আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

মিশেল ফুকোর বাতি জ্বালানি - সলিমুল্লাহ খান ( শেষ পর্ব )

পতন আবশ্যক ...............
মিশেল ফুকোর বাতি জ্বালানি - সলিমুল্লাহ খান ( প্রথম পর্ব) এর লিঙ্ক মিশেল ফুকোর বাতি জ্বালানি - সলিমুল্লাহ খান ( দ্বিতীয় পর্ব) এর লিঙ্ক ৫ এইটা বলে যদি তিনি পার পেতেন, তাহলে আমরা আর তাঁকে নিয়ে আলোচনা করতাম না। কিন্তু, তিনি কিছু সমস্যা রেখে গেছেন। সেইটাই আমাদের দেখতে হবে। এখন, ‘ক্রিটিক’ বলতে তিনি কি বোঝাচ্ছেন? উনি বলছেন, ‘এলাইটেনমেন্ট মতবাদ বটে, সে অন্যের সমালোচনা শুধু করে না, সে নিজেও নিজের সমালোচনা করে’। এটা সেফ রিফ্লেকসিভ।

অর্থাৎ এনলাইটেনমেন্ট বলে দিতে পারে যে এটা আমার ত্রুটি। তিনি বলছেন, ‘আমার সেই এনলাইটেনমেন্ট চাই যে নিজেই নিজের ত্রুটি দেখাতে সক্ষম’। তো, সেটা কী করে সম্ভব? তাই তিনি বললেন, আসুন আমরা কান্টের লেখাটা পড়ি। কান্ট যেহেতু খ্রিস্টধর্মের ভিতরে বড় হয়েছেন, সেহেতু তাঁর লেখাও খ্রিস্টিয় রেফারেন্সে ভর্তি। কান্টের রেফারেন্স হলো এই, ‘মানুষ যতদিন পর্যন্ত নাবালেগ থাকে, ততদিন পর্যন্ত তাকে বাইরের থেকে হাত ধরে ধরে নিয়ে যায় কেউ।

মানুষ যখন সাবালেগ, প্রাপ্তবয়স্ক হবে তখন সে নিজে নিজেই চলতে পারে’। এয়ুরোপের পরিপ্রেক্ষিতে উনি নামটা না বললেও এটাই বোঝাচ্ছেন। খ্রিষ্টধর্মের ধর্মসভা, অরগানাইজেশন অব ক্রিশ্চিয়ান থিয়োলজি, যিশুর অনুসারির চার্চ। আমরা চার্চ মানে দালানটা মনে করি, উনি দালানটা না বলে বলেছেন, দালানের ভেতরে যে মনোভাবটা থাকে সেটাই চার্চ। এসোসিয়েশন অব ক্রিশ্চিয়ানস।

এটা অফিসিয়াল এসোসিয়েশন। সংক্ষেপে খ্রিস্টান-সমাজ। এটাই নিয়ম করেছে তুমি এটা করতে পারবা, সেইটা করতে পারবা না। এটা জায়েজ, ওইটা নাজায়েজ। ইতি আদি।

কান্টের বক্তব্য হলো, ‘যে মানুষ চার্চের হাতে আত্মসমর্পণ করেছে সে মানুষ বালেগ নয়। যে মানুষ নিজেই নিজের কর্তব্য নির্ধারণ করতে পারে, সেই বালেগ’। কাজেই উনি এনলাইটেনমেন্টের সংজ্ঞা দিলেন এভাবে, ‘মানুষ যখন সাবালেগ হয়, সেই যুগটাই এনলাইটেনমেন্টের যুগ। তো, সাবালেগ হবার লক্ষণ কী? সে যেমন পরের সমালোচনা করতে পারে, তেমন নিজেও নিজের সমালোচনা করতে প্রস্তুত বা সক্ষম। এই মানুষ আলোকিত নয়, আলোকক।

