আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

সংবাদপত্রের আদিকাল থেকে আজকের ‘সমকাল’--হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ

জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান, সাবেক ফল রাষ্ট্রপতি পল্লীবন্ধু হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ ও জাতীয় পার্টি

সংবাদপত্রের আদিকাল থেকে আজকের ‘সমকাল’ --হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ ‘অ্যাকটা ডায়ারনা’ থেকে শুরু করতে চাই না। সেটা হবে দীর্ঘ ইতিহাস। ‘দিকদর্শন’ কিংবা ‘সমাচার দর্পণ’ থেকে ‘সমকাল’। মাঝখানে বাংলা ভাষাভাষী অঞ্চলের নদীসমূহে গড়িয়ে গেছে অনেক পানি। গুটেনবার্গের- (১৩৯৭-১৪৬৮ খ্রিঃ) আবিষ্কৃত মুদ্রণ যন্ত্র থেকে সিসার টাইপ কিংবা কাঠের ওপর খোদাই করা হরফে ছাপা হওয়া সংবাদপত্র দীর্ঘ পথ সাঁতার দিয়ে আজ বিশ্বের বিস্ময় কম্পিউটার জগতে প্রবেশ করেছে।

সংবাদপত্রের আদি বা মধ্যযুগে যা কখনো স্বপ্নেও ভাবা যায়নি অথবা কল্পনায়ও স্থান পাওয়া যা অসম্ভব ছিলো- পত্র পত্রিকা জগতে আজ সেই যুগ এসেছে। জানি না এখান থেকে সংবাদপত্র আর কতদূর অগ্রসর হবে। হয়তো এমনও দিন আসবে যখন সংবাদপত্র ইন্টারনেট বা ওয়েবসাইট মাড়িয়ে হাতের মুঠোর মধ্যে রাখা মোবাইল সেটের পর্দায় দেখা যাবে। এখনো যে তা পাওয়া যায় না তা নয়- তাজা খবর মোবাইল টেলিফোন সেটের মাধ্যমে শোনা যায়। অনাগত ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য সংবাদপত্র আরো আধুনিক থেকে অত্যাধুনিক যুগে প্রবেশ করুক সেই আশায় থেকে আজ এখানে বর্তমানকে নিয়ে কিছু কথা বলি আর অতীতকে নিয়ে খানিকটা স্মৃতিচারণ করি।

আমার এই কথাগুলো যখন একটি আধুনিক ছাপার মেশিনে সাদা কাগজের উপর ছাপা হয়ে আসবে তখন সেই ছাপানো কাগজটি হবে বাংলাদেশের সংবাদপত্রের পরিবারে নতুন অতিথি। তাকে সদ্য প্রসূত শিশুর সাথে তুলনা করতে যাবো না। কারণ এই অতিথি হবে সম্পূর্ণ পূর্ণতাপ্রাপ্ত টগবগে যৌবনের সংবাদপত্র। সে জন্মেই ট্রাক এন্ড ফিল্ডে নামবে দ্রুততম হবার প্রতিযোগিতায়। অন্তত পূর্বায়োজন থেকেই তা আমার কাছে মনে হয়েছে।

এই পত্রিকার সম্পাদক গোলাম সারওয়ার- যিনি স্বনামেই ধন্য। কোনো নির্দিষ্ট ভাষায় প্রশংসা করে তাঁকে খাটো করতে চাই না। তিনি সংবাদপত্র শিল্পকে কতদূর এগিয়ে নিতে পারেন- তা আমরা ইতিপূর্বে দেখেছি। এই শিল্পে তার নতুন সংযোজন দৈনিক সমকাল প্রতিষ্ঠার প্রস্তুতিপর্বে তিনি আমাকে একটি চিঠি লিখেছেন। অপূর্ব ছন্দের বাণীতে গাঁথা সেই চিঠি।

সম্পাদক সাহেব আমার মতো একজন অনিয়মিত এবং নিছক শখের লেখকের কাছে তাঁর পত্রিকার উদ্বোধনী সংখ্যায় একটি লেখা চাইবেন- এটা ছিলো আমার জন্য অনেক সম্মানের, অনেক গৌরবের। সাধারণ একজন রাজনীতিবিদ কিংবা সাবেক রাষ্ট্রপতি হিসেবে আমার কাছে মাঝে মধ্যে কোনো পত্রিকার উদ্বোধনী সংখ্যা বা বর্ষপূর্তি সংখ্যার জন্য শুভেচ্ছা বাণী চাওয়া হয়ে থাকে। আমি সে ক্ষেত্রে অভিনন্দন জানিয়ে সাফল্য-সমৃদ্ধি কামনা করি। এখানে ঠিক তা নয়। সমকালের জন্য একটি লেখা চাওয়া হয়েছে।

ফলে এই দৈনিকটির কাছে অনেক প্রত্যাশার কথা বলার সুযোগ হলো। সমকালের যাত্রায় আমার অংশীদারিত্ব থাকলো- সমকালের সাথে একাত্ম হবার সুযোগ হলো। কিন্তু কী লেখা যায়? তাই ফিরে তাকাতে চাই সংবাদপত্রের অতীতের দিকে। কী প্রত্যাশা করা যায় সমকালের কাছে? সে জন্য দেখতে চাই সংবাদপত্র প্রকাশের প্রয়োজনীয়তা কেনো হয়েছিলো। সংবাদপত্রের সেই আদি ইতিহাসের পাতাগুলো যদি উল্টিয়ে দেখতে যাই তাহলে দেখতে পাবো অভ্যুদয়ের সূচনাকাল থেকেই সংবাদপত্র সমাজ ও রাষ্ট্রের উন্নয়নে ইতিবাচক ভূমিকা পালন করেছে।

বিশ্বের প্রথম সংবাদপত্রের নামই ‘অ্যাকটা ডায়ারনা। ’ সেখান থেকে শুরু করে আমি স্বল্প পরিসরে অগ্রসর হতে পারবো না। প্রসঙ্গক্রমে সংক্ষেপে কিছু কথা বলি। ‘অ্যাকটা ডায়ারনা’ যখন প্রকাশিত হয় তখন ছাপা মেশিনের উদ্ভব হয়নি। যীশুখৃষ্টের জন্মের আগেই সংবাদপত্র প্রকাশিত হয়েছে।

