আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

‘হেরেমের কৃষ্ণাঙ্গ ইউনাখ’

বাংলার মাটি বাংলার জল, বাংলার বায়ু, বাংলার ফল, পুন্য হউক, পুন্য হউক, পুন্য হউক, হে ভগবান। বাংলার ঘর, বাংলার হাট, বাংলার বন, বাংলার মাঠ, পুর্ন হউক, পূর্ন হউক, পূর্ন হ্‌উক, হে ভগবান। রবীন্দ্রনাথ
খোজা। এক দল পৌরুষবর্জিত পুরুষকেই ইউনাখ বলা হয়; এবং এইরকম হীনবীর্য হয়ে যাওয়াটা এদের ইচ্ছেয় ঘটে নি। ইউনাখ-রা আসলে ক্ষমতাধর পুরুষদের স্বার্থের বলি।

ক্ষমতাসীন পুরুষের অন্দরমহলে (বা হেরেমে) নারীদের বন্দিত্ব পাকাপোক্ত করতেই ইউনাখ নিযুক্ত করা হত। হেরেমে খোজাকৃত পুরুষের নিয়োগের কারণ সহজেই অনুমান করা যায়। নপুংসক এর প্রজনন ক্ষমতা নেই যে। আশ্চর্য এই যে ... কখনও কখনও বালকেরা কিংবা তরুণেরা স্বেচ্ছায় শিশ্নচ্ছেদকরাতে রাজী হত। কারণ? রাজপ্রাসাদে উচ্ছপদ লাভ করা! এই শিশ্নচ্ছেদ ঘটানো হত বয়োঃপ্রাপ্তির আগে বা পরে।

এসব কারণেই ইউনাখ দের ইতিবৃত্ত বিচিত্র বলেই মনে হয় ... বাংলায় আমরা ইউনাখ দের বলি ‘খোজা’। খোজা শব্দটি উর্দু, পুরো শব্দটি হল খোজা সারাহ। তবে ইউনাখ কিংবা খোজাকৃত পুরুষরা যে শুধু মধ্যপ্রাচ্যে ছিল তা নয়- এদের প্রাচীন চিনের অভিজাত সমাজেও এদের বিশেষ ভূমিকায় দেখা গিয়েছে। চিনে শিশ্নচ্ছেদ (castration) ছিল একাধারে শাস্তি এবং ইউনাখ করার অন্যতম পদ্ধতি। ষোড়শ সপ্তদশ শতকে সম্রাট কর্তৃক নিয়োগপ্রাপ্ত ইউনাখ ছিল প্রায় ৭০,০০০! চৈনিক ইউনাখ।

এই লেখায় কুড়ি শতকের এক চৈনিক বালকের শিশ্নচ্ছেদ-এর ভয়াবহ বর্ননা ফুটে উঠেছে ...Sun's impoverished family set him on this painful, risky path in hopes that he might one day be able to crush a bullying village landlord who stole their fields and burned their house...His desperate father performed the castration on the bed of their mud-walled home, with no anesthetic and only oil-soaked paper as a bandage. A goose quill was inserted in Sun's urethra to prevent it getting blocked as the wound healed...He was unconscious for three days and could barely move for two months...When he finally rose from his bed, history played the first of a series of cruel tricks on him -- he discovered the emperor he hoped to serve had abdicated several weeks earlier... তবে চিনে ইউনাখ-রা কখনও কখনও রাজনৈতিকভাবেও শক্তিশালী হয়ে উঠেছিল। বিংশ শতকে চিনের অভিজাত সমাজে এদের ভূমিকা হ্রাস পায়। বন্দি নারীদের সামনে দু'জন ইউনাখ কেবল হেরেম পাহারা নয়, আসলে ইউনাখ -রা কাজ করত। যেমন প্রভূর বিছানা তৈরি, গোছল করানো, চুল কাটা, পালকি টানা। ইত্যাদি।

ইংরেজি eunuch শব্দটির উদ্ভব হয়েছে গ্রিক শব্দ eune এবং ekhein থেকে। এর অর্থ - "যে বিছানার দেখাশোনা করে"। এই কারণে ইউনাখ এর হিব্রু প্রতিশব্দ ‘কারিক’-এর ইংরেজি তর্জমা করা হয়েছে ‘অফিসার’ এবং ‘চেম্বারলেইন। ’ মানচিত্রে সুমেরিয় সভ্যতার লাঘাশ নগর। নীচে, ডান দিকে ... আমরা সুমেরিয় সভ্যতার কথা শুনেছি।

সুমেরিয় সভ্যতায় লাঘাশ নামে একটি নগর ছিল। সে নগরের নথিপত্রে প্রথম ইউনাখ-এর কথা জানা গিয়েছে। তার মানে, ইউনাখ রা সভ্যতার সূচনা লগ্ন থেকেই প্রভাবশালী পুরুষের দাসত্ব করত! প্রাচীন গ্রিস ও রোমেও ইউনাখ ছিল; তবে প্রাচ্যের মতন এত প্রবল ভাবে নয়। মানচিত্রে প্রাচীন মিশর। প্রাচীন মিশরেও পুরুষের অঙ্গচ্ছেদ করা হয়।