কোন মানুষ আলোকক? যে নিজেই নিজের সমালোচনা করতে প্রস্তুত সেই মানুষই আলোকক, বাংলার গুণে বলা যাক আলোর মোরগ। আর সেই মানুষই হচ্ছে আলোর মুরগি যে শুদ্ধ পরের সমালোচনা করে, নিজের বিচার করতে সক্ষম নয়। অক্ষম কেবল বলে বেড়ায়, আমার বিচার তুমি কর। এলাইনটেনমেন্ট বলতে আমাদের বুঝতে হবে আরো নানান জিনিশ, এনলাইটেনমেন্টর মধ্যে একটা পরোপকারের ভাব আছে। যেমন এয়ুরোপ থেকে এনলাইটেনমেন্টের জন্য রবার্ট ক্লাইব বা ক্রিস্টোফার কলম্বাস সমুদ্র পাড়ি দিয়েছেন।

ক্রিস্টোফার কলম্বাস সদা বিশ্বাস করেছেন (অলওয়েজ বিলিভড দ্যাট) তিনি একজন মিশনারি, ধর্মপথিক, তীর্থযাত্রী বা হাজি। শুদ্ধ ঈশ্বরের গুণগান কীর্তনের জন্যই আমেরিকায় গিয়েছিলেন তিনি। হি অলওয়েজ থট দ্যাট হি ওয়াজ এ রিলিজিয়াস ম্যান এন্ড দ্যাট ওয়াজ হিজ মিশন। মগর তিনি কিতা খরলেন ভগবানের আমেরিকাখণ্ডটায়? বাট হোয়াট হি ডিড ইন দি আমেরিকাস? এখন আমরা বুঝতে পারছি যে, যা করেছিলেন তার সরল পরিচয় প্রলয়, সেটা ডেভাস্টেশন। আফ্রিকা থেকে লোক ধরে দাস বানালেন তাঁরা, একরোখা কলম্বাসবাদীরা।

দে ওয়ার ব্রিঙ্গিং স্ল্যাভস ফ্রম দি পপুলেশন। তাহলে ওই আমেরিকানদের দোষটা ছিল কী? এক নম্বর দোষ তারা খ্রিষ্টান ছিলেন না। দুই নম্বরে তারা এয়ুরোপীয় ছিলেন না। এরকম দোষ আপনারা ধরতে পারেন। সেখান থেকে তারা যে ইন্ট্রিগ্রেটেড হয় নাই এজন্য তাদেরকে সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস করে ফেলেছে।

একটা-দুটা কাহিনী আমরা পড়ি। যেমন ‘পো-কা-হুন-টাস’। একটা আমেরিকান-ইন্ডিয়ান মেয়েকে এয়ুরোপে নিয়া আসলো। তারপর কী যেন, একটা চিড়িয়াখানার বাঘের মত সে তো শেষে মারাই গেলো। আমি এজন্যই বলছি যে, এনলাইটেনমেন্ট বলতে চলন্ত ধারণা হলো, ‘দি ডিসকোর্স অব প্রগ্রেস, মডার্নিটি এন্ড হিয়ুম্যানিজম।

’ মিশেল ফুকো বলছেন, ‘নো, এনলাইটেনমেন্ট কথাটির আরেকটি অর্থ করা যায়। এনলাইটেনমেন্ট মিনস্ দি পসিবিলিটি অব অটোক্রিটিক। ’ অর্থাৎ, বিদ্যমান সবকিছুরই নিরন্তর সমালোচনা। এটা কার্ল মার্ক্সের বক্তব্য। এটা কি সম্ভব? আমি আপনাদের বোঝাতে চাচ্ছি, হোয়াট ইজ দ্যা প্রজেক্ট অব মিশেল ফুকো? আপনারা লেখাটা পড়ে দেখেন যে আমি যে সারমর্ম করলাম তার মধ্যে কী পরিমাণ বিকৃতি সাধন করলাম।

