আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

মোগল হেরেমের দুনিয়া কাঁপানো প্রেম ১৬ তম পর্ব

আধো আধো জ্যোৎস্না-প্লাবিত রাতে শাহানশাহ নূরউদ্দিন মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর তার ফতেপুর সিক্রির রাজপ্রাসাদের বেদিতে বসে সম্রাজ্ঞীর কাছে সুবে বাংলার কাহিনী শুনতে গিয়ে হঠাৎ কেন জানি আনমনা হয়ে পড়লেন। রাতের দ্বিপ্রহর ইতোমধ্যেই অতিক্রান্ত হয় গিয়েছিল। এ সময় তিনি সাধারণত গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন থাকেন। শাহী হেকিম বারবার তাকে সতর্ক করেছেন যে কোনো মূল্যে রাত দ্বিপ্রহরের আগেই শয্যায় চলে যাওয়ার জন্য। ইদানীং বেশকিছু শারীরিক সমস্যা সম্রাটকে দিন দিন দুর্বল করে দিচ্ছে।

পেটের সমস্যা তার মধ্যে অন্যতম। এর আগে সম্রাটের খাদ্যাভ্যাসে যথেষ্ট পরিবর্তন আনা হয়েছে। তারপরও সমস্যার সমাধান হচ্ছে না। মনের ওপরও মাঝেমধ্যে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলেন। কখনো কখনো ভরা মজলিসে হঠাৎ করেই উদাস হয়ে পড়েন।

স্বাভাবিক ঘটনায়ও ফিক করে হেসে দেন। আবার সামান্য আবেগের দৃশ্য দেখামাত্র অশ্রুসজল হয়ে পড়েন- যা কিনা তার রাজকীয় পদ-পদবির সঙ্গে একেবারেই বেমানান।

সম্রাজ্ঞীর সঙ্গে কথা বলতে বলতে তার হঠাৎ করেই আফসানার কথা মনে পড়ে যায়। তিনি কোনো ভূমিকা না রেখেই বিদায় নেওয়ার জন্য উঠে দাঁড়ালেন। বিয়ের পর এই প্রথম সম্রাটের একটি অদ্ভুত আচরণ সম্রাজ্ঞীর দৃষ্টিগোচর হলো।

তিনি কিছু না বলে শাহানশাহকে বিদায় জানালেন এবং কিছুটা বিষণ্ন মনে নিজ কামরার দিকে পা বাড়ালেন। অন্যদিকে সম্রাটও তার কামরার দিকে এগোতে এগোতে ভাবতে থাকলেন আফসানার কথা। আজ এত বছর পর কেন সেই বিষাদময় স্মৃতি জাগরূক হয়ে সম্রাটের মানসপটকে ভারাক্রান্ত করে তুলল তা তিনি ভেবে পেলেন না। আফসানার সঙ্গে তার প্রথম দেখা হয়েছিল ১৫৯১ সালে ঠিক সেই সময় যখন তিনি তার মহান পিতার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে পরাজিত হলেন। তার সেই বিপদের দিন সম্রাট আকবরের দুই স্ত্রী, রুকাইয়া সুলতান বেগম এবং সালিমা সুলতান বেগম তাকে আশ্রয় প্রদান করলেন।

সম্পর্কে সৎমা হওয়া সত্ত্বেও এই দুই মহীয়সী নারী তাকে যেভাবে আশ্রয় দিয়েছিলেন তা ইতিহাসে একেবারেই বিরল। তাদের প্রখর ধীশক্তিসম্পন্ন সমর্থন এবং কূটনৈতিক প্রচেষ্টার কারণে আকবর শাহজাদা সেলিমকে ক্ষমা করে পরবর্তী উত্তরাধিকারী মনোনীত করতে বাধ্য হন।

বিভিন্ন শারীরিক, মানসিক এবং রাজনৈতিক চাপের কারণে যুবরাজ সেলিম ১৫৯৭ সাল থেকে প্রচণ্ড অস্থিরতার মধ্যে দিন কাটাচ্ছিলেন। বিশেষ করে আনারকলির ঘটনার পর তিনি প্রায়ই বেসামাল হয়ে পড়তেন। দিনের বেশির ভাগ সময় মদ্যপ অবস্থায় মাতলামি করতেন।

