আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

একটি ফুটবলের আত্মকাহিনী

আমি চিরদুর্দ্দম, দুর্বিনীত, নৃশংস, মহা- প্রলয়ের আমি নটরাজ, আমি সাইক্লোন, আমি ধ্বংস, আমি মহাভয়, আমি অভিশাপ পৃথ্বীর! আমি দুর্ব্বার, আমি ভেঙে করি সব চুরমার! আমি অনিয়ম উচ্ছৃঙ্খল, আমি দ'লে যাই যত বন্ধন, যত নিয়ম কানুন শৃংখল! আমি মানি নাকো কোনো আইন, আমি ভরা-তরী
আমার নাম ফুটবল। আপনারা সবাই এটা জানেন তারপরও বললাম। কিন্তু আমার বাংলা নামটা কি সেটা কেউ কি জানেন? অবশ্য আমি নিজেও আমার বাংলা নামটা জানি না। সম্ভবত আপনারাও জানেন না। কারণ,যদ্দুর জানি বাংলায় কেউ আমাকে চেনে না।

ইংরেজি নাম ‘ফুটবল’ বললেই একশো বছরের বুড়ো থেকে এক বছরের পোলাপানও আমাকে চিনবে। বাদ দিলাম। নাম নিয়ে চেঁচামেচি করে বেশি ঘাম ছোটাতে চাইনে। কামের কথাই হল আসল কথা। আপনারা তো জানেনই আমার কাম কি! তারপরও বলি-আমার কাম হল শুধু লাথি খাওয়া।

শুনতে ক্যামন যেন লাগলেও এটাই সত্য। আমি আর কি বলব, আপনি নিজেই চিন্তা করে দ্যাখেন, আমাকে যদি পায়ের কাছে পড়ে থাকতে দ্যাখেন আপনার নিজেরও কি আমার পিঠে দুটো লাথি কষতে ইচ্ছা করে না? আপনি নিজেও কি লাথি মারেন না? অবশ্যই মারেন। সুতরাং, আমি লাথি খাই বলে আপনার মন খারাপ করার কিছু নেই। কারণ, আমার কাজই এটা। আপনি আমাকে লাথি মেরে খুশি হলে আমিও লাথি খেয়েই খুশি।

জšে§র পর আজ অবধি একটা বিষয় কিছুতেই আমার মাথায় ঢোকে না। কোনওদিন ঢুকবেও বলে মনে হয় না। ঠিক আমারই প্রজাতি, আমারই জমজ ভাইয়ের মতো দেখতে, অথচ ওদের একজনকে মানুষ ‘ভলিবল’ আরেকজনকে ‘হ্যাণ্ডবল’ বলে ডাকে ক্যান? রাগবীর কথা না হয় বাদই দিলাম। কারণ, ওইটা দেখতে নারকেলের মতো। সুতরাং আমি নিজেও ওইটাকে আমার ভাই-বেরাদার হিসেবে স্বীকার করি না।

আমার জš§ চীনে হলেও আমি যদ্দুর জানি, আমার মাতৃভূমি এই দেশটা ফুটবল খেলায় মোটেও সুবিধার নয়। প্রথম বিশ্বকাপ হতে শুরু করে আজ অবধি কোনও বিশ্বকাপেই তারা চান্স পায় নি। অদূর ভবিষ্যতেও কোনওদিন চান্স পাবে বলে মনে হচ্ছে না। এ দুঃখ আমার অনেক দিনের। মাতৃভূমি বলে কথা।

ক্যামন করে মায়া ভুলি বলেন? ফুটবল বলে আমাকে কেউ কিন্তু হেয় করার চেষ্টা করবেন না। কারণ, কি টেলিভিশন কি পত্রিকা, খুললেই তো দেখতে পান আমাকে নিয়ে কোটি কোটি মানুষের মধ্যে কি পরিমাণ মাতামাতি। নির্দিধায় তাই আমিও বলতে পারি, সম্ভবত আমিই পৃথিবীর সবচেয়ে জনপ্রিয় ব্যক্তি, ওহ! স্যরি, আমি তো আর আপনাদের মতো ব্যক্তি না, আমি হলাম বস্তু! আপনারা তো দেখেছেন, মাঠে আমাকে একবার পেলেই হয়। ব্যস আমার পিছে ছুটে-দৌড়িয়ে মানুষের আমাকে নিয়ে সে কি কাড়াকাড়ি! বিষয়টা ভাবতে আমার নিজেরও ভালো লাগে। আমি যে একটা বিরাট স্টার, আইমিন মহাতারকা, সেইটা ঠিকই বুঝতে পারি।

গর্বে আমার বুকটাও হাতখানেক ফুলে ওঠে। আজ সারাবিশ্বে আমার কত যে কদর সেটা আর চোখে আঙ্গুল দিয়ে কাউকে দেখিয়ে দিতে হয় না। আজ আমার কারণেই, এক ক্লাব থেকে অন্য ক্লাবে একজন প্লেয়ার কোটি কোটি ডলারে বিক্রি হচ্ছে। আমি না থাকলে তাদের কি কানাকড়ি মূল্যও ছিল? তাছাড়া আমি যদি আবিষ্কৃত নাই হতাম তবে পেলে, ম্যারাডোনা, রোনালদো, জিদানকে কে চিনত বলেন? সুতরাং এই কথাটা মনে রাখবেন দলের চেয়ে যেমন দেশ বড় তেমনি পেলে, ম্যারাডোনার চেয়ে ফুটবল বড়। মাঠে বরাবরই আমিই সবার মধ্যমণি।

