আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

সুন্দরবনে মধু ট্যূর অভিযান - পর্ব ৪

জাগরী একটি নির্দলীয় মঞ্চ যেখানে বাংলাদেশের যুবসমাজ দেশের রাজনৈতিক ও নীতিনির্ধারণী ক্ষেত্রে সচেতন,সোচ্চার ও সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহন করতে পারে। www.jagoree.org  

আমাদের এইবার জাহাজে ফেরার পালা, কিন্তু কেন জানি এত অল্পসময়ের এডভ্যঞ্চারে মন ভরল না। আমাদের সাথে হাসান ভাই এসেছেন কিন্তু ছাটায় যান নি যেহেতু উনি আমাদের এ গ্রুপের সদস্য না। উনি এসেছেন আমাদের সাহস যোগাতে। স্পিডবোট এই বসে ছিলেন সারাক্ষ্ণণ।

আমরা জাহাজে ফিরলেই গ্রুপ-বি বের হবে পরবর্তী ছাটাতে। মন খারাপ করে বসে আছি, মনে হচ্ছিল কেন যে ১৫ মিনিটে মৌচাক পেয়ে গেছি? এর জায়গায় যদি এক ঘন্টা লাগত মৌচাক পেতে তাইলে মনভরে জংগলে ঘুরতে পারতাম। হাসান ভাই আমার মন খারাপ দেখে জিজ্ঞাসা করলেন কি হ্ল ? ভাল লাগে নাই? আমি বললাম কি যে বলেন না, ১৫ মিনিট হেটেই মৌচাক পেয়েগেলাম এইটা কোন ছাটা হল? কি একটু ভেবে বললেন - তোমাদের সময় ছিল দেড় ঘন্টা কিন্তু তোমরা ১৫ মিনিটেই মৌচাক পেয়ে গেছ। হয় এখন জাহাজে ফিরতে পার অথবা যদি ইচ্ছা কর তাইলে ৪৫ মিনিটের জন্য আরেকটি ছাটা মারার স্পেশাল পারমিশন আমি দিতে পারি তোমাদের। শুনে গ্রুপের সবাই হই হই করে উঠল।

আমরা পরবর্তী ছাটা মারার জন্য আর একটি লোকেশন খুজতে লাগলাম। স্পিডবোট চালিয়ে আরো গভীরে যেতে যেতে মৌয়ালের দল তিখন দৃস্টিতে মৌচাক খুজতে লাগল। এক জায়গায় উচু এক গাছের মাথায় কিছু মৌমাছি উড়তে দেখে ইব্রাহিম ভাই বোট ভিড়াতে বললেন। বোট থেকে নামতে গিয়ে আমাদের গ্রুপের একমাত্র বিদেশি গেস্ট ওয়ান্ডা (আমি নাম দিয়েছিলাম ওয়ান্ডার ওমেন) প্রথম দূর্ঘটনা ঘটায়। বোট থেকে লাফ দিয়ে নামার সময় পিছলা খেয়ে একবারে কাদায় ধপাস।

শুধু বসে পড়া নয় কাদার মধ্যে একবারে শুয়ে পরল । তাড়াতাড়ি আমরা দুইজনে মিলে ওনাকে তুললাম। ওনাকে তুলতে তুলতেই ইব্রাহিম ভাই বললেন আপনারা সবাই বোটে উঠেন তাড়াতাড়ি - এইখানে থাকা নিরাপদ নয়। এই মৌচাক আমাদের আগে আরেক গ্রুপ ভেংগে গেছে, মৌমাছিরা খেপে আছে। আমরা আবার বোটে উঠে নতুন মৌচাকের সন্ধানে বের হলাম।

এর মধ্যে ইব্রাহিম ভাই এর সাথে কথা বলে জানলাম যে এই অঞ্চলে মৌমাছির কামড়ে মনুষ মড়ার কোন রেকর্ড নাই তবে মৌমাছি কামড়ালে প্রচন্ড ব্যাথা হয়, এবং এর কোন ঔষধ নাই, একমাত্র কামড়ের জায়গায় মধু মাখলে একটু আরাম হয়। ভয় শুধুমাত্র মামাদের (বাঘ) নিয়ে। কথা বলতে বলতে প্রায় আরও ২০মিনিট স্পিডবোট চালিয়ে আসার পরে আমাদের লোকেটর মৌয়াল বলল এক জায়গায় নেমে পরতে। তবে সাবধান করল যে এই স্থানে মৌচাক পেতে কিন্তু অনেকদুর হাটতে হবে। আমাদের আবার হাটার বা দৌড়ানোর সমস্যা কি? শুরু হলো আমাদের দিতীয় ছাটা মারা।

এইবার যেখানে নেমেছি তা যেন আগের জায়গার থেকেও দুর্গম লাগছিল। ঢোকার মুখে অরণ্য এইখানে যেন প্রচীর তুলে আছে। আগের মতই আবার আমরা একই ভাবে দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে গেলাম। ইব্রাহিম ভাই আগে আগে দা দিয়ে সামনের জংগল পরিস্কার করতে করতে এগুচ্ছিলেন আর আমরা সবাই তার পিছনে পিছনে। ৫-৭মিনিট এইভাবে পথ চলার পর গরানের বন শেষ হয়ে গেল কিন্তু সামনে পড়ল বিশাল এক টাইগার ফার্ন এর মাঠ।