কখনো শিকারের কথা বলে সদলবলে বের হয়ে পড়তেন দূর-দূরান্তের বন-জঙ্গলের উদ্দেশে। তারপর সেখান তাঁবু গেড়ে শুরু করতেন আনন্দ-ফুর্তির নামে সীমাহীন অনাচার আর মাতলামি। রাজ্যের নাম করা সুন্দরী দাসী আর নর্তকীরা এ সময় ভিড় করত যুবরাজের তাঁবুতে। আর এই কাজে সহযোগিতা করার জন্য যুবরাজের আশপাশে গড়ে উঠছিল ভয়ানক একটি চক্র। তারা যুবরাজকে মদ আর মেয়ে মানুষের ফাঁদে ফেলে একদিকে যেমন দেদার অর্থবিত্ত লুটপাটের আয়োজন করত, অন্যদিকে তার পিতার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করার জন্য উসকানি দিত।

সাঙ্গোপাঙ্গদের অনবরত উসকানি আর প্ররোচনায় যুবরাজ সেলিম সত্যি সত্যিই পিতার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে বসেন। প্রাণপ্রিয় পুত্রের এহেন জঘন্য আচরণে মহামতি আকবর ভীষণ মানসিক কষ্ট পান। তিনি তখন যথেষ্ট বয়োবৃদ্ধ হয়ে পড়েছিলেন। অন্যদিকে সুবেবাংলা, দাক্ষিণাত্য এবং আফগানিস্তানে চলছিল ভয়াবহ অরাজক অবস্থা। বৃদ্ধ সম্রাট নিজে যুদ্ধ করার জন্য রাজধানী ফতেপুর সিক্রি থেকে বহুদূরে দাক্ষিণাত্যে অবস্থান করছিলেন।

ঠিক সে সময় তিনি যুবরাজের বিদ্রোহের খবর পেয়ে দ্রুত রাজধানীর দিকে ধাবিত হতে থাকেন। ইতিহাসের দুর্ভাগ্য, পৃথিবীর একজন অন্যতম শ্রেষ্ঠ ও মহান শাসককে তার আপন পুত্র এবং সিংহাসনের একমাত্র উত্তরাধিকারীর সঙ্গে সরাসরি সম্মুখযুদ্ধে অংশগ্রহণ করতে হয়েছিল।

যুবরাজের সঙ্গে যুদ্ধে অবতীর্ণ হওয়ার আগে সম্রাট বহু চেষ্টা করলেন বিষয়টি কূটনৈতিকভাবে নিষ্পত্তি করার জন্য। রাজ মহীয়সী যোধাবাইও চেষ্টার ত্রুটি করলেন না।

যুবরাজের প্রভাবশালী মামা ও নানারা বিভিন্নভাবে চেষ্টা করলেন।

সব চেষ্টা ব্যর্থ হওয়ার পর রাজমহীয়সী যোধাবাইয়ের ঐতিহ্যবাহী রাজপুত রক্তে অসম্মানের ছোঁয়া লাগল। তিনি নিজ হাতে মহামতি আকবরকে যুদ্ধের পোশাক পরিয়ে দিলেন প্রাণপ্রিয় পুত্রের বিরুদ্ধে যুদ্ধাভিযানে সম্রাটকে উৎসাহ জোগালেন। মনে মনে প্রতিজ্ঞা করলেন পুত্রকে কোনো দিন ক্ষমা করবেন না। সম্রাট আকবর যুদ্ধের ময়দানে অবতীর্ণ হওয়ার আগে তার ব্যক্তিগত দলিল লেখক ও সংরক্ষণকারী মুন্সী ইফতেখারকে ডেকে পাঠালেন। তারপর পুত্রের উদ্দেশে পত্র লেখার নির্দেশ দিলেন।