এবং তিনটি পদ্ধতি অবলম্বন করা হত। (১) পুরুষ জননাঙ্গের অপসারন; (২) কেবল অন্ডকোষের অপসারন; এবং (৩) একত্রে পুরুষাঙ্গ ও অন্ডকোষের অপসারন। প্রাচীন মিশরের নথিপত্র ঘেঁটে দেখা গেছে পুরুষ বন্দিদের অঙ্গচ্ছেদ করে ফারাও-এ কাছে উপস্থাপন করা হত। এ ছাড়া ধর্ষকেরও শাস্তিও ছিল অঙ্গচ্ছেদ। এবং প্রাচীন মিশরের রাজকীয় জেনানামহলে ইউনাখরা নিজ নিজ দায়িত্ব পালন করত।

প্রাচীন মিশরের ইউনাখ এবার মুসলিম বিশ্বের বাদশাদী হারেম-এর সঙ্গে ইউনাখ এর সম্বন্ধ আলোচনা করা যাক। আগেই বলেছিল বাংলায় আমরা ইউনাখ দের বলি খোজা, এবং এটি উর্দু শব্দ, পুরো শব্দটি হল খোজা সারাহ। খোজারা ছিল মূলত হারেমের প্রহরী ও ভৃত্য। হারেম শব্দটি এসেছে আরবি শব্দ ‘হারাম’ থেকে। হারাম অর্থ (আমরা জানি) নিষিদ্ধ।

তবে হারেমের একটি নিরীহ সংজ্ঞা এই রকম: “দি পার্ট অভ আ হাউজ সেট আপার্ট ফর দ্য ওমেন অভ দ্য ফ্যামিলি ইন মুসলিম কান্ট্রি। ” আসলে আমরা জানি হারেমের সংজ্ঞা এত সাদামাটা না। কেননা হারেমের সঙ্গে জড়িত রাজাবাদশাগনের সুপ্ত কামনাবাসনা। যে কারণে আমরা বলি- মুগল হারেম। ‘মুগল হারেমের অন্তরালে’ নামে বাংলায় বিখ্যাত একটি বইই আছে ।

যে বইটি ছোটবেলায় লুকিয়ে পড়েছি। যা হোক। ইন্টারনেটে হারেমের একটি ভয়ানক সংজ্ঞাও পেলাম। “...দ্য কালেকশন অভ ওম্যান হু ওয়্যার এট ফ্রি ডিসপোজাল অভ দ্য মেল ওনার। ” এতক্ষণে বিষয়টি বোঝা গেল! লেখক আরও লিখেছেন: “দ্য ওম্যান অভ দ্য হারেম ওয়্যার নট ওয়াইভস, বাট দেয়ার পজিশন ওয়াজ নট কম্পারাবেল টু দ্যাট অভ আ প্রসটিটিউস।

” এবার আরও ভালো করে বোঝা গেল। আমাদের আলোচ্য খোজারা ছিল তুর্কি কি মুগল হারেমের প্রহরী ও ভৃত্য। তুর্কি হেরেম। হেরেম বলতে চোখে ভাসে অটোমান তুর্কি বাদশাদের হেরেম। যেমন ইস্তানবুলের তোপকাপি প্রাসাদ।

সময়কাল ১৪৬৫/১৮৫৩। প্রাসাদটি ছিল খোজাদের অধীন। তুর্কিদের হেরেমে দু’ধরনের খোজা ছিল। (ক) কৃষ্ণকায়; ও (খ) শ্বেতকায় খোজা। কৃষ্ণকায়রা মূলত আফ্রিকার।

কৃষ্ণকায়রা হেরেমের নারী, অন্যান্য কর্মকর্তা ও নিুশ্রেণির বাঁদিদের দেখাশোনা করত। ইস্তানবুলের তোপকাপি প্রাসাদের শ্বেতকায় খোজারা ছিল মূলত ইউরোপীয় বলকানের-এখনকার বুলগেরিয়া-রুমানিয়া। শ্বেতাঙ্গ খোজারা তোপকাপি প্রাসাদের বিদ্যালয়ের দেখভাল করত ... তবে ১৫৮২ খ্রিস্টাব্দের পর এরা আর হেরেমের অভ্যন্তরে ঢোকার অনুমতি পায়নি। ওটোমান দরবারে গুরুত্বপূর্ন ভূমিকা ছিল প্রধান কৃষ্ণকায় খোজার; এদের বলা হত-চিফ ব্ল্যাক ইউনাখ। চিফ ব্ল্যাক ইউনাখ ছিল হারেমের গুপ্তচর নেটওয়ার্কের কেন্দ্রে ... এবং যে কোনও ধরনের প্রাসাদ ষড়যন্ত্রে তার প্রত্যক্ষ ভূমিকা ছিল।

