আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

বঙ্গবন্ধুকে প্রথম দেখা ।। রেজা ঘটক

বাংলাদেশ আমার দেশ, বাংলা আমার ভাষা...

বঙ্গবন্ধুকে প্রথম দেখা রেজা ঘটক আমি তখন কাস ফাইভে পড়ি। ১৯৮০ সালের আগস্ট মাসের প্রথম সপ্তাহের ঘটনা। সম্ভবত দিনটি ছিল রোববার। আমি আর আমার বন্ধু প্রকাশ, দু’জনে মিলে ঠিক করলাম টুঙ্গিপাড়ায় বঙ্গবন্ধুকে দেখতে যাব। দু’জনেই তখন মাত্র নতুন সাইকেল চালানো শিখেছি।

কিন্তু কারোরই দূরযাত্রার অভিজ্ঞতা নেই। এক ঢিলে দুই পাখি মারার ইচ্ছা নিয়ে আমরা সকালের দিকেই সুজিতদা’র গ্যারেজে উপস্থিত হলাম। সুজিতদা’র গ্যারেজে রাজ্যের যতো সাইকেল। কোনোটির ব্রেক নেই। কোনোটির মাডগার্ট নেই।

কোনোটির টায়ার লিক। কোনোটির বেল নেই। কোনোটির স্পোক ভাঙা। কেনোটির ঘন ঘন চেইন পড়ে। কোনোটির প্যাডেল ভাঙা।

কোনোটির বডি ছুটে গেছে। কোনোটির স্ট্যান্ড নেই। কোনোটির মেরুদন্ড ভেঙে গেছে। এরকম বাহারি সাইকেলগুলো সার্ভিসিংয়ের জন্য সুজিতদা’র গ্যারেজে রোজ জমা হয়। আর প্রত্যেকটি সাইকেলই সুজিতদা’র হাতের যাদুতে তাজা সাইকেল হয়ে ওঠে।

এমনিতে সুজিতদা’ আমদের ঘন্টায় এক টাকা দরে সাইকেল ভাড়া দেয়। কিন্তু আমরা তার হাতের কিছু কাজ করে দিলে বিপরীতে খানিক ওভার টাইমও চালানো যায়। আমরা তখন প্রায়ই ওই সুযোগ কাজে লাগাই। দু’জনের সম্বল মাত্র বারো টাকা। ডাবলিংটা শেখা থাকলে কিছু টাকা হয়তো বাঁচানো যেত।

কিন্তু সুজিতদা’ আমাদের মতো লিলিপুটদের ডাবলিংয়ের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করে রেখেছেন। অবশ্য আমারা তখন সুজিতদা’র চালাকিও পুরোপুরি ধরতে পারি। কিন্তু আমরা যেহেতু টুঙ্গিপাড়া যাব সেজন্যে দু’জন একত্রে না গিয়ে, আধা ঘন্টা বিরতি দিয়ে একটি করে সাইকেল নিয়ে কেটে পড়লাম। দীঘিরজান বাজারের কাঠের পুলের ওপর দু’জনে দুই সাইকেলে পুনরায় মিলিত হলাম। এর আগে হরিদাস কাকার কাছ থেকে টুঙ্গিপাড়া যাওয়ার পথঘাট কিভাবে যেতে হবে সবকিছু শুনে নিয়েছিলাম আমরা।

এমনিতে মাটিভাংগা পর্যন্ত আমরা নিজেরাই চিনি। সে পর্যস্ত কোনও সমস্যা নেই। মাটিভাংগা বাজারে এসে অম্বরেশ বাবু’র দোকানে জিজ্ঞেস করলাম- বাংলাবাজার যাব কোন পথে ? অম্বরেশ বাবু আমাদের পথ দেখিয়ে দিলেন। বাংলাবাজারের পথে দেখা হলো মহানন্দদা’র সাথে। বাংলাবাজারের ওপারে শৈলদাহ গ্রামে আমাদের মহানন্দদা’র মামা বাড়ি।

মহানন্দ দা তার মামীমাকে নিয়ে তখন ওইপথে ফিরছিলেন। আমাদের জিজ্ঞেস করলেন- কই যাও তোমারা ? আমারা বললাম- বাংলাবাজার। তাহলে জোড়ে চালাও, খেয়া এপার আছে, মহানন্দদা’ জবাব দিলেন। আমরা খেয়াঘাটে পৌঁছে অন্য কোনো যাত্রীর দেখা না পেয়ে নিজেরাই খেয়া চালিয়ে ওপারে রওনা হলাম। কিন্ত বলেশ্বরের এই জায়গাটা বানিয়ারীর যেখানে আমাদের বাড়ি ওখানকার চেয়ে অনেক বেশি খরস্রোতা।

তাই আমরা অনেক ভাটিতে ওপারে খেয়া থামাতে পারলাম। মাঝি যে ওপারেই ছিল, তা বুঝতে পারলাম ঘাটে ঠিকমতো খেয়া নিতে না পারার কারণে। ওপার থেকে সে আমাদের ভারী গালাগাল দিচ্ছিলেন আর ভারী তোর-জোর করছিলেন। তার সেই হুঙ্কার শুনে আমাদের কেল্লা তখন কেতাদুরস্থ। হিসাবে এক টাকা ভাড়া হয় (দু’জন চার আনা করে আট আনা আর সাইকেল চার আনা করে আট আনা)।