রোম নগরী সংবাদপত্রের প্রথম জন্মস্থান। বিশ্বখ্যাত রোমান রাষ্ট্রনায়ক জুলিয়াস সিজারই হলেন সংবাদপত্রের জনক। তিনি খ্রিস্টপূর্ব ১০২ অব্দে জন্ম গ্রহণ করেন এবং খ্রিস্টপূর্ব ৪৪ অব্দে ঘাতকের ছুরিকাঘাতে মারা যান। মৃত্যুর ৫ বছর পূর্বে তিনি ‘অ্যাকটা ডায়ারনা’ প্রকাশ শুরু করেন। এই নামটির বাংলা অর্থ দাঁড়ায় ‘ঘটনা-বিবরণী’।

প্রতিদিন হাতে লিখে এই দৈনিক কাগজটি প্রকাশ করা হতো। এই খবরের কাগজটি প্রতিদিন রোম নগরীর গুরুত্বপূর্ণ স্থানসমূহের প্রাচীর বা স্তম্ভগাত্রে ঝুলিয়ে রাখা হতো। অসাধারণ প্রতিভাধর রাষ্ট্রনায়ক জুলিয়াস সিজার হয়তো অবাধ তথ্যপ্রবাহের নীতিতে বিশ্বাস করতেন। তা না হলে সেই যুগে তিনি তথ্যাবলী জনসম্মূখে উপস্থাপনের ব্যবস্থা গ্রহণ করতে যাবেন কেনো। তার প্রকাশিত সংবাদপত্রে সামরিক, রাজনৈতিক এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগ সংক্রান্ত তথ্যাদির পাশাপাশি সিনেট বিতর্কের বিবরণ, সিনেটে প্রণীত আইনসমূহের ভাষ্য এবং জনকল্যাণমূলক ব্যবস্থাদির খবর অ্যাকটা ডায়ারনায় প্রকাশিত হতো।

সিজারের শাসনামলে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে নির্বাচিত রোমান সিনেট তথা এক কবিশিষ্ট পার্লামেন্ট ছিলো রাষ্ট্রের জন্য গুরুত্বপূর্ণ আইন প্রণয়ন এবং প্রশাসনের সর্বোচ্চ কর্তৃপ। সিনেটর সংখ্যাগরিষ্ঠের ভোটেই নির্বাচিত হতেন প্রশাসক, ম্যাজিস্ট্রেট এবং সেনাপতিমণ্ডলী। দুঃখজনক ঘটনা যে, সেই যুগে সিজার এতোটাই গণতান্ত্রিকমনা হওয়া সত্ত্বেও সিনেট কক্ষেই ছুরিকাঘাতে প্রাণ হারিয়েছেন। সিজার রেখে গেছেন অনেক ইতিহাস। তার মধ্যে অন্যতম শ্রেষ্ঠ কৃতিত্ব তথ্য প্রচারের জন্য সংবাদপত্র প্রকাশ।

সমাজ ও রাষ্ট্রের উন্নয়নে জনগণের ব্যাপক অংশীদারিত্বকে নিশ্চিত করতে হলে রাষ্ট্রীয় কর্মকাণ্ড সম্পর্কে তাদের সবকিছু জানানোর প্রয়োজন রয়েছে। এই বাস্তব সত্যটি জুলিয়াস সিজার অনুধাবন করেই তিনি সংবাদপত্র প্রকাশ করেছিলেন। আজ একবিংশ শতাব্দীর সূচনালগ্নে দাঁড়িয়ে সিজারের ধ্যান-ধারণার কথা চিন্তা করলে স্বাভাবিক কারণেই বিস্ময়বোধ করবো। সংবাদপত্র যুগে যুগে ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করে এসেছে সেই অ্যাকটা ডায়ারনা থেকেই। ১৭৮৯ সালে বিশ্বকাঁপানো ফরাসী বিপ্লবকালেও সংবাদপত্র গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে।

ফরাসি বিপ্লবের অন্যতম উদ্যোক্তাই ছিলেন সাংবাদিক কামি দামুলি। ১৭৮৯ সালে প্রকাশিত তাঁর সংবাদপত্র ‘রিভ্যালিওশনস্ দ্য ফ্রাঁসে’ এবং কিছুকাল পরে প্রকাশিত ‘ট্রিবিউনে দে প্যাত্রিতেস’ এর জ্বালাময়ী নিবন্ধমালা সম্রাট ষোড়শ লুই-এর অরাজক শাসন এবং গণনির্যাতনের বিরুদ্ধে প্রথম জনমনে বিক্ষোভ ধূমায়িত করে তোলে। সংবাদপত্রের সোচ্চার ভূমিকার কারণেই অত্যাচারী শাসকের বিরুদ্ধে জনতা ১৭৮৯ সালের ১৪ জুলাই অবরোধ করে কুখ্যাত বাস্তিল দুর্গ। এই ঘটনার মধ্য দিয়েই সূচিত হয়েছিলো সারা বিশ্বের পুরানো ঘুণে ধরা রাষ্ট্রব্যবস্থা ভাঙার বিপ্লব। ইতিহাস বলে, যার মূলমন্ত্র ছিলো মানবিক সাম্য, স্বাধীনতা এবং গণতন্ত্র।

