আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

সমুদ্রে জীবন - ১৪

Real knowledge is the knowledge about "The Real", or at least, that which leads to "The Real" - rest is just conjecture! তেরোটি পর্ব লেখার পর আমি সঙ্গত কিছু কারণে সিরিজটা বন্ধ করে দিয়েছিলাম - যার একটি ছিল আমার ব্লগিং-এর উদ্দেশ্য থেকে বিচ্যুতি। অনেকেই সিরিজটার কথা এখন হয়তো ভুলে গিয়ে থাকবেন, আর তাই সেটাকে ঘিরে যে "বিনোদনের" পরিবেশ গড়ে উঠেছিল তার রেশও এখন হয়তো কেটে গিয়ে থাকবে, ইনশা'আল্লাহ্! তাই আমার ব্লগিং-এর উদ্দেশ্যের সাথে সঙ্গতি রেখে আবার সিরিজটা শুরু করার চিন্তা করলাম। ভেবেছিলাম ইউরোপের কথা এখন আর বলবো না! তবু অন্য একটা প্রসঙ্গে মনে হলো আরেকটু বলে নিই - পরে না হয় ধারাবাহিকতায় ফিরে যাওয়া যাবে - যদিও এখন যে কেবলই ইউরোপের কথা আসবে তা নয়। ৯/১১ পর থেকে সারা বিশ্বে মুসলিমদের অবস্থা ও অবস্থানে ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে। যারা একটা মুসলিম দেশে স্থায়ীভাবে বসবাস করেন, তাদের জীবনেও যে নানাবিধ পরিবর্তন এসেছে তা বলাই বাহুল্য।

কিন্তু মুসলিম নাবিক - বিশেষত যারা পৃথিবী ঘুরে বেড়ান, তাদের না বুঝে উপায় ছিল না যে, পৃথিবীতে যুগান্তকারী একটা প্রলয়কান্ড ঘটে গেছে! ইসলাম নিয়ে যেহেতু লেখা-পড়া করি, বা দুই একছত্র লিখতেও চেষ্টা করি, তখন স্বাভাবিকভাবেই পৃথিবীতে ইসলামের স্কলার যারা রয়েছেন - তাদের মাঝ থেকে একটা সমষ্টির কথা, আমার কাছে, অন্যদের কথার চেয়ে, অধিকতর গ্রহণযোগ্য মনে হয়। এদের প্রায় সকলেই মনে করেন যে, সন্ত্রাস বা ভয়-ভীতির মাধ্যমে ইসলামের প্রচার-প্রসার হবার নয় - যদিও পৃথিবীর বর্তমান পরিস্থিতে মুসলিমদের ক্ষয়িষ্ণু অবস্থা, অর্থনৈতিক-রাজৈনতিক-সামরিক দুর্বলতা ইত্যাদি দেখে নৈরাশ্যে ভোগা আবেগী মনের অধিকারী তরুণ কারো মনে হতেই পারে যে, সহজে হৃত গৌরব পুনরুদ্ধারের জন্য সন্ত্রাস বা বল প্রয়োগ একটা উপায়। কিন্তু দু'টি ব্যাপার খেয়াল করলেই আমরা বুঝবো যে এই ধারণাটা কত বড় ভুল: (১) ইসলাম বর্তমান দুঃসময়ের চেয়ে অনেক খারাপ প্রতিকূল অবস্থা survive করে এপর্যন্ত এসেছে। (২) খারেজীদের দিয়ে শুরু করে "আসাসিন" বা আধুনিক যুগের মিশরের "তাকফির ওয়া হিজরাহ্" - এই ধরনের চরমপন্থী গোষ্ঠিদের কেউ তাদের প্রচেষ্টায় যেমন সফল হন নি, তেমনি তারা কেবল মুসলিম উম্মাহর ক্ষতিই করেছেন - কোন লাভ করতে পারেন নি! যাহোক, সন্ত্রাসবাদের বিশ্লেষণ আমার এই লেখার উদ্দেশ্য নয়। আমরা বড় কন্টেইনার জাহাজগুলোতে যখন ইউরোপে যেতাম, তখন ইউরোপ coasting-এর দিনগুলোতে একজন পাইলট (North Sea Pilot) সার্বক্ষণিকভাবে আমাদের সাথে থাকতেন -এই তথ্য আপনাদের আগের কোন একটা পর্বে জানিয়েছি।

তিনি প্রায় সপ্তাহখানেক আমাদের সাথে থাকতেন বলে, আমাদের সাথে বেশ সখ্যতা গড়ে উঠতো। পাইলটরা সিনিয়র অফিসারদের টেবিলে আমাদের সাথে খেতে বসতেন বলে নানা বিষয়ে আলাপ আলোচনা হতো। ২/১ জনের সাথে বার বার ঘুরে ফিরে দেখা হওয়াতে সম্পর্কটা অনেকটা ব্যক্তিগত বন্ধুত্বের পর্যায়ে উন্নীত হয়। যাহোক্, North Sea Pilot ছাড়াও আরেক ধরনের অতিথি, মাঝে মধ্যে প্যাসেঞ্জার হিসেবে আমাদের সাথে coasting-এর দিনগুলোতে থাকতেন - তারা হচ্ছেন Trainee "Management Executive"। আমাদের কোম্পানীর অফিস যেহেতু সারা দুনিয়ার উল্লেখযোগ্য বন্দরগুলোতেই বলতে গেলে ছড়িয়ে ছিল, সেহেতু, কোন অফিস যে দেশে অবস্থিত - সেই দেশের মানুষ দিয়ে অফিস সাজাতে চায় তারা।