কিন্তু ওই ব্যাটা আমাদের থেকে দুই টাকা নিবেন। আর আমরা নিজেরা চালিয়ে এসেছি বলে আট আনা দিতে চাই। এই নিয়ে তখন মহা ক্যাচাল। শেষে পাশের কাঠের আড়ৎঘর থেকে এক বয়সি চাচা উঠে এসে আট আনায়-ই ব্যাপারটির রফা করে দিলেন। চাচার কাছ থেকে আমারা শৈলদাহ যাবার পথ চিনে নিলাম।

আর মনে মনে তাকে অসংখ্য ধন্যবাদ দিলাম। শৈলদাহ আসার পথে লক্ষ্য করলাম, প্রকাশের সাইকেলের পেছনের চাকায় হাওয়া কমে যাচ্ছে। পথে একজন বললো্- সামনে রাজনগর একটা গ্যারেজ আছে। রাজনগরের সেই গ্যারেজ পর্যন্ত গিয়ে আমরা সাইকেলে হাওয়া দিলাম। দরকার ছিল প্রকাশের সাইকেলের পেছনের চাকার।

কিন্ত আমার সাইকেলের সামনের চাকায়ও একটু হাওয়া দিলাম। তাই দেখে প্রকাশও ওর সাইকেলের সামনের চাকায় হাওয়া দিল। হাওয়া দেয়ার বিল হয় বারো আনা। কিন্তু গ্যারেজ অ’লা এক টাকার কম নিবে না বুঝতে পেরে আমার সাইকেলের পেছনের চাকায়ও হাওয়া দিলাম। সাইকেলে হাওয়া একটু বেশি দেয়ায় আর রাস্তা একটু খারাপ থাকায় দু’জনেই তখন ঝাঁকাঝাঁকিটা খুব টের পাচ্ছিলাম।

সাইকেলের ঝাঁকাঝাঁকি কমাতে আমরা চিংগইরের পথে একবার উভয় সাইকেল থেকে একটু একটু হাওয়া কমিয়ে নিলাম। তারপর সামনেই মধুমতি খেয়াঘাট। নদী এখানে বড়, তাই ভাড়াও ডাবল। জনপ্রতি আট আনা। আর সাইকেল প্রতি আট আনা।

মোট দুই টাকা। এখানে আমরা শুধু পরস্পর চোখাচোখি ছাড়া অন্য কোনও দুষ্টু বুদ্ধি খাটানোর সাহস পেলাম না। ওপারে নেমে কিছুদূর যাবার পরেই একটা বড়বাজার পেলাম। ওখানে রাস্তার পাশের টিউবওয়েল থেকে আমরা জল খেলাম। আর দোকান থেকে চারটা চকলেট কিনলাম।

দোকানদার আমাদের টুঙ্গিপাড়ার রাস্তা দেখিয়ে দিলেন। বড় রাস্তা থেকে ডানদিকে এগিয়ে ছোট রাস্তা ধরে যেতে হবে। দু’পাশে সবুজ পাট ক্ষেত। মাঝখানে সেই ছোট রাস্তা। রাস্তার সমান্তরাল খাল।

টুঙ্গিপাড়ার সেই রাস্তা পেয়ে আমরা আনন্দে একটু জোড়ে সাইকেল চালাতে লাগলাম। আর সেই সুযোগে একটু অসাবধানতার কারণে প্রকাশের সাইকেলের পিছনের চাকা লিক হল। এবার দু’জনেই সাইকেল ঠেলে ছেলে যাচ্ছি। আর একটু আগালে বাধাগ্রাম। দুইদিকে দুই রাস্তা।

আমরা কোনদিকে যাবো? কাউকে জিজ্ঞেস করতে হবে। আমরা ধারণা করেছিলাম, বড় রাস্তা ধরেই বঙ্গবন্ধুর বাড়ি। কিন্তু এক লোক আমাদের দেখিয়ে দিলেন ছোট রাস্তা। আমরা আবারো পরম্পর চোখোচোখি করলাম। লোকটি আমাদের সন্দেহ আন্দাজ করতে পেরে বললেন- সামনেই একটা রাইস মিল আছে।

ওখানে গ্যালিই শ্যাখের বাড়ি দ্যাখফানে। আমরা সাইকেল ঠেলে রাইস মিল পর্যন্ত গেলাম। বঙ্গবন্ধুর বাড়ি কোনটা জানতে চাইলাম। বয়স্ক এক চাচা বললেন- ওইতো। আমরা এখানে সাইকেল রাখতে পারি কিনা জানতে চাইলে, সে আবার বললেন- না কিচ্ছু হবে নানে, থুইয়া যাও না।

