আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

মীরজাফর জামাতা সেনাপতি মীর কাশেমের চেহারার সঙ্গে (একমাত্র দাড়ি ছাড়া) সেনাপতি জিয়াউর রহমানের চেহারা-চরিত্রের অদ্ভুত সাদৃশ্য।



আজ তেসরা জুলাই : এরই পুনরাবৃত্তি কি পনেরোই আগস্ট নয়? গাছে যেমন পুরনো পাতা ঝরে যায় এবং নতুন পাতা গজায়, ইতিহাসেও তেমনি অনেক স্মরণীয় দিন ঝরে যায়, সেখানে নতুন স্মরণীয় দিন এসে যুক্ত হয়। তেসরা জুলাইও আমাদের জাতীয় জীবনের, জাতীয় ইতিহাসের তেমনি একটি স্মরণীয় দিন ছিল, যা বহুকাল ধরে বিস্মৃত। তেসরা জুলাইয়ের এই ট্র্যাজিক দিনটিকে পনেরোই আগস্টের আরেকটি মহাট্র্যাজিক দিন এসে ঢেকে দিয়েছে। ১৭৫৭ সালের তেসরা জুলাই এবং ১৯৭৫ সালের পনেরোই আগস্টের ন্যাশনাল ট্র্যাজেডির মধ্যে সাদৃশ্য এত বেশি যে, অনেক সময় বিস্মিত হয়ে ভাবতে হয়, দুটি ঘটনার একটি আরেকটির পুনরাবৃত্তি কি-না? একই চরিত্রের লোক দ্বারা দুটি ঘটনাই সংঘটিত হয়েছে কি-না? আজ ২০১০ সালের ৩ জুলাই। আগের দিন সকালে ঘুম ভাঙতেই দিনটির কথা মনে পড়েছে।

১৭৫৭ সালের ২৩ জুন হয়েছিল পলাশীর যুদ্ধ আর দশ দিন পর ৩ জুলাই তারিখে ষড়যন্ত্র দ্বারা পরাভূত বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজউদ্দৌলাকে অন্ধ বন্দিশালায় নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছিল। পাকিস্তান আমল থেকে এ দিনটি আর পালন করা হয় না। কিন্তু ব্রিটিশ আমলে অবিভক্ত বাংলার হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে সব মানুষ এ দিনটিকে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করত, স্কুল-কলেজে দিবসটি জাতীয় শোক দিবসের মতো পালিত হতো। অসংখ্য স্মরণসভা অনুষ্ঠিত হতো। আমরা যারা ব্রিটিশ আমলে জন্মেছি, তাদের কাছে তেসরা জুলাই একটি বিস্তৃত দিবস নয়।

আমার মনে আছে, শৈশবে স্কুলজীবনে শহীদ নবাব সিরাজউদ্দৌলা স্মরণে স্কুলের অনুষ্ঠানে আমরা নজরুলের একটি কবিতা অবশ্যই সমস্বরে পাঠ করতাম। তার কয়েকটি বিখ্যাত চরণ হলো_ "কাণ্ডারী! তব সম্মুখে ঐ পলাশীর প্রান্তর, বাঙালীর খুনে লাল হ'ল যেথা ক্লাইবের খঞ্জর! ঐ গঙ্গায় ডুবিয়াছে হায়, ভারতের দিবাকর! উদিবে সে রবি আমাদেরি খুনে রাঙিয়া পুনর্বার" বাংলার স্বাধীনতা-হরণকারী ব্রিটিশ হানাদার কোলাবরেটর, বিশ্বাসঘাতক, দেশদ্রোহী মীরজাফরের দল তরুণ সিরাজউদ্দৌলাকে শুধু হত্যা করেই ক্ষান্ত হয়নি, তার চরিত্রহননের জন্য একদল লেখক, ইতিহাসবিদ এবং বুদ্ধিজীবীকেও ভাড়া করেছিল। তাদের মধ্যে বাঙালিও ছিলেন। কেন, নবীন সেনের মতো মহাকবিকে দিয়ে কি 'পলাশীর যুদ্ধ' নামে মহাকাব্য লেখানো হয়নি এবং সিরাজ-চরিত্রে জঘন্য কালিমা লেপন করা হয়নি? সিরাজ-হত্যার দুইশ' বছর পরও কি আমরা বাংলাদেশে আমাদের নেশন স্টেটের স্থপতি শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যার পর একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি লক্ষ্য করছি না? বদরুদ্দীন উমর থেকে ফরহাদ মজহার এবং বিএনপি-ঘরানার খ্যাত-অখ্যাত অনেক লেখক-সাংবাদিকই কি গত পঁয়ত্রিশ বছর ধরে পরম নিষ্ঠায় মুজিব-চরিত্রে অনবরত কালিমা লেপনের কাজটি করে চলছেন না? ব্রিটিশ শাসকরা সিরাজ চরিত্রকে চিরকলঙ্কিত করে রাখার জন্য তার ওপর কলকাতা দুর্গ আক্রমণকালে বন্দি ইংরেজ সৈন্যদের একটি অন্ধকূপে আটক রেখে মৃত্যুবরণে বাধ্য করেছিলেন বলে মিথ্যা এবং বানোয়াট কলঙ্ক আরোপ করে মৃত ইংরেজ সৈন্যদের স্মরণে কলকাতায় একটি স্মৃতিসৌধ তৈরি করে তার নাম দেন ব্ল্যাকওয়েল মনুমেন্ট। গত শতকের চলি্লশের দশকের একেবারে গোড়ায় (সম্ভবত ১৯৪০ কি '৪১ সালে) নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসু সিরাজ চরিত্রের এই কলঙ্ক মোচনের জন্য আন্দোলন শুরু করেন এবং একদিন আইন অমান্য করে এক বিরাট মিছিলসহ পুলিশের বাধা অগ্রাহ্য করে এই মনুমেন্ট ভেঙে ফেলেন।