আমি যা বলেছি তার মধ্যে ফুকোকে কী পরিমাণ মিস-রিপ্রেজেন্ট করেছি। মিশেল ফুকোর কথা গ্রহণ করতে হলে উনি যেই সোর্সগুলোর নির্দেশনা দিয়েছেন তা দেখতে হবে। প্রথম সোর্স হল, ইমানুয়েল কান্টের লেখা। উনি কী বলছেন? পত্রিকায় একটা প্রশ্নের উত্তরে উনি এটা লিখেছিলেন। জার্মানির একটি পত্রিকা বার্লিনিশে মোনৎশ্রিফ্ট্, (Berlinische Monatschrift) বাংলায় করলে দাঁড়ায় ‘মাসিক বার্লিন পত্রিকা’।

সেই পত্রিকা প্রশ্নে বলছে, ‘এনলাইটেনমেন্ট কী বস্তু? মাননীয় দার্শনিকগণ উত্তর দিন। ’ প্রথম যিনি উত্তর দিলেন তাঁর নাম ‘মোজেজ মেন্ডেলসন’। ইনি জার্মানির সবচেয়ে মশহুর এয়াহুদি দার্শনিক তখন। ইয়াহুদি হিসেবেই তিনি পরিচিত। আর এমানুয়েল কান্ট মহোদয় খ্রিস্টান দার্শনিক।

এই কান্টের উত্তরটা দ্বিতীয় উত্তর। সেখানে কান্ট বলছেন, ‘এনলাইটেনমেন্ট বলতে আমরা বুঝবো, মানবসন্তান যে পর্যন্ত নিজেই নিজেকে নাবালক করে রাখে, সেই অবস্থা থেকে তার মুক্তি। ’ তাহলে নাবালক অবস্থা কী জিনিশ? এটা একটা কথার রূপ বা মেটাফোর। যে মানুষ বয়সে পঁয়ত্রিশ বছর হয়েছে কিন্তু এখনো পাঁচ বছরের বাচ্চার মত কথা বলে। অর্থাৎ আমরা এয়ুরোপের অনেকদূর অগ্রগতি করেছি কিন্তু কোনো কোনো জায়গায় এখনো শিশুর মত আছি।

সেই শৈশব থেকে মানব জাতির বন্ধনদশা যখন ঘোচে তখনই এলাইটেনমেন্টের উৎপত্তি হয়। এটা একরকম ভোরবেলা। যখন আলো ফোটে। আমরা বেগম রোকেয়ার ভাষায় বলতে পারি এটা ‘সুব্হে সাদেক’। এখন সকাল হল।

আলো ফুটল। আরবিতে ‘সাদেক’-এর মধ্যে যে সত্যের একটি আভাস আছে, এইখানেও এরকম একটি আভাস দেখছেন উনি। দি এনলাইটেনমেন্ট মিন্স ইউর ইমার্জেন্স টু ট্রুথ। যদিও উনি বলছেন না বাংলায় আমরা এটার নাম দিয়েছি খুব বিশ্রি, ‘প্রথম আলো’। বাংলায় এনলাইটেনমেন্টের সবচেয়ে চালু অনুবাদ কোনটা জানেন? ‘প্রথম আলো’।

দিস ইজ দ্যা টাইটেল অব এ বুক বাই সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় এন্ড হুইচ আওয়ার ফ্রেন্ডস্ আর কপিয়িং হিয়ার। তার জন্মের মধ্যে এই ত্রুটিটা আছে আরকি। এটা নকলনবিশ নাম। ‘প্রথম আলো’ মানেই সুব্হে সাদেক। ‘প্রথম আলো’ মানেই এনলাইটেনমেন্ট।

এইটাকেই জার্মানরা বলে ‘আউফক্লারুঙ্গ’। আউফ মানে আপ। ক্যারুঙ্গ মানে ক্লিয়ারিং। আক্ষরিক অর্থে। অর্থাৎ ময়লাটা মুছে ফেলুন।