আমার চারপাশে নেচেই আজ ব্রাজিলের মতো দল নাম্বা নাচের দেশ হিসেবে বিখ্যাত। আমি আছি বলেই প্রতি বিশ্বকাপে চারদিকে বিভিন্ন দেশের অজস্র ফ্ল্যাগের ছড়াছড়ি দেখা যায়। এইসব কৃতিত্ব শুধুই আমার। এটা কিন্তু সত্য কথা, আমাকে দু’চারটে লাথি মারেন নাই এমন মানুষ সম্ভবত ইহজগতে নেই। শুধু তাই না।

মানুষের কথা না হয় বাদ দিলাম, শুনেছি আজকাল নাকি কুকুর, বিলায় থেকে শুরু করে সার্কাসের হাতি পর্যন্ত ফুটবল খেলে। তাহলে চিন্তা করেন, সর্বস্তরের প্রাণিকুলে আমার কদর কত? সবচেয়ে বিস্ময়কর ব্যাপার কি জানেন, মানুষের চিকন পা থেকে শুরু করে ইয়া বিশাল সাইজের হাতির থামের মতো পায়ের নিচে পড়তে কিংবা লাথি খেতেও আমার একটুও ভয় করে না। ছোট হলে কি হবে, আমার কিন্তু অত্যাধিক সাহস। তা না হলে দ্যাখেন কেউ আমাকে একটা লাথি দিলে চোখের পলকেই আমি কয়েক’শ হাত উপরে উঠে আবার ধপাস করে মটিতে পড়ে ডিগবাজি খেতে থাকি, তারপরও কিন্তু আমার কিছু হয় না। আমার জায়গায় একজন মানুষ কিংবা অন্য কোনও প্রাণীর কথা চিন্তা করে দ্যাখেন অত উঁচুতে উঠে আবার এমন নিচে পড়ে সে কি আমার মতো অমন নেচে নেচে ডিগবাজি খেলতে পারবে? তাকে তো হাসপাতালে নেওয়ারও টাইম পাবেন না? কারণ, সে তো তখনই স্পট ডেডের খাতায় নাম লেখাবে।

সবচেয়ে মজা লাগে কিসে জানেন? সারা মাঠে আমি একা আর আমার টিকিটি ধরার জন্যে বাপের নাম ভুলে ঘাম ছুটিয়ে মরে কুড়ি, বাইশজন লোক। একটা বিষয়ে আফসোসও হয়, আমার পিছে দৌড়ে প্লেয়ারদের যে কেউ ফুটবলে লাথি দেওয়ার চান্স পেলেও রেফারি নামক বেচারা সারামাঠ আমার পিছে ফ্যা ফ্যা করে ঘুরে মরে ঠিকই কিন্তু একটাও লাথি কষতে পারে না। ইস! কি দুঃখ! আবার খারাপ লাগে, যখন আমাকে লাথি মারার ছলে কোনও প্লেয়ার অন্য আরেক প্লেয়ারের পায়ের মধ্যে পা ঢুকিয়ে লাথি-ধাক্কা-গুঁতো মারে আর লালকার্ড-হলুদ কার্ড পায়। আমার কিন্তু তখন কিছুই করার থাকে না। কারণ, যা করার রেফারি নামক লোকটাই করে।

সে নিজে কখনও পা দিয়ে বলে লাথি মারতে পারে না বলেই হয়তো ঈর্ষাপরায়ণ হয়ে এই কাজটা করে বলে আমার মনে হয়। ফুটবল হওয়ার কারণে প্রথম প্রথম আমার একটু খারাপই লাগত। যেই লোকটা আমাকে তৈরি করেছে, মনে মনে আমি তাকে খুঁজে বেড়াতাম। আমি তার কি ক্ষতি করেছিলাম যে, সে আমাকে ফুটবল বানালো আর এখন আমার সারাজীবন লাথি খেয়ে ছুটতে হয়। এখন কিন্তু আর কাউকে খুঁজি না।

মানুষ আমাকে নিয়ে আনন্দ পাচ্ছে, এটাই সব থেকে বড় কথা। এই সহজ কাজটাই কয়জন করতে পারে বলেন? আমি পারি, এটাই আমার জšে§র স্বার্থকতা। কিন্তু মানুষের একটা আচরণ আমাকে খুবই কষ্ট দেয়। সেটা হল, এই মানুষই মাঠে আমাকে তার নিজের স্বার্থে বিভিন্নভাবে ব্যবহার করে। কখনও মাথায় তুলে হেড মারে, কখনও বুক দিয়ে ঠ্যাকায়, সবশেষে আবার পা দিয়ে কষে লাথিই মারে।

হায় রে মানুষ! এদের যে বুদ্ধিশুদ্ধি হবে কবে? আমারেও ঠিকমতো চিনবার পারল না! বিচ্ছু থেকে নেওয়া
 

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.