বিস্ময়ের কথা, সুভাষ বসুর এই মিছিলে তখনকার যে দু'জন তরুণ মুসলিম ছাত্রনেতা ছিলেন, তাদের একজন পরবর্তীকালে সিরাজের ভাগ্যবরণকারী শেখ মুজিবুর রহমান এবং অন্যজন চাটগাঁর ফজলুল কাদের চৌধুরী। সিরাজ-হত্যায় দেড়শ' বছরের বেশি সময়ের পর তার চরিত্রে আরোপিত মিথ্যা কলঙ্ক ও অপবাদ গবেষণার সাহায্যে খণ্ডন করেন বিখ্যাত পণ্ডিত অক্ষয় কুমার মৈত্রেয়। মুজিব-হত্যার পর পঁয়ত্রিশ বছর কেটে গেছে। জানি না, এই গ্রিক ট্র্যাজেডির হিরোকে নানা মিথ্যা অপবাদ ও কলঙ্ক থেকে মুক্ত করার জন্য বাংলাদেশে আরেকজন অক্ষয় কুমার মৈত্রেয়ের আবির্ভাব হবে কবে? ২০০৪ সালে 'পলাশী থেকে ধানমণ্ডি' শীর্ষক ডকুড্রামাটির ভিডিও তৈরির শুটিং উপলক্ষে আমি মুর্শিদাবাদেও গিয়েছিলাম। আমার সঙ্গে ছিলেন বিখ্যাত শিল্পী-দম্পতি সৈয়দ হাসান ইমাম-লায়লা হাসান, আমিনুল হক বাদশা এবং আরও অনেকে।

খোশবাগে নবাব আলিবর্দীর কবরের পাশেই তার নাতি নবাব সিরাজউদ্দৌলার কবর। পায়ের দিকে আলেয়ার কবরসহ আরও দু'একটি কবর। আমি সিরাজউদ্দৌলার কবরের শিয়রে মূর্ছাহতের মতো বসে ছিলাম এক ঘণ্টার ওপর। এই একই অনুভূতি আমার মনে জেগেছিল ১৯৯৩ সালে আমি যখন টুঙ্গিপাড়ায় বঙ্গবন্ধুর সমাধিতে (তখনো বর্তমান স্মৃতিসৌধ তৈরি হয়নি) প্রথম যাই। মূর্ছাহতের মতো বঙ্গবন্ধুর সমাধির শিয়রেও এক ঘণ্টার মতো বসে ছিলাম।

উঠতে গেলেই মনে হয়েছে বঙ্গবন্ধু বলছেন, আরেকটু বসো। কতকাল পরে এলে? মুর্শিদাবাদে শহীদবাগে গিয়ে আমার চোখে পানি এসেছে। শহীদবাগ একটি গণকবর। পাশাপাশি ৯টি কি ১০টি কবর। সেখানে রাসেলের মতো দশ বছরের এক বালকের কবরও আছে।