বলা যায়, অন্যায়ের বিরুদ্ধে একজন কলমযোদ্ধা সাংবাদিক কামি দামুলির আপোসহীন ভূমিকা এবং নিজ জাতির প্রতি তাঁর নৈতিক দায়িত্ববোধের কল্যাণেই তাঁর স্বদেশ ফ্রান্স পরবর্তীকালের অনেক রক্তরণ আর টানাপড়েনের মধ্য দিয়ে অগ্রসর হলেও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার মুখ দেখেছে। এবং দেশটি বিশ্ব সাংবাদিককতা, গণতান্ত্রিক চিন্তা এবং গণমুখী সমাজ ব্যবস্থার নতুন যুগ প্রবর্তক হিসেবে আধুনিক ইতিহাসে নিজের আসন দখল করে নিয়েছে। ইতিহাসের এই সব তথ্য উত্থাপনের কারণ হলো- ইতিহাস থেকে শিক্ষা গ্রহণ করতে হয়- যা এখন আমরা ভুলতে বসেছি। ষোড়শ শতকে ইউরোপে প্রথম যে সংবাদপত্রটি প্রকাশিত হয়েছিলো সেটির নাম ‘নোতিজিয়েস্ক্রিতে’ ১৫৫৬ সালে এই কাগজটির আত্মপ্রকাশ ঘটে। তখন গুটেনবার্গের মুদ্রন যন্ত্রটি পুরোপুরি ছাপার জন্য চালু হয়ে গেছে।

নোতিজিয়ে স্ক্রিতে ছাপার মেশিনে মুদ্রিত হয়েই প্রকাশিত হতে থাকে। ওই সময়ে পাক-ভারত উপমহাদেশে ঘটে আর একটি ঐতিহাসিক ঘটনা। পানিপথের দ্বিতীয় যুদ্ধের মাধ্যমে ভারতবর্ষে মোগল সাম্রাজ্যের গোড়া মজবুত হয়। উপমহাদেশে তখন সার্বিক অর্থে সংবাদপত্রের অভ্যুদয় না ঘটলেও রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক সিদ্ধান্তসমূহের বিবরণ সংবলিত এক ধরনের তথ্যসমৃদ্ধ রাজকীয় ইশতেহার বিলি করা হতো দরবারের আমির-ওমরাহ, মন্ত্রিপরিষদের সদস্যবর্গ, প্রদেশের সুবেদার, সামরিক কর্মকর্তা, ফৌজদার তথা জেলা প্রশাসক এবং বিচার বিভাগীয় কর্মকর্তাদের মধ্যে। এসব ইশতেহার বিলি-বণ্টন ছাড়াও সম্রাটের দরবার, রাজধানী ও সাম্রাজ্যের গুরুত্বপূর্ণ শহরে টাঙিয়েও রাখা হতো।

যারা এই ইশতেহারের তথ্য সংগ্রহ করতেন তাদের বলা হতো ‘ওয়াকিয়ানবিস’। অর্থাৎ বর্তমান সময়ের সাংবাদিক। দিল্লির প্রথম তুর্কি সুলতান কুতুবউদ্দিন আইবেকের আমল থেকে শুরু করে বাংলার স্বাধীন সুলতান আমল, গোটা মোগল যুগ (১৫২৬-১৭৫৬) এবং শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজ-উদ-দৌলার আমল পর্যন্ত ওয়াকিয়ানবিসগণ ছিলেন খোদ সম্রাট বা সুলতানের আস্থাভাজন ও দায়িত্বশীল সরকারি কর্মচারী। এদের প্রভাবটাও ছিলো অনেক বেশি। বর্তমান সময়ের সাংবাদিকরাও সেরকম প্রভাবশালী।

আকবরের প্রধানমন্ত্রী এবং তাঁর সময়কার ঐতিহাসিক আবুল ফজল তাঁর রচিত বিশ্বখ্যাত ইতিহাসগ্রন্থ ‘আইন-ই-আকবরীতে’ প্রামাণ্য তথ্য ও সূত্র হিসেবে ব্যাপকভাবে ব্যবহার করেছেন তাঁর পূর্বতন যুগের ওয়াকিয়ানবিসদের বর্ণিত বিবরণসমূহ। আওরঙ্গজেবের রচিত ঐতিহাসিক পত্রগ্রন্থ ‘খত-ই-আলমগিরি’ তেও বহু গুরুত্বপূর্ণ ঘটনার নির্ভরযোগ্য সূত্র হিসেবে কয়েকজন ওয়াকিয়ানবিসের নাম উল্লেখ করা হয়েছে। মূলত ওয়াকিয়ানবিসগণ বর্তমান সময়ের রিপোর্টারের মতোই কাজ করেছেন। প্রখ্যাত ইতিহাসবেত্তা শামসুদ্দিন সিরাজ, আফিক প্রমুখ ছিলেন মধ্যযুগের বিশিষ্ট ওয়াকিয়ানবিস তথা রিপোর্টার। এদের বর্ণানার ভিত্তিতে লিপিবদ্ধ তথ্যজ্ঞাপক ইশতেহারসমূহের সাথে খ্রিস্টপূর্ব যুগে জুলিয়াস সিজারের প্রতিষ্ঠিত পত্রিকা অ্যাকটা ডায়ারনার অনেকখানি মিল খুঁজে পাওয়া যায়।

সম্রাট জাহাঙ্গীরের আমলে একটি রাজকীয় ইশতেহারের কথা এখানে উল্লেখ করা যায়। এতে মধ্য প্রদেশে উল্কাপাতের একটি ঘটনার বিশদ বিবরণ রয়েছে। একজন ওয়াকিয়ানবিস ঘটনাস্থল সরজমিনে পরিদর্শন করে রিপোর্টের আকারে খবরটি পাঠিয়েছেন সম্রাটের কাছে। একেবারে স্পষ্ট রিপোর্টিং-এর মতো। সম্রাট এই খবরের ভিত্তিতে স্থানীয় ফৌজদারকে নির্দেশ দিলেন- উল্কাপাতের জায়গাটি খনন করে দেখতে হবে- উল্কার কোনো নিদর্শন পাওয়া যায় কিনা।

পাওয়া গেলে তা সম্রাটের দরবারে পাঠিয়ে দিতে হবে। জায়গাটি খোঁড়ার সময় খননকারী দল ও স্থানীয় বাসিন্দারা খুবই আতঙ্কগ্রস্ত ছিলেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত মাটির খুব গভীরে পাওয়া গেলো উল্কার প্রচুর ধাতব উপাদান। সম্রাটের কামারেরা তা থেকে আধা মণ লোহা বের করে। এরপর সম্রাটের নির্দেশে সেই লোহা দিয়ে কয়েকটি তরবারি তৈরি করা হয়।