আমরা রাইসমিলের সামনে একটা কড়ই গাছের সাথে সাইকেল ঠেস দিয়ে রেখে বঙ্গবন্ধু’র বাড়ির দিকে হাঁটা ধরলাম। দু’বন্ধুর কারোরই বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে বিশেষ কিছু জানা ছিল না। ক্লাস টুয়ের বাংলা বইতে যতটুকু পড়েছিলাম, ওইটুকু সম্বল স্মরণ করে করে আমরা বাড়ির দরজায় গিয়ে দাঁড়ালাম। বাড়িতে ঢোকার মুখে একটা ছাদওয়ালা বৈঠকখানা। প্রথমে আমরা তাই মনে করেছিলাম।

ওখানে কিছুক্ষণ বসলাম। দেখি, সামনে দুটো কবর সুন্দর করে পাথরে বাঁধানো। স্মৃতিফলকে বঙ্গবন্ধুর মা-বাবার জন্ম ও মৃত্যু সন উল্লেখ করা। পরে বুঝলাম এটা আসলে গোরস্থান। আমাদের ওভাবে বসাটা মনে হয় উচিত হয়নি।

দেখলাম উঠানে মাঝবয়সি একজন লোক মুরগি তাড়া করে আমাদের দিকে আসছেন। আমরা তার কাছে জানতে চাইলাম, বঙ্গবন্ধুর কবর কোথায় ? লোকটি আমাদের কথা শুনে মুরগি তাড়ানো বন্ধ করে এক পলক আমাদের দেখলেন। তারপর বললেন- ওই তো, ওই যে বঙ্গবন্ধুর কবর। আমরা গুটি গুটি পায়ে বঙ্গবন্ধুর কবরের দিকে গেলাম। একদম কাছে গিয়ে দু’জনেই চুপচাপ অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকলাম।

লাল পুরনো ইটগুলো বেরিয়ে আছে। কবরের তেমন কোনও যত্ন নেই। পাশে একটা ডালিম গাছ। তার ছায়া কবরের ওপরে বাতাসের দোলায় শুধু নড়ছিল তখন। কবরের দক্ষিণ-পশ্চিম পাশে কিছু ফুলগাছ।

দু’চারটা ফুল তখনো ফুটে ছিল। আমরা কি করব বুঝতে পারছিলাম না। দু’জনে এদিক-ওদিক ভাল করে দেখে ওখান থেকে দু’টো ফুল ছিঁড়ে চুপচাপ কবরের ওপরে রেখে দিলাম। বঙ্গবন্ধু তা দেখলেন কি না আমরা জানি না। সেই লোকটি আমাদের কাছে ডাকলেন।

আমরা জানতে চাইলাম- বঙ্গবন্ধু কোন ঘরে ঘুমাতেন, কোথায় বসতেন, কোথায় খাবার খেতেন- এসব। লোকটি আমাদের ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দো’তলা বাড়িটার আগাগোড়া দেখালেন। আমরা এই প্রথম বঙ্গবন্ধুকে চিনতে শুরু করলাম। এরপর লোকটি আমাদের নিজেদেরকে ইচ্ছামতো ঘুরতে বলে পাশের খালে গোসলের জন্য চলে গেলেন। আর এক মহিলাকে ডেকে বললেন- ওরা যেন ভাত খেয়ে যায়, তার ব্যবস্থা করতে।

আমরা মহিলার চোখ ফাঁকি দিয়ে একবার দোতালায় উঠলাম। আবার পরক্ষণেই নামলাম। এরপর পা টিপে টিপে আবার বঙ্গবন্ধুর কবরের কাছে গেলাম। সেখানে মিনিট খানেক উঁকিঝুঁকি মেরে সোজা রাইসমিলের ওখানে। দেখলাম, সেই লোকটি গোসল সেরে বাড়ির ভেতরে ঢুকছেন।

সেই ফাঁকে আমরা দু’জনেই সাইকেলে চাপলাম। প্রকাশের সাইকেল আগে থেকেই লিক ছিল, আর জোরে চালানোতে তার আরও বারোটা বাজল। বড় রাস্তায় এসে দেখলাম- আমার সাইকেলটারও একই দশা। তারপর পাটগাতী বাজার পর্যন্ত ঠা ঠা রোদে সাইকেল ঠেলতে ঠেলতে বঙ্গবন্ধুর কথা আমরা সত্যিই কি ভুলে গেলাম? বঙ্গবন্ধুর সেই কবরের কথা তো আজও ভুলতে পারলাম না। বাঙালি জাতির জন্য তাঁর অবদানের কথা না হয় না-ই বললাম।

এভাবেই সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ ভাঙালি বঙ্গবন্ধুকে প্রথম দেখেছিলাম। তাই আগস্ট এলেই বারবার বঙ্গবন্ধু'র কথা মনে পড়ে। আর তখন প্রায়ই রবীন্দ্রনাথের ওই গানটি গেয়ে উঠি- 'নয়ন তোমারে পায় না দেখিতে, রয়েছ নয়নে নয়নে। ' লেখাটি প্রকাশিত হয়- সাপ্তাহিক বিচিত্রা, ৭ বর্ষ ৩৭ সংখ্যা ১২ আগস্ট ২০০৫, ২৮ শ্রাবণ ১৪১২

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.