আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

সমুদ্রে জীবন - ৮

Real knowledge is the knowledge about "The Real", or at least, that which leads to "The Real" - rest is just conjecture!

কেবল আমি নই, যে কোন জাহাজীকেই যে কয়টি recurrent প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয়, তার একটি হচ্ছে:"তুমি/আপনি কখনো সমুদ্রে ঝড়ে পড়েছো/পড়েছেন? সে সময় তোমরা/আপনরা কি করেন?" গল্পে, সাহিত্যে ঝড়ে পড়া পাখিদের বা পথ হারানো সাঁঝের পাখিদের নিয়ে, সহানুভুতি দেখিয়ে, অনেক কথা লেখা হয়। জাহাজীদের জন্য বাস্তবতাটা একদম উল্টো! যে সব অঞ্চলে হঠাৎ করেই একটা নিম্নচাপ সৃষ্টি হয়ে ঝড় হবার সম্ভাবনা দেখা দেয় - সে সব অঞ্চলের বন্দরে, একটু পুরানো নাবিক মাত্রই হয়তো এই পরিস্থিতিটার অভিজ্ঞতা লাভ করে থাকবেন যে, সব কিছুই নিয়মিত বা স্বাভাবিকভাবেই চলছিল - হঠাৎ দেখলেন সাজ সাজ রব। কি ব্যাপার? জাহাজকে যথাশীঘ্র সম্ভব বন্দর ছেড়ে বাইরে চলে যেতে হবে! বাইরে মানে এমন কি Anchorage-এও নয় - একেবারে সমুদ্রে ! বরং Anchorage-এ যে সব জাহাজ অপেক্ষমান ছিল (বিশেষত inner-anchorage যদি হয়), তাদেরও বলবে বাইরে বা দূরে চলে যেতে। আমার জীবনে এমন ঘটনা বেশ কয়েকবার ঘটেছে। পূর্ব-এশিয়ায় জাপান, কোরিয়া, চীন ও তাইওয়ানের বন্দর সমূহে, "টাইফুন" মৌসুমে, যে কারো এমন অবস্থায় পড়তে হতে পারে।

আমার বেশ মনে আছে আমি একটা জেনারেল কার্গো জাহাজে সেবার জাপানের Yokohama-য় ছিলাম - আমরা New Zealand-এর (Auckland, Wellington) জন্য বড় বড় কাঠের বাক্সে CKD (Cars Knocked Down) লোড করছিলাম। বন্দরটি Tokyo সংলগ্ন বলে, সবাই সুযোগ পেলেই Tokyo-তে বেড়াতে যায়। আমিও গিয়েছিলাম। জাহাজে ফিরে দেখি সাজ সাজ রব - তাড়াহুড়া করে কোনমতে লোডিং শেষ করে আমাদের বাইরে বের করে দিচ্ছে। কারণ? বার্থে থাকলে ঝড়ের সময় বাতাসের প্রভাবে জাহাজের মুরিং-এর দড়ি ছিড়ে, জাহাজ জেটিতে bang করতে করতে জাহাজের তথা জেটির মারাত্মক ক্ষতি হতে পারে - সেই ক্ষতি এড়ানোর জন্য এই ব্যবস্থা ।

ঝড়ে inner বা outer-anchorage-এ থাকা জাহাজগুলোরও anchor বা নোঙ্গর drag করে একটার সঙ্গে আরেকটা ধাক্কা লেগে ক্ষতি হতে পারে - তাছাড়া এসব থেকে উদ্ভূত পরিস্থিততে চ্যানেল বন্ধ হয়ে জাহাজ চলাচলে অচলাবস্থা দেখা দিতে পারে। সেজন্য সেখানকার জাহাজগুলোকেও সমুদ্রের গভীরে চলে যেতে বলা হয়। এরকম অবস্থায় ঝড়ের তীব্রতার সংকেতের উপর নির্ভর করে, জাহাজগুলো দূরে সরে যায় - এবং প্রয়োজনবোধে ইন্জিন চালু রেখে বাতাসকে face করার চেষ্টা করা হয় - যাতে ঝড়ের প্রভাবটা কম হয়। ঝড় বা দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ায়, জাহাজের Main Engine অকেজো হয়ে যাওয়া - জাহাজ-ডুবি বা জাহাজ চরে (reef-এ) আটকে "মৃত ইতিহাস" হয়ে যাবার একটা অন্যতম প্রধান কারণ। আমার মনে আছে, আমি একবার জাহাজে করে জর্ডানের Aqaba-য় গিয়েছিলাম Rock Phosphate লোড করতে।