আজও পৃথিবীর পিতৃত্বের ইতিহাসে সেই চিঠি অমর হয়ে আছে। সম্রাট লিখলেন_

'আমার প্রাণপ্রিয় সেলিম। আমার কলিজার টুকরা, আমার আকাশের চাঁদ, তোমার বিরুদ্ধে এই বৃদ্ধ বয়সে তলোয়ার হাতে যুদ্ধে নামতে গিয়ে বারবার অসংখ্য স্মৃতি আমাকে তাড়া করে ফিরছে। যে সিংহাসনের জন্য তুমি বিদ্রোহ করছ তা কেবল তোমাকে উপহার দেওয়ার জন্য গত ৩০টি বছর আমি অপেক্ষার প্রহর গুনছি। ১৫৬৯ সালের ৩০ আগস্ট তুমি যখন এই পৃথিবীতে আসলে তখন থেকেই সিংহাসনটি তোমাকে প্রদান করার জন্য আমি নিজ হাতে প্রায়ই ঝাড়পোছ করে আসছি।

তোমার সিংহাসনটি কলঙ্কমুক্ত করার জন্য গত ৩০ বছরের বহু রাত আমি ঘুমাইনি; বহুদিন আমি যুদ্ধক্ষেত্রে দাঁড়িয়ে হাজারো মৃত্যুকে খুব কাছে থেকে দেখেছি। আজ জীবনসায়াহ্নে এক সীমাহীন অব্যক্ত বেদনা আর অপমান নিয়ে আপন ঔরসজাত সন্তানের মুখোমুখি হচ্ছি নিজের এই ব্যর্থ জীবনটি তোমার হাতে বিসর্জন দেওয়ার মানসে।

আজ আমার মনে পড়ছে খাজা নিজামউদ্দিন আউলিয়ার কথা। মনে পড়ছে খাজা সেলিম চিশতির কথা। মহান আল্লাহর অনুগ্রহ লাভের জন্য আমি সেদিন তাদের রুহানি শক্তির সাহায্য কামনা করছিলাম।

আমার প্রার্থনা ছিল একটি পুত্রসন্তান, যাকে আমি হিন্দুস্তানের সিংহাসন উপহার প্রদান করতে পারি। আল্লাহর দয়ায় তুমি ভূমিষ্ঠ হওয়ার পর থেকে বহু যত্ন করে সেই উপহার সংরক্ষণ করে আসছি। প্রতিটি মুহূর্তে কেবল অপেক্ষা করে আসছি কখন উপহারটি হস্তান্তর করব। মোগল রীতি অনুযায়ী আমার মৃত্যুই কেবল সেই ক্ষণটি তোমার কাছে নিয়ে আসতে পারত। মহান আল্লাহপাকের মৃত্যু পরোয়ানা আসার আগেই আমার সন্তানের কাছ থেকে মৃত্যুর এত্তেলা পেয়ে আমি যুদ্ধক্ষেত্রে যাচ্ছি- এই আনন্দ, গর্ব আর সম্মান এখন আমি কোথায় রাখব!

প্রিয় সেলিম, তোমার হয়তো মনে নেই শৈশবের সব স্মৃতি।

যখন তোমার বয়স ৮-৯ বছর ছিল তখন কারণে-অকারণে আমার কাছে ছুটে আসতে। আমার বহু সাধনার ধন শাহজাদাকে কীভাবে ধারণ করতাম তা হয়তো তোমার মানসপটে আজ আর জাগরূক নেই। কিন্তু আমার পিতৃহৃদয় তোমার শরীরের উত্তাপ, সুগন্ধ, চপলতা মাখানো সমধুর হাসি এবং উচ্ছল প্রাণবন্ত ছোটাছুটির শব্দমালা ধারণ করে আছে। যখন আমি ক্লান্ত ও বিধ্বস্ত হয়ে পড়ি তখন তোমার সেসব মধুর স্মৃতি স্মরণ করে নিজেকে বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা করি। আজ এই যুদ্ধপূর্ববর্তী সময়ে আমি আকাশে-বাতাসে কেবল তোমার কলকাকলি শুনতে পাচ্ছি ঠিক যেমনটি তুমি করতে তোমার সেই ৮-৯ বছর বয়সে।