এই এনলাইটেনমেন্ট আসছে খ্রিস্টধর্মের বিচার বা সমালোচনা হিসেবে। সব কথা বলা যাবে না এখানে। সময় সংক্ষিপ্ত, মোখ্তসর। সেখানে স্বৈরতন্ত্র ছিল। ধর্মতন্ত্র আর স্বৈরতন্ত্র সমার্থক।

হোয়াট ওয়াজ জার্মানি এট দ্যাট টাইম? ইট ওয়াজ এ হলি রোমান এম্পায়ার। মানে পবিত্র রোম সাম্রাজ্য। ভলতেয়ার ভাঁড়সুলভ ভাষায় কয়েছেন ঐ সাম্রাজ্য না ছিল হলি, না রোমান, না এমনকি সাম্রাজ্য। তবে অবিচার ছিল, ভাগাভাগি ছিল ক্ষমতার। ওরা বলেছিল এখানে পরকালের দায়িত্ব পোপ সাহেবকে দিচ্ছি।

আর ইহকালের দায়িত্ব আমরা সম্রাট সাহেবরা নিচ্ছি। কিন্তু আমাদের অথরিটি আসছে ফ্রম দ্যাট, মানে ঐখান থেকে। ধর্মই আমাদের সিদ্ধির মাপকাঠি। তার ভেতরেই চাকরি করেন দার্শনিক ‘ইমানুয়েল কান্ট’। এর মধ্যে থেকে তিনি যেটুকু বলতে পারেন, বলছেন যে, ‘সমস্ত ব্যাপারে চার্চের মাতব্বরি মেনে নেওয়া আমাদের প্রগতির পক্ষে অসুবিধা।

’ প্রশ্ন হল, কী সমালোচনা করা যাবে আর কী করা যাবে না? তখন সেন্সর চালু ছিল। নিয়ম বেঁধে দিয়েছে, এইটা সমালোচনা করতে পারবেন আর এইটা সমালোচনা করতে পারবেন না। কারণ কী? এটা সেন্সিবিলিটিতে আঘাত করবে। এইভাবে আসতে আসতে কান্টের মূল সিদ্ধান্ত হল: ‘আপন যুগের, আপন ধর্মের সমালোচনা আপনাকে করতে হবে। এনলাইটেনমেন্ট মাস্ট পারমিট ক্রিটিসিজম অব রিলিজিয়ন।

’ কান্টের এই কথার সূত্র ধরেই মিশেল ফুকোও যোগ করলেন আপনকার এক ফোঁটা নবীন শিশির । উনি বললেন, ‘তাহলে ইস্! উই ক্যান ক্রিটিসাইজ এনলাটেনমেন্ট ইটসেল্ফ। ’ দার্শনিক যুক্তি হিসেবে এমন মহা নতুন কিছু নয়। কিন্তু কোন জিনিসের মূল্য নির্ভর করে তার মৌলিক উত্তরের উপর শুধু নয়। তার সমসাময়িকতার উপরও।

কোন সময়ে কোন জায়গায় কে কী বলছেন, সেটাই দরকারি হয়ে ওঠে। মিশেল ফুকো বলছেন, ‘এখন এয়ুরোপে যে ধনতন্ত্রের উদ্ভব হয়েছে তার আধ্যাত্মিক আদর্শ এনলাইটেনমেন্ট। এই এনলাইটেনমেন্টের মাধ্যমে আমরা হয়ত এই ধনতন্ত্রকে অতিক্রম করতে পারবো না, কাজেই আমাদের এইটার সমালোচনা করার মত একটা সূত্রও বের করতে হবে। নাম তিনি দিয়েছেন ‘ক্রিটিক’। ‘ক্রিটিক’ কথাটা এয়ুরোপে প্রথম প্রমিনেন্ট করেছেন ইমানুয়েল কান্ট।