একটি তুর্কি হেরেম এর অভ্যন্তর ভাগ এবার এ প্রসঙ্গে বাংলা ও ভারতীয় উপমহাদেশের দিকে চোখ ফেরানো যাক। ঐতিহাসিক সিরাজুল ইসলাম লিখেছেন, সংস্কৃতে লেখা নথিপত্র পাঠ করে জানা যায় প্রাচীন বাংলায় শাসকগন হিজড়াদের তাদের অন্দর মহল প্রহরার জন্য নিযুক্ত করত, কখনও খোজাকৃত পুরুষ নিয়োগ করত না। প্রাচীন ভারতেও ওই একই পথা ছিল। এই তথ্যটি আমাদের স্বস্তি দেয়। ঐতিহাসিকেরা এ ব্যাপারে নিশ্চিত হয়েছেন যে বাংলায় এবং ভারতবর্ষে তুর্কি-মুগল শাসনামলের আগে খোজা প্রথার অস্তিত্বই ছিল না।

কাজেই তুর্কি-মুগলরাই ভারতীয় উপমহাদেশে এবং মধ্যযুগের বাংলায় খোজা প্রথার প্রবর্তন করে। বহুবিবাহ ও উপপত্নী (বাঁদি) ও হারেম ব্যবস্থা গড়ে ওঠার কারণে মুসলিম বিশ্বে খোজা ব্যবস্থারও উদ্ভব ঘটে। হারেমের নারীদের ওপর নজর রাখার জন্য খোজাকৃত পুরুষ প্রহরী নিয়োগ করা হত। সাধারণত রণাঙ্গনে বন্দি তরুণ সৈনিকদের খোজা করা হত। (মনে থাকার কথা প্রাচীন মিশরে নথিপত্র ঘেঁটে দেখা গেছে পুরুষ বন্দিদের অঙ্গচ্ছেদ করা হত।

) তাছাড়া দাস ব্যবসায়ীরা দাস বাজার থেকে স্বাস্থ্যবান ও সুদর্শন বালকদের খোজা করে ও প্রাথমিক শিক্ষা দিয়ে রাজকীয় ও অভিজাত হারেমে বিক্রি করত। মুগল হেরেম মুগল যুগে রাজকীয় হারেম বা জেনানামহলে খোজারা গুরুত্বপূর্ন দায়িত্ব পালন করত। এদের কারও কারও অবস্থান ছিল অনেক ওপরে। কোনও কোনও খোজা ছিল খেতাবধারী, বৃত্তিভোগী, যোদ্ধা ও মন্ত্রীদের পরামর্শদাতা। ভারতবর্ষে খোজাপ্রথা গড়ে ওঠে সম্ভবত সুলতানি আমলের গোড়ার দিকে।

চিনা খোজাদের মতো এরাও গুরুত্বপূর্ন দায়িত্ব পালন করত। সুলতান আলাউদ্দীন খলজির (১২৯৬/১৩১৬) অন্যতম বিখ্যাত সেনাপতি ও ওয়াজির মালিক কাফুর ছিলেন একজন খোজা। দিল্লির খোজাদের মতো বাংলার অভিজাতবর্গের খোজারাও প্রশাসনে ঐতিহাসিক দায়িত্ব পালন করে। এদেরই অন্যতম শাহজাদা ওরফে বারবক নামে এক খোজা ১৪৮৭ বঙ্গাব্দে বাংলার মসনদ দখল করে। বাংলার শাসক অভিজাতবর্গের হারেমগুলিতে দেশীয় ও বিদেশি বংশোদ্ভূত খোজারা প্রহরায় নিয়োজিত থাকত।

সুবাহ বাঙালার বাংলার মানচিত্র। ষোড়শ / সপ্তদশ শতকের মুগল শাসিত সুবাহ বাংলা হয়ে উঠেছিল সমগ্র মুগল সাম্রাজ্যের জন্য খোজাদের শীর্ষ যোগানদার। ইউরোপীয় লেখকগন ও বিশিষ্ট মুগল ঐতিহাসিক আবুল ফজল আইন -ই -আকবরী গ্রন্থে এ তথ্য সমর্থন করেছেন । খোজা সরবরাহের একচেটিয়া বানিজ্য করত সিলেট ও ঘোড়াঘাটের সরকারেরা। ঠিক কখন বাংলা এই ব্যবসায় জড়ায় জানা যায়নি।

তবে বাংলাই য খোজাদের অন্যতম উৎস ছিল, আধুনিক ঐতিহাসিকেরা স্বীকার করেন না। কেননা, ভারতবর্ষের যে কোনও স্থানেই খোজাদের “তৈরি” করা যেত এবং প্রয়োজনীয় শল্যবিদ্যা জানা ছিল । তথ্য : বাংলাপিডিয়া ও ইন্টারনেট। ছবি: ইন্টারনেট। বিশেষ দ্রষ্টব্য: ‘হেরেমের কৃষ্ণাঙ্গ ইউনাখ’- এই লেখার শিরোনামের জন্য এই বাক্যটি গ্রহন করেছি ২ জুন ২০১০ সালে দেশ পত্রিকায় প্রকাশিত সুবোধ সরকার রচিত একটি নিবন্ধ (দু’পায়ের নীচে দুই মহাদেশ ) থেকে।


 

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।