রাজকীয় ইশতেহারে এই ঘটনাটি লিপিবদ্ধ করা হয় এবং তারপর সম্রাট তাঁর আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থ ‘তুজুক-ই-জাহাঙ্গীরি’- তে এই ঘটনার উল্লেখ করেন। মধ্যযুগে ইউরোপে যখন সংবাদপত্র প্রকাশ শুরু হয়- এশিয়ায় তখন সেভাবে সংবাদপত্র প্রকাশিত হতে না থাকলেও প্রকাশনার বিকাশ ঘটতে থাকে। চতুর্দশ শতকে দিল্লির তুঘলক বংশের সুলতান মুহম্মদ তুঘলকের আমলে দিল্লিতে প্রথম স্থাপিত হয় হস্তচালিত ছাপযন্ত্র তথা প্রেস মেশিন। এটাই ছিলো এই উপমহাদেশে প্রতিষ্ঠিত প্রথম প্রেস। যার প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন মুহম্মদ বিন তুঘলক, যাঁকে পাগলা সুলতান বলা হয়ে থাকে।

চীনের দৃষ্টান্ত অনুসরণ করে তুঘলক, যাঁকে পাগলা সুলতান বলা হয়ে থাকে। চীনের দৃষ্টান্ত অনুসরণ করে তুঘলক প্রেস স্থাপন করেছিলেন। চীন সম্রাট কুবলাই খান বিশ্বে প্রথম কাগজের নোট বের করে মুদ্রার জগতে এবং সভ্যতার ইতিহাসে এক নবদিগন্তের উন্মোচন করেন। কুবলাই খানের প্রবর্তিত কাগজের নোট ছাপা হতো পিকিং শহরে স্থাপিত হস্তচালিত কাঠের প্রেস থেকে। খ্রিস্টীয় প্রথম শতকে চীনেই প্রথম উদ্ভাবিত হয় ছাপার প্রেস।

বলাই খানের দেখাদেখি মুহম্মদ বিন তুঘলকও কাগজের নোট চালু করেন এই উপমহাদেশে। দিল্লিতে স্থাপিত কাঠের প্রেসে ছাপা হতো কাগজের নোট। সংবাদপত্রের ক্রমবিবর্তনের ইতিহাস থেকে জানা যায় খ্রিস্টীয় অষ্টম শতকে এশিয়ার মধ্যে চীনেই প্রথম সংবাদপত্রের আত্মপ্রকাশ ঘটে। বাণিজ্যিকভাবে বিশ্বের প্রথম প্রকাশিত সংবাদপত্রটি হচ্ছে ‘নোতিজিয়ে স্ক্রিতে’। ১৫৫৬ সালে এটি প্রকাশিত হবার বছরখানেকের মধ্যে পাঠক নন্দিত হয়ে ওঠে।

পাঠক সমাজ পয়সা দিয়ে পত্রিকাটি কিনতে শুরু করেন। পরবর্তী শতকে বৃটেনে আরো উন্নতমানের সংবাদপত্র প্রকাশ হতে থাকে। আমি সেই ইতিহাস নিয়ে আলোচনায় যেতে চাই না। ফিরে আসতে চাই আমাদের বাংলা সংবাদপত্রের জগতে। সংবাদপত্রের সাথে ছাপাখানা বিষয়টি একই দেহের দুইটি অঙ্গের মতো জড়িত।

একথা স্বীকার করতেই হবে যে, বাংলায় যন্ত্রচালিত ছাপার মেশিনের প্রচলন বাংলাভাষায় সংবাদপত্র প্রকাশ এবং বাংলা গদ্যের বিকাশের জন্য আমরা ইউরোপীয়দের কাছে অনেকখানি ঋণী। পলাশী যুদ্ধের আট বছর পরে ১৭৬৫ সালের দিকে চুঁচড়া শহরে প্রথম যন্ত্রচালিত ছাপাখানা চালু করেন গুলন্দাজ ধর্মযাজকগণ। ছাপাখানায় বাংলা মুদ্রারও প্রথম ব্যবহার করেন তারা। বাংলাভাষায় খ্রিস্টধর্ম বিষয়ক পুস্তক প্রকাশের লক্ষে ইউরোপের ধর্মযাজকরা এই কাজটি শুরু করেন। বাংলা ভাষায় প্রথম ব্যাকরণ পুস্তকটিও ছাপিয়েছিলেন পশ্চিমা ধর্মযাজকরা।

এই বাংলা ব্যাকরণ লিখেছিলেন বৃটিশ পণ্ডিত ও ধর্মযাজক হলহ্যাড সাহেব। এই উপমহাদেশে প্রথম প্রকাশিত হয়েছিলো একটি ইংরেজি সাপ্তাহিক। জেমস আগস্টাস হিকি ১৭৮০ সালের ২৯ জানুয়ারি “বেঙ্গল গেজেট” নামের এই ইংরেজি সাপ্তাহিক পত্রিকাটি প্রকাশ করেন। হিকির গেজেট প্রকাশের ৩৮ বছর পরে ১৮১৮ সালে প্রথম অভ্যুদয় ঘটে বাংলা সংবাদপত্রের। ‘দিকদর্শন’ নামের আদি বাংলা সাময়িক পত্রটির প্রতিষ্ঠাতা ও সম্পাদক ছিলেন একজন ইংরেজ।

তাঁর নাম ছিলো জন কার্ক মার্শম্যান। তিনি বাংলা সংবাদপত্রের প্রথম সম্পাদক। সেখানে থেকে যাত্রা শুরু করে আজ পর্যন্ত হিসেবে বাংলা সংবাদপত্রের জগতে নবীনতম পত্রিকা সমকালের সম্পাদকের দায়িত্ব গোলাম সারওয়ারের কাছে পৌঁছেছে। হয়তো কাল আর একটি নতুন পত্রিকা প্রকাশিত হবে-আর একজন নতুন সম্পাদক হবেন। তবে আজ আমি এই নতুন পত্রিকার নতুন সম্পাদকের সাফল্য কামনা করি একান্ত মনে।