‘ক্রিটিক’ মানে সমালোচক নয়, সমালোচনার ধর্ম। অনেকে এই ‘ক্রিটিক’-এর বাংলা অনুবাদ করেছেন ‘সম-আলোচনী’। ক্রিটিক মিনস্ এ ডিসকোর্স হুইচ কন্টেইনস ক্রিটিসিজম। কন্টেইন শব্দে যেমন ধারণ করা বোঝায়, আবার রোধ করাও বোঝায়। এ তলোয়ার দুধারি।

‘ডিসকোর্স’ কথাটার অর্থ আমরা পরিষ্কার বুঝি কিনা বোঝা দরকার। আমি নিজেও বুঝতাম না। আনটিল আই কেইম এক্রস দি রাইটিংস্ অব জাক লাকাঁ। জাক লাকাঁর মধ্যে ডিসকোর্স কথাটা কোন অর্থে আসছে? ডিসকোর্সের যদি আক্ষরিক অর্থ করেন, ইট ইজ এ কোর্স অব স্পিচ্। এখন এর একটা নতুন বাংলা আমি প্রস্তাব করেছি।

আপনারা হয়ত এখনো শোনেন নাই। এই ডিসকোর্সের বাংলা ‘সন্ধ্যা’। আপনারা সান্ধ্য আইনের কথা শুনেছেন, কিন্তু ‘সন্ধ্যাভাষা’র কথা হয়ত এখনো শোনেন নাই। একটা উদাহরণ দিলেই ব্যাপারটা পরিষ্কার হবে। সন্ধ্যাভাষা বলে কোনটাকে? চর্যাপদের ভাষা এক ধরনের সন্ধ্যাভাষা।

আমরা যে অর্থ নিয়েছি এর তা কি জানেন? মধ্যযুগ বলে একটা জায়গা আছে। তার সঙ্গে আছে অমধ্যযুগ। দুইয়ের একটা সন্ধিস্থল থাকবেই। কিন্তু চর্যাপদ কোন সময়ে লেখা? বাংলাদেশে যখন বৌদ্ধধর্মের প্রচার তুঙ্গে উঠেছে, এটা মূলত হযরত গৌতম বুদ্ধের অনেক পরে। তাঁর এক হাজার দেড় হাজার বছর পরে বঙ্গীয় তান্ত্রিক বৌদ্ধরা তাঁদের গান (প্রার্থনা সঙ্গীত) যে ভাষায় করছেন সেইগুলিকে আমরা সন্ধ্যাভাষার নমুনা বলি এখন।

এখনও দাবি করি এসব বাংলা। হরপ্রসাদ দাবি করলেন এগুলো হাজার বছরের পুরানা বাংলা। কে জানে এগুলো কি বাংলা, না বাংলা নয়? হিন্দিওয়ালারা বলেন হিন্দি। উড়িয়ারা বলেন উড়িয়া। অহমিয়ারা বলেন অহমিয়া।

আমরা বলি বাংলা। কিছু আসে যায় না। এসব ব্রজের ভাষার মত বা মিথিলার ভাষার মত। এখন সন্ধ্যাভাষা কোন সমাজের বৈশিষ্ট্য? শহীদুল্লাহ সাহেবের থিওরি যদি সত্য হয় তবে, সপ্তম থেকে একাদশ-এর মধ্যে হয়েছে এটা। খ্রিস্টিয় শতাব্দী অনুসারে আজ থেকে চোদ্দশ তেরোশ বারোশ বছর আগে।

আসলে কিন্তু আমরা ওই সম্পর্কে খুব বেশি কিছু জানিও না। আমি সেই অর্থে সন্ধ্যা ব্যবহার করি নাই। সন্ধ্যা মানে হেঁয়ালিও নয় । দিবা ও রাত্রির সন্ধিক্ষণ, সেইখান থেকে সন্ধ্যা কথাটা আসছে। সন্ধি মানে চুক্তি, যুদ্ধে যেমন সন্ধি হয়।

সন্ধি মানে এক অর্থে মিলন। কিন্তু এই মিলন আবার এক অর্থে যুদ্ধচিহ্নিত। সন্ধ্যাভাষায় তাহলে কার সাথে কার চুক্তি? ল্যাঙ্গুয়েজ ইজ এ ভেক্টর। রাশি বলি দুই ধরনের। স্কেলার রাশি আর ভেক্টর রাশি।