আজকের এই যুদ্ধের ফলাফল আমি জানি না, তবে আমার বাহিনীর অগ্রবর্তী, পাশর্্ববর্তী সব শাখাকে নির্দেশ দেওয়া আছে যাতে কেউ কোনো অবস্থায়ই তোমাকে আক্রমণ বা আহত না করে। আমার প্রতি তোমার কী নির্দেশ জানি না! তবে আমার বড় আকাঙ্ক্ষা হচ্ছে তোমার হাতে নির্মমভাবে মৃত্যুবরণ করার জন্য। কতটা যত্ন আর আদর দিয়ে আমি তোমাকে বড় করে তুলেছি ঠিক ততটা ঘৃণা আর নিষ্ঠুরতা দিয়ে তুমি আমাকে আক্রমণ করে হত্যা কর আর আমি তোমার মুখের দিকে তাকিয়ে বহু বছর আগের আমার সেই শাহজাদার শরীরের ঘ্রাণ অনুভব করতে করতে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ি, এই কামনা বুকে ধারণ করে যুদ্ধক্ষেত্রে রওনা হলাম।

এই চিঠি স্পর্শে আমি ওসিয়ত করে যাচ্ছি- আমার মৃত্যুর পর তুমি যেদিন সিংহাসনে বসবে এবং দিন শেষে তুমি যখন বিশ্রামে যাবে তখন এটি তোমার কাছে হস্তান্তর করা হবে। আর তোমার প্রতি এই বৃদ্ধ অধমের নিবেদন শুধু এই কথাটি মনে-প্রাণে বিশ্বাস কর যে, হিন্দুস্তানের বাদশাহ আকবর তার সন্তান সেলিমকে অনেক অনেক ভালোবাসত।

পৃথিবীর সব ধন-সম্পদের চেয়েও বেশি। ঠিক যেভাবে একজন মরুচারী তৃষ্ণার্ত এক ফোঁটা পানির জন্য মৃত্যুর আগে ছটফট করে তেমনি আমিও তোমার ভালোবাসা আর শ্রদ্ধা পাওয়ার জন্য সারা জীবন ভিক্ষুকের মতো তোমার পানে চেয়েছিলাম।

ও আমার সেলিম! তুমি ভালো থাক! সুখে থাক। ইতি- তোমারই হতভাগ্য পিতা- জালালউদ্দিন মুহাম্মদ আকবর। '

স্বল্পকালীন যুদ্ধে শাহজাদা সেলিমের বাহিনী শোচনীয়ভাবে পরাজিত হয় রাজকীয় বাহিনীর হাতে।

শাহজাদা প্রাণপণ চেষ্টা করেন পালিয়ে যাওয়ার জন্য। কিন্তু রাজকীয় বাহিনীর সুদক্ষ সেনাপতিরা পালানোর সব পথই বন্ধ করে দেন। এক সময় মূল বাহিনী, সঙ্গীসাথীদের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে সম্পূর্ণ একাকী অবস্থায় যুদ্ধক্ষেত্রে সংজ্ঞা হারিয়ে ফেলেন শাহজাদা। যখন জ্ঞান ফিরল তখন লক্ষ্য করলেন তিনি চমৎকার একটি প্রাসাদের ততধিক চমৎকার একটি কামরায় শয্যাগত অবস্থায় রয়েছেন। একটি অপরূপ সুন্দরী মেয়ে তার শিয়রে বসে মাথায় পানির পট্টি দিচ্ছে এবং মাঝেমধ্যে কপালে হাত রেখে তার জ্বরের মাত্রা পরিমাপের চেষ্টা চালাচ্ছে।

শাহজাদা বেহুঁশ থেকে হুঁশে ফিরেও বুঝতে পারলেন না তিনি আসলে কোথায় কিংবা কেনই বা এখানে এসেছেন। সংজ্ঞা হারানোর আগ মুহূর্ত এবং যুদ্ধের ময়দানের পরাজয়ের কথা স্মরণ হওয়া মাত্র তিনি সারা শরীরে তীব্র ব্যথা অনুভব করলেন। এরই মধ্যে তিনি পাশ ফিরে শুতে গিয়ে যন্ত্রণায় চিৎকার করে উঠতেই মেয়েটি সকাতরে ঝুঁকে তাকে সাহায্য করতে গিয়ে শাহজাদার বুকের ওপর হুমড়ি খেয়ে পড়ল। আর শাহজাদাও অনেক দিন পর এক অভাবিত সুযোগ পেয়ে নিজের বুককে ধন্য করলেন।