Aqaba Bay-তে ঢোকার মুখে দুপাশে দু'টো জাহাজ দেখেছিলাম - যে গুলো reef বা চড়ায় উঠে "ইতিহাস" হয়ে গেছে। তার মূল কারণ হচ্ছে এই যে, একটা critical moment-এ ওগুলোর Main Engine fail করেছিল। জীবনে অনেক সময়ই দেখা যায় যে, একটা জিনিস আপনার সবচেয়ে বেশী যখন প্রয়োজন, তখনই তা আপনাকে ছেড়ে যায়! তবে এর উল্টোটাও হয় - আমার জাহাজী জীবনেই হয়েছে। সেই গল্প না হয় পরে কখনো বলা যাবে ইনশা'আল্লাহ্। যাহোক, এর আগে একটা পর্বে, আপনাদের একটা কন্টেইনার জাহেজের কথা বলেছিলাম যা কিনা ঝড়ে মারাত্মক ক্ষয়ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছিল।

ঐ জাহাজটি প্রশান্ত মহাসাগরে ৪০৬ টি কন্টেইনার হারিয়েছিল, আরো ১০০০ টি কন্টেইনার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল আর অর্থের নিরিখে ক্ষতি হয়েছিল ১০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের। । আজ ঐ জাহাজটা সম্বন্ধে কিছু বলার চেষ্টা করবো ইনশা'আল্লাহ্! ঐ জাহাজটি Kaohsiung (Taiwan) থেকে Seattle (US) যাচ্ছিল - তখন পথে, উত্তর প্রশান্ত মহাসাগরে, ক্যালিফোর্নিয়া উপকূল থেকে ২৭০০ মাইল পশ্চিমে, সে টাইফুনের কবলে পড়ে। ভীষণ উত্তাল সমুদ্রে তখন ঢেউয়ের উচ্চতা ছিল ৭৫ ফিট। দুর্ভগ্যজনকভাবে, ঐ দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ায় এক সময় কোন কারণবশত জাহাজটিতে black-out হয়, ফলে Main Engine ও Steering Gear সহ সকল যন্ত্রপাতি অকেজো হয়ে পড়ে।

অত্যাধুনিক সব ব্যবস্থা থাকা সত্ত্বেও, ইমার্জেন্সি জেনারেটর ঐ সময় চালু হয়নি। ঝড়ো হাওয়া আর বিশাল ঢেউ তখন জাহাজটিকে নিয়ে "রাগবি" খেলতে শুরু করে। প্রকৃতির সর্বগ্রাসী শক্তির কাছে মানুষের দম্ভ ও অহংকারের "শিল্প" তখন ভাসমান "ম্যচ-বক্সের" মত insignificant । ১৯৬০ সালে কন্টেইনার ট্রেড শুরু হবার পর, এটাই ছিল সর্ব-বৃহৎ ক্ষয়-ক্ষতি! জাহাজটি তার সিডিউলের ২ দিন পর Seattle (US) পৌঁছে। শীতের সময়টায় উত্তর প্রশান্ত মহাসাগরে একের পর এক লঘুচাপ সৃষ্টি হতে থাকে।

বড় কন্টেইনার জাহাজগুলো তাদের শক্তিশালী ইন্জিন, দ্রতগতি আর অত্যাধুনিক নেভিগেশন তথা আবহাওয়া পযর্বেক্ষণ যন্ত্রপাতি ব্যবহার করে, প্রায়ই খারাপ আবহওয়াকে পাশ কাটিয়ে যেতে সক্ষম হয়। কিন্তু, ভাগ্য বিরূপ হলে, কখনো টের পাবার খুব অল্প সময়ের ভিতরই, কোন জাহাজ নিজেকে "eye of the cyclone"-এ আবিষ্কার করে - তখন আর করার কিছুই থাকে না! [ক্ষতিগ্রস্ত জাহাজটির সাইড থেকে তোলা ছবি] [ক্ষতিগ্রস্ত জাহাজটির পেছন থেকে তোলা ছবি]

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।