আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

সমুদ্রে জীবন-১০

Real knowledge is the knowledge about "The Real", or at least, that which leads to "The Real" - rest is just conjecture!

ঝড়ের আর জাহাজ-ডুবির গল্প শোনানো হলো গত সংখ্যায়। এর আগের আরেকটি সংখ্যায় বলেছিলাম যে, কিভাবে ঝড়-তুফানের আগাম/আগমনী সংবাদ পেলে আমাদের বন্দর থেকে বের করে দেয়া হয়। সকল ইন্ডাস্ট্রীর মতই, এখানেও মানুষকে নাম্বার হিসাবেই দেখা হয়। একটা জাহাজ-কোম্পানীর মালিক পক্ষের কাছে, কোন একটা দুর্ঘটনায় তাদের "সম্পদ" নষ্ট হলো কি না - সেই প্রসঙ্গটাই আগে আসে। মানুষের ব্যাপারে আসলে, তাদের কোন compensation দিতে হবে কি না , না কি ইনস্যুরেন্সের ঘাড়ে সব চাপিয়ে দেয়া যাবে, এসব চিন্তা ভাবনাই প্রাধান্য পায়।

তাছাড়া কোম্পানীর বদনাম হবার ভয়টাও তাদের থাকে। আজকালকার ব্যয়বহুল কন্টেইনার জাহাজগুলোতে, জাহাজে কমর্রত লোকজনের উপর এত "চাপ" থাকে যে, অনেক সময় সে চাপের বশবর্তী হয়েই মানুষ অনেক ধরনের ভুল করে বসে! আমার কোম্পানীর জাহাজগুলোর Home Port ছিল সিঙ্গাপুর। কোন জাহাজের রুটে যদি সিঙ্গাপুর থাকে, তবে সিঙ্গাপুর আসাটা সেই জাহাজের মানুষদের জন্য এক প্রচন্ড ব্যস্ততার ব্যাপার হয়। বাঙ্কার (জ্বালানী - কখনো একাধিক গ্রেডের) নেয়া, খাবার নেয়া, বন্ড স্টোর (সিগারেট, পানীয়) ইত্যাদি নেয়া, কোন রিপেয়ার থাকলে তা করিয়ে নেয়া, লন্ড্রীর কাপড় দেয়া ও নেয়া, কোন সার্ভে থাকলে তা করানো, ইন্জিনের কোন ওভারহোলিং থাকলে তা করা, কোন যন্ত্রাংশ off-load করতে হলে তা off-load করা, স্পেয়ার পার্টস গ্রহণ করা, সাধারণ স্টোর (যেমন ধরুন সাবান, কাগজ, কলম, ফাইল, বাসন পত্র, বিছানার চাদর ইত্যাদি - কখনো ৩০০/৪০০ আইটেমের সাপ্লাইও নেয়া হয়) গ্রহণ করা, ক্রু রদ-বদল ইত্যাদি সব নিয়ে একটা হুলুস্থূল কমর্কান্ডের সৃষ্টি হয় - তার উপর স্বাভাবিক loading discharging-এর কাজ তো রয়েছেই। এসব কাজ করতে গিয়ে জাহাজের নিজস্ব Provision Crane - যা দিয়ে আমাদের খাবার বা স্টোর নেয়া হয় বা যন্ত্রাংশ ইত্যাদি off-load করা হয় - সেটার operation-এর সাথে পোর্টের Gantry Crane - যা দিয়ে কার্গো অর্থাৎ কন্টেইনার ওঠা নামা করা হয় - তার operation-এর কোন বিরোধ যাতে না দেখা দেয়, সে জন্য ন্যূনতম সময়ে যাতে আমাদের জিনিসপত্র ওঠা নামার কাজ শেষ করা যায়, সে ব্যাপারে একটা "চাপ" থাকে।