ভেক্টর মানে যেখানে ডিরেকশন্ থাকে। আমি আপনার উদ্দেশে বলছি, আপনি আমার উদ্দেশে বলছেন। এই ভেক্টর যেখানেই থাকে সেখানেই সন্ধির উৎপত্তি হয়। ইট ইজ দি ভেক্টর অব সাবজেক্ট। হুইচ ট্রাইস টু মেক এ লিঙ্ক উইথ দ্যা ল্যাঙ্গুয়েজ।

আমি যখন দাঁড়িয়ে এখানে বক্তৃতা দিচ্ছি আপনারা বলছেন সলিমুল্লাহ খান বক্তৃতা দিচ্ছেন। কিন্তু আমি যে বক্তৃতা দিচ্ছি সে আর আমার ‘আমি’ কিন্তু এক নয়। আমার একটা ‘সহ-জ’ আছে, যে আমার সঙ্গে জন্মেছে। বক্তৃতা আমি দিচ্ছি। কিন্তু আবার আমার সহজও দিচ্ছে।

যুগপৎ। কখনও আমি দিচ্ছি। এ বক্তৃতা খালি। কখনও সে (সহজ) আর আমি দিচ্ছি। এটা ভরা।

আমরা ডিসকোর্স বলি সেই ভাষাকেই যে ভাষা ডিরেকশন বা দিক গ্রহণ করেছে। এইজন্য বলি মাস্টারস ডিসকোর্স, স্লেভস ডিসকোর্স, উমেনস ডিসকোর্স, ইতি আদি। স্পিচ, ল্যাঙ্গুয়েজ, ডিসকোর্স তিনেই এক জিনিস বুঝায়। কিন্তু আলাদা তারা। সবগুলিরই বাংলা করতে পারেন ‘ভাষা’।

স্পিচ বলতে আমরা বলি ‘বাক্’। যথা মানুষ বাক্শক্তিসম্পন্ন প্রাণী। মানুষের স্পিচ পাওয়ার আছে। আবার বলছি কি মানুষ কী ভাষার মধ্যে বাস করে। ম্যান লিভস ইন ল্যাঙ্গুয়েজ।

এখন নতুন কথা হিসেবে বলছি কী? মানুষ যেভাবে কথা বলে সেটা কোনো না কোনো ডিসকোর্সে বিভক্ত। ইন্সটিটিউটের মধ্যে যেমন ডিপার্টমেন্ট থাকে, তেমনি ল্যাঙ্গুয়েজ ইজ ডিভাইডেড ইনটু ডিসকোর্সেস। এখন ডিসকোর্সের নিকটতম তুলনা কী? সেন্টেনস্। আপনি একটা শব্দ দেন। কোন এক অর্থ বহন করবে।

যদি শব্দটা কোন বাক্যের মধ্যে বলেন তবে আরেকটা অর্থ গ্রহণ করবে। যদি বাক্যটা কোন প্যারাগ্রাফ বা এসের অংশ হয় তবে আরেকটা অর্থ হবে। আপনার গোটা বক্তৃতাটাকে আমরা ডিসকোর্স বলি। এইজন্যই আমি বলছি, সন্ধ্যা কথাটা আমরা আনছি ওই জায়গায় থেকেই। সন্ধ্যা সন্ধির ভাষা বটে।

সন্ধিটা কার সাথে? সহজের সঙ্গে ভাষার সন্ধি। ল্যাঙ্গুয়েজের মধ্যে আমি নিজেকে প্রকাশ করেও করি না। কিন্তু আমি ছুটতে থাকি ল্যাঙ্গুয়েজের পেছনে। এই ছোটার মধ্যেই আমি। আমার সহজ জন্মায় এই ছোটার টানে।