‘দিকদর্শন’ কিন্তু পুরোপুরি বাংলা পত্রিকা ছিল না। এই পত্রিকায় বাংলা সংবাদ নিবন্ধের পাশাপাশি ইংরেজি ভাষাতেও লেখা ছাপা হতো। বাংলা ভাষাভাষী হিন্দু-মুসলমান যুবকদের খ্রিস্ট ধর্মের প্রতি আকৃষ্ট করাই ছিলো দিকদর্শনের উদ্দেশ্য। দিকদর্শন প্রকাশের এক মাস পরে উইলিয়াম কেরির সম্পাদনায় আত্মপ্রকাশ ঘটলো বিখ্যাত বাংলা সাপ্তাহিক ‘সমাচার দর্পণ’ পত্রিকাটির। কেরি সাহেবের কেরানি রাম রাম বসু ছিলেন সমাচার দর্পনেণ সম্পাদনা সহকারী।

এটিও ছিলো মূলত খ্রিস্ট ধর্মের প্রচারপত্র। কিন্তু তা সত্ত্বেও সমাচার দর্পণ বাংলা সাংবাদিকতার গোড়াপত্তনে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছে। বাংলা সংবাদপত্রের ইতিহাস মন্থনে নিজের কাছে ভালো লাগছে বলেই এই আলোচনার অবতারণা করলাম। আজ থেকে দুশ’ বছর আগে অর্থাৎ উনিশ শতকের প্রথম পর্বে বাংলাদেশে কোনো ইংরেজি কিংবা বাংলা দৈনিকের আত্মপ্রকাশ ঘটেনি। উনিশ শতকের শেষ ভাগে ইংরেজি ভাষার কাগজ স্টেটসম্যান যার আদি নাম ফ্রেন্ডস অব ইন্ডিয়া এবং অমৃতবাজারসহ কয়েকটি দৈনিক পত্রিকা প্রকাশিত হয়।

অমৃতবাজার দেশীয় স্বার্থ রক্ষা করার নীতি অবলম্বন করতে গিয়ে বৃটিশ শাসকদের রাজরোষে পড়ে। ফলে অমৃতবাজারকে ইংরেজিতে রূপান্তরিত করা হয়। ১৮১৮ সালে সমাচার দর্পণ প্রকাশিত হবার পকালের ব্যবধানেই প্রথম বাঙালি সম্পাদিত পত্রিকা সাপ্তাহিক ‘বাঙ্গালা গেজেটি’ প্রকাশিত হয়, এই পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন গঙ্গাকিশোর ভট্টাচার্য এবং প্রকাশক ছিলেন হরচন্দ্র রায়। এই উপমহাদেশের পত্রপত্রিকার ইতিবৃত্ত থেকে জানা যায়, উপমহাদেশীয় ভাষাগুলোর মধ্যে বাংলা ভাষাতেই প্রথম আত্মপ্রকাশ ঘটে সংবাদপত্রের। আজ ভাবতেও ভালো লাগে যে, উপমহাদেশীয় সাংবাদিকতায় বাঙালিরাই পালন করেছে অগ্রপথিকের ভূমিকা।

এই ইতিহাস হয়তো অনেকেরই জানা হয়তো বা অনেকের জানা নেই। তবে গৌরবের ইতিহাস যতই ঘাঁটা হবে ততই মঙ্গল হবে। নতুন প্রজন্ম পুরনো দিনের কথা জানবে। তারা গৌরবের পথে অগ্রসর হতে অনুপ্রাণিত হবে। সে কারণেই আমার এই আলোচনা।

১৮৩১ সালে মুসলমান সাংবাদিক সম্পাদিত প্রথম পত্রিকা সাপ্তাহিক ‘সমাচার সভা রাজেন্দ্র’ প্রকাশিত হয়। রাজা রামমোহন রায়ও একটি পত্রিকা প্রকাশ করেছিলেন। তার সম্পাদিত পত্রিকার নাম ছিলো ‘আখবার’। এটি ছিলো ফার্সি ভাষার কাগজ। ‘সমাচার সভা রাজেন্দ্র প্রকাশিত হয়েছিলো কোলকাতার কালিঙ্গা রোড থেকে।

এই পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন শেখ আলিমুল্লাহ। তার পথ ধরে অনেক মুসলমান সম্পাদক পত্রিকা প্রকাশে এগিয়ে আসেন এবং তারা বাংলা সংবাদপত্রকে এগিয়ে নিতে যথেষ্ট অবদান রেখেছেন। এখানে তাদের কথা স্মরণ করা যেতে পারে। সম্পাদক শেখ আলিমুল্লাহর পর ১৮৪৬ সালে কোলকাতার বৈঠকখানা রোড থেকে ফরিদুদ্দিন খাঁ পঞ্চভাষিক সাপ্তাহিক ‘জগদুদ্দীপক ভাস্কর’ প্রকাশ করেন। উনিশ শতকের শেষার্ধে বাংলাদেশের মফস্বল শহর ও গ্রামাঞ্চল থেকেও বেশ কিছু পত্রপত্রিকার আত্মপ্রকাশ ঘটে।