জাহাজ যখন সিঙ্গাপুর থেকে ৫/৬ ঘন্টা দূরে, তখনই জাহাজের অফিসার ও ক্রুরা যে সব জিনিস নামানোর কথা, সেগুলোকে জাহাজের নিজস্ব Provision Crane-এর নীচে এনে সাজিয়ে রাখতে শুরু করে। অনেক সময়ই ৫ থেকে ৮ টন ওজনের যন্ত্রাংশ, ইন্জিন রূম থেকে বের করে, আগেই ডেকের ওপর Provision Crane-এর নীচে এনে রাখতে হয়। এরকমই একটা প্রস্তুতির সময় আমাদের কোম্পানীর অপর একটি জাহাজে, একবার wire sling ছিড়ে গিয়ে ভারী একটা যন্ত্রাংশ একজন ইন্জিনিয়ারের বাহুর উপর এসে পড়ে এবং তার সেই হাত তাৎক্ষণিক শরীর থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। চাইনিজ ঐ ইন্জিনিয়ারকে সাথে সাথে হেলিকপ্টার যোগে সিঙ্গাপুর নিয়ে যাওয়া হয়, বরফের মাঝে সংরক্ষিত তার বিচ্ছিন্ন হাত সমেত। পরে শুনেছি মাইক্রো-সার্জারীসহ ব্যয়বহল চিকিৎসার মাধ্যমে তার হাতখানা আবার জুড়ে দেয়া হয়েছিল এবং ক্রমেই তা স্বাভাবিক হয়ে আসছিল।

ঘটনার তদন্তে, যথারীতি, জাহাজের নাবিকদের ওপরই দোষ চাপানো হয়েছিল - তারা কেন খেয়াল করেনি যে, Crane-দিয়ে উঠানোর সময় wire sling খানা স্কাইলাইটের (ইন্জিনরুমের ওপরের opening বা খোলা জায়গা) একটা লোহার পাতে ঘষা খেয়ে খেয়ে ক্ষয় হয়ে যাচ্ছিল - ইত্যাদি ইত্যাদি। কিন্তু এখানে অদৃশ্য একটা ফ্যাক্টর লোক চক্ষুর অন্তরালে থেকে যায় - তা হচ্ছে সব কিছু স্বল্প সময়ে করার একটা তাড়া। এই তাড়ার পেছনের চালিকা শক্তি হচ্ছে "প্রতিযোগিতা" - আর এই প্রতিযোগিতার মাধ্যমেই গুটিকতক বড় বড় জাহাজ কোম্পানী আন্ত-মহাসাগর আন্তর্জাতিক কন্টেইনার পরিবহনের ব্যবসায় থেকে ছোট ছোট কোম্পানী তথা উন্নয়নশীল দেশগুলোকে একদম ঝেঁটিয়ে বিদায় করেছে। আজকে কল্পনাই করা যায় না যে, বাংলাদেশের মত একটা দেশ সুদূর ভবিষ্যতেও এমন একটা জাহাজ কিনবে বা চালাবে যার দৈনিক fuel consumption হবে ১৮৫ টন আর যার ধারন ক্ষমতা হবে সাড়ে ৫ হাজার কন্টেইনার। আজ থেকে ২৫/৩০ বছর আগে, যখন এসব বড় কন্টেইনার জাহাজগুলো ছিল না - জেনারেল কার্গো জাহাজের ঐ যুগে একটা উন্নত দেশ আর একটা অনুন্নত দেশের ভিতর বৈষম্যটা মোটেই এরকম ছিল না।

কারো হয়তো ১০০ টা ছিল, আর কারো হয়তো ১০টা জাহাজ ছিল - কিন্তু ১০০ জাহাজওয়ালা কোম্পানীর কোন জাহাজ যে কাজ করতে পারতো, ১০ জাহাজ ওয়ালা কোম্পানীর একটা জাহাজও মোটামুটি সেই কাজই করতে পারতো! কিন্তু বিশাল ও সাংঘাতিকরকম ব্যয়বহুল ও দ্রতগামী এসব জাহাজ বানিয়ে, ধনী দেশ বা কোম্পানীগুলো একসাথে অনেক কন্টেইনার বহন করে মালামাল বহনের খরচ ও সময়কাল এত কমিয়ে দিয়েছে যে, অন্য কোন ধরনের জাহাজে করে মালামাল বহন করে কেউ তাদের দেয়া সার্ভিসের ধারে কাছেও যেতে পারবে না। আপনি জিজ্ঞেস করতে পারেন যে, অন্যরা কেন তাহলে একই ধরনের জাহাজ বানাচ্ছে না - এর সরল উত্তর হচ্ছে: "অন্যদের সে রকম পয়সা নেই"। এখানে ব্যবসাটা manipulate করে "বড়দের" একধরনের monopoly সৃষ্টি করা হয়েছে - যা "ছোটদের" ধরা ছোঁয়ার বাইরে! আমি মাঝে মাঝে ভাবতাম, একটা যন্ত্রাংশ (অর্থাৎ, একটা কার্গো) ১০ দিনের জায়গায় ২০ দিনে জাপান থেকে যুক্তরাষ্ট্র গেলে কি এমন আসে যায়? কিছুই না বোধ করি। তাতে আমার ঐ জাহাজটিতেই এমন একটা ইন্জিন বসানো যেতো, যা হয়তো দিনে মাত্র ২০ টন জ্বালানী পোড়াতো। তাতে আমাদের অনাগত বংশধরদের জন্য একদিকে যেমন অনেক জ্বালানী বেঁচে যেতো - তেমনি কার্বন-ডাই-অক্সাইড, কার্বন-মনোক্সাইড, সালফার-ডাই-অক্সাইড, সালফার-ট্রাই-অক্সাইড, নাইট্রজেন-অক্সাইডস সহ যাবতীয় ক্ষতিকর গ্যাসের emission দারুন রকমের হ্রাস পেতো।

