্তানে হোক বা অন্যত্র হোক, মেয়েদের নাম শুনলে ভয়ে অস্থির।

মেয়েদের মাথার খোলা চুল দেখলেও নাকি তাদের পাজামার দড়ি ছিঁড়ে যায়। ভয়টা সে কারণেই। অনেকেই ভাবছেন, গত এক দশকে মার্কিন উপস্থিতির কারণে আফগানিস্তানের মেয়েরা যে অগ্রগতি অর্জন করেছে, তা শুধু মুখ থুবড়েই পড়বে না, উল্টো পথেও হাঁটা শুরু করবে। তখন হয়তো এক আয়েশা নন, হাজার হাজার আয়েশার নাক কাটা যাবে। শুধু নাক কাটা কেন, পাথর ছুড়েও মৃত্যু হবে অনেকের।

কিন্তু এ কথাও তো ঠিক, মেয়েদের অধিকার প্রশ্নে যে লড়াই, তা আফগানিস্তানের মানুষের নিজের লড়াই। এই লড়াইয়ে জিততে হলে তাঁদের নিজেদের মনে এই প্রত্যয় জাগাতে হবে, মেয়েদের অধিকারের প্রশ্নে তাঁদের মধ্যযুগীয় আচার-আচরণ কেবল পৃথিবীর মানুষের নিন্দারই কারণ নয়, তাঁদের দেশকেও অগ্রগতি থেকে দূরে সরিয়ে রাখছে। মেয়েরা দেশের মোট জনসংখ্যার অর্ধেক। তাঁদের যদি নিষ্ক্রিয় করে রাখা হয়, তাহলে দেশের অর্ধেক জনসম্পদ অব্যবহূত হয়ে থাকে। এ অবস্থার পরিবর্তন চাইলে আফগান নারী ও পুরুষ উভয়কেই নারী অধিকারের পক্ষে লড়তে হবে।

তাহলে জয় আসবে। বাইরে থেকে এসে কেউ যদি সে যুদ্ধে জয় এনেও দেয়, তার ফলাফল দীর্ঘস্থায়ী হবে না। পাদটীকা: আয়েশার জন্য একটি ভালো খবর আছে। উরুজগান থেকে মেয়েটিকে উদ্ধার করে ক্যালিফোর্নিয়ায় আনা হয়েছে। আপনারা এ লেখা যখন পড়ছেন, তত দিন তার নাকের অস্ত্রোপচার হয়তো শেষ।

কয়েক দিন আগেও তাঁর দিকে তাকালে মেয়েটি লজ্জায় নাক ঢেকে রাখতেন। না, আয়েশাকে আর লজ্জায় মাথা কুটতে হবে না। হাসান ফেরদৌস ১৩ আগস্ট ২০১০, নিউইয়র্ক

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.