তারা সবাই নবাব সিরাজউদ্দৌলার নিকট আত্মীয়। কিন্তু কেউ সিরাজউদ্দৌলার সরকার ও দেশ শাসনের সঙ্গে জড়িত ছিলেন না। তথাপি মীরজাফর পুত্র শয়তান মীরন এদের আমন্ত্রণ জানিয়ে মুর্শিদাবাদে এনে খাবারের সঙ্গে বিষ মিশিয়ে হত্যা করে শহীদবাগে তাদের গণকবরের ব্যবস্থা করেছিল। এ কবরগুলো দেখার সঙ্গে সঙ্গে আমার মনে পড়েছে ঢাকায় বনানীর গোরস্তানে গণকবর বা পাশাপাশি ৯-১০টি কবরের কথা। যেখানে নৃশংসভাবে হত্যা করে জাতির জনকের পত্নীসহ তার ছেলে, ছেলে-বৌ, ভাগিনা, ভগি্নপতি, শিশুপুত্র রাসেল এবং তিন জাতীয় নেতাকেও পাশাপাশি শুইয়ে রাখা হয়েছে।

কী বিস্ময়কর সাদৃশ্য! মুর্শিদাবাদের শহীদবাগে দাঁড়িয়ে আমার মনে হয়েছে ঢাকায় বনানীর গোরস্তানে দাঁড়িয়ে রয়েছি। এই বয়সেও আমার চোখে পানি এসেছে। ১৭৫৭ সালের পলাশী এবং ১৯৭৫ সালের ধানমণ্ডির ঘটনা বিন্যাসের মধ্যে শুধু নয়, চরিত্র বিন্যাসের দিকে তাকালেও এক বিস্ময়কর সাদৃশ্য লক্ষ্য করি। পলাশীর যুদ্ধের দুইশ' বছরেরও বেশি সময় পর যেন বাংলাদেশে একই ট্র্যাজেডি এবং তার নায়ক ও খলনায়করা আবার জীবন্ত হয়ে উঠেছিলেন। বঙ্গবন্ধুকে যদি নবাব সিরাজের আসনে বসাই, তাহলে মীরজাফরের স্থানে অনায়াসে খন্দকার মোশতাক আহমদকে বসানো যায়।

মীরজাফর পাগড়ি পরিধান করতেন। মোশতাক পরতেন টুপি। নইলে দাড়ি, চেহারা ও চরিত্রে দারুণ মিল। মীরজাফর জামাতা সেনাপতি মীর কাশেমের চেহারার সঙ্গে (একমাত্র দাড়ি ছাড়া) সেনাপতি জিয়াউর রহমানের চেহারা-চরিত্রের অদ্ভুত সাদৃশ্য। মীর কাশেম সিরাজউদ্দৌলাকে হত্যা করেননি।

কিন্তু তাকে ভগবানগোলা থেকে ধরে আনার জন্য পরে সসৈন্য অভিযান চালিয়েছিলেন। জেনারেল জিয়াউর রহমানও মুজিব হত্যায় সরাসরি জড়িত ছিলেন না বলে দাবি করা হয়। কিন্তু হত্যাকারীদের সঙ্গে তার যে যোগাযোগ ছিল এবং তাদের তিনি পরোক্ষভাবে উৎসাহ জুগিয়েছেন, তার তো অনেক প্রমাণ এখন পাওয়া যায়। আমি মুর্শিদাবাদে গিয়ে বিস্ময়কর মিল খুঁজে পাই ভগবানগোলার ভণ্ডপীর এবং বর্তমান বাংলাদেশের জামায়াত নেতা গোলাম আযমের চেহারা ও চরিত্রের মধ্যে। নবাবকে সপরিবারে মীর কাশেমের সৈন্যদের হাতে ধরিয়ে দেওয়ার পর ভগবানগোলার পীর তার আস্তানা থেকে পালিয়ে গিয়েছিলেন।

বেশ কিছুকাল এখানে-সেখানে ঘোরাঘুরির পর তিনি বুড়ো হয়েছেন এবং জনক্রোধ তাকে স্পর্শ করবে না ভেবে পুরনো আস্তানায় ফিরে এসেছিলেন। স্থানীয় জনক্রোধই তাকে হত্যা করে বলে একটি সূত্র থেকে জেনেছি। মীরজাফর মারা গিয়েছিলেন কুষ্ঠরোগে। মোশতাক আহমদ দীর্ঘকাল নিজের তালামারা ঘরে স্বেচ্ছাবন্দি হয়ে থাকার সময় রোগে-শোকে মারা যান। তার জানাজা অনুষ্ঠানও সম্ভব হয়নি।