১৮৫ টন জ্বালানী ব্যবহার করা ইন্জিনটাকে একটা যন্ত্র-দানবের মত কল্পনা করা যায়, যা তার বিশাল ফুসফুস ভর্তি করে মিনিটে ৮৫ বার (যদি তা 85 rpm-এর একটা ইন্জিন হয়ে থাকে) বায়ূমন্ডল থেকে অক্সিজেন সমৃদ্ধ নিমর্ল বায়ূ টেনে নিচ্ছে, আর তার পর মুহূর্তে বায়ূমন্ডলে ত্যাগ করছে কার্বন, সালফার ও নাইট্রোজেনের বিষাক্ত সব অক্সাইড সমৃদ্ধ exhaust গ্যাস। এসব কিছুর পেছনে কাজ করে "কাফির-worldview" - যা কেবল, যে কোন মূল্যে নিজের লাভ ও প্রাপ্তিটুকু বুঝে পেতে চায় - অপরের, এমনকি নিজের বংশধরদের কথা ভাবারও অবকাশ নেই যাদের। যারা আখেরাতে বিশ্বাস করে না। Instant gratification-এ বিশ্বাস করে যারা। "নগদ যা পাও, হাত পেতে নাও বাকীর খাতায় শূন্য থাক" - এটা যাদের জীবনের ব্রত।

সবাইকে বাজার থেকে তাড়িয়ে দিতে যারা পৃথিবীর সম্পদ অপচয়ের এই মহোৎসবে মেতে ওঠে - তারা essentially অবিশ্বাসী, বস্তুবাদী কাফির দর্শনে বিশ্বাসী পূঁজিবাদী শক্তি। তারা যখন পরিবেশ নিয়ে মায়াকান্না কাঁদে, তখন সেটা পরিহাসই মনে হয় - তৃতীয় বিশ্বের অসহায় বাংলাদেশ আর মালদ্বীব, যারা বায়ূ-মন্ডলের উষ্ণতার জন্য একদিন ডুবে যাবে - তাদের প্রতি উপহাস। অথচ "ইসলামী-worldview" মতে নদী থেকেও আমরা শুধু সেটুকু পানিই খরচ করবো, যা আমাদের প্রয়োজন, যদিও আমাদের মনে হতে পারে যে, নদীর পানি তো হিসাব নিকাশের বাইরে! "সমুদ্রে জীবন-৯"-তে আমি একটা জাহাজের ছবি দিয়ে বলেছিলাম যে, আমার জীবনের প্রথম বড় কন্টেইনার জাহাজটা দেখতে এরকম ছিল। আসলে ওটা ছিল আমার জীবনের প্রথম বড় কন্টেইনার জাহাজের sister ship - কিন্তু খোদ "আমার জীবনের প্রথম বড় কন্টেইনার জাহাজ" নয়! আমাদের কোম্পানী একসাথে ঐ ধরনের ৪ টি জাহাজ বানিয়েছিল - যেগুলো সবদিক দিয়ে একেবারে identical। আজকের ছবিটা সত্যি সত্যি "আমার জীবনের প্রথম বড় কন্টেইনার জাহাজের"।

জাহাজটার দৈর্ঘ ছিল:294M, প্রস্থ:32.3M। জাহাজটি 4388টি কন্টেইনার বহন ক্ষমতাসম্পন্ন। এর ইন্জিনের ক্ষমতা ছিল 58700 BHP (ব্রেক হর্স পাওয়ার)। আর টনে যার বহনক্ষমতা ছিল 66511 Ton।


অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।