ইব্রাহিম ভাই হঠাৎ থমকে গেলেন। কি এক সাংকেতিক শব্দ করলেন, মৌয়ালদের অপর গ্রুপ থেকেও অনুরুপ শব্দ ভেসে আসল। ইব্রাহিম ভাই দেখি দুইটা পটকা ফাটালেন পর পর, শব্দে আমাদের কানে তালা লেগে গেল। একটু পরেই দেখি ওইদিক থেকেও দুইটি পটকার শব্দ ভেসে আসল। হাতে করে আরও কয়েকটি পটকা রেডি করে উনি ফার্ন বনের ভিতর দিয়ে এগোতে লাগলেন।

ফরেস্ট গার্ডদের বললেন বন্দুক লোড করে রেডি রাখতে। এ কিসের আলামত তা কেবল আমিই বুঝতে পেরেছি (এই ঘন টাইগার ফার্ণ এর এত বড় মাঠ আর ঘন জঙ্গল মামাদের খুবই প্রিয় জায়গা - দুর্ঘটনা ঘটার এর চেয়ে উৎকৃস্ট জায়গা আর হয় না) । অন্যরা যাতে টের না পায় বা ভয় না পায় তাই আমি কানে কানে ইব্রাহিম ভাইএর কাছে বললাম, এই মাঠ না পার হয়ে ঘুরে গেলে ভাল হত না? উনি বললেন আপনি বুঝতে পেরেছেন না? কিন্তু উপায় নাই, অনেক ঘুরে যেতে হবে আর মাঠ পার হয়ে আরেকটু সামনে গেলেই বোধহয় মৌচাক এর দেখা পাব। কিছু মৌমাছি দেখচিলাম মাঠ পার হয়ে উড়ে যাচ্ছে। আল্লাহ ভরসা চলেন আগাই।

যেতে যেতে উনি আরো ৪টি বোমা ফাটালেন। আমরা সবাই খুব দ্রুত হাটছিলাম আর শব্দ করে নিজেদের মধ্যে কথা বলছিলাম। আমাদের মধ্যে একমাত্র খোকন ভাই বোধহয় আমার মত আসল ঘটনা বুঝতে পেরেছিলেন, তাই ওনার গলার ভয়েজ ছিল সবচেয়ে বেশি। এই মাঠ পার হতে আমাদের প্রায় পাচ মিনিট লাগল, মাঠ পার হওয়ার পর আমার গায়ের সব লোম দাঁড়িয়ে গিয়েছিল। কি পার হয়ে আসলাম তা শুধু আমিই জানি।

আল্লাহর কাছে লাখো শুকুর যে কোন দুর্ঘটনা ঘটে নাই। মাঠ পার হয়ে সামনে এগিয়ে যাচ্ছি, কিছুদুর যাবার পরে দেখি জোয়ারের পানিতে সামনের প্রায় সিকিমাইল পানি আর পানি, খুব বেশি গভীর না তা বুঝতে পারছিলাম, ম্যানগ্রোভের শাসমূল পানির উপর দিয়ে দেখা যাচ্ছিল। ফিরে যাবার পথ নেই, সামনে আগাতেই হবে। এ যেন ফুটন্ত কড়াই থেকে জলন্ত আগুনে ঝাপ দেয়া। একটু একটু করে পানি ভেংগে এগুতে থাকি।

কোথাও উচু কোথাও নিচু, কোথাও গিরু পানি তো কোথাও হাটু পানি আবার মাঝে মাঝে ডুবে যাচ্ছিলাম কোমড় পানিতে, এর মধ্যে যন্ত্রনা আবার ম্যানগ্রোভের বড় বড় চোখা আগাগুলি, বুটজুতার নিচে মট মট করে ভাংছিল ওইগুলা। এখন বুঝতে পারছি আর্মিদের এই প্রায় হাটু পর্জন্ত গামবুট কেন এই ট্যুরের আবশ্যিক অংশ । ভর দিয়ে ব্যলেন্স রাখার জন্য ইব্রাহিম ভাই আমাদের প্রত্যেককে একটি করে গাছের ডাল কেটে লাঠি বানিয়ে দিলেন। কোনরকম ৭-৮মিনিট অক্লান্ত পরিস্রম করে ম্যানগ্রোভের এই অংশ পার হলাম। না কোন দুর্ঘটনা ছাড়া এই অংশ পার হওয়া গেল না।

আমাদের ওয়ান্ডার ওমেন এবং মনি আপা দুই জনেই এর মধ্যে একবার করে আছার খেয়ে ফেলেছেন । মনি আপা যদিও বেশি ব্যথা পান নি কিন্তু ওয়ান্ডা ভালই ব্যথা পেয়েছেন। এই বৈতরনি পার হওয়ার পর আরো প্রায় ১০ মিনিট হাটলাম। তবে এই পথ এত বেশি দুর্গম নয়। মোটামুটি ঘন জংগল ছিল তাতে আমাদের বেশি অসুবিধা হচ্ছিল না।

হঠাৎ করে মৌয়ালদের আরেক গ্রুপ থেকে কিছু সাংকেতিক শব্দ ভেসে আসল। ইব্রাহিম ভাই বললেন আপনাদের কস্ট সার্থক হয়েছে। আমরা আরেকটি মৌচাকের সন্ধান পেয়েছি। সংকেত বিনিময় করতে করতে আমরা ওই গ্রুপের সাথে মিলিত হলাম। চারিদিক ঘিরা একটি ঝোপের ভিতর একটি নিচু কেওরা গাছ কিন্তু গাছটি বেশ মোটা, মাটি থেকে মাত্র ৩-৪ হাত উপরে বিশাল আকৃতির একটি মৌচাক।

(আজ এই পর্যন্তই থাকলো, বাকিটুকু পরে লিখব। ) যারা পূর্বের পর্বগুলো পরেন নি তাদের জন্য লিঙ্ক - পর্ব ১ এবং ২ - Click This Link পর্ব ৩ - Click This Link

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।