এগুলোর মধ্যে ১৮৬১ সালে আলাহেদাদ খাঁ সম্পাদিত পাকি ‘ফরিদপুর দর্পণ’ মানিকগঞ্জের পারিল গ্রাম আনিসউদ্দিন আহমদ সম্পাদিত পাকি বার্তাবহ, মাগুরা থেকে মুনশি গোলাম কাদেরের সম্পাদনায় মাসিক ‘হিন্দু-মুসলমান সম্মিলনী’ কুষ্টিয়ার লাহিড়ী পাড়া থেকে মীর মশাররফ হোসেনের সম্পাদনায় পাকি ‘হিতকরী’-১৮৯০- ১৮৯২ সালে টাঙ্গাইল থেকে মোসলেম উদ্দিন খানের সম্পাদনায় টাঙ্গাইল হিতকরী, কুষ্টিয়া থেকে মুহম্মদ রওশন আলীর সম্পাদনায় মাসিক সাহিত্যপত্র ‘কোহিনূর’ পত্রিকা প্রকাশিত হয়। আমার জানা মতের বাইরে এ সময়ের মধ্যে আরো পত্রিকা প্রকাশিত হয়ে থাকতে পারে। আমার নিজ শহর রংপুরও সংবাদপত্রের ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানে রয়েছে। বাংলাদেশের আজকের ভৌগোলিক সীমানার মধ্যে প্রথম সংবাদপত্রটি প্রকাশিত হয়েছিলো রংপুর থেকেই। ১৮৪৭ সালের আগস্ট মাসে অর্থাৎ বৃটিশ শাসনাধীন থেকে দেশ স্বাধীন হবার ঠিক একশ’ বছর আগে এই অঞ্চলের প্রথম সংবাদপত্র ‘রঙ্গপুর বার্তাবহ’ প্রকাশিত হয়।

বাংলা ভাষার এই পত্রিকার নিজস্ব প্রেস ‘বার্তাবহ যন্ত্রালয়’ থেকে মুদ্রিত হয়েছে। ১৮৫৩ সালের সরকারি রিপোর্ট অনুসারে ‘রঙ্গপুর বার্তাবহ’ পত্রিকার প্রচার সংখ্যা ছিলো মাত্র একশ কপি, চাঁদা ছিলো বার্ষিক ৬ রুপি এবং অগ্রিম দিলে ৪ রুপি। রঙ্গপুর বার্তাবহ আজ সংবাদপত্রের এক গৌরবের ইতিহাস। সেই গৌরবের ধারাবাহিকতা নিয়ে আমাদের হাতে আসছে দৈনিক সমকাল। দেড় শতাধিক বছর আগের ‘রঙ্গপুর বার্তাবহ’ দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে বর্তমানের কাছে পৌঁছাতে পারেনি- মাঝে কখন কোথায় হারিয়ে গেছে জানি না, আশা করি সমকাল শতাব্দীর পথে চলতে কখনো হারাবে না।

শত বছর পরে কোনো পাঠক যদি সূচনা সংখ্যাটির ইতিহাস নাড়াচাড়া করতে যায় তাহলে আমার আজকের পরিশ্রম সার্থক হবে। আমি আগেই বলেছি বাংলা সাংবাদিকতায় মুসলমানরা অবিস্মরণীয় ভূমিকা পালন করেছেন। উনিশ শতকের শেষ অধ্যায়ে এবং বিশ শতকের গোড়ার দিকে মুসলমান সম্পাদকদের সম্পাদনায় বেশ কয়েকটি উন্নত মানের পত্রিকা প্রকাশিত হয়েছে। এর মধ্যে টাঙ্গাইলের জমিদার সৈয়দ নওয়াব আলী চৌধুরী ও ঢাকার নবাব স্যার সলিমুল্লাহর পৃষ্ঠপোষকতায় ১৮৯৫ সালে মিহির ও সুধাকর প্রকাশিত হয়। এই পত্রিকায় পর্যায়ক্রমে সম্পাদনা করেন শেখ আব্দুর রহিম, মোহম্মদ রিয়াজউদ্দিন আহমেদ ও সৈয়দ ওসমান আলী।

১৮৭৭ সালে মৌলভী আব্দুল খালেকের সম্পাদনায় উত্তর শিয়ালদা থেকে প্রকাশিত হয় অর্ধসাপ্তাহিক ‘মহাম্মদ আখবর’। ১৮৮৯ সালের নভেম্বর মাসে স্বদেশী আন্দোলনের প্রখ্যাত নেতা সুরেন্দ্রনাথ ব্যানার্জী ও সৈয়দ হাসান আলীর পৃষ্ঠপোষকতায় প্রকাশিত হয় ‘সাপ্তাহিক সুধাকর’। ১৯০১ সালে শেরেবাংলা একে ফজলুল হক ও নিবারণ চন্দ্র দাসের যুগ্ম সম্পাদনায় বরিশাল থেকে প্রকাশিত হয় ‘সাপ্তাহিক বালক’। ১৯০৩ সালে কোলকাতা থেকে কবি সৈয়দ এমদাদ আলী সম্পাদিত মাসিক নবনূর এবং একই বছর আগস্ট মাসে প্রথিতযশা সাহিত্যিক- সাংবাদিক মওলানা আকরম খাঁর সম্পাদনায় মাসিক এবং পরবর্তীকালে সাপ্তাহিক ও দৈনিক হিসেবে ‘মোহাম্মদী’ প্রকাশিত হয়। ১৯১৮ সালে ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, ভোলার কবি মোজাম্মেল হকের যুগ্ম সম্পাদনায় কোলকাতা থেকে ‘মুসলমান সাহিত্য পত্রিকা’ এবং একই বছর মোহাম্মদ নাসির উদ্দিনের সম্পাদনায় কোলকাতার জাকারিয়া স্ট্রিট থেকে ‘মাসিক সওগাত’ প্রকাশিত হয়।