মীর কাশেম বক্সারের যুদ্ধে ইংরেজদের কাছে পরাজিত হওয়ার পর তার দুই ছেলে ও মেয়ে গুল ও বাহারকে নিয়ে পালিয়ে যান। তার এবং তার লাশেরও কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি। কেউ কেউ বলেন, বহুকাল পর দিলি্লর রাস্তায় একটি মৃতদেহ পড়ে থাকতে দেখা গেছে। তার চোগা-চাপকান খুঁজে প্রমাণ পাওয়া গেছে, ওই মৃতদেহ মীর কাশেমের। বর্তমান বাংলাদেশের জিয়াউর রহমানের মতো তিনি লক্ষ্মীট্যারা ছিলেন।

জিয়াউর রহমানও চট্টগ্রামে নিহত হওয়ার পর দু'তিন দিন তার লাশ খুঁজে পাওয়া যায়নি। পরে জঙ্গলের গর্তে পুঁতে রাখা তার মৃতদেহ (?) উদ্ধার করতে হয়েছে। মীরজাফর পুত্র শয়তান মীরনের মৃত্যু হয়েছে মুঙ্গের শহরে বাইজি নিয়ে প্রমোদ রজনীযাপনের সময় আকস্মিক বজ্রপাতে। সিরাজ-হত্যার প্রধান চক্রান্তকারী জগৎশেঠ, রায়দুর্লভ ও ইয়ার লতিফকে মাঝনদীতে নিয়ে নৌকাডুবি ঘটিয়ে মারা হয়েছিল। আর এ যুগে মুজিব-হত্যা চক্রান্তের অন্যতম পালের গোঁদা মাহবুব আলম চাষীর মর্মান্তিক মৃত্যু হয়েছে সৌদি আরবে নিজের গাড়িতে জ্বলন্ত গ্যাসের আগুনে পুড়ে।

ইতিহাসের এসব ঘটনা, সবই কি কাকতালীয় ব্যাপার? সিরাজ-হত্যা চক্রান্তের অন্যতম প্রধান নায়িকা কাশিমবাজার কুঠিতে বসে যিনি ষড়যন্ত্রের কলকাঠি নাড়তেন তিনি ছিলেন ঘসেটি বেগম। সিরাজ-হত্যার পর বহুকাল তিনি বেঁচে ছিলেন। কিন্তু তার শেষ পরিণতি হয়েছিল বড়ই অশুভ। তার এ যুগের রূপকল্পও ক্যান্টনমেন্টে বসেই ষড়যন্ত্রের রাজনীতির কলকাঠি নাড়েন। তার ভাগ্যেও কী আছে, তা অনুমান করা যায়, বলার সময় এখনও আসেনি।

সব কথার শেষ কথা, আজ তেসরা জুলাই। শহীদ নবাব সিরাজউদ্দৌলার দুইশ' তেপ্পান্নতম মৃত্যুবার্ষিকী। এই জাতীয় বীরকে আবার শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করার ব্যবস্থাটি বাংলাদেশে পুনঃপ্রবর্তিত হওয়া উচিত। কলকাতাসহ পশ্চিমবঙ্গের কয়েকটি স্থানে প্রতি বছর তেসরা জুলাই এখনও পালিত হয়। বাংলাদেশে সরকারিভাবে পালিত হওয়া উচিত।

ব্রিটিশ আমলেও পুরান ঢাকায় একটি সিরাজউদ্দৌলা পার্ক ছিল। এখনও নিশ্চয়ই আছে। কী অবস্থায় আছে জানি না। ঢাকা সিটি করপোরেশনের উচিত এটির সংস্কার ও সম্প্রসারণ করা। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে আমার অনুরোধ, নবাব সিরাজউদ্দৌলার নামকে শীর্ষ জাতীয় বীরদের তালিকাভুক্ত করে সরকারিভাবে তাকে স্মরণ ও তার স্মৃতিরক্ষার ব্যবস্থা করুন।

বর্তমানের ঘসেটি বেগমেরা তাদের ক্ষমতার স্বার্থে ভুয়া শহীদ নিয়ে মাতামাতি করবেন; জাতীয় স্বার্থে প্রকৃত শহীদ ও জাতীয় বীরকে তারা সম্মান দেখাবেন না, তাদের স্মৃতি রক্ষারও ব্যবস্থা করবেন না। আমাদের প্রস্তাবিত স্বাধীনতা স্তম্ভের পাশাপাশি একটি পলাশী স্তম্ভও নির্মাণ করা উচিত। (সমকাল)

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.