আরও প্রায় সপ্তাহখানেক পর শাহজাদা সুস্থ হয়ে উঠলেন।

সেবক মেয়েটির সঙ্গে তার চমৎকার একটি সম্পর্ক গড়ে উঠেছে। কাশ্মীরের একটি বনেদি মুসলিম পরিবারের সন্তান আফসানার বয়স এখন ১৮ বছর। গত ৮ বছর ধরে সে শাহজাদার সৎমা রুকাইয়া সুলতান বেগমের প্রাসাদে লালিত-পালিত হয়ে আসছে। যুবরাজ সেলিমের সেবার জন্যই তাকে বিশেষভাবে প্রশিক্ষিত করে লালন-পালন করা হচ্ছিল। কোনো পুরুষ তাকে কখনো স্পর্শ করেনি।

রুকাইয়া বেগমের ইচ্ছা ছিল যে কোনো একটি অনুষ্ঠানের মাধ্যমে তিনি শাহজাদাকে চমকিত করে দেবেন আফসানা নামক প্রকৃতির অপরূপ উপহারটি প্রদানের মাধ্যমে। মোগল রীতি অনুযায়ী ১৮ বছর পূর্ণ না হলে কোনো তরুণী রাজপুরুষদের সেবার জন্য নীত হয় না। আফসানার যখন ১৮ বছর পূর্ব হলো ঠিক তখনই শাহজাদা সেলিম তার পিতার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে বসলেন। আর পরাজিত হয়ে তাকে নিয়তির দায় শোধ করার জন্য আফসানার কাছেই আসতে হলো। শাহজাদা সেলিম আফসানার কাছ থেকে জানলেন যে- সম্রাজ্ঞী রুকাইয়া সুলতান বেগম এবং সম্রাজ্ঞী সালিমা সুলতান বেগম প্রায় পাঁচশত অশ্বারোহীর একটি চৌকস সেনাবাহিনী যুদ্ধের ময়দানে প্রেরণ করেছিলেন আপদকালীন সময়ে শাহজাদাকে উদ্ধার করার জন্য।

যুদ্ধের ময়দানে সংজ্ঞাহীন অবস্থায় পড়ে থাকা শাহজাদাকে উঠিয়ে এনে অতি সঙ্গোপনে সম্রাজ্ঞী রুকাইয়ার প্রাসাদে লুকিয়ে রাখা হয়েছে। অন্য সম্রাজ্ঞী সালিমা সুলতান ছাড়া এই ঘটনা মোগল হেরেমের আর কেউ এখনো জানে না। কূটনৈতিকভাবে পিতা-পুত্রের বিরোধ নিষ্পত্তির জন্য শাহজাদার দুই সৎমা অত্যন্ত আন্তরিকতা নিয়ে অনবরত চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। এরই মধ্যে সকাল-সন্ধ্যায় তারা অসুস্থ শাহজাদাকে সেবা-যত্নও করে যাচ্ছেন। কিন্তু সবচেয়ে বেশি ধকল যাচ্ছে আফসানার ওপর।

এ নিয়ে আফসানার কোনো অনুতাপ নেই। বরং এক ধরনের আত্দতৃপ্তি তাকে যারপরনাই আহ্লাদিত করে তুলছে।

সার্বিক অবস্থা জানার পর শাহজাদা বেশ চিন্তিত হয়ে পড়লেন। অবশ্য রাজমহীয়সী রুকাইয়া সুলতান বেগমের ওপর তার পরিপূর্ণ আস্থা ছিল। কারণ তিনি কেবল সম্রাটের প্রথম স্ত্রীই নন বরং মোগল শাহী খান্দানের প্রথম রাজকুমারী।