১৯১৯ সালে আব্দুল করিম সাহিত্য বিশারদ ও আব্দুর রশিদ সিদ্দিকীর যুগ্ম সম্পাদনায় চট্টগ্রাম থেকে প্রকাশিত হয়েছিলো মাসিক সাহিত্য পত্র ‘সাধনা’। ১৯১৯ সালে শেখ হাবিবুর রহমানের সম্পাদনায় ‘মাসিক বঙ্গনূর’, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের সম্পাদনায় কোলকাতার কলেজ স্কয়ার থেকে অর্ধসাপ্তাহিক ‘ধূমকেতু’ এবং ১৯২৬ সালে মোহাম্মদ জাফর আলীর সম্পাদনায় ঢাকা থেকে ‘মাসিক সবুজ পল্লী’, কমরেড মোজাফ্ফর আহমদের সম্পাদনায় কোলকাতার হ্যারিসন রোড থেকে সাপ্তাহিক গণবাণী, আব্দুল মোনেমের সম্পাদনায় চট্টগ্রাম থেকে সাপ্তাহিক জনমত এবং ১৯২৭ সালের এপ্রিল মাসে মুক্তবুদ্ধি আন্দোলনের নেতা আবুল হোসেন ও পরে ডক্টর কাজী মোতাহার হোসেনের সম্পাদনায় ঢাকা থেকে ‘শিখা’ প্রকাশিত হয়েছিলো। শেরেবাংলা ফজলুল হকের পৃষ্ঠপোষকতায় এবং কাজী নজরুল ইসলাম ও কমরেড মোজাফ্ফর আহমদের যুগ্ম সম্পাদনায় ১৯২০ সালের মে মাসে কোলকাতা থেকে প্রকাশিত হয় ‘দৈনিক নবযুগ’, মওলানা আকরম খাঁর সম্পাদনায় ১৯২১ সালে প্রকাশিত দৈনিক সেবক, ১৯২২ সালে দৈনিক মোহাম্মদী, ১৯২৬ সালে মাওলানা মনিরুজ্জামান ইসলামাবাদীর সম্পাদনায় ‘দৈনিক সোলতান’, ১৯৩৬ সালে প্রথমে মওলানা আকরম খাঁ এবং পরে আবুল কালাম শামসুদ্দিনের সম্পাদনায় ‘দৈনিক আজাদ’, ১৯৪৬ সালে আবুল মনসুর আহমদের সম্পাদনায় ‘দৈনিক ইত্তেহাদ’- ইত্যাদি পত্রিকাগুলো পাক-ভারত বিভাগ যুগে জাতীয় সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে এক সুদূরপ্রসারী যুগের উন্মোচন করেছে। এই কাগজগুলোর প্রাতঃস্মরণীয় সম্পাদকদের নির্মিত পথ অনুসরণ করেই আজ আমাদের সংবাদপত্র জগতের মহাশূন্য বিজয়ের এ যুগে প্রবেশ করেছি। আজ আমরাও এ যুগে পেয়েছি গোলাম সারওয়ার, এ. বি. এম. মূসা, বজলুর রহমান, তোয়াব খান, মাহবুবুল আলম, রাহাত খান, এনায়েতউল্লাহ খান, ইকবাল সোবহান চৌধুরী, রিয়াজউদ্দিন আহমেদ, মাহফুজ আনাম, মতিউর রহমান, জাকারিয়া খান, আসাফউদ্দৌলা, মহিউদ্দিন আহমেদ, আমানুল্লাহ কবীর, এ. এম. এম. বাহাউদ্দিনের মতো সম্পাদকবৃন্দকে।

তাঁরা আমাদের সংবাদপত্র জগতের গৌরবের উত্তরাধিকারী। আজ বাংলাদেশে অসংখ্য পত্রিকা প্রকাশিত হচ্ছে। আমি নিজেও একটি দৈনিক প্রকাশের দুঃসাহসী কাজে হাত দিয়েছিলাম। তবে সফল হতে পারিনি। অনেক তিক্ত অভিজ্ঞতা অর্জন করেছি- পত্রিকা প্রকাশ করতে গিয়ে।

সংবাদপত্রের প্রতি দুর্বলতা আমাকে গভীরভাবে আকৃষ্ট করেছিলো। আমি নিজে এই শিল্প প্রতিষ্ঠা করে সফল হতে না পারলেও এই শিল্পের সাথে জড়িত মানুষগুলোর জন্য অনেক কিছু করার চেষ্টা করেছি একান্তভাবে। আমাদের সাংবাদিকরা যাদের উত্তরাধিকারী হিসেবে আজ সাফল্যের শিখরে পৌঁছে গেছেন তাদের গৌরবগাথা ইতিহাস আমাকে গভীরভাবে অনুপ্রাণিত করেছে। আমি যখন ক্ষমতায় ছিলাম আমাদের সাংবাদিক সমাজের কল্যাণে অনেক কিছু করার চেষ্টা করেছি। সাংবাদিকদের জন্য পঞ্চম ওয়েজবোর্ড পর্যন্ত আমার আমলেই দেয়া হয়েছে।

তারপর সাংবাদিকরা গত ১৪ বছরে সরকারের কাছ থেকে কত কী সুবিধা আদায় করতে পেরেছে তা আমার জানা নেই। আমিই প্রথম সাংবাদিকদের জন্য আবাসিক প্রকল্পের কাজ হাতে নিয়েছিলাম। তাদের জন্য মিরপুরে প্লট বরাদ্দ করেছি। আমি খুবই গর্ববোধ করছি আমার সেই বরাদ্দকৃত প্লটে সাংবাদিকদের নিজস্ব ভবন তৈরি হয়েছে। জাতীয় প্রেসকাবের জন্য অর্থ বরাদ্দ করেছিলাম- সেই অর্থে প্রেসকাবের দৃষ্টিনন্দন ভবন নির্মাণের কাজ হয়েছে।

শুধু জাতীয় প্রেসকাব নয়- দেশের আরো কয়েকটি প্রেসকাবে আমার শাসনামলে অনুদান পেয়েছে। জানা মতে আমার পরে আর কোনো সরকারের কাছ থেকে এদেশের সাংবাদিক সমাজ এমন কোনো সুযোগ-সুবিধা আদায় করতে পারেনি। সংবাদপত্র শিল্পকে দিয়ে আমি এদেশের কাগজ শিল্পকে রা করতে চেয়েছিলাম। আমার শাসনামলে দেশীয় কাগজে আমাদের সংবাদপত্র ছাপা হতো। আজ আর সেই অবস্থা নেই।