এই জন্য প্রভুদের ভাষা সন্ধ্যা নামে খ্যাত হয়। মানে আমরা যাঁদের বৌদ্ধধর্মগুরু বলি বা যাঁদের বলি সিদ্ধাচার্য তাঁদের ভাষার মধ্যে যে একটা আলো-আঁধারির ভাব আছে তা সন্ধ্যা নামে খ্যাতি পায়। এখন আমি অনুবাদ করবো সহজ (Subject) ও সন্ধ্যা (Discourse)। ইংরেজিতে ‘সহজ’কে বলেছি সাবজেক্ট, আর ‘সন্ধ্যা’কে ডিসকোর্স। তাহলে সাবজেক্ট এন্ড ডিসকোর্স, তাদের মধ্যে একটা দ্বন্দ্ব চলতে থাকে।

এইজন্য আমি এটার নাম প্রস্তাব করেছি ‘সন্ধ্যাভাষা’। সন্ধির ভাষা। জানতে হবে, সন্ধির দুইপক্ষ কে কে। দি স্পিকার ইজ স্পিকিং টু সামবডি। প্রভু দাসের উদ্দেশে কিছু বলছেন।

স্বামী স্ত্রীর উদ্দেশে, ছাত্র শিক্ষকের উদ্দেশে বলছে। জাক লাকাঁ তাঁর ডিসকোর্সে চারটা ডিসকোর্সের কথা বলেছেন। দি মাস্টারস ডিসকোর্স বা সেয়ানার সন্ধ্যা। এইক্রমে ইনভার্সিটি ডিসকোর্স। দি এনালিস্টস ডিসকোর্স এবং শেষ তক দি এনালিসেন্ডস বা হিস্টেরিক্স্ বা বোকাচোদার ডিসকোর্স।

নামটা বসেছে সেয়ানের জায়গায় যে বসেছে তার নামে। ৬ আমার শেষ মন্তব্য এনলাইটেনমেন্ট বোঝার সময় গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন: ‘হুজ ডিসকোর্স ইজ এনলাইটেনমেন্ট?’ কে বলছে? সেয়ানা কে এখানে? আগে লোকে বলেছে, ঈশ্বর মানুষের কাছে যখন ওহি পাঠান তখন ঈশ্বর বলছেন বহুবচনে আমরা এটা করেছি, আমরা ওটা করেছি। ল্যাঙ্গুয়েজটা খেয়াল করবেন। এখন মানুষ যখন মানুষের উদ্দেশে বাণী পাঠায় এবং কোনো কোনো সময় ঈশ্বরের জায়গা নিজে দখল করে বলে কি, ‘আমি মানুষ, কিন্তু আমি সেয়ানা, তোমাকে ঈশ্বরের জায়গা থেকে আদেশ করছি’। সেইটা কিন্তু ওই ঈশ্বরের ডিসকোর্স গ্রহণ করে।

এই জন্য মিশেল ফুকোর নতুন কথা হল, ‘মানুষ কথাটা অর্বাচীন কথা। মানুষ শব্দটার বয়স এই মাত্র দুইশ বছর। ’ আপনারা সকলেই তার প্রতিবাদ করতে পারেন। কারণ, মানুষ শব্দটা আমরা বহুদিন আগ থেকে - হযরত আদমের সময় থেকে দেখছি। আমরা সব ভাষায় দেখতেছি ‘ইনসান’ কথাটা, ‘হিয়ুম্যান’ শব্দটা আছে।

কিন্তু মিশেল ফুকোর কথা অন্য। মানুষের অহমটা, অহংকারের হুংকারটা নতুন। এই বিখ্যাত বইয়ের শেষ বাক্যে মিশেল ফুকো বলছেন, “সবকিছুর কেন্দ্রে বসা মানুষ’ কথাটা মানুষই লিখেছে। ওটা বেশি দিন টিকবে না। সমুদ্রতীরে, বালির তটে সামনের জোয়ারে সেটা মুছে যাবে।