সম্পর্কে তিনি সম্রাট আকবরের চাচাত বোন। অর্থাৎ হিন্দাল মির্জার কন্যা। বাদশাহ হুমায়ুনের ভাতিজি এবং সম্রাট বাবরের নাতনি। ১৫৫১ সালে বয়স যখন সবে নয় বছর তখন কাবুলে আকবরের সঙ্গে তার বিয়ে হয়। এর ছয় বছর পর অর্থাৎ ১৫৫৬ সালে আকবর দিলি্লর সিংহাসনে আসীন হলে তিনি প্রধান রাজমহীয়সীর মর্যাদা পান।

ফলে সেই ১৪ বছর বয়স থেকেই তিনি দুর্দান্ত প্রতাপ নিয়ে আজ অবধি মোগল হেরেম শাসন করে আসছেন। সম্রাট আকবরের ওপর রয়েছে তার প্রচণ্ড প্রভাব। অন্যদিকে সালিমা সুলতান বেগমের প্রতি সম্রাট আকবরের ছিল ভিন্ন রকমের এক দুর্বলতা এবং করুণামিশ্রিত শ্রদ্ধাবনত ভালোবাসা। কারণ সম্রাট আকবরের একটি ভুলের জন্য সালিমা সুলতান বেগমকে অন্যের স্ত্রী হিসেবে বেশ কয়েকটি বছর কাটাতে হয়েছিল। শাহজাদা সেলিম তার সৎমায়ের সেই কাহিনী জানার পর অন্তরে ভীষণ আঘাত পেতেন প্রতিবারই যখন তিনি মায়ের সুন্দর মুখখানা স্মরণ করতেন।

সালিমা সুলতান বেগমের কাহিনী শোনার পর শাহজাদা তার পিতার প্রতিও এক ধরনের মমত্ব অনুভব করতেন। রাজনীতির জন্য সম্রাট আকবর যেভাবে নিজের প্রেমকে বিসর্জন দিয়েছেন সেভাবে শাহজাদা সেলিম হয়তো কোনো দিনই পারতেন না। সালিমা সুলতান বেগমও ছিলেন মোগল রাজদুহিতা। সম্রাট বাবর ছিলেন তার নানা। তার মা গুলরাং বেগমের বিয়ে দেওয়া হয়েছিল কনৌজের মোগল শাসনকর্তা নূরউদ্দিন মির্জার সঙ্গে।

সেই হিসেবে বাদশাহ হুমায়ুন এবং শাহজাদা হিন্দাল মির্জা ছিলেন তার মামা। আর বিয়ের আগে সম্রাট আকবরের সঙ্গে তার সম্পর্ক ছিল মামাত-ফুফাত ভাই-বোন। সম্রাটের সঙ্গে তার বয়সের পার্থক্য ছিল মাত্র ৩ বছর ৭ মাস।

বহুদিন থেকেই সম্রাট আকবর সালিমাকে পছন্দ করে আসছিলেন। তাদের মধ্যে ছিল চমৎকার একটি প্রেমময় সম্পর্ক।

কিন্তু এই সম্পর্কের কথা তারা দুজন ছাড়া অন্য কেউ জানত না। হুমায়ুনের মৃত্যুর পর সেনাপতি বৈরাম খানের অভিভাবকত্বে সম্রাট আকবর রাজ্য চালাতে থাকেন। তখন পর্যন্ত তার একজনই স্ত্রী ছিলেন। দ্বিতীয় স্ত্রী হিসেবে তিনি তার প্রেমিকা তথা ফুফাত বোনকে গ্রহণ করার জন্য অধীর আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করছিলেন। কিন্তু একের পর এক যুদ্ধবিগ্রহ আর বহুমুখী এবং নিত্যকার ভয়াবহ প্রাসাদ ষড়যন্ত্রের কারণে বিয়ের সুযোগ করে উঠতে পারছিলেন না।

এরই মধ্যে সালিমা সুলতানের বয়স ১৮ তে পড়ে। আর তখনই ঘটে সেই দুর্ঘটনা।

সালতানাতে মোগলের প্রধান সিপাহসালার, সম্রাটের অভিভাবক এবং দিলি্ল-আগ্রা-ফতেপুর সিক্রির রাজদরবারের প্রধান অমাত্য সেনাপতি বৈরাম খান একদিন সালিমা সুলতানকে একনজর দেখামাত্র তার প্রেমে পড়ে যান। বৈরাম খানের বয়স তখন ৫১ বছর আর সলিমার মাত্র ১৮। সমগ্র সাম্রাজ্যে তখন বৈরাম খান ছিলেন অপ্রতিরোধ্য এবং প্রায় সর্বক্ষেত্রে স্বয়ং সম্রাটকে তার মুখাপেক্ষী হয়ে থাকতে হতো।