দেশের কাগজের বাজার দখল করেছে বিদেশী কাগজ। বন্ধ হয়ে গেছে খুলনার বিখ্যাত নিউজপ্রিন্ট মিল। বেকার হয়েছে হাজার হাজার শ্রমিক। বেকার হয়েছে এই শিল্পের সাথে প্রত্য ও পরোভাবে জড়িত লাখো মানুষ। দেশের কাগজ শিল্পকে ধ্বংস করে বিদেশী বর্ণিল কাগজ আমদানির নীতি অবলম্বন করে জাতীয়ভাবে কতোটুকু লাভ পাওয়া গেছে তা সময়ই বলে দেবে।

আমি সংবাদপত্র শিল্প এবং সাংবাদিক সমাজের জন্য যা কিছু করেছি- তা বিবেকের তাগিদেই করেছিলাম। তবে আমার জন্য দুঃখজনক ঘটনা হলো সংবাদপত্রের কাছ থেকে আমি সুবিচার পাইনি। যাদের আমি ঘর দিয়েছি, ওয়েজবোর্ড দিয়েছি, তারাই আমার বিরুদ্ধে যেনো বেশি সোচ্চার হয়েছে। মনে হয়েছে- আমাকে কটাক্ষ করে কিংবা আমাকে আঘাত করে কিছু লিখতে পারলেই যেনো জাতি উদ্ধার পেয়ে যাবে। আমার রাজনৈতিক দল দেশের তৃতীয় বৃহত্তম রাজনৈতিক দল হওয়া সত্ত্বেও অনেক সংবাদপত্রে সেভাবে মূল্যায়ন করা হয় না।

এর জন্য আমি আহত ও ব্যথিত হলেও ক্ষুব্ধ হই না। আমি বিশ্বাস করি সাংবাদিক বন্ধুগণ একদিন তাদের প্রকৃত বন্ধুকে চিনতে পারবেনই। কারণ আমার শাসনামলে কোনো সাংবাদিককে শামসুর রহমান, মানিক সাহা, হুমায়ুন কবির বালু, দীপঙ্কর, বেলালের মতো প্রাণ দিতে হয়নি। কোনো সাংবাদিককে নিরাপত্তাহীন জীবনযাপন করতে হয়নি- কোনো সাংবাদিকের শরীরে এতোটুকু আঘাত লাগেনি। আমার শাসনামলে কোনো পুলিশ প্রেসকাবে ঢুকে সাংবাদিকদের বেধড়ক পিটুনি দেয়নি।

কোনো প্রেসকাবে বোমা হামলা হয়নি। এসবের মূল্যায়ন তো একদিন হতেই হবে। তা না হলে ন্যায়নীতি, আদর্শ, কৃতজ্ঞতা এসব শব্দ তো অভিধানের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকবে। আমি গণতান্ত্রিকভাবে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়নি এটাই যদি আমার একমাত্র দোষ হয়ে থাকে, তাহলে আরো অনেকেই এই দোষে দুষ্ট আছেন। একটি কথা আমি স্পষ্ট করেই বলতে চাই- ক্ষমতা আমি গ্রহণ করিনি।

ক্ষমতা আমার উপর অর্পিত হয়েছে। পরবর্তীতে আমি আমার ক্ষমতাকে গণতান্ত্রিক বিধিসম্মত করে নিয়েছি। আর সে কারণেই আমার পরে বেগম খালেদা জিয়া ও শেখ হাসিনা গণতান্ত্রিক পন্থায় ক্ষমতা গ্রহণ করতে পেরেছেন। তবে এই দুই নেত্রীর আমলের গণতন্ত্র আর আমার আমলের গণতন্ত্রের মধ্যে তুলনা করে দেশ ও জনগণের শান্তি, সমৃদ্ধি, নিরাপত্তার ব্যবধানটা বের করতে পারলেই প্রকৃত গণতন্ত্রের ব্যাখ্যা খুঁজে পাওয়া যাবে। সেই সাথে আমার পূর্বে ক্ষমতা গ্রহণের ইতিহাসটাও পর্যালোচনা করা প্রয়োজন আছে।

সদ্য স্বাধীন দেশে যে নেতৃত্ব ক্ষমতা গ্রহণ করেছিলো, তারা স্বাধীন দেশের নির্বাচিত সরকার ছিলো না। তখন জাতীয় সরকার না হয়ে একটি দল ক্ষমতা গ্রহণ করছে। খন্দকার মোস্তাক বা জেনারেল জিয়াউর রহমানের ক্ষমতা গ্রহণ গণতান্ত্রিক পন্থায় হয়নি। কিন্তু সেই জিয়াউর রহমানই দেশকে দিয়েছেন বহুদলীয় গণতন্ত্র। আর আমি দেশকে উপহার দিয়েছি উন্নয়ন সমৃদ্ধি এবং সাংবিধানিক ও গণতান্ত্রিক পন্থায় সরকার বদলের প্রক্রিয়া।

যারা ৪টি মাত্র পত্রিকা রেখে বাকি পত্রিকাগুলো নিষিদ্ধ করে দিয়ে সাংবাদিকদের বেকার করে দিলেন, যারা প্রেসক্লাবে ঢুকে সাংবাদিকদের নির্দয়ভাবে পিটিয়ে যখম করে দিলেন, যাদের আমলে একের এক সাংবাদিক নির্মমভাবে নিহত হলেন- আহত হলেন তারাই হয়ে গেলেন সাংবাদিকদের বন্ধু। তারা হয়ে গেলেন গণতান্ত্রিক- আমি হলাম গিয়ে “স্বৈরাচার”- এটাই বিস্ময়ের ব্যাপার। তবু আমি কোনো কিছুতেই হতাশ হই না, হাজার প্রতিকূল অবস্থার মধ্যে আশায় বুক বেঁধে রাখি। ভীষণভাবে একজন আশাবাদী মানুষ আমি। পুরাতনের যা মন্দ তা পরিত্যাগ করে যা কিছু সুন্দর, যা কিছু গৌরবের সেসব কিছুকে বুকে ধারণ করে পথ চলতে চাই।

নতুনের কাছে অনেক প্রত্যাশা করি।

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে ১১ বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.