” সমুদ্রের কাছে গিয়ে লোকে মাটিতে বসে বালিতে নিজের নাম লেখে না? জোয়ার আসলে আবার মুছে যায়। তাহলে মানুষ শব্দটা মানুষ লিখেছে এইরকম, বালির তটে সামনের জোয়ারে সেটা মুছে যাবে। বাক্যটা খুব স্মরণীয়। ফুকো ক্লাসিকাল আর মডার্ন এজ বলতে কী বোঝাচ্ছেন? ফুকোর কাছে নাইনটিনথ সেঞ্চুরি মানে আঠারো শ সন থেকেই মডার্ন যুগের শুরু। আর আগের যুগটাকে - মানে এর আগের দেড়শ বছরকে - তিনি বলেন ক্লাসিকাল বা বুনিয়াদী যুগ।

মানে ১৬৫০ থেকে ১৮০০ পর্যন্ত এই সময়টাই ফুকোর অভিধানে ক্লাসিকাল যুগ আর ১৮০০ থেকে আজ পর্যন্ত বাকিটা মডার্ন যুগ। এখানেই ফুকো বলেছেন, খেয়াল করবেন, ‘ওয়ান ক্যান সার্টেইনলি ওয়েজার (Wager - এর অর্থ বাজি ধরা, রেসের ঘোড়ার মানুষ যে বাজি ধরে, কোন ঘোড়া ফার্স্ট হবে? এইটা হল সেই বাজি ধরা) দ্যাট ম্যান উড বি ইরেজড লাইক এ ফেস ড্রন ইন স্যান্ড এট দি এজ অব দি সি। ’ আপনি বাজি ধরতে পারেন, মানুষের দিন শেষ হয়ে গেছে। এই জন্য তিনি ফরাসিদেশে আবির্ভূত হয়েছিলেন এন্টি-হিয়ুম্যানিস্ট হিসেবে। ফ্রান্সে কয়েকজন দার্শনিককে এন্টি-হিয়ুম্যানিস্ট বলা হয়েছে সেই সময়।

একজন ফুকো। আরজন লুই আলথুসার। আরেকজন জাক লাকাঁ। এরা কেন মানববিরোধী? আমরা মানববিরোধী থেকে অনুবাদ করে বলেছি মানববিদ্বেষী। ম্যান উড বি ইরেজড লাইক এ ফেস ড্রন ইন স্যান্ড এট দি এজ অব দি সি।

ক্লাসিকাল যুগের চিন্তা মানে দেকার্ত থেকে শুরু করে কান্ট পর্যন্ত সময়টা। তার ভেতরে এনলাইটেনমেন্টও আছে। তার পরেই শুদ্ধ মানব বা ম্যান আইডিয়াটা চলেছে এয়ুরোপে। সেটাও এতদিনে ধ্বংসের মুখে এসেছে, চলে যাবে। এটাই ছিল তাঁর প্রজেক্ট।

মিশেল ফুকোর প্রকল্প এন্টি-হিয়ুম্যানিজম। কিন্তু লোকটি কেন এনলাইটেনমেন্টে আবার ফিরে আসলেন? এটা বোঝার জন্য আপনারা যদি শুদ্ধ একটা ক্লু লাভ করতে চান আমি এটা বলেই শেষ করছি, ইরানের বিপ্লব সম্পর্কে তাঁর বক্তব্য পড়ে দেখলেই তা পাবেন বলে। মিশেল ফুকো কেন ইরানের বিপ্লবকে প্রথমে সমর্থন করেছিলেন এবং কেন পরে সমর্থন করতে পারেন নাই, কেন পরে তা প্রত্যাহার করলেন, সেই রহস্যের চাবিকাঠি সেখানে আছে বলে আমার বিশ্বাস। মিশেল ফুকো : পাঠ ও বিবেচনা নামের সংকলনে অন্তর্ভুক্ত একটা সামান্য প্রবন্ধে আমি এই বিষয়টা বলতে চেয়েছি।
 


সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে ১০ বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.