এই অবস্থায় বৈরাম খান যখন সালিমাকে দ্বিতীয় স্ত্রী হিসেবে বিয়ে করার জন্য সম্রাটের অনুমতি চাইলেন তখন রাজ্যের বিষাদ আর অপারগতার বোঝা মাথা পেতে নিয়ে আকবরকে তা মঞ্জুর করতে হলো। নিজের প্রেয়সীকে অন্যের হাতে তুলে দেওয়ার বেদনা সম্রাট আকবর মৃত্যুর পূর্বক্ষণ পর্যন্ত ভুলতে পারেননি। এই অবস্থায় ১৫৫৭ সালের ডিসেম্বর মাসে বেরাম খানের সঙ্গে সালিমার বিয়ে হয়ে যায়।

ট্র্যাজেডির নায়িকা হয়ে বৈরাম খানের ঘর করতে গিয়ে সালিমা একদিনের জন্যও সুখী হতে পারেননি। অন্যদিকে সম্রাট আকবরও সালিমার শোকে পাগলপ্রায় হয়ে পড়েন।

তার আচার-আচরণে অসংলগ্নতা দেখা দেয়। এভাবেই কেটে যায় ৩টি বছর। ১৫৬১ সালে বৈরাম খান আততায়ীর হাতে নিহত হওয়ার পরপরই সম্রাট তার প্রেয়সীকে কালবিলম্ব না করে স্ত্রী হিসেবে ঘরে তোলেন। তিন বছরের দাম্পত্য জীবনে বৈরাম খানের ঔরসে কোনো সন্তান-সন্ততির মা হননি সালিমা। আকবরের সঙ্গে বিয়ের নয় বছরের মাথায় অর্থাৎ ১৫৭০ সালে তিনি শাহজাদা মুরাদের জন্মদাত্রী হন।

নিজ সন্তানের জন্য তিনি কখনো ভুলেও সিংহাসনের দাবি করেননি। বরং শাহজাদা সেলিমকে তিনি শাহজাদা মুরাদের তুলনায় ভালোবাসতেন এবং সিংহাসনের উত্তরাধিকারী হিসেবে সেলিমকে মনোনয়ন দানের জন্য সর্বদা চেষ্টা-তদবির করতেন।

বড়মা রুকাইয়া সুলতানের প্রাসাদে কার্যত আত্দগোপনে থাকা শাহজাদা শারীরিক অসুস্থতার পাশাপাশি বিষণ্নতায় ভুগছিলেন। তার দুই সৎমা সম্পর্কে যতই ভাবছিলেন- ততই তাদের প্রতি শ্রদ্ধাবনত হয়ে পড়ছিলেন। অন্যদিকে, পিতার বিরুদ্ধে কৃত বিদ্রোহ নিয়েও তার অনুশোচনার অন্ত ছিল না।

সারা দুনিয়ার মানুষ জানে যে, তিনি কেবল ক্ষমতা লাভের জন্য তার মহান পিতার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছেন। অথচ আসল ঘটনা ছিল সম্পূর্ন ভিন্ন। তিনি এখন বুঝতে পারছেন যে, রাজদরবারের একটি প্রভাবশালী কুচক্রী মহল যারা দীর্ঘদিন ধরে শত চেষ্টা করেও সম্রাটের খবরদারির জন্য তাদের পছন্দমাফিক অনৈতিক

কর্ম করতে এবং অবৈধ সুযোগ গ্রহণ করতে ব্যর্থ হয়ে তার দ্বারস্থ হয়েছিলেন এই আশায় যে, মাতাল যুবরাজ হিন্দুস্তানের সম্রাট হলে তারা অতি সহজেই অপকর্মগুলো করতে পারবে। [চলবে]

 

 

সোর্স: http://www.bd-pratidin.com/

এর পর.....

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.