অফিসে বসে তারা আসলে কি নিয়ে কাজ করছে - সেটা বোঝাতে নতুন রিক্রুট করা শিক্ষানবিশ "Management Executive"-দের জাহাজে পাঠায় সরজমিনে জাহাজের "অপারেশন" দেখার জন্য। এরকমই একবার হল্যান্ডের Rotterdam সংলগ্ন ইউরোপোর্ট থেকে ২ জন Trainee "Management Executive" আমাদের জাহাজে উঠলো - আমাদের সাথে coasting সময়টা জাহজে থাকবে বলে - একটা ডাচ্ মেয়ে এবং একটা বৃটিশ ছেলে। দুজনের বয়সই ২৫/২৬ মত হবে। মেয়েটির নাম Lisalot আর ছেলেটির নাম যতদূর মনে পড়ে Edward বা ঐ ধরনের কিছু ছিল! প্রথমদিন থেকেই এক টেবিলে খেতে বসার সুবাদে অনেক গাল-গপ্প হতো খাবার সময় - এছাড়া জাহাজের "অপারেশন" নিয়ে তো অফিসিয়াল কথা-বার্তা হতোই। মেয়েটি ছেলেটির তুলনায় অনেক বেশী আলাপী ছিল।

জাহজে জয়েন করার অল্পক্ষণের মাঝেই তার জানা হয়ে যায় যে, আমিই ঐ জাহাজে একমাত্র মুসলিম এবং বাংলাদেশী - যদিও আমার ঐ জাহাজটিও আক্ষরিক অর্থেই বহুজাতিক। বিকালে আমাদের অতিথিরা smoke room-এ (সাধারণের জন্য TV ইত্যাদি যেখানে থাকে) বসে অন্যদের সাথে আড্ডা দিত। একদিন শুনলাম তাদের দু'জনের ভিতর বচসা হচ্ছে - কাদের কয়টা উপনিবেশ ছিল তা নিয়ে। স্বভাবতই বৃটিশ হিসেবে ছেলেটা গর্ব করে বলছিল যে তারাই এব্যাপারে অগ্রগামী ছিল। আমি বেশ অবাক হলাম - কারণ মেয়েটা বেশ ফলাও করে নিজেকে বর্ণ-বৈষম্য বিবর্জিত মানবতাবাদী বলে প্রকাশ করতো - এবং বেশ আঁতেল আঁতেল একটা ভাব নিয়েই।

একিদন আমরা জাহাজের বেশ কয়েকজন অফিসার UK-র Felixstoweতে বেঁধে রাখা আমাদের জাহাজ থেকে ২ টা টেক্সি রিজার্ভ করে Ipswich-এ গেলাম শপিং করতে - ওরাও আমাদের সাথে গেল। পথে মেয়েটা নানা প্রসঙ্গে কথা বলছিল, যার এক পর্যায়ে ইহুদীদের কথা আসলো। আমি কথা প্রসঙ্গে বললাম যে, ধর্মীয় আচার-আচরণের নিরিখে ওরা আমাদের খুব কাছাকাছি। মেয়েটা হঠাৎ থমকে গিয়ে কিছুক্ষণ চুপ করে রইলো - তারপর আমাকে প্রশ্ন করলো "আমাদের" বলতে আমি কি বোঝাচ্ছি? "ইসলামী জনগণ(Islamic People)?" আমি বললাম: "হ্যাঁ!" তখনি বুঝলাম এতদিন/এতক্ষণ সে আমাকে কেবলই একজন মুসলিম মনে করেছিল, এখন বুঝেছে যে, আমি Islamic People-দের একজন। এর পর থেকে সে হঠাৎই আমাকে বেশ সমীহ ও খেয়াল করে দেখতে শুরু করলো - আমার দাড়ি, হালাল বাছাবাছি, পোর্ট সংলগ্ন নাবিকদের ক্লাবে গিয়ে পান না করা বা ধূমপান না করা - সবই যেন তার কাছে jigsaw puzzle-এর মতো হঠাৎই মিলে গেল।

আমি ভাবছিলাম কি বদনসীব আমাদের যে, একজন বিধর্মী, ইসলামবিহীন মুসলিম দেখতে দেখতে ভাবতে শুরু করেছে যে, মুসলিম আর Islamic People দু'টো আলাদা জাত!!তাদের ধারণা হয়েছে যে, যারা মুসলিম, তারা তাদেরই মত - তাদের সবই চলে, তাদের নিয়ে কোন সমস্যা নেই। সমস্যাটা হচ্ছে যারা "ইসলামী" তাদের নিয়ে! আরো পরে বুঝেছি যে, সঠিকভাবে ইসলাম মেনে চলার চেষ্টা করা যে কাউকে তারা Islamic People মনে করে এবং তাদের "ভয়ঙ্কর" কোন প্রজাতি বলে জ্ঞান করে থাকে। Thanks to CNN, BBC, CBS, NBC ইত্যাদি আর হ্যাঁ আমাদের প্রথম আলো ও ডেইলি স্টারের কৃতিত্বও কম না! [উপরের ছবিটি - যে জাহাজের গল্প এতক্ষণ বললাম, সেটার। এই জাহাজে ঐ পোর্টে (জার্মানীর Bremerhaven) জীবনে বহুবার গিয়েছি আমি। ]  ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।